মা, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তুমি যেখানে আছ-নিশ্চয় ভাল আছ। তোমার কর্মফল-তোমাকে ভাল রাখবে- তা আমি জানি। যদিও ঐ ধর্মবিশ্বাস আমার নেই। তবে তোমার মূল্যবোধ যে, কোন লাভের পাল্লায় হিসাব কষেনি তা আমি দেখেছি। তুমি পুণ্য সংসারি ছিলে, হয়তো বাঙালি নারীর শ্বাশত উদাহরণ নিঃসন্দেহে হতে পার। কারণ তুমি কল্যাণ করেছ সকল স্বার্থের ঊর্ধে থেকে আর সংসারের সবাইকে আগলে রেখেছ পরম যত্নে। ত্রিশ বছরে তিল তিল করে গড়া সংসারটা তোমার চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকবে, এমনটা আর মনে হচ্ছে না। তুমি হয়তো জাননা সংসারের অলিখিত নিয়মগুলো পাল্টে গেছে। অফিস ছুটির পর বাবা আর সময়মত বাড়ি ফিরে না, বিকেলের নাস্তা তো হয়ই না বরং গল্পের রংটাও নিভে গেছে। কতদিন যে গল্প করি না, তার হিসাব কষতে পারব না। সবার ভিতরের সুতায় আর টান নেই। শুনছি বাবা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। বিষটায় অমতের ব্যাপার নেই কিন্তু ধৈর্যের ব্যাপার আছে। একটু দেরিতে হলে সংসারে ভাল হয়। কয়েকদিন আগে আরেকটি কাণ্ড ঘটেছে, বাবা বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তোমার ছোট ছেলের সাথে রীতিমত তর্কযুদ্ধে নেমেছে। বড় ছেলে হিসেবে আমি কোন ভূমিকা রাখতে পারিনি। হয়তো এ আমার দোষ কিংবা এ আমার গুণ।
তোমার একমাত্র মেয়ে, মিনি। ওর বিয়ে দেয়াটা জরুরি। কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেরিতে দিতে গেলে, খুব বেশি দেরি হয়ে যায়। পড়াশুনাও তো কম হলো না! তাছাড়া তুমি থাকলে এমন ভাবনা চিন্তার কারণ ছিল না। তোমার ছোট ছেলে বলেছে ‘মিনির বিয়ে দিয়ে তবেই যেন বাবা বিয়ে করে’। না হলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু বাবা বলেছে, ‘বিয়ে বললেই তো হল না!আমার একমাত্র মেয়ে। যে কোন পাত্র এলেই তো বিয়ে দিতে পারিনা’। ‘আবার একটা কথা ভাব, আমার বয়স বেশি হয়ে গেলেও তো ভাল বিয়ে করতে পারবনা, বিষয়টা আমার মাথায় আছে বলেই তো ঘটককে খবর দিয়েছি-কথাও বলেছি’।কিন্তু জান মা আমি ঘটকের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, বাবা মিনির বিয়ের ব্যাপারে অতটা জোর দিয়ে কথা বলেননি। তিনি নিজের বিয়ের চিন্তায় বেশি ব্যস্ত। আমি বাবাকে গোপনে বুঝাইছি, একটু ধৈর্য ধরতে বলেছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
মা, তুমি তো জান এ মধ্যবিত্তের সংসারে নতুন কেউ এলে, কতটা সেক্রিফাইজ করবে তা ভাববার বিষয়। ছোট ভাইটার একটা চাকরি অথবা মিনির বিয়ে কিংবা আমার একটা চাকরি-এর যে কোন একটা সমাধান জরুরি।কিন্তু সমস্যা শুধু বেড়েই চলছে। তাছাড়া সংসারে এখন কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়।
আচ্ছা মা, তুমি চলে না গিয়ে যদি বাবা চলে যেত, তবে কি এ সমস্যা গুলো হত! আমি অনেক বার ভেবেছি কিন্তু সামলে উঠতে পারছিনা। একজন বেকার বড় ভাইয়ের কী বা করার আছে!, তুমি বলেছিলে-‘যখন আমি থাকবনা তখন বুঝবি!, আজ বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি তো জান, আমি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। সমস্যার সাথে সমস্যার যুদ্ধে জয়ে সফলতাকে পরীক্ষিত প্রমাণে আমি বিশ্বাস করি। যদিও আমার মতবিশ্বাসকে নিয়ে তোমার মত ভিন্ন। কিন্তু দেখ মা- বাবা মারা গেলে যেমন সন্তান অনাথ হয়, মা মারা গেলেও তো সন্তান অনাথ হয়। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার নীতিবাক্য ছুড়ে আমরা প্রায় সবাই প্রথম কথাটি স্বীকার করি। আর দ্বিতীয় কথাটি স্বীকার করলেও সুবিধা দিতে রাজি নই। কয়েকদিন আগে একটা সরকারি শিশু পরিবারে গেছিলাম। সেখানে জানলাম, মা-হীন শিশু যার বাবা আছে তাকে তারা ভর্তি করেনা কিন্তু মা আছে, বাবা নেই এমন শিশু ভর্তির ক্ষেত্রে অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাবা-হীন শিশুর থেকে একটি মা-হীন শিশু বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, বিশেষ করে একটি শিক্ষিত পরিবারে এমনটা বেশি লক্ষণীয়।
মা, তোমাকে যদি একটা প্রশ্ন করি, সংসারে বাবা না থেকে যদি তুমি থাকতে, তবে কি তুমি আমাদের আগলে রাখতে না! শোন তুমি আবার রাগ করো না। আমি বাবাকে দোষ দিচ্ছিনা। আমি জানি , তুমি বাবাকে অনেক অনেক ভালবাস। আসলে পরিস্থিতি আমাকে এমনটা করেছে।
আমি সবসময় বাবার সম্মানের কথা ভাবি। সবচে বেশি ভাবি মিনি কে নিয়ে। ও বেচারা শুধু কেঁদেই খালাস। আমি কখনও ছোট ভাই-বোনদের মতকে উপেক্ষা করে বাবার সঙ্গী হতে পারবনা। এতে বাবা যা ভাবে ভাবুক। আসলে, মা ছাড়া পৃথিবীতে তাঁর সন্তানরা কতটা অসহায়-তা আজ তুমি দূরে গিয়ে জানিয়ে গেলে। ঐ চাঁদ তাঁরা আর অসংখ্য প্রকৃতির সৌন্দর্য শুধু নিরব সাক্ষী হয়ে রইল।কিন্তু দাবির ভবিষ্যত নির্মাণে এদের বলিষ্ঠ ভূমিকা নেই। এ খোলা চিঠি তুমি পাবে, হয়তো তোমার পাশে চিরবাসস্থানে থাকার জন্য যে যাবে তার কাছে! কিংবা পাবে ঐ নিরব প্রকৃতির কাছে, যারা অভিযোগ করতে জানেনা বরং সৃষ্টির আমরণ লড়াইয়ে জয়ের মুকুট পড়ে।আমি কি পাব সেই যাপিত জীবনে একটি সুন্দর সকাল। সেই প্রতীক্ষায় রইলাম, মা।