১।
বটগাছের নিচ দিয়েই দোকানে যেতে হবে। এটাই সহজ আর সোজা পথ। সময় কম লাগে দূরত্বও কম হয়। সবাই সাধারণত এই পথ দিয়েই যাওয়া আসা করে।
আজকাল এমন হয়েছে যে, প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর বা একটু রাত হলে দোকানে যেতে হচ্ছে। যাওয়ার প্রয়োজনও পড়ছে। এটা আনতে ওটা আনতে। নতুন নতুন দোকানে যাওয়ার অভ্যাস হয়েছে অনির। ভালোই লাগছে। এর অবশ্য কারণও আছে। দোকানে যেতে হলে অনেক কিছুই মাফ হয়ে যায়। এই সময়টুকু সে একদম স্বাধীন। তার ভীষণ ভালো লাগে। ঘর থেকে বের হলেই স্বাধীন হওয়া যায়, স্বাধীনভাবে লাফালাফি করা যায়। একটু আধটু সময় কাটে। ঘোরাঘুরিও হয়। এতেই তার ভীষণ আনন্দ। এই সময়টাতে সে খুব খুশি হয়। স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করা, গুনগুন গান গাওয়া - এসবে মনটা ফুরফুরে লাগে। অল্প সময়ের জন্য হলেও সময়টুকু ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যায়।
তবে ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে, সব স্বাধীনতা সব সময় ভালো না।
তার স্বাধীনতায় কে যেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেউ একটা কিছু দিয়ে যেন তার গলা চেপে ধরতে চায়। কখনো মনে হয়, কেউ যেন তার বুকের উপর চেপে বসে আছে। তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আবার কখনো মনে হয় একটা মোলায়েম ঠান্ডা শরীর তাকে জাপটে ধরছে। শীতল দুটো হাত দিয়ে কেউ যেন তার গলা মুঠো করে ধরে ফেলেছে। এতে তার শরীর আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসছে।
আবার কখনো মনে হয় কেউ যেন তার শ্বাসনালি চেপে ধরে আছে। দম বন্ধ হয়ে যাবে। সে যে নিশ্বাস নিতে পারবে না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তার হাত থেকে নিজেকে ছোটাতে পারছে না। সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত-পা ছুড়াছুড়ি করেও লাভ হয় না।
কেন এমন হচ্ছে? কে এটা করছে? কেন করছে? তার ঘাড়ের উপর কে সব সময় জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে? ভয়ংকর গরম নিশ্বাস। অনেক ভারী। এত ভারী নিশ্বাস কিসের? কে ঘাড়ের পিছনে? কে! কে!
চমকে চমকে ঘাড় ঘোড়ায়। কাউকে দেখতে পায় না। আবার খুব সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে কাজটা কার তা দেখার চেষ্টা করে। হঠাৎ হঠাৎ ঘাড় ঘুরায়, যাতে এই কাজ যে করছে সে যেন বুঝতে না পারে। তাকে যেন ধরা যায় হাতেনাতে। চকিতে দেখে নেবে পিছনে লাগা কাউকে।
তার আর দেখা হয় না। তার চেয়ে আরো দ্রুত কেউ যেন সরে পড়ে। না, কোথাও কেউ নেই!
অনিরা যে কলোনিতে থাকে সেখানে বাংলোটাইপের বাড়ির সংখ্যাই বেশি। আধুনিক সুযোগ সুবিধা বলতে গেলে প্রয়োজন অনুযায়ী সবই আছে। প্রতিটি বাড়িতেই ফুলের বাগান রয়েছে। কোনো কোনো বাড়িতে একাধিক বাগানও দেখা যায়।
এত সুন্দর পরিবেশ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা চমৎকার। চুরি ছিনতাইয়ের ভয় নেই। এখান থেকে কারোর স্বাভাবিকভাবে হারিয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ আর সম্ভাবনা নেই। দারোয়ান ভাইরাও সবাইকে চেনে। ফলে কে কোন দিকে গেল কে কোন দিকে যাচ্ছে তা তাদের নজরেই থাকে। তারা ছোটবড় সবাইকেই যেন সমানভাবে আগলে রাখে।
তারপরও অনির ভয় হয়। আগে এমনটা কখনো হয়নি। এখন ঘন ঘন হচ্ছে। কে যেন ঘাড়ের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। তাকালেই চলে যায়। আবার আসে। বরফের মতো ঠান্ডা একটা মোলায়েম হাতের স্পর্শ কাঁধে পড়ে। আলতো করে কেউ যেন হাতটা রাখছে, যাতে কোনো প্রকার ব্যথা না লাগে। সে ব্যথা যে দিলে লাগা শুরু হয়েছে তা কি কেউ জানে? না কি যাতে দিলে লাগে এরকম কিছুর জন্য কেউ এভাবে কাজ করছে?
প্রথম যেবার হাত রেখেছিল তখন তেমন কিছু বোঝা যায়নি। মনের ভুল বলে সন্দেহ হয়েছিল। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখা যায়নি ঠিকই, যেখানে হাত দিয়ে ধরেছিল জায়গাটা ঠান্ডা হয়েছিল অনেকক্ষণ।
ঘটনাটা দ্বিতীয়বার যখন ঘটল তখনই বুকটা ধুক করে ওঠে! গায়ের লোমগুলো সটাং করে দাঁড়িয়ে পড়ে! রক্ত চলাচল এমনই থমকে গিয়েছিল যে তাতে পুরা শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় মুহূর্তে। আবার পরক্ষণেই রক্ত চলাচল দ্রুত হতে থাকে। বুকটা দ্রুত ওঠানামা করতে থাকে। কামারের হাপরের মতো মুখটা খোলে আর বন্ধ হয়। নিশ্বাস জোরে জোরে পড়ছে। সেটা আরো ঘন হতে থাকে। শরীর অস্থির হয়ে ওঠে। অনি ঘেমে যায় ওই রাতের চমৎকার শীতল বাতাসেও।
খুব দ্রুত তালে সে আল্লাহর নাম ডাকতে থাকে। বুকটা বেশ জোরে জোরে ওঠানামা করে। ঘন ঘন নিশ্বাস বের হয়। সময়টা অনেক লম্বা বলে মনে হয় তার কাছে।
‘বোকা কোথাকার! তখন বোঝনি। এখন বুঝতে পারবে। সময় হলে টের পাবা আরো কিছু!’
‘কে! কে ওখানে! কে কথা বলে?’ এর রেশ কাটতে তাকে সকালের ঘুম থেকে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। চোখের পাতা এক করা যায়নি অনেক রাতেও। ক্লান্তিতে ধীরে ধীরে চোখটা বুজে না আসলে ঘুমের যে কি হতো আল্লাহ মালুম।
চলবে ...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৪১