somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।।--গল্প - রক্তরঙা ফানুস--।।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শান্ত বিকেলে ছেলেটাকে বেশ অগোছালো ও অশান্তই দেখাচ্ছে। কলেজ ড্রেসটা সারাদিনের ব্যবহারের ধকলে মলিন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সারাদিন ক্লাসের পর মুখখানি ক্লান্ত। তবে চোখ জোড়া চকচক করছে। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটার চেষ্টাটা সহজেই চোখে পড়ে। প্রতিমিনিটে একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, খুব জরুরী কোন কাজ আছে যেন। আবীরের হাঁটা দেখে অবাক হলো বন্ধু নীরব। একসাথেই রোজ বাসায় ফেরে, আজ যেন কিছুতেই আবীরের পাশে হাঁটতে পারছে না ও। বিরক্ত হয়ে থামালো আবীরকে, ‘পাগল হলি নাকি? দৌড়াচ্ছিস কেন এভাবে?’ আবীর চলতে চলতেই বলল, ‘গাধা! আজ বাংলাদেশের খেলা আছে জানিস না? এতক্ষণে দশ ওভার পার হয়ে গেছে মনে হয়! দ্রুত চল!’

নীরবও জোরে হাঁটতে শুরু করলো, দু’বন্ধু সবসময় একসাথেই ক্রিকেট দেখে। এখন আবীরই পেছনে পড়ে যাচ্ছে! আবীররা বাসায় ফেরামাত্র ব্যাগদুটো ছুড়ে ফেলে টিভির সামনে বসে পড়লো। বাংলাদেশ ব্যাট করছে, চকচক চোখে দু’জন খেলা দেখতে লাগলো, উত্তেজনা প্রচন্ডে! ফোর হলেই চিৎকার-হাইফাইভে অঞ্চলের সবাইকে সন্তস্ত্র করে তুলছে। ইতোমধ্যে আবীরের মা চার পাঁচবার হাতমুখ হয়ে খেতে বসার কথা বলে গেলেও তেমন পাত্তা পান নি। ওরা এখন কিছু শোনার মতো অবস্থায় নেই।

রাত হয়ে গেছে। কাপড়টা ছাড়লেও খায়নি এখনও আবীর, খেলা শেষে চলে গেছে নীরবও। বাংলাদেশ অল্পের জন্য হেরে গেছে, ওর অনেক মন খারাপ। মলিন মুখে জানালা দিয়ে হাইওয়ের গাড়ীগুলো দেখছে। গাড়িগুলোর আসা যাওয়া দেখে যেন রাত পার করে দিতে পারবে সে। মা খেতে ডাকতে এসে দেখেন ছেলে মন খারাপ করে বসে আছে, বুঝতে অসুবিধা হলো না কি হয়েছে।

‘কীরে আজও হেরে গেলো? এসব নিয়ে এতো মন খারাপের কিছু আছে?’
‘উফফ মা, যাওতো। ভালো লাগছে না এখন।’
‘তাই বলে খাবি না?’
‘পরে খাবো।’
আবীরের মুখটা টেনে ঘুরালেন মা, নীরবে কাঁদছে পাগলটা! একটু রেগেই গেলেন এবার ছেলের উপর।
‘কাঁদার কি হলো? আজ জেতেনি কাল জিতবে!’
‘এ জন্য না।’
‘তাহলে?’
‘পরশু ষোলই ডিসেম্বর, সকালে বাবার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর শোনা হবে না, বেড়াতেও নিয়ে যাবে না আমাকে।’

কি বলবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না ফাহমিদা, তার নিজেরও প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেলো। চট করে অশ্রু লুকিয়ে ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘মন খারাপ করিস না, তোর বাবা নেই কে বলল? তোর বাবা কি বলতো ভুলে গেছিস? দেশটাই মা, দেশটাই বাবা।’

আবীর আর কিছু বলল না, মায়ের মনও খারাপ হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে সে। এক টেবিলে চুপচাপ রাতের খাবার খাওয়া হলো। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো আবীর, পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে থাকা একটা কালো ডায়েরি টেনে নিলো, চামড়ায় মোড়ানো ছোট্ট একটা ডাইরি। বাবা চলে যাবার পরে ফাহমিদাই দেন আবীরকে, বাবার নাকি তেমনটাই ইচ্ছে ছিল। সেটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বুকে চেপে রাখে নাকের সামনে নিয়ে ডাইরিটার শুঁকে। পুরনো একটা গন্ধ। এই গন্ধ একাত্তরের দিনগুলোর স্বাক্ষী। এই ডাইরিটাতে জীবনটাকে মাতৃভুমির জন্যে উৎসর্গ করে দেয়া, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে ক্যাম্প পাহারা দেয়া একজনের। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করা একজন মুক্তিযোদ্ধার, যিনি সময় পেলেই লিখতেন। ডাইরিটা প্রতিবার হাতে নিয়ে আবীর বন্ধ চোখে অনুভব করার চেষ্টা করে উত্তাল সেই দিনগুলো। অবিরাম গুলিবর্ষনের শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব। দিনের পর দিন চুলদাড়ি না কামানো অর্ধভুক্ত একজন মানুষ যার হাতে অস্ত্র এবং চোখে স্বপ্ন একটি পতাকার, আপন মানচিত্রের। লাল ফিতে ধরে নির্দিষ্ট একটি পাতা মেলে ধরলো আবীর, ওর প্রিয় ঘটনাটা আবারও পড়তে শুরু করলো।

“আমাদের টিম নিয়া মস্ত বিপদে পড়িয়াছি। বাঁশবাগানে আড়াল হইয়া থাকা পুরানো ও পরিত্যাক্ত একটা বাড়ীর মেঝে খুঁড়িয়া আমরা সাতজন আছি আজ তিনদিন হইতে চলিলো, কাঠ-চট ও মাটির ছাউনি দিয়া গর্তটা আড়াল করিয়াছি। চারদিন আগের অপারেশনে আংশিক সাফল্য পাওয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু হারাইয়াছি বাকী পাঁচজন সহযোদ্ধাকে। এর মধ্যে শফিকুলও রহিয়াছে। সে আমার ভাইয়ের মতো। একসাথে বড় হইয়াছিলাম, স্কুলে যাইতাম একসাথে, এই বছর আমাদের কলেজে ভর্তি হইবার কথা আছিল। সে বড় মেধাবী ছাত্র, প্রতি শ্রেণীতে প্রথম হইতো, আমাকে অংক শিখাই দিতো। তার মৃতদেহটাও নিয়া আসাও সম্ভব হইলো না, আরেক ট্রুপ সেনা ততক্ষণে অপারেশনের এলাকা ঘিরিয়া ফেলিয়াছে, আমরা কোনঠাসা ও গোলাবারুদহীন অবস্থায় পালাইয়া আসতে বাধ্য হই। তাহার আম্মাজান প্রতিদিন স্কুলে যাইবার সময় মুড়ি মাখাইয়া দিতো আমাদেরকে, আসবার সময়ে চাচী বলিয়াছিল তার ছেলেটারে খেয়াল করিয়া রাখিতে। আমি চাচীর পা ছুঁইয়া সালাম করার সময় বলিয়াছিলাম, “চাচী চিন্তা করবেন না।” কিন্তু আমি তার মৃতদেহটা পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারিনাই। এই আক্ষেপ বোধকরি অবশিষ্ট জীবন আমাকে তাড়াইয়া বেড়াইবে। শফিকুলের মাথায় লাগা গুলিটা বোধহয় আমারই লাগার কথা আছিল। প্রায় দুই হাত দূরে দাঁড়ানো শফিকুল আচমকা কেন আমারই সামনে লাফ দিয়া পড়িলো ইহার উত্তরও আর কোনদিনও পাওয়া যাইবে না বোধকরি। রসদ ফুরাই আসিতেছে, চারিপাশে শত্রু, বেসে ফেরা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে, বাহিরে সেনারা আমাদের খোঁজে তোলপাড় করিয়া ফেলিতেছে। অন্য কোন ক্যাম্পেও যোগ দিতে পারতেছি না। কিছু চাউল ফুটাইতে হবে। একবেলা খাইতেছি আমরা, তবুও অনেক কষ্টে সংগ্রহ করিয়া আনা সামান্য চালও ফুরানোর পথে। দেশের অবস্থা কি চলিতেছে তাও ধরিতে পারিতেছিনা, রেডিও নাই এইখানে। আর তিনঘন্টা বাকী, আজ রাত্রিতেই এলাকা ত্যাগের চেষ্টা করিবো আমরা সবাই, লক্ষ্য বারো-চোদ্দ মাইল দূরের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। খোদা জানে আজ বাঁচিয়া ফিরতে পারিবো কিনা, না ফিরিতে পারিলে এটাই হইবে শেষ লেখা… জয় বাংলা…”

ঘটনার বাকীটা আবীর জানে, ওরা অনেক কষ্টে, নদী সাঁতরে সে রাতে বেসে ফিরতে পেরেছিল। সাঁকোর নীচ দিয়ে সাঁতরানোর সময় উপর থেকে পাকসেনারা শব্দের আন্দাজে গুলিও করে, ভাগ্য ভালো ছিল কারো গায়ে গুলি লাগেনি। অমাবস্যার রাতটায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে ফিরেছিল ওরা। সে রাতের গল্প অনেকবার করেছেন বাবা। কিন্তু লেখাটার তুলনা হয় না, সেই সময়টায় ফিরে যাওয়া যায়, দেখা যায় তাদের কষ্ট, দুঃসহ সংগ্রাম। ছোট্ট ডায়েরীটা সেদিন হয়ত আবীরের জন্যই লেখা হয়েছিল, অবচেতনে হলেও হিমঠান্ডায় আগলেছেন হয়ত প্লাস্টিক ব্যাগের আচ্ছাদনে।

আবীরের মনে আছে, ছোটবেলায় যখন বাবা গল্পগুলোর ডালা মেলে ধরতো ওর সামনে, সে সব শুনে আবীরও যুদ্ধে যেতে চাইতো। প্রতিবার বাবার চোখ চকচক করে উঠতো, বলতো, ‘বাবা, যুদ্ধ তো এখনও শেষ হয়নাই। এই দেশ দেখছো, এটাই তো তোমাদের যুদ্ধ। একে চালাতে হবে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেশের জন্য কাজ করবা তোমরা বড় হয়ে, দেশকে ভালোবাসবা। আমাদের যুদ্ধটা রক্ত আর যন্ত্রণার ছিল, শুরুর ছিল, তোমাদের দায়িত্ব যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়ার, শেষ করার।’

আবীর শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনতো, সেসবের কিছু সে বুঝতো না তখন, আজও তেমন বোঝে না, কিন্তু কথাগুলো খুব ভালো লাগতো। সেই ছোট্টটি থেকেই তার মনে বাবা গেঁথে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে ভালোবাসতে হবে, সবকিছুর উর্ধে। কিন্তু দেশকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় আবীরের জানা নেই, দেশপ্রেম নামক রচনা পড়েও তার মাথায় ঢোকেনি ব্যাপারটা। এসব ঘটনা, প্রশ্ন আর বাবা- এই নিয়ে আবীরের একান্ত একটা জগত আছে। যেখানে কারো অনুপ্রবেশের কোন সুযোগ নেই। বাবাকে হারিয়েছে অনেক বছর হতে চললো, কিন্তু তার প্রতিটি কথা, উচ্চারণ, দেশকে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আবীরের মনের প্রতিটি কোণায় স্থায়ী বাসা বেঁধেছে যেন।

আজ বিজয় দিবসের ছুটি, ছুটির দিনে আবীর একটু দেরী করে ওঠে, আজ সকালেই উঠে পড়েছে। ফাহমিদা ভাবলেন ছেলের মন এখনও খারাপ, বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে আবীর না করে দিলো। ওয়্যারড্রপের এক কোণে একটা লাল-সবুজ পতাকা আছে, খুব যত্ন করে রাখা। পতাকাটা আবীরের খুব প্রিয়। বাবা কিনে দিয়েছিল, নিজে থেকে নয়, ও জেদ করে কিনে নিয়েছিল। সে দিনটার কথা আবীর হয়ত ভুলে যেত, বাবা চলে গিয়ে আর ভুলতে দেন নি। দিনটি যে ছিল তার যাবার আগের দিন! এমনিতে আবীর তেমন একটা কথা বলে না কারো সাথে, আর বাবার সাথে কথা বলা হয়েছে আরও কম, কিন্তু যতটুকুই হয়েছে কেন জানি মনে গেঁথে গেছে।

‘বাবা, বড় দেখে একটা পতাকা কিনে দাও।’
‘পতাকা দিয়ে কি করবা বাবা?’
‘আমার কাছে রেখে দিবো।’
‘নাহ, অযথা কিনো না, নষ্ট করে ফেলবে।’
‘নষ্ট করবো না বাবা, কিনে দাও।’
‘আচ্ছা, দেখছি।’

পতাকা বিক্রেতা ভদ্রলোক বাবার পরিচিত কেউ। লোকটা খুবই সাধারণ, লাল-সবুজ রঙ এর একটা টিশার্ট আছে উনার, ওটাই পড়েন বেশীরভাগ সময়। থাকেন আমাদেরই গলিটার এক ভাঙ্গা ঝুপড়িতে। বৃষ্টি এলে চালের ফুটোতে দেয়া পলিথিনগুলো ঠিকঠাক করে নেন। একা থাকেন, একা চলেন, পতাকা হাতে। গাঢ় সবুজ টিশার্ট এর বুকে লাল সূর্য থাকে আর মাথায় বাঁধা আরেকটা পতাকা। কাচাপাকা চুলদাড়ি আর ভাঙ্গা দুই গাল, জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা সহ লোকটাকে অদ্ভুত লাগে দেখতে।

বড় একটা পতাকা নিয়ে ফিরলেন বাবা। আবীরের হাতে দিলেন, ধরতেই নীচের দিকটা মাটিতে ছুঁয়ে গেলো। বাবা বসে মাটিটা ঝেড়ে দিলেন পতাকা থেকে। সুন্দর লাল-সবুজ আবীর জড়িয়ে নিলো পীঠে। হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিল ওরা। কিছুক্ষণ চলার পরে বাবা বললেন,
‘পতাকা কেন কিনে দিতে চাইনি জানিস?’
‘কেন?’
‘এই পতাকা সহজে পাবার বস্তু না, দুই টুকরা কাপড় না, এর মূল্য চেয়ে পাওয়া একটা ‘জিনিসের’ থেকে অনেক বেশী। বুঝলি?’
আবীর এদিক ওদিক মাথা নাড়ছিল, ‘বুঝিনাই।’
‘দেশকে ভালোবাসতে হয়। দেশের সবুজ ঘাস, লাল সূর্য, যার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। এই পতাকার জন্য, অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, সে পতাকাকে বুকের মাঝে নেয়ার আগে বুকের ভেতরে ধারণ করতে জানতে হয় বাবা।’
‘পতাকাওয়ালা চাচা কি দেশকে ভালোবাসেন? পতাকা ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ, ভালোবাসে। জানিসনা বোধয়, সে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ছিল, পতাকা ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ করেছিল। কাউকে বলে না, লজ্জা পায়।’
‘দেশকে ভালোবাসা, পতাকাকে ভালোবাসা কি লজ্জার?’
‘তার ভয় তার দেশপ্রেমকে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন নাম দেবে, কেউ প্রসংশা করবে, বীর বলবে, কেউ বলবে মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করা ধান্দাবাজ! আমাদের সমাজের মানুষ বড় অদ্ভুত রে বাবা, কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে করুণা করবে। এসব তার পছন্দ না।’

আবীরের মাথায় ঢুকছিল না, তার মন খারাপ করা উচিত কিনা। সে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। পীঠে পতাকা আর মাথায় নতুন অনেকগুলো শব্দ, এলোমেলো আঘাত করছে, অর্থ জানা নেই ওর। পতাকাটা হাতে নেবার সময় প্রতিবার ওর শরীরে রোম শিউরে ওঠে। পতাকাওলা চাচাও আর বেঁচে নেই, বাবার মতোই হারিয়ে গেছেন, একদিন… নীরবে। তার মৃত্যুর সময়টা সঠিকভাবে কেউ জানে না, কখন মরে পড়েছিল কে জানে। দু’দিন না দেখে ডাকতে গিয়েছিলেন কেউ, সাড়া না পেয়ে বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখে মরে পড়ে আছে লোকটা। অদ্ভুত লাগছিল আবীরের, যে লোকটার কোনদিন কেউ খোঁজ নেয় নি, মৃত্যুর পরে সবাই বলাবলি করছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধা ছিল! আহারে লোকটা এভাবে চলে গেলো…’ অতি উৎসাহী কেউ ঘরের কোণায় থাকা ছোট্ট বাক্সে যত্নে রাখা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটা খুঁজে পায়, অতঃপর আসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের পালা, বাবাকেও এভাবে দাফন করা হয়। আবীর সেদিন বোঝে নি, আজও বুঝতে পারে না, কি নিয়ে গেলেন পতাকাওয়ালা কাকু? সারাজীবন পতাকা বয়ে বেড়িয়েছেন যে লোকটা, তাকে পতাকা তলে বিদায় দিয়ে আমাদেরই বা গর্বিত হবার কি আছে? হয়ত আছে! এলাকার লোকজনকে গর্বিত দেখাচ্ছিল। যে লোকটার খোঁজও নেয় নি কেউ কোনদিন তাকে নিয়ে গর্ব করছিল, আমাদের মাঝে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন!

পতাকাটা জড়িয়ে বসেছিল আবীর, অযথা অসংখ্য এলোমেলো ভাবনা মাথায় খেলা করে। চিন্তুার সুতো কাটা পড়ে হঠাত দরজায় নীরবের টোকায়। দরজা খুলে দিলো আবীর।
‘কীরে, পতাকা জড়িয়ে কি করিস?’
‘কিছুনা, হঠাত তুই?’
‘বুদ্ধু, আজ ক্রিকেট ম্যাচ আছে মনে নাই?’

ঝিলিক দিয়ে উঠলো আবীরের মুখটা! দুজনে গিয়ে টিভি অন করে খেলা দেখতে শুরু করলো। আবীরের গায়ে পতাকাটা জড়ানোই আছে। পতাকার আচ্ছাদনে কেন জানি নিজেকে শক্তিশালী মনে হচ্ছে, কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে বাংলাদেশ আজ জিতবে! ফাহমিদা আশ্বস্ত হলেন, অন্তত মন খারাপ করে বসে থাকবে না ছেলেটা।

সন্ধ্যায় যখন বাংলাদেশ জিতে গেলো, আবীরের চোখদুটো আনন্দের অতিশহ্যে ভিজে একাকার। পতাকাটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। ওর অনেক আনন্দ হচ্ছে, উচ্ছ্বাসে নিজের সবটা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করছে। বাহিরে তাকিয়ে দেখলো ছেলেরা জয়ের আনন্দে মিছিল করছে! নীরবকে নিয়ে সেও ছুটলো! পতাকাটা জড়িয়ে ছুটছে আবীর, পেছনে নীরব। ওর চোখে অনবরত অশ্রু আসছে, অদ্ভুত আনন্দের অশ্রু। পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরলো আবীর।

ছেলেটার জানা নেই, কীভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়। জানা নেই পতাকার প্রতি ভালোবাসার মর্মার্থ। কিন্তু এই পতাকা ওকে শক্তি দেয়, গায়ে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে সে। আপাতত স্বপ্ন দেখতে চায় আবীর, পতাকাটা জড়িয়ে উচ্ছ্বাসে কাঁদতে চায় কিছুক্ষণ, মিছিলে হারিয়ে গিয়ে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিৎকারে মুখর হতে চায়। একদিন হয়ত ও জেনে যাবে কি করে দেশকে ভালবাসতে হয়, কতোটা প্রচন্ড সে প্রণয়ের টান, নাড়ীর বন্ধন… একদিন হয়ত আবীরও দেশপ্রেমিক হবে, বাবার মতো! আপাতত সেই পতাকাটা বুকে জড়িয়ে মিছিলে হারিয়ে যেতে চায় সে…

-------------------------------------------------------------------

উৎসর্গ - বাবা-কে, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে, যিনি সব সময় গর্বিত করেছেন।
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঈদ মোবারক!

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০৪



ঈদ মোবারক!

ঈদ উল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন! এক মাসের সংযম ও আত্মশুদ্ধির পর এসেছে খুশির ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, ভালোবাসা ও একসঙ্গে থাকার মুহূর্ত। আসুন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

উন্মাদযাত্রা

লিখেছেন মিশু মিলন, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:২১

একটা উন্মুল ও উন্মাদ সম্প্রদায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের শিকড় থেকে বিচ্যুত হলে যা হয় আর কী, সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো ঘুরপাক খায় আর নিন্মগামী হয়! এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্লোবাল ব্রান্ডঃ ডক্টর ইউনুস....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৯

গ্লোবাল ব্রান্ডঃ ডক্টর ইউনুস....

রাজনৈতিক নেতাদের সাথে, ক্ষমতাসীনদের সাথে তাদের কর্মী সমর্থক, অনুগতরা ছবি তুলতে, কোলাকুলি করতে, হাত মেলাতে যায় পদ-পদবী, আনুকূল্য লাভের জন্য, নিজেকে নেতার নজরে আনার জন্য। আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির ব্যক্তিটি কোন আমলের সুলতান ছিলেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪১



বাংলাদেশে এবার অভিনব উপায়ে ঈদ উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। ঈদ মিছিল, ঈদ মেলা, ঈদ র‍্যালী সহ নানা রকম আয়োজনে ঈদ উৎসব পালন করেছে ঢাকাবাসী। যারা বিভিন্ন কারণে ঢাকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঈদ মোবারক || ঈদের খুশিতে একটা গান হয়ে যাক || নতুন গান || হঠাৎ তাকে দেখেছিলাম আমার বালক-বেলায়||

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬

ঈদ মোবারক। ঈদের দিন আপনাদের জন্য আমার একটা নতুন গান শেয়ার করলাম। অনেকগুলো নতুন গানই ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে ইউ-টিউবে। ওগুলো ব্লগে শেয়ার করতে হলে প্রতিদিনই কয়েকটা পোস্ট দিতে হবে।



তবে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×