স্বপ্ন। দুই শব্দের সামান্য এই শব্দটা সামনে এলেই অন্য একটি জগতের কথা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে! রহস্যময় সে জগতের নাম স্বপ্নের জগত। জেগে জেগে মানুষ ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী হয়, পরিকল্পনা করে, শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় এটিও অবশ্যই সঠিক। কিন্তু এখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো শুধু ঘুমের মাঝের ওই অসামান্য কল্পনার, অসীম রহস্যময় জগতটার প্রতি।
জেনারালাইজড স্বপ্নের সংজ্ঞাটি হচ্ছে এমন, “স্বপ্ন (ইংরেজি: Dream) মানুষের একটি মানসিক অবস্থা, যাতে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করে থাকে।” [উইকিপিডিয়া]
অন্যভাবে বললে, 'Dreams are successions of images, ideas, emotions, and sensations that occur involuntarily in the mind during certain stages of sleep.'
এভাবেও বলা যায়, “স্বপ্ন হচ্ছে অনুরণিত ছবি, ধারনা, অনুভূতি এবং অবচেতনের স্মৃতি যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুমের নির্দিষ্ট ধাপে মনের মাঝে ঘটে থাকে।”
মানুষ জীবনের ৩৩% সময় অর্থাৎ ৬৫ বছরের একটি জীবনে প্রায় সাড়ে ২১ বছর মানুষ ঘুমিয়ে কাটায়। সুতরাং এটি অনস্বীকার্য যে ঘুম আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, আর স্বপ্ন মানুষের ‘ঘুমন্ত জীবনের’ অবিচ্ছেদ্দ বিষয়! তবে স্বপ্নের ধারনা মাত্র এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এর বিস্তৃতি, ব্যাপ্তি, প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব আমাদের বাকি ৬৭% জীবনেও ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।
ঘুমন্ত অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি স্তিমিত হয়ে যায় এমন মনে হলেও তা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয় না। তাই নিদ্রাকালে নানারূপ কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা ও দৃশ্য উদিত হয়। নিদ্রিত অবস্থায় জাগ্রত অবস্থার ধারাবাহিকতাকেও স্বপ্ন বলা যেতে পারে। স্বপ্নে নিজের কাছে নিজের নানারকম আবেগ, তথ্য ও তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। স্বপ্নে দেখা দৃশ্য জাগ্রত প্রতক্ষ্যের মতোই স্পষ্ট। আমরা স্বপ্ন দেখি অর্থাৎ স্বপ্ন মূলত দর্শন-ইন্দ্রিয়ের কাজ। স্বপ্ন দেখা অনেকটা সিনেমা দেখার মতো। স্বপ্নে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের গৌণ ভূমিকা থাকে। কিন্তু টেকনিক্যালি বিচার করলে দর্শন ইন্দ্রিয় মুলত চক্ষু কেন্দ্রিক বিধায় এটাকে কঠিন ফ্যাক্ট হিসেবেও ধরা যায় না। চিন্তাশক্তির মাধ্যমে দেখা এই ছবিগুলো অনেক সময় তৈরি হয় আবার অনেক সময় মানুষের নিউরন সেলেপূর্বেই সংরক্ষিত থাকে।
জাগ্রত অবস্থায় কিছু দেখার মাধ্যমে যেমন শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, আমরা রিয়াক্ট করি, তেমনি স্বপ্ন দেখাতেও কিছু না কিছু শারিরীক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সব থেকে বেশী ‘রিপোর্টেড কেইস’ ও গবেষণা যেটা বারবার কনফার্ম করেছে তা হচ্ছে স্বপ্ন দেখার সময় চোখের মনি বন্ধ অবস্থায়ই নড়াচড়া করতে থাকে। অনেকে ঘুমের মাঝে দেখা বিষয়গুলো আক্ষরিক অর্থেই Acting করে বা হাত নেড়েচেড়ে করার চেষ্টা করেন। অনেকের আছে স্বপ্নের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস! নিউজে এসেছে ঘুমের মাঝে, স্বপ্নে গাড়ি চালিয়ে প্রায় ৯০ কি.মি. যাবার ঘটনাও! সে যে ঘুমিয়ে গাড়ী চালাচ্ছিল সেটা একে একে ষোলটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও একজন প্রত্যক্ষদর্শী কনফার্ম করেন। উনি পুলিশে ইনফরম করলে পুলিশই গাড়ীটির পিছু নিয়ে মহিলাটিকে সাইরেন বাজিয়ে জাগান ও গাড়ী থামানোর পর উদ্ধার করেন।
আমাদের মাঝে একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে শুধু মানুষই স্বপ্ন দেখে বা দেখতে জানে! এটি কিন্তু একেবারেই সত্য নয়। আমরা যেমন আমাদের জীবন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখি তেমনি পশু-পাখীরাও তাদের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে সম্পর্ক দেখে। বিড়াল স্বপ্ন দেখা অবস্থায় কোন কিছুর সাথে ধাক্কা না খেয়ে সাবলীলভাবে হাঁটতে সক্ষম এটা প্রমাণিত সত্য। তাদের মগজে অবশ্য অনেক অতীত মেমরী থেকে না বরং নিয়মিত কাজগুলো বা তাদের দৈনন্দিন বিষয়গুলো নিয়েই তারা স্বপ্ন দেখে। যেমন বেশ কিছু বিড়ালের মগজ পরীক্ষা করে ইঁদুর শিকারের স্বপ্ন দেখার প্রমান পাওয়া গেছে।
আর হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষই কিন্তু স্বপ্ন দেখে! হ্যাঁ, প্রতিটি। আপনি হয়ত দাবী করবেন আপনি দেখেন না, কিন্তু আপনি অবশ্যই দেখেন। শুধু মাত্র একটি অরগান বিশেষ অকেজো হলেই মানুষ স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মানুষের ঘুমের মোট পাঁচটি স্তর থাকে, এর প্রতিটি স্তরে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখে। প্রথম স্টেজটি হচ্ছে হালকা ঘুম যেখান থেকে সহজেই জেগে ওঠা যায়, এটাকে তন্দ্রা দিয়েও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রতিটি স্টেজে আমরা আরও গভীর ঘুমের দিকে যেতে থাকি। চতুর্থ ও পঞ্চম স্তর নির্দেশ করে গভীরতম ঘুম যা শরীর এর মাংসপেশী আক্ষরিক অর্থে পঙ্গু করে দেয় ও মস্তিস্কে চলমান তরঙ্গ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে যায়। তখন শুধু ডেলটা মেমরী ওয়েভ চলতে থাকে মস্তিষ্ক জুড়ে। ঘুমিয়ে পড়ে চতুর্থ স্টেজে পৌঁছানোর নব্বই মিনিট পরে আমরা চলে যাই রেম স্লিপ নামক স্টেজে।
REM sleep হচ্ছে Rapid eye movement বা স্বপ্নের গভীরতম জগত। একবারের পুরোরাতের ঘুমে আমরা ৪/৫ বার সাধারণত ঘুমের এই স্তরগুলোর ভেতর দিয়ে যাই। মানে প্রথম থেকে পঞ্চম আবার পঞ্চম থেকে প্রথম এভাবে। অনেকে আবার একটা স্তর সম্পূর্ণ করে জেগে যান। একারণেই রাতে আমরা জেগে উঠি, আর র্যাম স্লিপ থেকে জেগে উঠলে অনেক সময় তেষ্টা পাবার প্রনবতা দেখা দেয়। এসবই আবিস্কার হয় ১৯৫৩ সালে নাথানিয়াল ক্লাইটম্যান (Nathaniel Kleitman) and ও এগুয়েন এজোরেনস্কির (Eugene Aserinsky) গবেষণায়। তারা University of Chicago তে রিসারচার হিসেবে ছিলেন।
নীচের ছবিদুটিতে ঘুমন্ত ব্রেইনের দুইটি ভাইটাল স্টেজের ব্রেইন ওয়েভ ও কর্মপ্রক্রিয়ার পার্থক্য দেয়া আছেঃ
অনেক সময় কোন নির্দিষ্ট চিন্তার উপরে ফোকাস করে একটি দৃশ্যপট বানিয়ে ফেলে মস্তিষ্ক নিজে থেকেই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, স্বপ্ন আপনি আমি সবাই দেখি, কিন্তু যখন জেগে উঠি তখন খুব কম সংখ্যক মানুষ তা মনে করতে পারেন। খুবই দাগ কাটার মতো কোন স্বপ্ন হলে অনেক সময় মনে থাকে, তবে মস্তিষ্কের গঠনের উপরে ভিত্তি করে অনেকে সবই মনে রাখতে পারেন। এই মনে রাখার ক্ষমতা আবার একটি পর্যায়ে বা বয়সকালে গিয়ে কমে যায় বা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। এসব নিয়ে পড়ার পরে নিজের উদাহরণটাই দিতে পারবো, আমি ১৮ বছর বয়সের পরে ঠিক মনে করতে পারিনা তেমন সিগ্নিফিকেন্ট কোন স্বপ্নের কথা। কিন্তু তার আগে দেখা ভয়াবহ সব স্বপ্ন আমি এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি। ছোট বেলায় যে বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত স্বপ্ন দেখতাম, ওগুলোর কিছু আমার লাইফটাইম ফোবিয়া হয়ে গেছে। যেমন আমি প্রতিনিয়ত সাপের তাড়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, অনেক ধরনের সাপ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি এমন স্বপ্ন দেখতাম, আমি সাপ এখন এই বয়সেও বেজায় অপছন্দ করি। ওরা এখনও আসে, তবে লক্ষণীয় নয় তেমন।
দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ঘুম সময়ের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং কৈশোরে ঘুম সময়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশ স্বপ্ন দেখে। চল্লিশের পর থেকে ঘুম সময়ের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ স্বপ্ন দেখা হয়। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে স্বপ্ন দেখা তত কমতে থাকে। সুতরাং, প্রাকৃতিক প্রবণতা হচ্ছে মানুষ সর্বস্বপ্নহীন ভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে।
স্বপ্ন ভয়ের হতে পারে, আনন্দের হতে পারে, স্মৃতিচারনের হতে পারে, কাল্পনিক হতে পারে, সম্পূর্ণ বাস্তব ভবিষ্যৎ প্রেডিকশন হতে পারে, কোন বিদ্যমান সমস্যার জট খোলার জন্যও হতে পারে! কিন্তু যাই হোক স্বপ্নের ধরন, কখনও কি জিজ্ঞেস করেছেন, কেন আসে স্বপ্ন? কেন প্রকৃতি আমাদের শরীর প্যারালাইজড করে দিয়ে, মস্তিষ্ক বিশ্রামের সময়টায় আরও বেশী একটিভ করে দেয় শুধু কিছু আপাত ‘অপ্রয়োজনীয়’ স্বপ্নের জন্য? কেন ওরা আসে? আর এর অর্থ কি? আদৌ কী কোন অর্থ রয়েছে? বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করেছেন, খুঁজেছেন এসবের উত্তর।
Oneirology হচ্ছে স্বপ্ন সংক্রান্ত সায়েন্টিফিক বিদ্যা বা চিকিৎসা বিদ্যাও বলা চলে। প্রযুক্তি এখন অনেক এগিয়েছে বিধায় বিজ্ঞানীদের পক্ষে অবশেষে সম্ভব হয়েছে আক্ষরিক অর্থেই অন্যের স্বপ্ন সচেতন ভাবে দেখার ক্ষমতা!
সিগমন ফ্রয়েড নামক জার্মান বিজ্ঞানী, যিনি সমস্ত জীবন গবেষণায় ঢেলেছেন এই স্বপ্নের রহস্য সমাধানে! তিনি ক্যাটাগরি করেছিলেন কি ধরনের স্বপ্নে মস্তিষ্কের কি রকমের প্রতিক্রিয়া হয় এবং স্পন্দন সহ আরও কিছু বিষয় মনিটর করে আসলে সংখ্যাকোডের মাধ্যমে দেখা সম্ভব একটি মানুষ তথা একজন ঘুমন্ত মানুষ কী স্বপ্ন দেখছেন। তার থিওরী ছিল, ‘Every single thing people dream of stands for something sexual’ - এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
ফ্রয়েডের মৃত্যুর বেশ পরে আসে আসল টারনিং পয়েন্ট যখন, ১৯৫৩ সালে নাথানিয়াল ক্লাইটম্যান (Nathaniel Kleitman) ও এগুয়েন এজোরেনস্কি (Eugene Aserinsky) যখন রাতভর ঘুমন্ত মানুষের ব্রেইন ওয়েভ রেকর্ড করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন। এই ওয়েভ থেকে তারা যা পান, মানুষ যখন জেগে থাকে তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গ দ্রুত ও সাধারণত (উল্লেখযোগ্য কিছু না ঘটলে, যেমন রাগ, হাঁসি ইত্যাদি) নির্দিষ্ট মাত্রায় নড়াচড়া করে থাকে। আর ঘুমের সময় এই তরঙ্গ যেমন ঘুমের স্টেজ বাই স্টেজ বদলাতে থাকে তেমনি হয়ে যায় অনিয়মিত, অনেক সময় অনেক উঁচু আবার অনেক সময় নীচু। যন্ত্রটা কিছুটা ব্যারোমিটারের ধর্মে কাজ করতো অর্থাৎ মস্তিষ্কের তরঙ্গ বা কম্পন মাপতো।
র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা র্যাম স্লিপের সময় আক্ষরিক অর্থে আমরা স্বপ্নে ডুবে যাই! তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গ হয় প্রচণ্ড অনিয়মি এবং চোখের মনি দ্রুত ডানে-বামে ও উপরে নীচে নড়তে থাকে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ভলান্টিয়াদের প্রতিবার র্যাম স্লিপের (RAM sleep) এর এই স্ট্যেজ থেকে জাগিয়ে তুললে তারা ইমিডিয়েটলি রিপোর্ট করেছে তারা কোন একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। কখনও কি দেখছিলেন তা মনে করতে পারেন, কখনও তা ভুলে যান, কিন্তু স্বপ্ন অবশ্যই দেখছিলেন এবং মনিটরিং যন্ত্রও তাই বলে। [ছবি উপরে সংযোজিত]
এগুলোই হলো আমরা যে স্বপ্ন দেখি তার প্রমান ও সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা। কিন্তু স্বপ্নে আমরা কি দেখি? হাজার-হাজার মানুষের তথ্য-উপাত্ত একখানে করে বছরের পরে বছর গবেষণা করে যা পাওয়া যায় তা আসলেই চমকে দেবার মতো। মনে পড়ে শিশুকালে ভয়ের স্বপ্ন দেখতেন বেশী? বা আপনার বাচ্চাটি (১২ বছরের নীচে) ভয়ের স্বপ্ন দেখার কথা শেয়ার করেছে কখনও? ছোট বাচ্চারা ভয়ের স্বপ্ন দেখে কারন প্রকৃতি তাদের এটা দেখায়। আর সব চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বাচ্চাদের কিন্তু ভয়াবহ এক্সপেরিয়েন্স নেই, তবু তারা কেন দেখে? কারন হচ্ছে এই স্মৃতিগুলো মূলত আমাদের ডিএনএর মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়ে হয়ে আসে। তাই তারা দেখতে পারে অদেখা অনেক কিছু! এই ডিএনএর প্রভাব শুধু আমাদের পিতা-মাতা বা তার পূর্ব পুরুষদের থেকে আসেনা বরং আসতে পারে হাজার-হাজার বছর বা মিলিয়ন-মিলিয়ন বছর আগে মানুষের আদিরুপ থেকেও! যারা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছে, যাপন করে গেছে পাষবিক জীবন! এখানে মুলত বিবর্তনবাদ থিওরী চলে আসে। আমাদের আদি-পুরুষদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শিশুদের ফাঁকা মেমরীতে প্রভাব ফেলে। তাই বন্য প্রানী তাড়া করা, অজানা অচেনা প্রানীদের হামলা মোকাবেলা করা ইত্যাদি স্বপ্ন এমনকি অবুঝ শিশুরাও দেখে।
কিন্তু যখনই আমরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি আমাদের স্বপ্নের ধরন বদলে যেতে থাকে। পার্স হারিয়ে যাবার স্বপ্ন, বিল্ডিং থেকে পড়ে যাবার স্বপ্ন, বিবস্ত্র অবস্থায় পাবলিকের সামনে থাকার স্বপ্ন, আগুনে দগ্ধ হবার স্বপ্ন সেখানে যায়গা করে নেয়। কিন্তু আবারও ভাবতে হচ্ছে, কেন এগুলো আমাদের স্বপ্নে আসে?
ভয়াবহ স্বপ্নগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. টম কারসলে ব্যাখ্যা করেন, “প্রকৃতি আমাদেরকে ঘুমের সময় এই এডভেঞ্ছারগুলোতে পাঠিয়ে দেয় মুলত আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে, প্রতিকূলতার যে উপাদানগুলো বিদ্যমান তা অবচেতন মনে জানতে পারে এবং নিজেই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে, অটোমেটেড সিস্টেমের মতো এবং আমাদেরকে দেখাতে থাকে সম্ভাব্য সমস্যা ও তাদের সমাধান! এগুলো অবচেতনে আমাদের ট্রেইন্ড করে রেখে যায় এবং সাবধান করে দিয়ে যায় বাস্তব জীবনে চলার সময়ে। স্বপ্ন চারটি নোবেলের কৃতিত্ব পেয়েছে, অনেক আবিষ্কার হয়েছে এই স্বপ্নের মাঝেই! অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ এর আবিষ্কার ছাড়াও Elias Howe (এলায়াস হাউ) যখন প্রথম সুইং মেশিন বা সেলাই মেশিন তৈরির সবথেকে ভাইটাল স্টেজে তখনই তিনি আটকে যান ভয়াবহ ভাবে। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না সুঁইয়ের কোথায় ছিদ্রটা হবে। তখনই এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন তিনি আক্রমণের শিকার হয়েছে হিংস্র Cannibal দ্বারা এবং শেষ উনি যা দেখেন প্রতিটির নখের একদম মাথায় একটা করে ফুটো ছিল, আচমকা জেগে উঠে তিনি অনুধাবন করেন সুইং মেশিনের সুঁই এর কোথায় ছিদ্রটি রাখতে হবে! এটি মুলত আমাদের সভ্যতারই একটি ভাইটাল স্টেপ ছিল। তাই স্বপ্নের এই জগত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যায় বর্ণনা করা যাবে না এমন অনেক মহান সৃষ্টি কর্ম, সাহিত্য কর্মের কৃতিত্বও স্বপ্নের!”
স্বপ্নের সাথে সম্পর্কিত কিছু দুর্দান্ত ফ্যাক্টঃ
র্যাম স্লিপ (গভীর ও স্বপ্নময় ঘুম) মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে বহুগুণে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কোন সমস্যা সমাধানে র্যাম স্লিপ স্তরে যাওয়া মানুষটি এবং স্বপ্ন দেখা মানুষটি উল্লেখযোগ্যভাবে শ্রেয়তর ফলাফল করে তার চেয়ে যে উক্ত ধাপগুলো পর্যন্ত ঘুমায়নি বা স্বপ্ন দেখে নি।
আপনি যদি মেডিটেশন করেন এবং মস্তিস্কে শান্তভাবে আনতে জানেন বা নিজেকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন তবে ঘুমাবার আগে যদি স্বপ্নের কাছে চেয়ে নেন, আমি আজ ‘অমুক বিষয় নিয়ে’ স্বপ্ন দেখবো তবে ৮০% মানুষ সফলতার সাথে তা স্বপ্নে দেখে!
স্বপ্ন মনে রাখা খুবই কঠিন ও সব স্বপ্ন মনে রাখা বস্তুত অসম্ভব। আপনি কোনদিনই জানতে পারবেন না এবং বলতে পারবেন না আপনার সব স্বপ্নগুলোর কথা কারন আপনি মনে রাখতে পারবেন না। ৪০% মানুষ তাদের স্বপ্নের ৪৮% সাফল্যের সাথে জেগে উঠে জানাতে সক্ষম হয় বলে একটা রিসার্চ স্টাডিতে উঠে আসে।
স্বপ্নের রঙ আজীবন রহস্যময় একটি বিষয়! কেউ আজ পর্যন্ত শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি তারা কি রঙে জিনিসগুলো দেখেছে। ধরে নেয়া হয় স্বপ্নের রঙ সাদাকালো!
স্বপ্নের ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দিতে গিয়ে অবচেতনে মিথ্যা বলতে শুরু করে অধিকাংশ মানুষ। যা দেখেছে তা বলতে গিয়ে অজান্তেই বদলে যায়! বক্তা অনেক সময় বুঝতে পারেন, তবে বেশীরভাগ সময় পারে না।
স্বপ্ন ও লক্ষ্য এক নয়। লক্ষ্য, স্বপ্নের মতো কল্পনা আশ্রিত নয়। লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট। স্বপ্ন স্পষ্ট হতে পারে কিন্তু সুনির্দিষ্ট নয়। লক্ষ্য সংক্ষিপ্ত। স্বপ্ন বিস্তারিত।
নিয়মিত সচেতনভাবে স্বপ্নের দিকে মনোযোগ দিলে আরও ভালোভাবে মনে রাখা সম্ভব।
আধ্যাত্মিক স্বপ্ন ধর্মপ্রেমী মানুষদের মাঝেই বেশী আসে কারন তাদের চিন্তাধারা ধর্ম কে নিয়ে আবর্তিত হয়। তবে সব সময় এর অর্থ থাকে না বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা।
মানব দেহে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা ক'ঘন্টার? আট বলেই জানি তাই না? আসলে দুই থেকে তিন ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট! আমাদের এতো লম্বা ঘুমাতে হয় ক্লান্তি ও স্বপ্ন দেখার জন্যই। স্বপ্ন আমাদের রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যলেন্স করতে সময় নেয়, কাজ করে শরীরের উপর, আর মস্তিষ্ককে ঘুমের আহ্বান জানাতে থাকে!
স্বপ্ন নিয়ে চর্চা করা একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতি ও জনপদ রয়েছে। প্রাচীন বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী এই জনপদের নাম ‘এটিগামেক।’ তারা বর্ণনা করা স্বপ্নের অর্থ বলতে পারে। যিনি অর্থ বলেন বেশীরভাগ সময়েই বক্তার সমস্তটা তার কাছে থাকে অজানা তবু আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।
ফ্যাক্টের বিশ্লেষণ করে, বছরের পর বছর এই রহস্যময় জগতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে এমনও জানিয়েছেন, স্বপ্নের জগতটি একটি আলাদা এবং বিদ্যমান জগত! যদি নাও হয়, স্বপ্নের গুরুত্ব আমাদের জীবনে অপরিসীম। অতিরিক্ত স্বপ্ন যেমন আমাদের বাস্তব জীবনে এনে দিতে পারে ডিপ্রেশনের মতো বাজে অনুভূতি, তেমনি সব সময় ভালো বা সুখের স্বপ্ন দেখাটাও আমাদের জন্য মঙ্গলকর নয়। গবেষণা, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকরা এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, বেশীরভাগ মানুষ যারা ভয়ের স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন দেখেন, বাস্তব জীবনে অনেক সুখী হয়ে থাকেন। আর তুলনামূলকভাবে সুখের স্বপ্ন, অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখা মানুষদের বাস্তব জীবন হয়ে থাকে বিষাদময়। তাই স্বপ্নের ভূমিকা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অপরিসীম রহস্যের এই জগতকে নিয়ে গবেষণা কাঁটা ছেঁড়া চলছেই, নতুন নতুন দিক সামনে আছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু স্বপ্ন আজও মহারহস্যের এক মহাসমুদ্র হয়েই রয়ে গেছে মানব জাতির জন্য।
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যা নিয়ে আমার অন্যান্য পোস্টঃ
১ , ২ , ৩ ।
তথ্যসুত্রঃ
উইকিপিডিয়া
অনলাইন রিসার্চ আর্টিকেলস
10,000 Dreams Interpreted by Gustavus Hindman Miller
টিভি শো - নোভা সায়েন্স নাউ
A Research Project by a group of students of University of California (San Francisco).
[যে কোন তথ্যগত ত্রুটি প্রমান সহ জানালে সংশোধন করা হবে]
ছবিঃ সংগৃহীত।