বেশ লাগছে হাঁটতে। আসেপাশের ধূসর জগতের দিকে তাকিয়ে "সব সুন্দরের" পথে হাঁটছি আমি। পায়ের নীচে মিহি তুষার কণা, হিমবায়ু চারিদিকে। তবে অবাক করা বিষয় হল, সাধারণ পোষাকেও এতটুকু শীত করছে না। ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাচ্ছে না হাত-পা। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছেনা এতটুকু। সুখের অনুভূতি যেন ঘিরে রেখেছে। চারিদিক যেন সুন্দর ও শান্তির সংজ্ঞা দিচ্ছে। হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কা, উঁহু, শব্দ। জগতটি মিলিয়ে গেল।
নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানায়, কম্বলের তলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। ধাক্কা বা শব্দ আসছে দরজা থেকে, মা ডাকছে।
সারা দিলাম। উঠতে ইচ্ছে করছে না, প্রচণ্ড আলসেমি হচ্ছে। স্বপ্নটি হুবহু মনে করতে পারছি । ঠিক যেমনটি সচেতনভাবে মনে রাখতে পারি চার বছর বয়স থেকে। এতো সুন্দর জায়গাটি! যাই হোক, ক্লাস আছে, উঠে পড়লাম। এই যাহ, আমাকে তো আপনারা কেউ চিনেন না। আমি রায়ান, রায়ান আলফ্রেড। বাবা বেঁচে নেই, মায়ের সাথে থাকি। আর বাকি ব্যাক্তিগত বিষয়গুলো না হয় নাই জানলেন।
স্বপ্নবাজ মানে কি? আক্ষরিক বিচারে হয়ত আমাকে বলাও যায়। প্রচুর স্বপ্ন দেখি, জেগে থেকে ভবিষ্যতের নয়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কালহীনতার স্বপ্ন। অন্যদিকে আমি আবার প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে। বেশ লম্বা সময় ধরে ঘুমানোর বিষয়টি রয়েছে আমার মাঝে। তবে আমার বিষয়ে আশ্চর্য বিষয় যেটি, আমার দুইটি জগত রয়েছে। সেখানে সমানভাবে বিচরন করি আমি। সেই জগতে আমি সম্পূর্ণ আলাদা, সেখানকার সবকিছুই আলাদা। ওখানকার মানুষ, জীবন, খাদ্য সবই আলাদা। আমার শব্দগুলো হয়ত ঠিক নেই। মানুষ বলে না ওদের, একই বৈশিষ্ট্য ও আকৃতির প্রাণীদের ওই জগতে বলা হয় Spebug(স্পেবাগ), আর সেই জগতের নাম স্পেলুকান। হাসি পেলে আমার কিছুই করার নেই। এসবই আমার অতিকল্পনা, অসুস্থতা নাকি সত্য সে প্রমান দিতে পারবো না। তবে ইটস ওকে! আমি মেনে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বিষয়ে কিছু বলার অনুমতিও নেই পৃথিবীর কাউকে, তাই লিখছি।
সেখানে একটি নির্দিষ্ট স্তরে না গেলে নাম পাওয়া যায়না। আমাদেরকে সংখ্যায় সম্বোধন করা হয়। এই “সংখ্যা সময়টিকে” বলা হয় শিশুকাল। তবে ওখানে সংখ্যা পদ্ধতি আলাদা, এখানকার সাথে মিলে না।
এখন বলি স্পেলুকান বিষয়ে। আমার পরিবারে আছেন মা ও বাবা, ওনারা যা যা বলেছেন তাই লিখছি। পৃথিবী হচ্ছে স্পেলুকান এর স্বপ্ন বা কল্পনা। আর পৃথিবীর অস্তিত্ব হচ্ছে স্পেবাগদের জীবনচক্রের একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেখা স্বপ্নের মাঝে। প্রতি একশ বছরের সমপরিমান সময়ে একজন করে স্পেবাগ এমন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় যে দুই জগতেই সমান বিচরন করতে সক্ষম। আমি এই শতকের সেই বিশেষ স্পেবাগ। খুবই উন্নত জগত স্পেলুকান, খুবই সুন্দর, সবকিছু সহজ ও সাজানো, কন্সেপ্টে কিছুটা কল্পনার স্বর্গের সাথে মিলে যায়। স্বর্গকে পৃথিবীতে ধারনই করা হয়েছে স্পেবাগদের জীবনকে কল্পনা করে। ওখানে শুধু জগতের স্বার্থে ও প্রয়োজনে কাজ করতে হয় বিভিন্ন সময়ে, বিনিময়ে সব চাহিদা পূরণ করা হয় আমাদের লিডার স্পেবাগের দ্বারা। তবে স্পেলুকানের প্রানিদের মাঝে শুধু একটা জিনিষ নেই, অতিরিক্ত ইমোশন, তারা ইচ্ছা করলেই এটি নিয়ন্ত্রন করতে পারে। ভালবাসা, মায়া-মমতা ওদের মাঝে বৃহত্তর প্রভাবক নয়। কিছুটা যান্ত্রিক কিন্তু অপার সুখের সে ভুবন। সবকিছু নিয়মে বাঁধা হলেও ওখানে সবাই সুখী।
শিশু স্পেবাগদের মনে বেশ আবেগের খেলা চলতে থাকে, তাই স্পেবাগদের কল্পনা অংশ এই মানবজীবন অংশে বেশ প্রকট হয়ে ধরা দেয়। আমার বয়স প্রায় চব্বিশ(পৃথিবীর হিসেবে), এতদিনে যা বুঝেছি, ক্ষুধা, দারিদ্র, ধনী-গরীব, সুখ-দুঃখ এবং ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন শব্দগুলো শুধু পৃথিবীর জন্যেই বরাদ্দ। বা পৃথিবীর জায়গায় আমার কল্পলোক শব্দটি ব্যাবহার করা উচিত হবে। সেখানে যেমন নেই কোন দুঃখ-কষ্টের অবস্থান, নেই কোন শেষ। সেখানে মৃত্যু নেই। হ্যাঁ তবে ধ্বংস আছে। এবং তা হয় শুধুই স্বেচ্ছায় যদি কেউ তা বরন করতে চায়। স্পেলুকানেও বিবাহের মতো একটা ব্যাবস্থা আছে। “কম্প্যাটিবিলিটির” ভিত্তিতে পেয়ার নির্ধারণ করা হয় এবং তাদেরকে একসাথে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। মিলের পূর্ব-পর্যবেক্ষণ কখনই ভুল হয়না।
শিশুটি জন্মানোর পরে একটি বয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠে। তবে এটি নির্দিষ্ট নয়। এই সময়কাল কখনও ১৫/২০ বছর আবার কখনও ৮০/১০০ বছর। শরীরের বিভিন্ন খনিজ এর তারতম্যের ভিত্তিতে এই সময়কাল নির্ধারিত হয়। এই বেড়ে ওঠার সময়টিই মুলত স্পেবাগরা ঘুমায়। বৃদ্ধির তারতম্যে এই ঘুমের পরিমানেও কম বেশী হয়ে থাকে। এই ঘুমের সময়টুকুতেই স্পেবাগদের কল্পনা করতে হয়, এটি বৃদ্ধির মানসিক অংশ। তবে এই কল্পনা বিশাল এক ক্যানভাসে এঁকে যাবার মতো। যেখানে তুলির আঁচড় দেওয়া চলে কিন্তু মুছে ফেলা চলে না। তাই এক স্পেবাগ আগুন জ্বালাতে শিখল তো আরেক স্পেবাগ দেখল চাঁদের পিঠ কি রকম। কোন কোন অসাধারণ প্রতিভাধর স্পেবাগ কল্পনায় গড়ে তুললো মহাবিশ্বের বিশালতা যা স্পেলুকানের তুলনায় এক মহাসুমুদ্রে একবিন্দু জলের সমানও নয়। কল্পনায় তারা গড়ে তোলে পরিবার এবং স্পেলুকানের ধারা বজায় রাখতে সেই পরিবার এগিয়ে চলে। কল্পনাও এগিয়ে চলে তার সাথে। অনেক অনেক অনেক গত বা বর্তমান স্পেবাগের কল্পনা হচ্ছে আজকের এ পৃথিবীর সমস্ত কাহিনী। আর ভবিষ্যৎ অশেষ স্পেবাগ হবে এই মহাবিশ্ব বা অশেষ ঘটনা প্রবাহের বিষয়। তারা এখানে নতুনত্বের খেলায় মাতবে, আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হবে, সৃষ্টিশিলতায় হতে চাইবে পরিপূর্ণ! কিন্তু এসবই একটি শিশু স্পেবাগের খেলা। পুতুল খেলার মতো বিষয়টি। তবে এই খেলার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি চির চলমান। স্পেবাগ এর শেষ হবেনা, ধ্বংস হবেনা স্পেলুকান, আর কল্পনা করে যাওয়া হবে এই পৃথিবীকে, স্পেবাগদের স্বপ্নে।
স্পেবাগের বেড়ে ওঠার শেষ হয় এক সময়ে, মস্তিষ্কের বিকাশও পূর্ণতা লাভ করে। তখন আর ঘুম আসেনা, কেউ ঘুমাতে পারেনা বা প্রয়োজন হয়না। কল্পনাও আর আসেনা তখন। তাই পৃথিবী বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আর থাকেনা তার জন্যে। আপাত অস্তিত্বহীন এই পৃথিবী গ্রহে স্পেবাগদের স্বপ্ন বুনে যাওয়া তবু চলতে থাকে।
কল্পনার মাঝে মৃত্যু হয়, কল্পনায় অবসান হয় কল্পনার মৃত্যু দিয়েই।
আমি কখনই দুঃস্বপ্ন দেখিনি। তবে আমি জেনেছি, কল্পনার অভিজ্ঞতা পড়েছি, শুনেছি। অনেকের সাথে কথা বলে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। পরে প্রশ্ন করে জেনেছি, প্রতিটি স্পেবাগের ব্যাক্তিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে তার স্বপ্ন নির্ধারণ হয়। এতে ভুমিকা থাকে শারীরিক উপাদানগুলোরও।
আমি অনেককে চিনি, যারা আমার আসেপাশেই রয়েছে। আমি জানি ওদের বিকাশ কবে পূর্ণ হয়ে যাবে, তবে আমার বলার অনুমতি নেই। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক স্পেবাগদের কল্পনার খাতিরে অনেক চরিত্র এখানে কো-একজিস্ট করে। যেমন আমার কারনে আমার মা হিসেবে একজন রয়েছেন যার ওরিজিন মুলত স্পেলুকান। তবে এর উপরে আমার নিয়ন্ত্রন নেই। এ শুধুই আমার মস্তিষ্কের খেলা।
স্পেলুকানে আমার পরিবার আমাকে ভালভাবে ব্রিফ করেছে সবকিছুই। আগামীকাল আমি আমার বিকাশ স্তর শেষ করতে যাচ্ছি। আজ রাতেই আমি জেগে উঠবো স্পেবাগে, আর কল্পনায় ফিরতে পারবো না। পৃথিবীর অস্তিত্ব আমার জন্যে বিলীন হয়ে যাবে। আর আমি চিরজীবন থাকবো "একমাত্র" জগতে। এই পূর্ণ জাগরন হয় প্রচণ্ড এক ব্যাথার মধ্যে নিয়ে। এটাই নিয়ম। আর ব্যাথাটি হয় মানসিক, অর্থাৎ স্বপ্নের মাঝে কিন্তু তা শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে জাগিয়ে তোলে। স্পেলুকানে "সে" ঘুমন্ত বা জাগ্রত থাকুক, স্পেবাগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে ব্যাথাটি আবশ্যক।
আজকের স্বপ্নটিই আমার শেষ স্বপ্ন। আমি স্পেলুকানে জেগে থাকা অবস্থায় আমার শিশুকাল শেষ করতে যাচ্ছি, আজ রাতে। আমার নিয়তি আমি জানি, পৃথিবীর কেউ যা জানেনা। ডায়েরিটা রেখে দিলাম একপাশে, আমার কল্পনায় রেখে যাচ্ছি এই ডায়েরি, যেই পড়বে, বিশ্বাস করতে পারবেনা কিছুই। তাই ভয়ের কিছু নেই। কল্পনা আর বাস্তবতায় এতো ভারী পর্দা টেনে দেওয়া রয়েছে, কেউ কোনোদিন দেখতে পারবেনা সত্যটি। কেউ জানতে পারবেনা, পৃথিবী শুধুই অলীক কল্পনার নাম। জীবন ধারন শুধুই কল্পনার খেলা। যাদের এসব জানতে নেই, তাদের জানিয়েই বা কি লাভ। কি লাভ এটি জেনে যে, পৃথিবীতে ঘুমিয়ে দেখা জগত আমাদের কল্পনা নয়, বরং সত্য। পৃথিবীতে জেগে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত শুধুই আমাদের কল্পনা, স্পেবাগদের।
আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। আমি বিদায় নিচ্ছি, আমি জানি এই ঘুম আমার ভাংবেনা... অথবা ঘুম আমার ভেঙ্গে যাচ্ছে চিরতরেই। আমি আমার মা-বাবাকে অপেক্ষায় দাঁড়ানো দেখতে পাচ্ছি। অসীম আলোর ওপারে ওরা দাঁড়িয়ে। সামনে স্পেলুকানের পথ, অপূর্ব। কল্পনার মা, বাবা, বন্ধুরা আজ বাস্তব হবে সবাই, বাস্তব জগতে। আমার এখন যাবার কথা, তবু যেতে ইচ্ছে করছে না কল্পনাকে পেছনে ফেলে।
আমি চিৎকার করে বললাম, "আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে", “স্পেলুকানের বাইরে কি রয়েছে?”
অপেক্ষমাণদের জবাব এলো, “স্পেলুকানের বাইরে কিছু নেই। স্পেলুকান হচ্ছে শুরু থেকে অশেষ। স্পেলুকানই সবকিছু। স্পেবাগই অস্তিত্ব। বাকি সবই অলীক। অলীকতা শুধু কল্পনায় শ্রেয়, বাস্তবে এর কোন অবস্থান নেই। তোমাকে এখন বাস্তবে ফিরতেই হবে, তুমি আর কল্পনা করতে পারোনা।”
কল্পনার জঞ্জালের দিকে শেষ দৃষ্টিপাত আমার। ছুটতে শুরু করলাম, জাগরনের পথে। আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা......
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ ভোর ৬:৫০