সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বিভিন্ন জায়গায় সুন্দরবনের ছবি দেখে মনে মনে অসংখ্যবার ইচ্ছা জেগেছে সেখানে যাওয়ার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি বিভিন্ন কারণে। তবে এইবার ২-২ এর টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শেষেই সুন্দরবন যাওয়ার সুযোগ চলে এল হাতের সামনে। লুফে নিতে দ্বিতীয়বার আর চিন্তা করলাম না।
কয়েক ব্যাচমেট মিলে সুন্দরবন যাওয়ার আয়োজন করল। পরীক্ষার মধ্যেই টানা বেশ কয়েকদিন গাধার খাটুনি খেটে পারমিট যোগাড়, লঞ্চ ভাড়া করা, বাজার করা সহ যাবতীয় ঝামেলাপূর্ণ কাজগুলো শেষ করে ফেলল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই কয়েক ব্যাচমেটের অমানুষিক পরিশ্রমের কারণেই এই ভ্রমণ টা আরও অনেক বেশি আনন্দদায়ক হয়েছিল।
যাই হোক, ৬ অক্টোবর সকাল ৬ টা ২০ মিনিটে কমলাপুর থেকে সুন্দরবন এক্সপ্রেসে করে খুলনার উদ্দেশে আমাদের ৭২ জনের যাত্রা শুরু হল। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি উত্তেজিত ছিলাম। আর তাছাড়া অনেক বন্ধু একসাথে যাওয়ার কারণে মজাও হয়েছিল বেশ
কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল এক দুর্ঘটনা। পাবনার পাকশিতে ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় কৌতূহলী হয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে উকি দিলাম বাইরে, আর তখনি শার্টের পকেটে রাখা মোবাইল টা পড়ে গেল, ব্রিজের উপর একটা ড্রপ খেয়ে একেবারে সোজা পানিতে । মোবাইল টা ছিল আমার টিউশনির টাকা দিয়ে কেনা। তাই কষ্ট লেগেছিল অনেক।
যাই হোক, প্রায় সোয়া ১০ ঘন্টার ট্রেন জার্নি শেষে বিকাল ৫ টার দিকে আমরা পৌঁছলাম খুলনা। সেখান থেকে অটো তে করে সোজা লঞ্চঘাট। লঞ্চঘাট থেকে দুই ভাগে স্টিমারে করে গিয়ে উঠলাম লঞ্চে। লঞ্চে উঠার পর সবাইকে যার যার রুম বুঝিয়ে দেয়া হল। গোসল করে ফ্রেশ হওয়ার পর সবাইকে নাস্তা দেয়া হল। নাস্তা করে আমরা সবাই লঞ্চের ছাদে উঠলাম। সেখানে জম্পেশ আড্ডার সাথে চলল রূপসা নদীর অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করা।
আড্ডা মারতে মারতে সময় যে কোনদিক দিয়ে চলে গেল তা কেউই টের পেলাম না। রাত ১০ টার দিকে খাবার দেয়া হল। ক্ষুধার কারণে হোক আর যে কারণেই হোক অমৃতের মত লেগেছিল খাবারটা। খাওয়া শেষ করে এসে বসতে না বসতেই জোয়ার শুরু হল। জীবনে এই প্রথমবারের মত জোয়ার উপভোগ করলাম। দেখতে দেখতে পানির উচ্চতা অনেকখানি বেড়ে গেল। আমাদের বলা হল, এই জোয়ার শেষ হয়ে যখন ভাটা শুরু হবে তখনি আমরা রওনা দিব।
সারাদিনের ভ্রমনের কারণে সবাই ক্লান্ত ছিল। তাই ১২ টা বাজার আগেই সবাই যার যার কেবিনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে কোনও এক সময় ঘুমের ঘোরেই টের পেলাম লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে।
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম ঘুম থেকে। চমৎকার একটা ঘুম হওয়ার কারণে খুব ফ্রেশ লাগছিল। ফজরের নামাজ পড়ে লঞ্চের ছাদে গিয়ে বসলাম। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। তবে আবছা আবছা ভাবে যা দেখা যাচ্ছিল তা থেকে বুঝতে পারছিলাম যে, আমরা সুন্দরবনের ভিতর ঢুকে পড়েছি। চারদিক আরেকটু পরিষ্কার হওয়ার পর দেখতে পেলাম সুন্দরবনের অসাধারণ সৌন্দর্য। স্রষ্টার অসাধারণ এক সৃষ্টির সাথে পরিচিত হলাম।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। আরেকটু বেলা বাড়ার পর নাস্তা দেয়া হল। নাস্তা করার পর আবার শুরু হল আড্ডা দেয়া আর একই সাথে চারদিকের দৃশ্য উপভোগ করা। দুপুর ১২ টার দিকে আমরা পৌঁছলাম কটকা খাল। এই খাল একেবারে সমুদ্রের সাথে গিয়ে মিশেছে। মোহনা থেকে একটু দূরে লঞ্চ নোঙ্গর করল। ট্রলার দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পাড়ে। ট্রলারে বসে আরেক প্রস্থ নাস্তা হয়ে গেল।
তীরে নেমেই আমরা সাগরের পানিতে নেমে পড়লাম। এরপর বেশ কিছুক্ষণ চলল পানিতে দাপাদাপি। সবাই পানি থেকে উঠে আসার পর গার্ড আমাদের নিয়ে গেল বনের ভিতরে। সমুদ্রের তীর ঘেঁষা বনের ভিতর দিয়ে হাটতে হাটতে আমরা সবাই অভিভূত হয়ে পড়লাম। বেশ খানিকটা হাটার পর একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে হরিণ দেখা গেল। জায়গাটাকে ফাঁকা জায়গা বললেও তা আসলে আগে ফাঁকা ছিল না। সিডরের কারণে ওই জায়গার সব গাছ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে জায়গাটাকে ফাঁকা মনে হচ্ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে সিডরের ভয়াবহতা এই প্রথম উপলদ্ধি করতে পারলাম। আসলে সুন্দরবন না থাকলে সিডরের তাণ্ডবলীলা কেয়ামতলীলা হতে পারত।
সেখানে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছবি টবি তুলে আবার আমরা বনের ভিতর দিয়ে হেটে লঞ্চে ফিরে এলাম। আসার পরপরই দুপুরের খাবার দেয়া হল। খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর বিকাল ৩ টার দিকে আবার আমরা বের হলাম। এবার গন্তব্য কটকা বিচ আর কচিখালি বিচ।
গার্ডের পিছন পিছন আমরা হাটা শুরু করলাম। কিছুদুর হাটার পরেই আবার বন্য হরিণ দেখা গেল। এরপর হাটতে হাটতে আমরা বনের ভিতর প্রবেশ করলাম। এই প্রথম গভীর বনের ভিতর দিয়ে হাটার অভিজ্ঞতা হল। বেশ অনেকক্ষণ হাটার পর আমরা পৌঁছলাম কটকা বিচে। বিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার বনের ভিতর দিয়ে হাটা শুরু করলাম। আরও বেশ কিছু সময় পর পৌঁছলাম কচিখালি বিচে। এবার শুরু হল বিচ দিয়ে ম্যারাথন হাটা। প্রায় দেড় ঘন্টা আমরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাটলাম। একপাশে সাগর আর আরেকপাশে বন। কি চমৎকার দৃশ্য তা না দেখলে বলে বুঝানো যাবে না। যদিও সাগরপার দিয়ে হেটেই আমাদের খুশি থাকতে হয়েছে, পানিতে আর নামার সুযোগ হয়নি। কারণ এই বিচের অনেক দুর্নাম আছে চোরাবালির কারণে। আর যেতে যেতে একই সাথে দেখছিলাম সিডরের ধ্বংসলীলার চিহ্ন। ভাঙা গুঁড়ি আর দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা গাছ দেখে বারবার কল্পনা করছিলাম সেই ভয়াবহ রাতের কথা আর সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিল।
যাই হোক হাটার শেষ দিকে আমরা একটা চর অতিক্রম করলাম। চরের নাম কচিখালি চর। এই চর জোয়ারের সময় পুরোপুরি ডুবে যায়। সম্পূর্ণ চরটা কাদা আর চোরাবালিতে ভর্তি। কয়েকজন চোরাবালির মধ্যে পড়েও গিয়েছিল। একজন আরেকজনের সহায়তায় উঠে এসেছে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমাদের দীর্ঘ পথচলা শেষ হল। একটা মিঠাপানির পুকুরে সবাই গোসল করে বা হাতমুখ ধুয়ে আবার লঞ্চে গিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই নাস্তা দেয়া হল। এর মধ্যে লঞ্চের এক লোক অনেক হাই পাওয়ারের টর্চ লাইট নিয়ে এসে তীরের দিকে মারল। আমরা দেখলাম অসংখ্য হরিণ তীরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওই দৃশের কথা আমি হয়ত কোনোদিনও ভুলতে পারব না।
কিছুখন পর লঞ্চ আবার ছেড়ে দিল। এবারের গন্তব্য হারবারিয়া আর করমজল। লঞ্চ ছাড়ার পর শুরু হল গানের আসর। সুরো বা বেসুরো গলায় অনেকে মিলে গান গাইতে লাগল। রাত ১০ টার দিকে রাতের খাবার দেয়া হল। খেয়েদেয়ে বেশির ভাগই শুয়ে পড়ল। আমি সহ অল্প কয়েকজন বসে গল্প করতে থাকলাম। ভাগ্যিস শুইনি। কারণ কিছুক্ষণ পরেই অসাধারণ কিছু দৃশ্য আমরা দেখতে পেলাম। লঞ্চ তখন গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন হাত বাড়ালেই গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেয়া যাবে। আরও মনে হচ্ছিল জঙ্গলের যেন নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে যেন সেই ভাষাতে আমাদের কিছু বলতে চাচ্ছে।একই সাথে ভেসে আসছিল জীবজন্তুর ডাক। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত এই ব্যাপারগুলো উপভোগ করতে লাগলাম। এভাবে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটার পর লঞ্চ এসে পৌছাল হারবারিয়া। রাত তখন ৩ টা। সবাই গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে নাস্তা করেই আমরা বের হলাম। আগের মতই ট্রলার দিয়ে তীরে নিয়ে যাওয়া হল। নেমে আমরা আবার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটা শুরু করলাম। একজায়গায় গিয়ে গার্ড আমাদের বাঘের পায়ের ছাপ দেখাল। বাঘ তো আর দেখা হল না, পায়ের ছাপ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আর কি
যাই হোক ওই জায়গায় শুধু জঙ্গল ছাড়া আর কিছু দেখার ছিল না। মানে কোনও পশুপাখির দেখা মিলল না। ফিরে এসে আবার ট্রলারে করে লঞ্চে উঠলাম। এরপর লঞ্চ আবার চলা আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ চলার পরেই পৌঁছে গেলাম করমজল। লঞ্চ থেকে নেমে প্রথমেই সামনে পড়ল ছোট একটা চিড়িয়াখানা। সেখানে দেখলাম কুমির, হরিণ আর বানর। সামনে এগিয়ে যেতেই শুরু হল জঙ্গল। হাটতে হাটতে আমরা জঙ্গলের যথেষ্ট ভিতরে চলে গেলাম। সুধুমাত্র এই করমজলে এসেই জঙ্গলের বিশালতাকে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করতে পেরেছি। জঙ্গলের ভিতরে সাপ দেখলাম, বানর দেখলাম। এর মধ্যে একটা বানর আমরা ছবি তুলছি দেখে লাফ দিয়ে গাছের উপর উঠে পোজ দিয়ে বসল । এই প্রানিটার নাম বানর তো আর খামাখা হয়নি
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা আবার একসময় আগের জায়গায় ফিরে এলাম। এখানে দেখলাম সুন্দরবনের ম্যাপ, বাঘের কঙ্কাল, কুমিরের ডিম ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আবার ট্রলারে করে লঞ্চে ফিরে গেলাম। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে আমরা খুলনার উদ্দেশে রওনা দিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ লঞ্চ খুলনা পৌঁছে গেল। এরপর রাতের খাওয়া দাওয়া করে গাড়িতে উঠলাম এবং পরদিন সকালে ঢাকা এসে পৌঁছলাম।
তিন দিনের অসাম এই ট্যুরের কথা মনে হয় জীবনেও ভুলতে পারব না আমি। আসার সময় বারবার মনে হচ্ছিল সুন্দরবন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। এই ডাক কোনও ভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। যাব আমি, সময় পেলে এই ডাকে সাড়া দিয়ে অবশ্যই আমি আবার যাব সুন্দরবন.।.।