হতাশার এক ধরনের ক্লান্তি আছে। ধরেন, খুব আশা করলেন কিছু নিয়ে। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বললেন। শেষে ঘটনা অন্যরকম হয়ে গেল। তাহলে মেজাজ খারাপ, বিরক্তি ইত্যাদির সাথে যে অনুভূতি হয় তার নাম ক্লান্তি। আমি আজকাল ক্লান্ত অনুভব করছি। ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি গণজাগরণ মঞ্চের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে।
কেন? একটা দাবি তো পূরণ হল! ক্লান্তি কেন?
সাইদি রাজাকারের ফাঁসি হয়েছে বলেই না এখনও কথা বলছি।নাহলে তো কবেই “ধুর বাল” বলে চিন্তা ভাবনা করাই বাদ দিয়ে দিতাম।
প্রজন্ম চত্বর আমাদের স্বপ্নগুলো কে জাগিয়ে তুলেছে। অনেকদিন পরে শিখিয়েছে ভয় না পেয়ে রুখে দাঁড়াতে। তাই প্রজন্ম মঞ্চের কাছে আমার আশাটাও আকাশ ছোঁয়া।
আশা গুলো হোঁচট খাচ্ছে ইদানিং । আমার প্রথম সমস্যা, মূল দাবি থেকে কেন বার বার শাখা প্রশাখা বের করা হচ্ছে?
দাবি তো সোজা! সব রাজাকারের ফাঁসি দাও, রাজাকারের দল নিষিদ্ধ কর, ব্যাস। এখন কিছু ছাগলের তিন, চার কিংবা পাঁচ নাম্বার বাচ্চা এর বিরুদ্ধে লাফালাফি করলে তাদের সাথে আমাদেরও তর্ক করতে হবে?
যুদ্ধাপরাধির শাস্তির দাবির বাইরে অন্য সকল কথা যখন “ বাংলা পরীক্ষা এর সাথে অংক পরিক্ষার চিন্তা করা” হয়। তাহলে কোথাকার কোন মাহমুদুর রহমানের বিচারের দাবিতে স্মারক লিপি দেয়া কি? আমার তো মনে হয় ওইটা বাংলা পরীক্ষা দিতে এসে সরাসরি শরীর চর্চা বিষয়ে পরীক্ষা দেয়ার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করা হয়ে গেল!
সব কিছুর জন্য দাবি তোলা যায় না। তাহলে দাবি ব্যাপারটাই হালকা হয়ে যায়। দাবি তুলতে হয় যা এমনিতে সাধারণ উপায়ে পাচ্ছিনা তা ছিনিয়ে আনার জন্য। ট্রাইব্যুনাল যদি ঠিকমতো রায় দিত তাহলে আমাদের শাহবাগে নামা লাগতো না। দেয় নাই, এইজন্যই দাবি। কারণ আমাদের কাছে দ্বিতীয় কোন রাস্তা ছিল না।
মাহমুদুর রহমান কে ঠাণ্ডা করতে স্মারক লিপি দিতে হয় না, কেস ঠুকে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত।
ক্রিকেটার তামিম ইকবাল চারটা ফিফটি মারার পর চার আঙ্গুল দেখিয়েছিল,মনে আছে? ওই চার আঙ্গুল ছিল লোটাস কামালের গালে চারটা থাপ্পর। গালে থাপ্পরের জ্বালা থাকে দশ মিনিট। কিন্তু মানসিক ভাবে থাপ্পড় খাওয়া একটু বড় ব্যাপার। আমার মনে হয় না লোটাস কামাল এই থাপ্পরের কথা সহসাই ভুলে যাবে। এই ধরনের থাপ্পর দেয়ার প্র্যাকটিস আমাদেরও করা উচিত। সায়েদি রাজাকার ঝুলল, এক আঙ্গুল তোলা হয়ে গেছে। বাকি গুলাকে ঝোলাতে পারলে দশ আঙ্গুল তুলবো। মাহমুদুর রহমানের গালে থাপ্পর মারা হয়ে যাবে। ওকে সম্মানের সাথে স্মারক লিপি দিয়ে ধরে আনার মানে হয় না।
আমার মনে হয় স্মারক লিপি দেয়া উচিত ছিল কাদের মোল্লার ফাঁসির আপিল দ্রুত করার জন্য, এবং দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর করার জন্য। ফাঁসির আদেশ দিয়ে তাদের বসায়ে বসায়ে খাওয়াবেন, চিকিৎসা করাবেন, আর শেষমেশ এই রাজাকারের মৃত্যু হবে আমার ট্যাক্সের টাকায় বানানো হাসপাতালের নরম বিছানায়, এইটা আমি মানি না। আমি রাজাকারের ফাঁসি চাই। তাকে ঝুলিয়ে লটকে রেখে মারা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়ার আগে আমার প্রতিশোধ নেয়া শেষ হবে না। এখনও রায় দ্রুত কার্যকর করার ব্যাপারে সরাসরি কোন দাবি তোলা হয় নাই, আমি সাধারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে এই বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দ্বিতীয়ত, যত পুলিশ ও সাধারণ মানুষ এই কয়দিনের শিবিরের নির্মমতায় প্রান দিয়েছেন, তাদের জন্য এক মিনিট নিরবতা পালনের কর্মসূচি আশা করছি। ব্লগার রাজিব হায়দার যেমন আন্দোলনের ইস্যুতে মারা গেছেন, এই পুলিশরাও রাজাকারের দলের আক্রমন থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতেই প্রান দিয়েছেন। আমার মনে হয় এইটুকু সম্মান তাদের প্রাপ্য। শহিদের মর্যাদা কখন কাকে দিতে হয় বা দেয়া যায় সে ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই তাদেরকে শহীদ বলছিনা। তবে ওই সব নিহত পুলিশবাহিনীর সদস্য ও তার পরিবার, আমাদের কাছে এইটুকু সম্মান তো আশা করতেই পারেন।তাই না?
তৃতীয়ত , গণজাগরণ মঞ্চে বক্তব্যে দেয়ার সময় “জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দেয়া বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেকবার যখন কেউ একজন এই স্লোগান দিচ্ছেন, তখনি আন্দোলন বিরোধীদের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দেয়া হয়ে যাচ্ছে। ছাগু বাহিনী হাসিমুখে বলতে পারছে, “স্লোগান দেখস না? সেই তো আওয়ামিলিগের চামচামি করলি!কেন এত নির্দলীয়! নিরপেক্ষ হেন তেন কথা বললি? ”
এই প্রশ্নের হাত থেকে আমি মুক্তি চাই। ছাগু বলে কাউকে চুপ করানো সহজ, তবে আমাদের নিজেদের ভুলগুলোকে শুধরানোর কথাও মনে রাখতে হবে।
একটা আন্দোলন শুধু মাত্র দাবির জোরে চলে না। সংগঠকদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতার পাশাপাশি কিভাবে তারা সব দিক সামলে চলতে পারল তাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা দেখি, তাতে মনে হয় সংগঠকদের নিষ্ঠার এবং আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। তবে একটা জিনিসের অভাব আছে। তা হল মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তা শুধরে নেয়ার চেষ্টার অভাব।
এই পোস্টের আগের পোস্টে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছিলেন, (থাবা বাবা ও গান্ম্যান ইস্যু) তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। তখন প্রিয় ব্লগার ও বড় ভাই কালা মনের ধলা মানুষ মন্তব্যে বলে ছিলেন - যদি কোন ভাবে এই আন্দোলনটা চুরি হয়ে যায়, ম্যাস হিস্টিরিয়ার মতো ম্যাস ফ্র্যাস্টেশন ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ছোট মুখে কিছু বড় কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম তাকে। আজকে এই পোস্টে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তার কাছে। কালা মনের ধলা মানুষ, আপনি সত্যি বলেছিলেন। সত্যিই ম্যাস হিস্টিরিয়ার মতো ম্যাস ফ্র্যাস্টেশন ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রজন্ম মঞ্চের দাম আজকে অনেক বেশি। এটা আওয়ামীলীগ বা বিএনপির সমাবেশ মঞ্চ নয়, যে এখানে যাই বলা হোক তা আমাদের কেউ পাত্তা দেই না। গণজাগরন মঞ্চের স্লোগানের সাথে এখন দেশের হৃৎপিণ্ডটাও ধুকধুক করে। এইখানের একটা হোঁচট আমাদের বুকে অনেক জোরে ধাক্কা দেয়। আশার পারদ এখন অনেক উপরে। এখানে কোন ছোটখাটো ভুলের আর সুযোগ নেই এখন।
গণজাগরণ মঞ্চকে বলছি। আপনারা আমাদের সামনে একটা স্বপ্ন তৈরি করেছেন। ভয় মুক্তির একটা গল্প এনে দিয়েছেন। এখন আপনাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও আকাশ চুম্বী। আমরা ধরেই নিয়েছি, গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই দেশের মানুষের সাথে যে বেইমানি হয়েছে আপনারা তার অনেক উরধে। আমরা বিশ্বাস করে আছি, যেখানে যাই কিছু ঘটুক, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি হবে নির্দলীয়। আমাদের বিশ্বাস টুকু নিয়ে সাবধানে নাড়াচাড়া করবেন। একটু ভুলের জন্য অনেক স্বপ্ন ভঙ্গের সৃষ্টি হতে পারে।
আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের অনেক কিছু নিয়ে অনেক দাবি। সব দাবি পাশে রেখে প্রজন্ম চত্বরে বার বার আসছি শুধু একটা কারনে। কারণ আপনারা কথা দিয়েছেন, আমরা দাঁড়ালে আমাদেরকে রাজাকারমুক্ত একটা দেশ দেবেন।
ছোটখাটো ভুল করে আমাদের স্বপ্নের মাঝখানে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন আনবেন না। প্রজন্ম চত্বর আমাদের প্রানের দাবির জায়গা। আমাদের নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা শুরুর জায়গা। এই জায়গাটুকুর নিরপেক্ষতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দিবেন না।
“দাবি এখন একটাই
রাজাকারের ফাঁসি চাই।”
জয় বাংলা।