আমি সবসময় দেখেছি জ্বর এর ঘোরে কিছু অদ্ভুত চিন্তা আসে মাথায়। দারুণ সব চিন্তা! সাধারণ ভাবে এইসব ভাবার ঠিক সময় হয়না।
আমার সাথে আবার জ্বরের খুব ভাল সম্পর্ক, কারনে অকারনে চলে আসে। বলতে পারেন কয়েকদিন পর পর জ্বরটা না আসলে আমি একটু চিন্তায় পড়ে যাই। ‘কি হইল! বড় অসুখ টসুখ আসছে না তো আবার!’ এই টাইপ ।
আমি যখন ক্লাস সেভেন এ তখন ক্যাডেট কলেজে চলে যাই। বাবা মার একমাত্র আদরের ছেলে ছিলাম তো, হঠাত হোস্টেল দেখে আমার মাথায় মোটামুটি আকাশ বাতাস সব ভেঙ্গে পড়েছিল।
অনেকেই হয়তো জানবেন যে ক্যাডেট কলেজে, আপনার অসুখ বিসুখ হলে নিজেকেই নিজের সেবা করতে হয়। কেউ আপনাকে খোঁজ করে নিয়ে যাবে না । তবে হ্যাঁ, পৃথিবীর কিছু শ্রেষ্ঠতম বন্ধু পাবেন। যারা সারাদিন পিটি, প্যারেড , পড়াশুনা, হেন তেন করার পরেও আপনার খোঁজ নিবে। গম্ভীর হয়ে বলবে ‘দোস্ত, সিক রিপোর্ট কর,হাউসে থাকলে পরে কেলায়ে পড়বি।’
ওই সময় হালকা পাতলা জ্বরকে তেমন পাত্তা দিতাম না। হাসপাতালে যেতে হলে ‘সিক রিপোর্ট’ নামের যে বিরক্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তার চেয়ে দাঁত চেপে কয়েকদিন সহ্য করা অনেক ভাল মনে হতো।
জ্বর হলেই কেন জানি খুব বাসার কথা মনে পড়ত। রাত ঠিক পৌনে এগারোটায় আমাদের লাইটস অফ হয়ে যেত। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়তাম। সারা গায়ে জ্বর, একটু একটু কাঁপছি। চোখ বন্ধ করলে কেমন জানি একটু জ্বালা করতো, তাও বন্ধ করে রাখতাম। তখন খুব মনে হতো, এখনি একটা ঠাণ্ডা, কোমল হাত কেউ আমার কপালে রাখবে। বলবে, ‘বাপ আমার! কষ্ট হচ্ছে খুব?’
তখন আসলে খুব ছোট ছিলাম।সেভেন এইটে পড়া ছেলেটার চারপাশে তখন অনেক রকম ভয়। আর সবচেয়ে বেশি যেটা, তা হচ্ছে বুক ভর্তি অভিমান। ‘কেন আমাকে এখানে রেখে গেল মা’ ।
এরপর আস্তে আস্তে বড় হলাম। জ্বর হলে মন খারাপ করে পড়ে থাকার বদলে দুইটা প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিখলাম। জ্বরকে আর তেমন অপরিচিত মনে হয় না। বুকের ভেতর অভিমানটাও কমে এসেছে ততদিনে, ক্যাডেট কলেজকে আমি ভালবাসতে শুরু করেছি তখন।
এরপর অনেক দিন গেল, এখন আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। কয়েকদিন পর বড় হয়েছি না বলে বুড়া হয়ে গিয়েছি বলতে পারব। এখন জ্বর টর টেরই পাই না!
খুব বেশি ঝামেলা হলে কাছেই শ্যালে, দুই পেগ জিন মেরে দিয়ে রুমে ফিরে ল্যাপটপ খুলে বসি। ভালবাসার মানুষটা ফোন দেয়-‘ অ্যাই, ঘুমাচ্ছ? জানো? আজকে সারাদিন তোমাকে খুব মিস করেছি।আজ সারা রাত তোমার সাথে কথা বলবো।’
আমি হাসি,বলি ‘আজকে একটু জ্বর তো, রেখে দেই ফোন? কাল কথা বলব নি।’
বালিকা মন খারাপ করে, কেন আগে বলিনি তাই নিয়ে অভিমান করে।আমি হাসি। সারা বিকেল রিকশায় ঘোরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অভিমান ভাঙাই।
হলে আমার বিছানার পাশের জানালাটার একটা কাঁচ ভাঙা। সেখান দিয়ে হঠাত পড়ে যাওয়া শীতের ঠাণ্ডা বাতাস আসে।
আমি সিগারেট ধরাই। জ্বর মুখে বিস্বাদ লাগে নিকোটিনের স্বাদ। আস্ত সিগারেট পুরনো সিগারেটের প্যাকেটে গুজে দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি।
কত শত প্রিয় মুখ, বন্ধু,প্রিয় বালিকাটি! আমার কারো কথা মনে পড়েনা। আমার খুব শীত করে। কম্বলের নিচেই কেঁপে উঠি বারবার, চোখ বন্ধ করলেই জ্বালা করে। আর,এত বড় হয়ে যাওয়ার পরও মনে হয়, এখনি একটা ঠাণ্ডা মমতাময় হাত আমার কপালে কেউ রাখবে। খুব আদর করে বলবে, ‘ বাপ আমার! কষ্ট হচ্ছে খুব?’