(কয়েকদিন ধরে কবিতা পড়া বেশি হচ্ছে। খুব বই টই ঘেঁটে পড়ছি এমন না,তবে পড়ছি। ভাবলাম একা একা পড়ব কেন, সবাইকে নিয়েই পড়ি! তাই শেয়ার করা। ভূমিকা দিয়ে বিরক্ত করার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি। )
১.
বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন
--মহাদেব সাহা
আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে আমার ফুসফুস থেকে দূষিত বাতাস;
বেড়ে গেলে শহরময় শীতের প্রকোপ
তার মুখ মনে হবে সবুজ চায়ের প্যাকেট,
এখানে ওখানে দেখা দিলে সংক্রামক রোগ,
ক্ষয়কাশ উইয়ে-খাওয়া কারেন্সি নোটের মতো
আমার ফুসফুসটিকে
তীক্ষ্ণ দাঁতে ছিদ্র করে দিলে,
সন্দেহজনকভাবে পুলিশ ঘুরলে
পিছে,
ডবল ডেকার থেকে সে আমাকে
ফেলে দেবে কোমল ব্যান্ডেজ,
সে আমাকে ফেলে দেবে
ট্রান্সপারেন্ট জাদুর রুমাল,
আমি যাবো পাখি হয়ে পুলিশ-স্কোয়াড থেকে
জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে বলবো -
আমি প্রেমিকার পলাতক গুপ্তচর;
সে এসে অন্ধকারে চতুর চোরের মতো
আমার পকেট থেকে নেবে সব স্থলপদ্মগুলি।
বলবে কানের কাছে চুপিচুপি অসম্ভব বদমাশ সে,
- চল ঘুরে আসি রাতের শো থেকে
তারপর নিয়ে যাবে ক্রমাগত ভুল ঠিকানায়
তবু সেই ভীষণ বদমাশটা আমার সমস্ত ভুল ভাগ করে নেবে,
ওর সমস্ত পাপ লিখে যাবে আমার ডায়েরিতে
আমার পাপ হাতে নিয়ে ধর্মযাজকের
মতো অহঙ্কারে ঢুকবে গির্জায়
আমি এই ঢাকা শহরের সর্বত্র, প্রেসক্লাবে,
রোস্তোরাঁয়, ঘোড়দৌড়ের
মাঠে এমন একজন বন্ধু খুঁজে বেড়াই যাকে আমি
মৃত্যুর প্রাক্কালে উইল করে যাবো এইসব অবৈধ সম্পত্তি, কুৎসা
আমার লাম্পট্য,
পরিবর্তে সে আমার চিরদিন
যোগাবে ঘুমের ওষুধ
আমার অপরাধের ছুরি রেখে দেবে তার বুকের তলায়,
আমার পিতার কাছে
চিঠি দেবে এই বলে - ওর কথা ভাববেন না, ও বড়ো ভালো ছেলে
নিয়মিত অফিস করে দশটা পাঁচটা;
অথচ সে জানবে আমার
সব বদঅভ্যাস, স্বভাবের যাবতীয় দোষ
তবু সে যাবে আমার সাথে ক্যামেরায় ফিল্ম ভর্তি করে
নিয়ে আত্মহত্যাকারী এক যুবকের ছবি তুলে নিতে,
অবশেষে মফস্বল শহরগামী কোনো এক ট্রেনে চড়ে নেমে যাবে
আমার সাথে ভুল ইস্টিশনে।
এখানে ওখানে সর্বত্র আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম
যে আমাকে নিয়ে যাবে সুন্দরবনে হরিণ শিকারে,
হরিণের শিং থেকে
তার স্বচ্ছ খুর থেকে খুঁটে নেবে দামী অংশগুলি যেন ও
গাভীর খুর থেকে বানাবে বোতাম, সে আমাকে প্রতিদিন ধার দেবে লোভ।
এখানে সেখানে শহরের পরিচিত অঞ্চলগুলিতে আমি সেই
সরল সাঙাতটিকে
খুঁজি,
আমি শুধু সারাজীবন একটি বন্ধুর জন্য প্রত্যহ বিজ্ঞাপন দিই
কিন্তু হায়, আমার ব্লাডগ্রুপের সাথে কারো রক্ত মেলে না কখনো!
২।
পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু
-নির্মলেন্দু গুন
একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।
একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।
একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।
একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।
একদিন পরাজিত হবো।
একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।
একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।
৩।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
-আনিসুল হক
.................
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।
তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?
৪।
অভিশাপ দিচ্ছি
-শামসুর রাহমান
না আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে
শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু
সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে
নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি
আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ
দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা। প্রেতায়িত
সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি...
৪।
বক্তৃতা বাবু
-সুকুমার রায়
হেই বক্তৃতা বাবু!
তুই হুই শহরের সাততলা বাড়ী থেকে
নামলি মাচায়,
এলি গাড়ী চড়ে মিটিং করতে
আমাদের শরীরের কালো রঙ সাবান মাখিয়ে ফর্সা করতে,
আমাদের ছেলে মেয়েদের ভালো,সভ্য করতে ;
এলি যেন লাট সাহেবের নাতি!
বক্তৃতা দিয়ে যাবিও
সেখানে—কল টিপলেই জল পড়ে।
ঘর আলো হয় ঘুটঘুটে কালো রাতে;
আবার বিজলি পাখাও ঘোরে-
বক্তৃতা দিয়ে শরীরে যদি ঘাম লাগে তোর, বক্তৃতা বাবু!
তুই বড় ভালো ছেলে।
আমাদের জন্য কত যে খাটিস-পিটিস!
কেবল ঘরের বিজলী পাখাটা বন্ধ হলেই মেজাজ গরম;
জলকে বরফ করার যন্ত্র-সেটাও বিকল!
তুই না রাজার বেটা!
রেশনে চাল ছেড়ে দিয়ে খাস বাসমতী চাল-
তবু আমাদের জন্য রাত্রে ঘুমাস না তুই ;
আহারে সোনার বাবু!
হেই বক্তৃতা বাবু ! হেই বক্তৃতা বাবু ! থু !
৫।
লোকেন বোসের জার্নাল
-জীবনানন্দ দাস
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক, ফ্রয়েড, প্লেটো, পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না!
পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
নাড়বো না আমি
নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —
কিন্তু কথাটা থাক;
কিন্তু তবুও —
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে
এখন কি করে মন ক্যারাভান হবে।
প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রেমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
কখন সময় হবে।
হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —
হৃদয় কেন যে কাঁপে,
'ভালোবাসতাম' — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে
তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে
এর উত্তর হবে?
সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।