ভাল্লাগেনা ব্যাপারটা আমাদের সবারই পরিচিত। আমার মাঝে মাঝেই এই ভাল্লাগেনা রোগটা বেড়ে যায়।কিছুই ভাল লাগেনা।সাত সকালে অ্যালার্ম এর শব্দ ভাল্লাগেনা,নাস্তায় ডিম ভাজা ভাল্লাগেনা,বিআরটিসি বাসের ভিড় ভাল্লাগেনা,কিচ্ছু ভাল্লাগেনা।
এই অসুখটা মনে হয় কম বেশি সবারই আসে।এবং সম্ভবত বেশ ঘন ঘনই আসে। কোন কারন ছাড়াই হঠাত মনে হয় ‘আমার কিচ্ছু ভাল্লাগেনা!’ এই সময়টুকু বেশ বাজে। মেজাজ খিচড়ে থাকে, রিকশাওয়ালা শুধু শুধু ঝারি খায়।ফেসবুকে অফলাইন হয়ে থাকা বাড়ে। হঠাত করেই মনে হয় প্রিয় মানুষটা খুব অবহেলা করছে। অসহ্য!! সবকিছু অসহ্য!!
বাংলাদেশে বাস করে অবশ্য ‘ভাল্লাগে’ টাইপ অনুভূতি আসাটা খুবই কঠিন। প্রতিদিন ভালো না লাগার এত কিছু হচ্ছে যে কোন ভাবেই ভালো থাকার কোন কারন নেই। ডেল কার্নেগী যদি বাংলাদেশে জন্মাতেন তবে ‘দুশ্চিন্তা মুক্ত মানব জীবন’ বইটা লিখতে গিয়ে বিরাট দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন।
কি করে ভালো থাকবেন,বলেন?এই দেশে কেউ ভালো নেই। নার্সারিতে পড়া অমিয় থেকে শুরু করে ওর আশি বছরের দাদু জব্বার সাহেব,কেউ ভালো নেই।অমিয়র টেনশন, ফার্স্ট হতে হবে। নয়তো দিনের মধ্যে চল্লিশবার শুনতে হবে পাশের বাসার তানভীরের কত খেলনা নেই তাও কি করে সে ফার্স্ট হয়,অথচ অমিয় হচ্ছে না! নারসারিতে পড়া অমিয়র কাছেও ফার্স্ট হতে না পেরে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হতে পারে।এই বয়সে ওর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পরের দিকের লোকজনের কথা বলার কোন মানে হয় না মনে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সবার মেজাজ ভীষণ খারাপ। আমার মাঝেই মাঝেই মনে হয় এত ক্ষোভ নিয়ে দেশটা এখনও বিস্ফোরিত হয় না কেন!!
জানেন তো ,সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ।এই দেশে সব সম্ভব।এখানে কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষে পিটিয়ে সহপাঠীকে মেরে ফেলা সম্ভব।দুই চারশ কোটি টাকা চুরি করে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব।একজন নোবেল বিজয়ীকে পদে পদে হেনস্থা করা সম্ভব।যেই লোকগুলো আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ঠাণ্ডা মাথায় এদেশের অনেকগুলো মানুষ মেরে ফেলেছিল তাদের নির্বাচিত করে সংসদে বসানো সম্ভব। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে দুইজন ভদ্রমহিলা পর্যায়ক্রমে বিস্তর পরিমানে দেশের মানুষকে কষ্ট দিয়ে গেলেও তাদেরকে বার বার দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া সম্ভব।
মজার ব্যাপার কি জানেন? এতকিছুর পরেও কিন্তু আমরা বেঁচে আছি, বেশ ভালই আছি!আমাদের ছোট বাচ্চাগুলোর পাঠ্যপুস্তকে প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমদের দেশটার জন্ম ইতিহাস বদলে যায়,আমরা ভালই থাকি। বিশেষ দলের সমর্থক হবার কারনে দুই মহান মানবীর অনুসারী কাউকে আমার এলাকার প্রতিনিধি বানাতে একবারও ভাবি না –“আচ্ছা? ভোট যে দিচ্ছি, লোকটাকে জীবনে দেখেছি তো?”
আমরা বাসার নতুন প্রাইভেট টিউটর রাখার আগে তার বাপ দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির খবর নেই,অথচ আপনার আমার জন্য যে লোকটা আইন বানাবে,পরের পাঁচ বছরের জন্য ঠিক করবে আমি কত টাকা দরে চাল কিনে খাব ,তার ব্যাপারে কিছুই জানি না!কি ভীষণ উদাসীন আমরা!
না, আমরা একবারও ভাবিনা। নির্বিকার থাকা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। দেশের সবচাইতে বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রতিবছর দুই তিনজন করে খুন হয়,আমরা নির্বিকার।কয়েকদিন পত্রিকা পড়ি, আহারে উহুরে করি, তারপর সব চুপ।রাস্তায় দুর্ঘটনা বাড়ে, বাড়ে খুন আর গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা,কিছু লোক কোটি কোটি টাকা পকেটে পোরে, প্রায় বিশ লক্ষ লোক শেয়ার বাজারে সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের প্যাদানি খায়। খালি কথা বলতে যান কিছু নিয়ে,আপনার দিকে আসবে হাজারটা আঙ্গুল। আপনি বিরোধী দলের,আপনি স্বাধীনতা বিরোধী, আপনি ভারত কিংবা পাকিস্তানের দালাল!
আরে বাবা!ভারতের এয়ারটেল কোম্পানি বাংলাদেশে ঢোকে দুইশ পঞ্চাশ কোটি টাকা স্ট্যাম্প মানি ফাকি দিয়ে,তারপরেও তাদের একশটা টাওয়ারে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ!আর আমাদের গার্মেন্টস কোম্পানি গুলো বিদ্যুৎ পায় না। লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন হয়না,নতুন জামা ছাড়াই ঈদ করে জরিনা সখিনারা।
কেন ভাই?এয়ারটেল, গ্রামীণ ,বাংলালিংক এদের একটু কম দিয়ে টেলিটক টাকে বাচিয়ে তুলতে কি তোমাদের কামড়ায়? ওরা টাকা দেয়,আর দেশি এবং সরকারি বলে টেলিটক থেকে টাকা খাওয়া যায় না,তাই?
না,হবে না।আমি নিজেও এয়ারটেল ব্যাবহার করতাম। আপনিও হয়ত করেন। তিন টাকায় এক টাকা ক্যাশ ব্যাক অফারের লোভে সারারাত মুঠোফোনে জেগে থাকে আমাদের ভালবাসা।
দোষ আমাদের না। ভালবাসা টেলিটকেও জেগে থাকতে পারত,কিন্তু তা হয়ে ওঠেনা। পনের কোটি মানুষের বিদ্যুৎ চুরি করে দেওয়া হয় এয়ারটেলকে। আমরা লোডশেডিঙয়ে খালি গায়ে বারান্দায় বসে ঘামতে ঘামতে ওদের সার্ভিস নেই,আমাদের টাকা চলে যায় ভারতে,নরওয়েতে।আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে আমাদের ভালবাসায় জেগে থাকি।ভাল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই।আর বিদ্যুতের অভাবে ধুকে ধুকে চলে আমাদের পোশাক শিল্প কারখানাগুলো, যাদের উপরে নির্ভরশীল আমাদের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ। আমাদের রাঘব বোয়াল নেতারা ভুলে যান যে দেশটা দরবেশ,আবুল কিংবা তারেক জিয়ার টাকায় চলে না। এয়ারটেল গ্রামীণ ফোনের টাকাতেও চলে না। চলে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভুমিতে তপ্ত রোদে কাজ করা আমাদের প্রবাসী ভাইএর ঘামে।সাভার এলাকার কোন গার্মেন্টস এ কাজ করা জরিনার সেলাই মেশিনের সাথেই ঘোরে আমাদের অর্থনীতির চাকা। নেতারা ভুলে যান। গ্রামীণ ফোন,এয়ারটেলরা খুব ভালো থাকে।আমাদের কোটি কোটি টাকা চোখের সামনে পাচার হয়ে যায়, আমরা নির্বিকার।
তারপরেও কিন্তু আমরা ভালই থাকি! একটা ক্রিকেট দল ষোল কোটি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে এশিয়া কাপে রানার আপ হয়।কয়েকজন দুঃসাহসী তরুন তরুণী আমদের পতাকা নিয়ে ধাম করে উঠে পরে হিমালয়ের চুড়ায়।খুব সাধারন কিছু মানুষ চাকরির ঝুকি নিয়ে বের করে ফেললেন রুই কাতলাদের পুকুর চুরির কেলেংকারি। কিছু তরুন কাজ করে যায় মৃত প্রায় পাট শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে।কিছু বোকা লোক নিরন্তর পরিশ্রম করে যান ষোল কোটি মানুষের স্বপ্নগুলো জাগিয়ে রাখতে!
স্বপ্ন তো আমরা অনেকদিন দেখলাম,এখন না হয় একটু চোখ খুলি? ফেসবুক ছেড়ে একদিন শহীদ মিনারে এসে চিৎকার করে বলি ‘আমি জবাব চাই!’ সমস্যা হয়ে যায়?তাহলে বাদ দেন,না হয় পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের পিচ্চি সোলায়মানকে লেখাপড়া শিখাই?সপ্তাহে একদিন? দুই কোটি শিক্ষিত মানুষ যদি এক কোটি বঞ্চিত শিশুকে পড়াশুনা করাই তাহলে দেশে অশিক্ষিত লোক একসময় হারিকেন দিয়া খুজেও বের করা যাবে না।
দেশের ষোল কোটি মানুষের দশ কোটিও যদি একসাথে চিৎকার দেয় তাহলে বঙ্গোপসাগরের সব মাছের চমকে ওঠার কথা, আমরা না হয় একটু করে আমাদের স্বপ্ন গুলোকে আকার দেই? প্রতিদিনের ‘ভাল্লাগেনা’ টাকে বদলাতে চেষ্টা করি।যেন একদিন অন্তত সকালে উঠেই বলতে পারি- ‘ভাল্লাগে!’