আমি হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। আমার পাশে নওশীন বসে বসে আলু নামে একটা চিপস খাচ্ছে। আমি নওশীনকে বললাম, “বাহিরে বৃষ্টি”।
নওশীন আমার দিকে তাকালোই না। আমি আবার বললাম, “বাহিরে বৃষ্টি হয়”।
নওশীন একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকে বলছো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “নাহ, যাই!”
আমি যাওয়ার কথা বলেও ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গ্যালারী থেকে বের হতে ইচ্ছা করছেনা। আজ বৃষ্টির দিন, অলস কবির কবিতার খাতা ফুরিয়ে যাবার দিন। আমি কি কবিতা লিখতে পারি? জানিনা, কাউকে কখনও পড়ে শোনাইনি। আমার নওশীনকে খুব কবিতা পড়ে শোনানোর ইচ্ছা। কিন্তু কোন এক কারণে নওশীন সবসময় আমার উপর বিরক্ত হয়ে থাকে। আমি একদিন সময় করে ওকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। আচ্ছা আজ জিজ্ঞাসা করা যায়না?
“নওশীন, তুমি আমার প্রতি কি একটু বিরক্ত?”
নওশীন একটা বই পড়ছিলো। Amazon and its Eco। বইটা পড়তে পড়তে সে আমাকে খুব বিমর্ষ কন্ঠে বললো, “কেন এমন মনে হলো?”
আমি মাথায় হাত দিয়ে চুল আচড়াতে আচড়াতে বললাম, “আমি তোমাকে গত কয়েকদিন ধরে ফোন করলে তুমি ফোন ধরোনা। কথা বলতে চাওনা। আমার দিকে তাকাওনা। আমার গা দিয়ে কি বাজে গন্ধ আসে যে তুমি আমাকে এতো অপছন্দ করো?”
নওশীন আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো, “এইতো ধরতে পেরেছো। তোমার গা দিয়ে শুটকি মাছের গন্ধ পাই শুধু। তুমি কক্সবাজারের লোক তো, তাই যখনই আমি তোমার আশেপাশে যাই লইট্যা আর নূনা ইলিশের গন্ধ পাই। তুমি আজকে হলে যেয়ে ক্যামেলিয়া সাবান দিয়ে গোসল করবে”।
আমি ওর পাশে বসে বললাম, “আজকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। খেয়াল করছো, বৃষ্টির পানি কিন্তু একদম ঠান্ডা না”।
নওশীন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি তোমাকে টাকা দিচ্ছি। তুমি একটা সাবান কিনে এনে এই বৃষ্টিতেই লুঙ্গি কাছা মেরে গোসলটা সেরে ফেলো”।
আমি হেসে বললাম, “দাও টাকা দাও। সকালে খাওয়া দাওয়া করা হয়নি। মাস শেষ, টাকাও শেষ”।
নওশীন আমার হাত ধরে বললো, “চলো”।
আমি যখন খাচ্ছি তখন নওশীন অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানিটা আড়াল করতে পারলোনা। আমার খুব ক্ষুধা লেগেছিলো, তাই দুই হাতেই খাচ্ছিলাম বলা চলে। নওশীন আমার দিকে একটু তাকায় আর মুখ লুকিয়ে হাসে। হাসির সাথে ওর চোখে পানি দেখতে কি ভয়ংকর সুন্দর লাগছে আমি তা তাকে বোঝাতে পারবোনা।খাওয়া শেষ করে আমি নওশীনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কাল রাতেও খাওয়া হয়নি”।
নওশীন বিরক্ত হয়ে বললো, “তুমি একটা টিউশনী করোনা কেন?”
আমি কিছু বললাম না। শুধু মাথা ঝাকালাম। ওকে বোঝাতে চাইলাম আমার হয়না। আমার দ্বারা কেন যেন টাকার জন্য কাউকে পড়ানো ব্যাপারটা হয়না।নিজেকে কেমন ছোটলোক লাগে। আমি অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের ছোট্ট সমুদ্র শহরে বাচ্চাদের পড়াতাম। আমার বাবা তখন সরকারী চাকরী করতেন। প্রতিদিন হাতে করে বড় বড় মাছ নিয়ে আসতেন। জেলেরা বাবাকে খুব পছন্দ করতো। মহাজন কিছু জানবার আগেই বাবাকে সবচেয়ে ভালো আর টাটকা মাছগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়ে দিতো। বাবা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন, অনেক টাকা ছিলোনা। জেলেরা তাই বাবার কাছ থেকে তেমন একটা টাকাও চাইতোনা।আমার বাবা এখনও চাকরী করেন। তার হাতে এখনও বিরাট বিরাট মাছ থাকে। কিন্তু কেউ রান্না করার নেই। মা খুব মাছ খেতে পছন্দ করতেন, আর বাবা মাছ রেধে মাকে চমক দিতে। মা যেদিন চলে গেলেন সেদিন থেকে আর বাবা রান্না করেন না। আমিও আর আগ্রহ করে মাছ খাইনা।কোনদিন না।
নওশীন আমার সাথে হাটতে হাটতে কার সাথে যেন ফোন করে কথা বলছিলো। ক্লাসের সামনে গেলে ও আমাকে বললো, “আমার আশেপাশে ঘুরবানা। তোমার জন্য আমি কারো সাথে একটু ভাব ভালোবাসা করতে পারিনা। সবাই ভাবে আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড, তাই কোন স্মার্ট ছেলে আমার আশেপাশেও আর ঘুরঘুর করেনা”।
আমি হাসিমুখে বলি, “আচ্ছা।একটা চুইংগাম দাও”।
নওশীন ব্যাগ থেকে একটা বাবল গাম বের করে দিলো। আমি বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এটা না। ওইযে ব্যাগের কোণায় একটা মিন্টো ফ্রেস আছে, ওইটা দাও”।
সে খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বললো, “বেশরম। এখন আমার ব্যাগের কোথায় কি আছে তাও খেয়াল রাখো। আমার উকুন মারার চিরুণীটা পাচ্ছিনা। কোন পকেটে আছে বলো”।
আমি মাথা চুলকিয়ে বললাম, “ওইটা কালকে তোমার থেকে একটু ধার নিছিলাম। আমার মাথায় তোমার সাথে থাকতে থাকতে কিছু উকুন হইছে। চিরুণীটা দিয়ে উকুন ঝাড়তেছি”।
নওশীন জিহবা বের করে ওয়াক করে বললো, “ভালো করে ধুয়ে নিয়ে আসবা কালকে”।
ক্লাস শেষ করে আমি নওশীনকে বললাম, “কালকে থেকে তো গ্রুপ ভাগ হয়ে যাবে। তুমি কি Power নাকি Communication নিবে?”
নওশীন মাথা নিচু করে হাটতে হাটতে বলল, “আজকে একটা প্রেমপত্র পেয়েছি। যেই ছেলেটা দিয়েছে, সে Electronics নেবে। আমিও ওইটাতেই যাবো। তাছাড়া জিপিএ তো ভালো না। এছাড়া উপায় নাই”।
আমি বললাম, “আচ্ছা। তাহলে তো আর ঠিকমত দেখা হবেনা। আমাকে তো মনে হয় Power দেবে”।
নওশীন মুখ ভেংচিয়ে বললো, “তোমার মত ভুয়া স্টুডেন্ট Power পড়ে কি করবে। তোমার জিপিএ তো ভালো না জানতাম”।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “তা ঠিক। তারপরও এডভাইজার স্যার...”
আমি কথা শেষ করার আগেই নওশীন অনিককে দেখিয়ে বললো, “ওইযে চুল বড় বড় স্মার্ট ছেলেটা ও আমাকে প্রপোজ করছে। ওর সাথে গত তিন বছরে আমার একবার কি দুইবার মাত্র কথা হয়েছে। তাতেই কত ফিদা হয়ে গেছে আমার জন্য”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ছেলেটা ভালো আছে। বাবার অনেক টাকা। তোমাকে অনেক গিফট দেবে”।
নওশীন হেসে বললো, “আমি জানি”।
এরপর একটু থেমে বললো, “তুমি কি বললা? আমি কি গিফটের ভুক্কা। ফাজিল ছেলে তিন বছর ধরে আমার পিছে ঘুরতেছো, কোনদিন কোন উপলক্ষ্যে আমাকে কোন গিফট দিছো?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আগের মাসেই না আমি তোমাকে বাগান থেকে একটা নীল প্রজাপতি ধরে এনে উপহার দিলাম?”
অনেক রাতে বাবা আমাকে ফোন দিলেন। সব সময়ের মত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাত খাইছো? টাকা লাগবে?”
আমি সব সময়ের মত বললাম, “খেয়েছি। টাকা লাগবে। ৫০০ দিলেই চলবে। হাত খালি”।
বাবা বললেন, “ঠিক আছে তোমার পরিচিত ওই দোকানে বিকাশ করে দিবো”।
বাবা এরপর অনেক ক্ষণ ফোন ধরে ছিলেন। আমি জানিনা উনি কিছু আর বলবেন কিনা। ফোনটাও রাখতে পারছিনা, কিন্তু ফোন রাখা দরকার। প্রকৃতি ডাক দিয়েছে।
বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুমি আসবা কবে আব্বু?”
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “জ্বী আব্বা পরের মাসে সেমিস্টার শেষ হওয়ার পর দুই সপ্তাহ ছুটি পাবো। তখন আসবো”।
বাবা কিছু আর বললেন না। ফোন রেখে দিলেন। অনেকদিন পর বাবা আমাকে রাতের ভাত আর মাসের টাকা বাদে আর কিছু বললেন। হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে।
এক বছর পর বাবা যখন আচমকা মারা গেলেন তখন জানলাম বাবার লিভারটা পচে গিয়েছিল। কাউকে জানাননি। আমরা খুব দরিদ্র সমুদ্রপারের মানুষ। সামান্য ৭৭৫৬ টাকা বেতনের চাকরী করে এমন ভয়ংকর সব অসুখগুলোর চিকিৎসা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
বাবা মারা যাওয়ার তিনদিন পর আমি সৈকত ধরে হাটছিলাম। আমার এক বছরের ছোট বোন সীমা আমার সাথে হাটছিলো। সীমা খুব ইতস্তত করে বললো, “ভাই তোমাকে জানাতে আব্বা না করে দিছিলেন।আব্বা বলছিলো তুমি পড়াশোনা না করে তাহলে বাড়ি এসে পড়বা”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “কিছু বলার দরকার নেই সীমা। আমি বুঝতে পারি”।
সীমা আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বললো, “ভাই চলো বাসায় চলো। তোমার জন্য রুটি বানাইছি। তিনদিন ধরে তুমি কিছু খাওনা”।
আমি সীমার দিকে তাকিয়ে বলি, “তোর কষ্ট লাগেনা আমাদের এতো ভালো বাবাটা আর নাই”।
সীমার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসে। আমাকে বলে, “কষ্ট লাগে। কিন্তু আমি গত এক বছর ধরে বাবার কষ্ট দেখতেছি। কতরাত গেছে আমি বাবার পাশে শুয়ে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম যেন সে একটু ঘুমাইতে পারে। বাবা যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতো। ঘুমাইতে পারতোনা। তখন অনেক কষ্ট লাগতো ভাই। এখন বাবার জন্য শান্তি লাগতেছে। যে যন্ত্রণা সে পাইছে তার থেকে বাবার মুক্তির দরকার ছিলো। আমার কষ্ট এখন তোমাকে নিয়ে।তুমি আমার সাথে আসো। একটু খাবা, আসো”।
আমি সীমার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের ছোট দু ভাইবোনের একটা আলাদা জগৎ গড়ে উঠেছিলো মা মারা যাওয়ার পর। বাবা মা চলে যাওয়ার পর থেকে আধা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আমার বোন আমার থেকে বয়সে ছোট হলেও তখন আমাকে দেখে শুনে রাখতো। নয় বছরের মেয়েটা এক বছর বড় ভাইটাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো ঠিক আমার মা যেমন করে খাইয়ে দিতো। সীমা আমার পাশে রাতে শুয়ে থাকতো যখন আমি ঘুম ভেঙ্গে কাঁদতাম। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করতো। আমার আর ওর বোর্ড পরীক্ষাগুলো একসাথে ছিলো। ও এস.এস.সিতে পুরো ইউনিয়নে একমাত্র টেলেন্টপুলে স্কলারশীপ পাওয়া মেয়ে ছিলো। আমি ডাব্বা মেরেছিলাম। জিপিএ ফাইভ কোনরকমে। আমি যেদিন ঢাকার জন্য রওনা দেই তাকে জিজ্ঞাসা করি, “তুই আমার জন্য এইচ.এস.সিতে রেজাল্ট খারাপ করলি?”
ও মুখ কালো করে বলে, “ভাই আমি ভালো করলে বাবা আমাকে ঢাকায় পড়তে পাঠায় দিতো। আমি কোথাও যাবোনা বাবাকে রেখে একা। তুই যা ভাই। অনেক পড়বি।আমারটাও পড়ে দিবি”।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে সেদিন অনেক কাঁদছিলাম। এই বোনটাকে আমি কোনদিন বকা দেইনি, মারিনি। ও আমাকে বকতো মারতো। বেশি রাগ করলে কেদে দিত। আজ যখন বাবাও চলে গেলেন আমাদের রেখে তখন আমি বুঝলাম এই জগতে আলো আধারে এই একটা মানুষকে আমার সবচেয়ে ভালোবাসা দরকার।
সীমা আমাকে আজকে আবার হাত ধরে রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাইয়ে দিচ্ছিলো। ওর চোখ ভরা জল, আমার বুক ভরা। আমি রুটি খাওয়া বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমাদের ভালো মানুষ বাপটা অনেক কষ্ট পাইতো প্রতি রাতে তাইনা। আমি কিচ্ছু করতে পারিনাই। তার জন্য আমি কিচ্ছু করতে পারিনাই। ঢাকায় বসে আমি শুধু মজা মারছি, একবারও বাপটার কষ্ট বুঝতে পারিনাই। আমার বাবা আমার কাছ থেকে কিচ্ছু পাইলোনা রে। একটা ভাত নিজের টাকায় কিনে খাওয়াইতে পারলাম। সীমা আমি এই দুঃখ কই রাখি। আমি এমন অকৃতজ্ঞ সন্তান কিভাবে হলাম? আমার নিজেকে ঘিন্না লাগতেছে”।
সীমা আমাকে জড়ায় ধরে কাদে আর বলে, “ভাই এইসব বইলোনা। বাবার আত্না কষ্ট পাবে। তুমি বাবারে অনেক দিছো। কয়টা ছেলে আমার ভাইয়ের মত ঢাকায় এতো ভালো জায়াগায় পড়াশোনা করে, কয়টা ছেলে এমন ইঞ্জিনিয়ার হইছে। ও ভাই, তুমি আর কাইদোনা। বাবা তোমারে নিয়ে অনেক গর্ব করতো। আমারে সবসময় বলছে তোমারে যেন ঠিকমত দেইখা রাখি। তুমি আমার সোনা ভাই না, আর কাইদোনা”।
আমি এক মাস পর ঢাকায় ফিরে আসি। আমার মাথায় তখন একটা চাকরির চিন্তা। সীমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে।কক্সবাজারে ওকে আমার এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায় রেখে আসছি। একা একা এভাবে ওকে রাখা যাবেনা আর। আমি যখন বিশবিদ্যালয়ে পৌছালাম জানলাম রেজাল্ট হয়ে গেছে লাস্ট টার্মের। আমাকে নওশীন নিজেই খবরটা দিলো। আমাকে দেখে বললো, “দাড়ি এত বড় রাখছো কেন?টাকা নাও, একটা রেজর কিনে শেভ করবা। ঠিক আছে?”
আমি ওকে বললাম, “আমাদের একটা টেম্পোরারি সার্টিফিকেট নাকি দিচ্ছে?”
ও মাথা নেড়ে বললো, “রেজিস্টারের অফিসে যাও। ১০০ টাকা লাগবে, আমার থেকে নিয়ে যাও”।
আমি নওশীনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রেজিস্টারের কাছে গেলাম। স্যার আমাকে দেখে বললেন, “কেমন আছো হাসিব? তোমাকে অনেক খুজেছিলাম। তোমার মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছিলোনা।তুমি যেয়ে একটু ভিসি স্যারের সাথে দেখা করো”।
আমি একটু ভয় পেয়ে স্যারকে বললাম, “স্যার আমি কি ফেল করছি কোন বিষয়ে?পরীক্ষা তো এতো খারাপ দেই নাই”।
স্যার হেসে বললো, “ভিসি স্যারের অফিসে যাও। তারপর আমার সাথে দেখা করো। তোমার সার্টিফিকেট আমি দিয়ে দিবো”।
আমি ভিসি স্যারের অফিসে গেলে দেখলাম উনি জোহরের নামাজ পড়ছেন। নামায শেষে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, “ঘরে আসো”।
আমি স্যারের রুমে ঢুকে হাত পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
স্যার নিজে থেকে বললেন, “এখন তো খুব ভয় পাইতেছো, সম্মান দেখাইতেছো। দুই মাস পর যখন লেকচারার হিসেবে জয়েন করবা তখন তো ভাব দেখাবা, আর আড়ালে যেয়ে বলবা ভিসি ব্যাটা কিচ্ছু জানেনা। কার্শফের কয়টা ল’ আছে এইটাও বলতে পারবেনা”।
আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম স্যারের সামনেই। কেউ জানেনা আমি ঢাকায় পকেটে মাত্র ১২৬ টাকা নিয়ে আসছি। আমার বোনের কাছে একটা টাকাও নেই। সরকারী থাকার জায়গাটা ইতোমধ্যে সরকারী দলের লোক দখল নেয়ার জন্য আমাদের সাথে দেখা করে আমাকে দুটো থাপ্পড় দিয়ে গেছে। বাবার কবর দেয়ার জন্য সরকার ৪৫৭৮ টাকা দান করেছেন, আর একটা টাকাও পাইনি। পাবো কিনা তাও জানিনা। আমার মাথার উপর কোন ছাদ ছিলোনা। এমন অবস্থায় একটা চাকরী কতটা জরুরী তা করুণাময় ছাড়া আর কেউ জানতোনা।
ভিসি স্যার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আরে বেটা কাদিস কেন? আমার সবচেয়ে ভালো ছাত্রটা এমন করে কাঁদলে তো সমস্যা। তুই হবি বেটা একদিন বাঘা প্রফেসর। আমার থেকেও বড় প্রফেসর। দেশ বিদেশ হুঙ্কার দিয়ে স্পিচ দিবি। এভাবে কাদার কি আছে?”
আমি স্যারকে বলি, “স্যার দুইদিন ধরে কিছু খাইনা। বাবা মারা গেছে এক মাস তিনদিন হয়েছে। গ্রামে আমার বোনটা একা। একটা চাকরী খুব দরকার ছিলো। আপনার পায়ে ধরি, খুব দ্রুত একটা ব্যবস্থা করে দেন”।
স্যার আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলেন।একসময় বললেন, “যতদিন না চাকরী হয় তুমি হলে থাকবা। আমার কাছে থেকে টাকা নিয়ে যাও। ঠিকমত খাবা প্রতিদিন। ডিপার্টমেন্টে আমি সুস্থ সবল ফ্যাকাল্টি দেখতে যাই। এরকম রোগাশোকা লেকচারার প্রয়োজন নাই”।
আমি জোহরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললাম, “আল্লাহ যেই ফেরেশতাদের দুনিয়াতে পাঠাইছো আমার মত অভাবীর মুখে পানি দেওয়ার জন্য তাদের আখেরাতে তোমার স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য দিও”।
আমি তিনদিন পরের কক্সবাজারের টিকেট কাটলাম। বাসে যাবো, গাড়ি ছাড়বে রাত ১১:৪৫ এ। টিকেট কেটে বিকেলে নওশীনের সাথে দেখা করতে গেলাম। এতোদিনের বন্ধু, ওকে কিছুই জানাইনি। পাশ করার পর ও হয়তো বিয়ে করে দেশের বাহিরে চলে যাবে, আমার পথ হবে আরেক। ঠিকমত বিদায় নেয়া উচিত।
নওশীনের সাথে যখন দেখা করতে গেলাম ও তখন হোটেলে বসে একা একা খাচ্ছে আর কাকে যেন খুজছে। আমি ভাবলাম সে হয়তো স্মার্টবয় অনিককে খুজছে। আমি তবুও তার পাশে এসে দাড়াললাম। সে হোটেলের মামাকে ডেকে বললো, “জ্বী এখন ভাত আর মুড়িঘন্ট দেন”।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “বুধবার কক্সবাজারে চলে যাচ্ছি আবার। আবার কবে দেখা হবে কে জানে”।
ও বললো, “কালকেই দেখা হবে। আমার কালকে এনগেজমেন্ট।পাত্রের নাম আশফাক লাভলু। লাভলু নামটা আমার এত পছন্দ হইছে যে আমি সাথে সাথে পাত্র পছন্দ করে ফেলছি”।
আমি হাসিমুখ বললাম, “বিয়ের পর কি দেশে থাকবে?”
নওশীন একটু চিন্তা করে বললো, “ছেলে এখন লন্ডনে একটা হোটেলে চাকরী করে। আমাকেও হয়তো নিয়ে যাবে। ছেলের এম.বি.এ শেষ হলে সে ইউ.এস.এ মুভ করবে। সো, আমার দেশে থাকার বা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম”।
আমি নওশীনকে শুভকামনা জানিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম।কতদিন পর ওর সাথে বসে ভাত খেলাম। আমি খেয়াল করলাম নওশীন আজকে তার চোখের পানি লুকালো না।আমিও তাই সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “নওশীন তুমি প্রতিদিন আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে কাদো কেন?”
নওশীন চোখ মুছতে মুছতে বললো, “তুমি হয়তো জানোনা কিন্তু আমি তোমার সাথে প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাই কেন জানো? আমার খুব মায়া লাগে তোমাকে পেট ভরে খেতে দেখলে। তোমার অর্থনৈতিক অবস্থা আমি জানি।অনেক রাত তুমি না খেয়ে থাকো। কত সকাল গেছে তুমি খালি পেটে ক্লাস করতে চলে আসছো। দুপুরে যখন পেট ভরে ভাত খাও তখন খুব ভালো লাগে জানো? তোমার সাথে কালকের পর আবার কবে দেখা হবে কে জানে। তাই ভালো লাগাটা জানিয়ে রাখলাম”।
আমি অনেক কষ্ট হলেও নওশীনকে বললাম, “ধন্যবাদ”।
নওশীন চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো, “কাল অবশ্যই বাসায় চলে এসো। ঘরোয়া অনুষ্ঠান। সবাইকে বলা হয়নি। তোমাকে অবাক লাগলেও সত্যি দাওয়াত দিলাম।আর আমাকে কিন্তু বললানা, তুমি এতো দিন ছিলে কোথায়?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “কোথাও না”।
বিকেলে যখন ওর বাসায় এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠানে গেলাম, তখন সবার হাতে খিলাল আর দাতে মাংশ। আমাকে দেখে নওশীন প্রায় না চেনার ভাব করলো। আমি একটু দেরী করে এসেছিলাম। আজকে সব বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো তাই দেরী হয়ে গেলো। নওশীন আমাকে একসময় হাত দিয়ে ইশারা করে ওদের বাসার ডাইনিং রুমে যেতে বললো। আমি খুব ইতস্তত বোধ করলাম, এভাবে হঠাৎ করে বাসায় ঢুকে খেতে বসে যাওয়া ব্যাপারটা খুব লজ্জাজনক।নওশীন আমার পাশে বসে বললো, “দুপুরে খাইছো? না খেয়ে আসলেও লাভ নেই। খাবার সব শেষ”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “কোন ব্যাপার না। তোমার জন্য একটা উপহার ছিলো”।
নওশীন মাথা নেড়ে বললো, “দেখাও তো। জীবনে প্রথম কিছু একটা দিচ্ছো”।
আমি হেসে পকেটে হাত দিতে দিতে বললাম, “আমি আসলে আংটিটা কেনার সময় খুব বিব্রত বোধ করছিলাম। তুমি লেভেল ১ এ থাকার সময় আমাকে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের একটা এড দেখিয়েছিলে। একটা আংটি দেখিয়ে বলেছিলে, ওটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে। কেউ তোমাকে উপহার দিলে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকতে।আমি সেদিন থেকে প্রায়ই নাস্তার টাকা জমাতাম, দুইমাস টিউশনীও করেছি। দেখোতো পছন্দ হয় কিনা?”
নওশীন আমার হাত থেকে আংটি নিয়ে বাসার ভেতরে চলে গেলো।একটু পর তার মা কে ধরে নিয়ে এসে বলো, “মা এই ছেলেটার কথা তোমাকে বলছিলাম না। এর সাথে আমাকে বিয়ে দেবে মা?”
আমি হা করে তাকায় থাকলাম।নওশীন কি কোনরকমে কোন ভুল বুঝেছে যে আমি তাকে পছন্দ করি ওই ভাবে? এমন তো কোন ব্যাপার নেই, কখনও এমন কিছু বলিনি ওকে।
নওশীনের মা আমার দিকে তাকিয়ে গাল ধরে বললো, “ছোট্ট ছেলে তো। বিয়ে করলে তো তোকে পালতেও হবে”।
আমি কোন শব্দ করছিনা। একসময় নওশীন আমার হাত ধরে বললো, “আমাকে বিয়ে করবে?”
আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখের দিকে একবার চোখ পড়েছিলো, আমি তাকাতে পারিনি। নওশীন আমাকে পছন্দ করতে পারে, এমন ভাবে চাইতে পারে কখনোও ভাবিনি। আমার সময়টা তখন ভালো ছিলোনা।আমি মাথা নিচু করে বসে ছিলাম।অবাক হয়ে ভাবছিলাম কি বলা যায়।
অনেকক্ষণ পর নওশীন নিজেই আবার হাসতে হাসতে বললো, “জোকস করেছি। তুমি আমাকে এত সুন্দর একটা আংটি দিলে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে তোমাকে দুই মিনিটের জন্য আমার জামাই বানিয়ে ফেলেছিলাম। আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করোনা। হাহা”।
আমি একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেদিন আবার বুঝতে পারলাম আমি অনেক ভীতু। আমার মধ্যে কাউকে ভালোবাসার সাহসটা তৈরী হয়নি আজোও।নওশীনের থেকে বিদায় নিয়ে হলে ফিরে আসলাম। ঘুম পাচ্ছে, খুব বেশি ঘুম পাচ্ছে।
একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম ঘুমাতে ঘুমাতে। দেখি আমার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা, বাচ্চাটা আমাকে বাবু বাবু বলে ডাকছে। আমি বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে আমার পাশের বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চারপাশটায় কেমন যেন নীলচে আলো। হঠাৎ আব্বা সামনে এসে হাজির হলেন। আমাকে বললেন, “বাচ্চাটাকে জিজ্ঞাসা কর ওর ক্ষিধা লাগছে নাকি”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ওকে একটু আগে নওশীন খাইয়ে দিয়েছে”।
কথাটা বলে নিজেই হতভম্ব হলাম। পাশে দেখি নওশীন দাঁড়ায় আছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, “তুমি কি আমার উকুন মারার চিরুনীটা আবার চুরি করছো?”
এটুকু দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ভোর ছয়টা বাজে। আমি নওশীনকে ফোন দিয়ে বললাম, “আজকে বিয়ে করি চলো”।
নওশীন হাই তুলতে তুলতে বললো, “নাহ। সম্ভব না। কালকে বলছিলাম তো, তখন তো ভাব দেখালে”।
আমি ফোন রেখে দিলাম। একটা পাঞ্জাবী লাগবে। হালকা রঙের। আমার কটকটে রংগুলো পছন্দ না। আটটার মধ্যে নওশীন হলের সামনে এসে পড়বে বলেই মনে হয়।
দুপুর দুইটায় নওশীনের বিয়ে হয়ে গেলো। আমার সাথে না, লাভলু ভাইয়ের সাথে। আমি হা করে তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখছিলাম যখন সীমা আমাকে ফোন করলো।আমি ফোন ধরলে বললো, “ভাই জ্বর ধরছে। তাড়াতাড়ি আসো। তোমারে খুব দেখতে মন চাইতাছে”।
আমি চলে যাওয়ার আগে নওশীনকে বিদায় জানাতে গেলাম। নওশীন তখন ওর বরের সাথে হাসিমুখে ছবি তুলছে। আমাকে দেখে ও হাত নেড়ে ডাকলো।আমি কাছে গেলে বললো, “আমি সিদ্ধান্তটা ভুল নেইনি, বিশ্বাস করতে পারো। তুমি আমাকে ভালোবাসোনা, আমি এটা জানি। তোমার চোখ আমি দেখেছি কাল।জীবনে অনেক সুখী হও হাসিব। আমি খুব চাই তুমি একজনকে ভালোবাসো”।
আমি নিজ হাতে নওশীনকে বরের গাড়িতে তুলে দিলাম।জীবনে প্রথমবার ওর হাত ধরলাম। হাত ধরে ওকে গাড়িতে বসালাম। ওর বাবা মা কাজিনরা সবাই ওর আশেপাশে ভীড় করে থাকলেও আমি ওর পাশে পুরোটা সময় থাকলাম। ও যখন গাড়িতে উঠে বসলো, আমি তেমন ভীড়ের মধ্যে থেকেই ওকে দেখতে থাকলাম। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। যখন গাড়িটা ছাড়লো, ও আমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখের পানি ফেললো। ব্যাপারটা খুব সিনেমেটিক হয়ে যাচ্ছে, আর আমার খুব হাহাকার লাগছিল। আমি তাই চলে আসলাম। কি অদ্ভুত ব্যাপার, নওশীন আমার দেয়া আংটিটা পড়ে ছিলো।পুরোটা বিয়েতে। She just did a joke, joke with me, my life and undoubtedly with her life.
ওর গাড়িটা চলে যাওয়ার পর আমি হা করে আরো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।লাল আলো নীল আলো চারদিক, আমি সেই আলোকে পাশ কাটিয়ে হলের পথে যাত্রা শুরু করি। এখান থেকে হল প্রায় ৩ কি.মি দূরে। ভাবছি হেটে হেটে হলে যাবো। কাপড় জামা গুছিয়ে গাবতলী যেতে হবে। সীমাকে বলা হয়নি এখন আমি টিচার হয়ে গেছি, ভার্সিটির টিচার। সীমা অনেক খুশী হবে তাই না?
আমার প্রথম ক্লাস পরলো Alternating Current নিয়ে। আমি ক্লাসে যেয়ে হা করে দাঁড়িয়ে থাকলাম দুই মিনিট। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আপনারা কেউ কি নদীর ঢেউ দেখেছেন? আমি যখন আপনাদের এই কোর্সটি করাবো তখন অনেকবার এই নদীর ঢেউ একে দেখাবো। আমি আপনাদের শিখাবো কিভাবে এই ইলেকট্রনের ঢেউ আমাদের পুরো পৃথিবীটা সচল রেখেছে। যারা আমার কাছ থেকে শিখতে চান, তারা বইটিকে ব্যাগে ভরে ফেলুন। খাতা কলমের কোন দরকার নাই। আসুন আমরা কিছু শিখি”।
নওশীনের বিয়ের তিন বছর পর ও আমাকে একদিন ফোন করলো কড়া দুপুরে। আমি ফোন ধরে বললাম, “কেমন আছো? তোমার মাথায় এখনো কি উকুন আছে?”
নওশীন হেসে বললো, “এখনো আছে। তুমি কেমন আছো হাসিব?”
আমি বললাম, “বেশ আছি তো। তুমি হঠাৎ করে আমাকে ফোন দিলে কেন?”
নওশীন আবারো হেসে বললো, “আমি এখন তোমার রুমে বসে আছি।ভাবলাম তোমার সাথে একটু দেখা করি”।
আমি আমার রুমে ঢুকে নওশীনকে দেখে স্থির হয়ে গেলাম। কতদিন পর এমন একটা হাহাকার অনুভব করলাম। কতগুলো দিন, শেষবার মনে হয়েছিলো যখন নওশীনের গাড়িটা আর দেখতে পাইনি। আমি ওকে একটু সহজ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছো মেয়ে? কতদিন পর দেখা”।
নওশীন ওর চুল ঠিক করতে করতে বললো, “আমি জানো জানতাম না তুমি টিচার হয়ে গেছো। তুমি এতো ভালো ছাত্র এটাও তো জানতাম না। আমি তো পড়াশোনার মধ্যে কখনই ছিলাম না। সারাদিন তোমার সাথে ঘুরতাম টই টই করে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে তোমার কাছে এসেছিলাম”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “বলো। শুনবো”।
নওশীন আমাকে বললো, তুমি কি সেদিন আমাকে সত্যি বিয়ে করতে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে জানো, গত তিনবছর ধরে প্রতিদিন আমার ভাবতে ইচ্ছে করে যে তুমি সত্যি চেয়েছিলে”।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন একটা কিছু ও জিজ্ঞাসা করবে আমি জানতাম। আমি কতদিন এই প্রশ্নটার উত্তর সাজিয়েছি। কিন্তু ভাবিনি কখনো যে এভাবে ওর মুখোমুখি বসে আমাকে উত্তর দিতে হবে। আমি ওকে বললাম, “আমি খুব ভীতু ছিলাম, এবং এখনো আছি। এই ধরো তোমাকে এখন আমার খুব মায়া লাগছে। বিয়ের এই তিন বছরে তুমি কত শুকায় গেছো।তোমার চোখ ভরা এত ক্লান্তি। আমার অনেক মায়া লাগছে নওশীন। আমার আগেও লাগতো। আমি তোমাকে বলতে পারতাম না। আজ বললাম। অর্থহীন, তোমাকে যাই বলি সব অর্থহীন। তুমি আর কখনো আসবেনা। আমি জানি তুমি মাঝে মাঝে আমাকে এখনও ফোন করো অজানা নাম্বার থেকে। আমার ভাবতে ভালো লাগে, তুমি আমাকে মনে করো। কিন্তু এখন মনে হয় কাজটা আর ঠিক হচ্ছেনা। তুমি তোমার মত থাকো। নিজের সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকো। আমাকে আমার মত থাকতে দাও”।
নওশীন আমার হাত ধরে বললো, “আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি গত একবছর ধরে অনেক ধকলের উপর দিয়ে গেছি। মাথাটা ঠিক নেই। কাল তোমাকে নিউমার্কেটে দেখার পর থেকে মাথাটা খুব এলোমেলো লাগলো। দেখলাম তুমি হাসতে হাসতে কি যেন কিনছো। আমার ভালো লাগেনি। আমি তো ভালো নেই, তুমি ভালো থাকবে কেন?”
নওশীন চলে যাওয়ার পর আমি বাসায় চলে গেলাম। শেষ ক্লাশটা আর করালাম না। বাসায় যেয়ে বিছানায় পড়ে গেলাম। আমার গা তখন জ্বরে কাপছে। শরীরে কোন জোর পাচ্ছিলাম না। ক্লান্ত, অনেক ক্লান্ত আমি।
রাতে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় একটা বাজে। আমি নওশীনকে ফোন দিলাম। ও ফোন ধরে ঠিকমত হ্যালো বলার আগেই আমি ওকে খুব দ্রুত বললাম, “তুমি তোমার ইচ্ছায় সব করেছো, আমি তোমার কোন সিদ্ধান্তে ছিলাম না নওশীন। আমাকে তুমি কখনও কিছু বলার সুযোগ দাওনি। যেদিন তুমি নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করলে আমি সেদিন তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছিলাম। আমি অপেক্ষা করেছিলাম তুমি আমার দিকে একবার তাকাবে। একবার আমার কথা শুনবে। তুমি আমাকে শোননি, তুমি আমার দিকে একবারও তাকাওনি। এখন বলো, আমি কেন ভালোভাবে বাচার অধিকার রাখিনা? কেন তোমার হিংসা হবে আমাকে দেখলে?”
নওশীন কাঁদছিলো, আমি শুনছিলাম। অনেক আগে তাকে যেমন করে মায়া করতাম ঠিক তেমন করে তাকে খুব মায়া লাগলো আবার।আমি ওকে বললাম, “তোমার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে তাই না?”
নওশীন অনেকক্ষণ পর উত্তর দিলো, “আছে। ওর বাবার সাথে থাকে। ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। আমারই এক বান্ধবীকে। দুজন মিলে আমার মেয়ের খুব যত্ন করে, ছবি তুলে প্রায়ই ফেসবুকে দেয়। আমি দেখি, আমার মেয়েটার ছবি দেখি।হাত দিয়ে মনিটরে ওকে ছুয়ে দেই। মাঝে মাঝে শুধু রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। মনে হয় আমার মেয়েটা কাঁদছে।দেড় বছর বয়স মাত্র, মাকে ছাড়া এত ছোট্ট বাচ্চা থাকতে পারে বলো?”
পরদিন দুপুরে সীমা আমাকে ফোন করলো লন্ডন থেকে। ফোন ধরে তার কি কান্না। আমার বললো, “ভাই তুমি মামা হবা। আমি আজকে মাত্র জানলাম। শুভ আমার জন্য এই এত্ত বড় একটা চকোলেট নিয়া আসছে। আমি তোমারে অর্ধেকটা পাঠায় দেই?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “নাহ ফ্রিজে রেখে দে। বাচ্চা বড় হলে ওকে দিয়ে বলবি এটা মামা দিছে। সীমা, শুভ ভালো আছে?”
সীমা মাথা নাড়ে। আমাকে বলে, “ভাই সবাই ভালো। আমার মনটা ভালো নাই খালি। তোমার কথা খুব মনে পড়ে”।
আমি ফোন ধরে থাকি। সীমার কথা শুনি। আজকাল খুব কমই এমন হয় আমি কোন আপনজনের কথা শুনি। আজকে নওশীনের সাথে দেখা করবো, ওর সাথে আবার আগের মত ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। সকালে না খেয়ে ওর সামনে মুখ ভার করে বসে থাকবো, আর ও আমাকে আদর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে খাওয়াতে। এমন কি হবে?
নওশীনের বাসায় যখন গেলাম তখন ওরা সবাই খাওয়া দাওয়া করছে। নওশীন দরজা খুলে বাহিরে এসে বললো, “চলো রবীন্দ্র সরণী যাই। অনেকদিন হাটা হয়না। তোমাকে আজকে দুপুরে খাওয়াবো ভূতের আড্ডায়। মাটন বিরিয়ানী আর এক গ্লাস বোরহানী”।
আমি বললাম, “একটু বসি আগে। আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?”
নওশীন পানি আর সাথে পিঠা নিয়ে আসলো। আমাকে বললো “খাও। ভালো লাগবে।তোমার কি শরীর খারাপ”।
আমি হাত নেড়ে বললাম, “নাহ ভালো আছি। নওশীন তোমাকে একটা কথা বলার দরকার। বলবো?”
নওশীন কিছু না বলে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি অনেকক্ষণ ইতস্তত করে এরপর বললাম, “থাক পরে বলবো”।
নওশীন ওর গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালো করেছো না বলে। আমার একটা ভালো খবর আছে। আমাকে আমার স্বামী ফোন দিয়েছিলো কাল রাতে। সে আমার কাছে ক্ষমা চায়। আমাকে বলে তার দ্বিতীয় বউ একদম ভালো না। তাকে আমার মত সত্যিকারের ভালোবাসেনা”।
আমি হেসে বললাম, “তুমি তাকে ভালোবাসতে?”
নওশীন কিছু বললোনা। আমিও কিছু বললাম না। যাওয়ার আগে ওকে শুধু শুভকামনা জানালাম।
বাসায় ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো। কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। আজ সারাদিন শুধু নওশীনদের বাসার ওই পিঠা খেয়েছি। বিছানায় যেয়ে যখন বসলাম মাথাটা এমন করে ঘুরানো শুরু করলো যে আমি নিজের অজান্তেই পড়ে গেলাম। যখন হুশ ফিরলো তখন ভোর হয়ে গেছে। আমার শরীর ভরা জ্বর। গ্রীষ্মকালীন জ্বর। চারপাশে কেমন যেন হলুদ হলুদ দেখছিলাম। আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
এখন একটা স্বপ্ন দেখছি। সেই খুব প্রিয় স্বপ্নটা। আমি, নওশী্ন, বাবা আর আমাদের বাবুটা। বাবা আমাকে এবার কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভাত খাস না কেন? ভাত না খেলে তো আরো জ্বর আসবে”।
আমি অপরাধীর মত করে বাবাকে বললাম, “বাবা তোমাদের সাথে খুব দেখা করতে ইচ্ছা করে। তাই না খেয়ে খেয়ে মরে যাচ্ছি। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে”।
বাবা আমার হাত ধরে বললো, “তুই যখন আমার কাছে আসবি তখন তোকে এই বড় বড় মাছ রান্না করে খাওয়াবো। তোর মা তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে। প্রাণ ভরে খেতে পারবি তো?”
যখন জেগে উঠলাম তখন চারদিক অন্ধকার। ঘরে কেমন যেন একটা উৎকট গন্ধ। আমার খুব এক গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু ওঠার শক্তিটাও পাচ্ছিলাম না। ঠান্ডাও লাগছিল, হয়তো জ্বরের জন্য। আমি অনেক কষ্টে জানালার পর্দা তুলে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। আকাশে আজকে একটাও তারা নেই। আমি তবুও কাথা মুড়ি দিয়ে তারা গোনার চেষ্টা করি। আমার ফোন অনেকক্ষণ ধরে একটানা বাজছে। একসময় বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে নওশীন বললো, “হাসিব তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
আমি দুর্বল কন্ঠে বললাম, “বলো”।
নওশীন খুব কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তোমার কি মনে হয়েছে একবারও যে আমি উপায় না দেখে তোমার কাছে সেদিন গিয়েছিলাম? আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে তাই তোমার সঙ্গ পেতে গিয়েছিলাম?”
আমি কিছু বললাম না। অপেক্ষা করলাম নওশীন আরো কি বলে তা শোনার। নওশীন একটু চুপ থেকে বললো, “আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম। সাহস করতে পারিনি। আমি জানি আমি তোমার সাথে ভুল করেছি। আমি খুব ভুল করেছি। তিন বছর আগে আমার তোমাকে বোঝা উচিত ছিলো। আমি না বুঝে খুব অন্যায় করেছি হাসিব। তুমি তোমার জীবনটা গুছিয়ে নাও”।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আমার তোমার জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। আমি প্রতিদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করি। প্রতিদিন নওশীন। এবং আমি জানতাম তুমি একদিন নিজ থেকে বুঝবে।দোষটা আমারও, তোমাকে কখনো হাত ধরে বলা হয়নি যে প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে যখন একটা পরিবারের কথা ভাবতাম, তখন তুমি কেমন করে যেন একটা বিতিকিচ্ছিরি শাড়ি পড়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়ে যেতে। আমাকে খুব মমতা নিয়ে বলতে আসো একসাথে সমুদ্রের স্রোত দেখি। আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি নওশীন। জীবনটা এখন আমার কাছে বিশাল একটা ধাধা। এখন খুব ক্লান্ত আমি, কথা বলতে পারছিনা। তুমি অনেক সুখী হও”।
ফোনটা কেটে দিয়ে আমি আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে খুব জরুরী একটা ক্লাস আছে। আমাকে যেতে হবে, ক্লাসটা যেমন করে হোক নিতে হবে। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগছে নওশীন তার মেয়ের হাত ধরে সমুদ্রের পারে হেটে বেড়াচ্ছে। আমি দূর থেকে দেখছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি। আমি চাইনা কেউ জানুক, কেউ বুঝুক এই একজন মানুষের জন্য আমি অনেক সাহস নিয়ে ভালোবাসাটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছি। আমার ভাবতে ভালো লাগছে, আমরা একই পৃথিবীতে বেচে আছি, শ্বাস নিচ্ছি আর কেউ কাউকে বুঝতে না দিয়েও ভালোবেসেছি। এই অস্থির শহরে আমি একজন যাযাবর হয়েই না হয় থাকি, সব বুঝতে হবে অথবা বুঝাতে হবে এমনটা কে বলেছে?