আমি যখন রাত নয়টায় কাশফীর বাসায় পৌছালাম তখন চারদিকে কুকুর বিড়াল বৃষ্টি।খালু আমাকে দেখে খুব বিরক্ত ভাব নিয়ে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে আমি আসতে বললাম সকাল আটটায় আর তুমি আসলা রাত আটটায়।খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছো?”
আমি মাথার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে খালুর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “রেসলিং খেলা দেখছিলাম তো, একটু দেরী হয়ে গেলো”।
খালু আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। এমনিতে খালুজান বেশ মোটা, তার মধ্যে চেহারায় একটা হিংস্র ভাব আছে।উনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো টিভির পর্দা থেকে রিকিশি পাথু উঠে এসেছে।আমি সময়ক্ষেপন না করে ঘরের ভিতর ঢুকে সোজা খালার কাছে চলে গেলাম।খালাজান আমাকে দেখে ফোস ফোস করে বলতে লাগলেন, “আজকে কাশফীর হলুদ।তুই একটা মাত্র ওর খালাতো ভাই হয়ে কিনা এইরকম একটা ফাজলামী করলি”।
আমি খালার দিকে তাকিয়ে পেট চেপে ধরে বললাম, “খালা রমনা থানায় আটকায় ছিলাম সারাদিন।কিচ্ছু খাইনাই।গড সয়্যার। কিছু আগে খাইতে দাও।পরে ডালঘুটনী দিয়ে মারলেও মাইন্ড খাবোনা”।
খালা আরো রেগে গিয়ে বললেন, “মশকরা করিস আমার সাথে?
আরেকবার মুসলমানী দিয়ে দিবো ফাজিল। ফ্রিজে মিষ্টি আছে, খেয়ে নে। বরপক্ষ একটু পরেই আসবে”।
আমি মুখে হাসি নিয়ে খালার সামনে থেকে দূর হলাম এবং মিষ্টি ভক্ষণরত অবস্থায় হলুদের কাজ তদারকি করা শুরু করলাম।তদারকি মানে আসলে ওই রকম কিছু না।হলুদ উপলক্ষ্যে রান্না করা খাবারগুলো একটু টেস্টিং আর কি! আজকে আমার প্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানী রান্না করা হয়েছে এই আনন্দে আমি সারা ঘর জুড়ে হেটে হেটে পেট খালি করার চেষ্টা নিলাম।একটু পরেই বাবা হাতে একটা ছাতা নিয়ে এলেন।আমাকে দেখে বললেন, “হারামজাদা সকাল থেকে কোথায় ছিলি?আমার ওষুধের টাকা যে দিছিলাম সেটা দিয়া কি বিড়ি খাইয়া উড়াইছোস?”
আমি আশা করিনাই আজকে এখানে আব্বাকে দেখবো।আমার প্রিয় পিতাজান একজন বিশিষ্ট শিক্ষক।যদিও উনার মুখের ভাষা শুনে কেউ বলবেন না যে উনি একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান।সাধারণত উনি এমন অনুষ্ঠানগুলোতে আসেননা।কাশফী কি কারণে যেন আমার বাবার খুব প্রিয়।কাশফীর যেদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সেদিন আমার বাবা আনন্দে চোখে পানি নিয়ে বলেছিলেন, “আম্মা আপনার জামাই বিশাল জ্ঞানীগুণী ছেলে।আমার একসময়ের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র।তবে তোমার কাছে সে কিছুই না।যে মমতা তোমার অন্তরে ধারণ করে আছো, সেই মমতা নিয়া তোমার সংসার সাজাও দোয়া করি”।
আমার প্রায় সময় মনে হয় আমার বাবা আমাকে দুচোখে দেখতে পারেন না।আমার জন্মের পর যখন মা মারা যান আমার তাতে কোন হাত ছিলোনা – একথাটা অনেকবার মনে হয়েছে বাবাকে বলি।কিন্তু বাবা পাত্তা দিবেন না আমি জানি।খুব খারাপ লাগে যখন মনে হয় আমার চেনা জানা জগতে আমার বাবাই হয়তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন।আমি কিন্তু বাবাকে একদমই ভয় পাইনা।ছোটকালে বাবা যখন আমাকে ধরে ধরে মারতো আমি তখন চুপ করে থাকতাম।ভাবতাম এটাই জগতের নিয়ম।বাবা যখন আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য, আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিলো আর ফিরে না আসতে।ছোট্ট শহর চিটাগাং আমার আর ভালো লাগতোনা।
বাবা আসার পর থেকে ঘরের কোলাহল প্রায় থেমে গেছে।কি কারণে যেন বাবাকে সবাই খুব ভয় পায়।কাশফীর যেই ছেলের সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে আমার ধারণা সে বাবার ভয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে।কারণ আমার কাশফীকে দেখে সবসময় মনে হয়েছে এই মেয়ের সাথে কে বিয়ে করবে?কাশফী আমার থেকে বয়সে এক মাসের ছোট।সাধারণত এই রকম ক্ষেত্রে সম্পর্ক খুব মধুর হওয়ার কথা।কিন্তু তা হয়নি।কি কারণে যেন কাশফীও আমাকে দুই চোখে দেখতে পারতোনা।আমি ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পুরো সময়টা ঢাকাতেই প্রায় কাটিয়েছি।দুই একদিনের জন্য চিটাগাং এলেও খালাদের বাসায় তেমন একটা যাওয়া হতোনা।সঠিক বললে কারো বাসাতেই যাওয়া হতোনা।কেউ মনে হয় চাইতোওনা আমি কারো বাসায় যাই।আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবার মত সবাই হয়তো এটাই ভাবে যে আমার জন্যই আমার মা মারা গেছেন।ছোটকাল থেকে খালা ফুফু মামা চাচা সবাই আমাকে ঝাড়ির উপর রাখতো।আমি কিছু ধরলেই তারা বলতো এই ভেঙ্গে ফেলবি তো, ধরিসনা।আমি যে চঞ্চল ছিলাম খুব তা কিন্তু না।আমি সবসময় খুব শান্তশিষ্ট ছিলাম।আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কাশফীর আম্মু নাসিমা খালা।উনি আমাকে যা মাঝে মাঝে একটু আদর করতেন।
হলুদের ডালা, পাটি সব ঠিকমত সাজানো হয়ে গেছে। একটু পরেই বরপক্ষ এসে পড়বে।আমার দিকে সবাই কেমন যেন একটু কটমট করে তাকাচ্ছে।একটু পর আমার ছোট খালা এসে বললেন, “তুই আজকের দিনে একটা সুন্দর পাঞ্জাবী না পরে এরকম একটা নীল টিশার্ট পরে আছিস কেন?তার উপর আবার দাড়ি গোফটাও কাটিসনাই।একটা ছেলে এত অগোছালো হয়”।
আমি মুখে হাসি নিয়ে খালার দিকে তাকিয়ে বললাম,” মিসটেক হয়ে গেছে খালা।আমার পাঞ্জাবী একটাই, ওইটাও পিঠের কাছে ছিড়ে গেছে খানিকটা।ছেড়া পাঞ্জাবী পরে হলুদে আসলে মানুষ কি ভাববে বলেন?”
খালা আমার দিকে আগুন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, “বাঁদর”।
রাত দশটা বেজে গেলো, কিন্তু বরপক্ষের কোন খবর নেই দেখে আমার খালার প্রেশার উঠে গেলো। আমার খালু আর বাবা বহুবার ছেলের বাবা, মামা, চাচা সবাইকে ফোন দিলেন। কেউ ফোন ধরেন না।আমি একসময় মিনমিন করে বললাম, “আব্বা আপনাদের নম্বর তো ওরা জানে।আমার আজকে একটা নতুন সিম কেনা হয়েছে।এইটা দিয়ে একটা ফোন দেন।হয়তো ফোন ধরবে”।
আমার বাবা দাত কিড়মিড় করে বললেন, “মুখ দিয়া তো ভালো কথা আসিবার চায়না।সারাক্ষণ বদ ভাষা বের হয়”।
একথা বলতে বলতে উনি আমার থেকে ফোনটা নিয়ে ছেলের বাবাকে ফোন দিলেন।আমার ধারণা সঠিক, “এইবার কেউ একজন ফোন ধরলো।আমার বাবা বেশ রাগত ভঙ্গিতে বললো, আপনাদের তো নয়টার মধ্যে আসার কথা ছিলো।দেরী হবে কি আরো?”
ওপাশ থেকে মনে হয় কেউ কথা বললোনা বেশ অনেকক্ষণ।প্রায় এক মিনিট পর বাবা দেখলাম উত্তেজিত স্বরে বললো, “এইটা কি রকম কথা।আপনে সাজ্জাদকে ফোন দেন।আপনারা মশকরা করেন নাকি।বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে।মহল্লার সব মানুষকে দাওয়াত দিয়ে দিছি, এখন এইসব ঠাট্টা করছেন কোন অধিকারে?”
বাবার মনে হয় প্রেশার খুব বেড়ে গেলো।উনি একটু পর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “আপনাদের মত বদমায়েশ ফ্যামিলীর সাথে আমরাই সম্পর্ক করবো না।আমাদের মেয়ের জন্য অনেক ভালো পাত্র আছে”।
দুর্ভাগ্যবশত বাবার রাগটা যেয়ে পড়লো আমার মোবাইলের উপর।নগদ ৪২০০ টাকা দিয়ে কেনা আমার প্রিয় সিমফোনি কোয়ার্টিজ কিবোর্ডের সেটটা বাবা ছুড়ে ফেলে ভেঙ্গে ফেললেন।আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা খারাপ।তাই ভয়ে ভয়ে খালার রুমে চলে গেলাম।ওখানে এখন আশা করি কেউ নেই।তবে আমার ধারণা ভুল।সেখানে কাশফী বসে ছিল।আমি মহাযন্ত্রণায় পড়লাম।এমন পরিস্থিতে মানুষকে শান্তনা দিতে হয়, দু একটা মিষ্টি কথা বলতে হয় বলেই জানি।কিন্তু আমি আসলেও একটু ছাগল টাইপের ছেলে।কখন কি বলতে হয়, করতে হয় সেই জ্ঞানটা আমার নেই।আমি কাশফীর দিকে না তাকিয়েই বুঝলাম সে তখন জেগে নেই।আমাকে দেখেও মনে হয় যেন ও দেখতেই পারলোনা।হলুদ রঙের শাড়ি পরা, তাতে লালচে পাড়। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, আজ প্রথম মনে হলো মেয়েটা কতটা মায়াবতী।নীরব নিশ্চুপ মেয়েটার চোখের পানিটা যেন আরও শব্দহীন, আরো নিষ্প্রাণ।আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একসময় কাশফীর পাশে বসে বললাম, “আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক হয়নাই।কিন্তু তুমি অনেক ভালো মেয়ে তো, তোমার জন্য এর থেকে অনেক ভাল ছেলে সবাই ম্যানেজ করে ফেলবে”।
কাশফী আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “শুভ ভাই আপনি এখন এইসব ফালতু কথা না বললেও তো পারতেন তাই না?কখন কি বলতে হয় এটা আপনার বোঝা উচিত”।
আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।ড্রইংরুমে তখন আমার খালার কান্নার আওয়াজ, আমার খালু মাথায় হাত দিয়ে অসহায় ভঙ্গীতে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে আর আমার বাবা একটু পরপর আস্ফালন করছেন।আমার ভালো লাগছিলোনা এসব দেখতে।একটু পর খালার বাসা থেকে রাস্তায় বের হয়ে গেলাম।তখনও চারদিকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।আমার বৃষ্টিতে ভিজতে কখনও ভালো লাগেনা।আজকে ভালো লাগলো, বেশ ভালো লাগলো।
এর ছয় মাস পর আমার সাথে কাশফীর বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো।বাবার পছন্দের ছেলের সাথে কাশফীর বিয়ে হলোনা তাই বাবা অনেকটা অপরাধবোধের কারণেই এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।আমার খালা খালু যে খুব খুশি মনে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন তা না।কিন্তু তাদের এছাড়া ঠিক আসলে উপায় ছিলোনা।একবার যে মেয়ের বিয়ে এমন করে ভেঙ্গে যায় তার জন্য ভালো পাত্র পাওয়াটা এই সমাজে খুবই দুঃসাধ্য।আমি এই বিয়েতে রাজী ছিলাম কিনা তা নিয়ে কথা বলাটা অপ্রয়োজনীয়।এই ব্যাপারটা নিয়ে কারোও মাথা ব্যথা ছিলনা।আমারও ছিলোনা।
বাসর ঘরে ঢুকে আমি প্রচন্ড ঘামতে থাকি।হঠাৎ খেয়াল করি কাশফী আমার দিকে খুব বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।চুপ করে বালিশটা হাতে নিয়ে নিচে মেঝেতে ঘুমাতে চলে গেলাম।সারারাত ও মনে হয় অনেক কাদলো, আমার নিজের উপর তখন খুব রাগ হচ্ছিলো।মাত্র দুদিন আগে মাস্টার্স শেষ হয়েছে।রেজাল্ট এখনো বের হয়নি।আমার এখন বাসায় বসে বসে মুড়ি খেতে খেতে টম এন্ড জেরী দেখার কথা ছিলো।আর সেখানে কিনা এমন একটা দায়িত্ব কাধের উপর এসে পড়লো।কাশফীকে আমি কখনো ওইভাবে দেখিনাই।আমি কখনোই কাউকে ওইভাবে দেখিনাই।আমার এই ২৫ বছরের জীবনে আমি কখনো পরিবার ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।আমি কখনো দেখিনি একটা সংসারে কেমন করে ভালোবাসা থাকে, মায়া বাস করে।আমি জানিনা আমি এই মেয়েটার সাথে কেমন করে একটা পরিবার বানাবো।আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আসিফের একটা বিখ্যাত উক্তি মনে পড়লো হঠাৎ করে।ও আমাকে একবার ডেটিং করে ফিরে এসে বলেছিলো, “বিয়াকুফ শুভ বলতো কোন জিনিসটা মাইয়ারা সবচেয়ে পছন্দ করে?”
আমি হাসিমুখে বললাম, “কসমেটিক্স”।
আসিফ খিকখিক করে হাসতে হাসতে বললো, “কথা সত্য।কিন্তু তার থেকে বেশি পছন্দ করে কেয়ারিং বইলা একটা শব্দ আছে না সেইটা।জর্ডানা অথবা ম্যারাডোনা যেই ব্র্যান্ডের কসমেটিকসই কিনে দেস না কেন, একটু কেয়ারিং না থাকলে কোন বেইল পাবিনা”।
আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, “তুই এত ব্র্যান্ডের নাম জানলি কেমন করে?”
আসিফ মুখ গোমড়া করে বললো, “ইয়ে মানে মাঝে মাঝে এগুলাও কিন্যা দিতে হয় তো!”
অনেক রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে কাশফীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।তখন কেবল ভোর হয়েছে, কাকেরা গলা খাকাড়ি দিচ্ছে।সূর্য ভাই উঠি উঠি করছে, আর সেই সময় আমি শুভ কাশফীকে কিভাবে কেয়ার করা যায় সেটাই ভাবছিলাম।মেয়েটা কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।আমার মুখ থেকে মনের অজান্তে বের হয়ে এলো, “আহারে!”
আমি সকালে উঠে কাশফীর জন্য সুন্দর করে নাস্তা বানালাম।একা একা জীবন কাটানোতে একটা অসাধারণ ভাল গুণ আমি রপ্ত করেছি। তা হলো রন্ধন।আমি অসাধারণ কিছু ০.০১ মিলিমিটার প্রস্থের পরোটা বানালাম, সুস্বাদু ডিম ভাজি করলাম, সালাদ কাটলাম।তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে কাশফীর বিছানার পাশে টেবিলে রাখলাম।চুপ করে বসে এরপর আমার প্রিয় বই হকিংসের ব্রিফ হিস্টোরী অফ টাইম বইটা হাতে নিলাম পরার জন্য।সেইসময় কাশফী জেগে উঠলো।আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “সুপ্রভাত।কাল রাতে আমার যতদূর মনে হয় তুমি কিছু খাওনাই।তাই তোমার জন্য সামান্য নাস্তা বানিয়ে রেখেছি।তুমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও”।
কাশফী আমার দিকে এবার বিরক্ত চোখে আর তাকালোনা।সে খুব সুন্দর করে উঠে চলে গেলো রুম থেকে।আমি দেখলাম মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ একটা অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হলো।কাশফীর চোখ ভরা পানিতে আমি উঠি উঠি সূর্যের ছবি দেখতে পেলাম।কি ভয়ংকর সৌন্দর্য।ইশ আমি যদি ঠিক এই সময় একটা ছবি তুলে রাখতে পারতাম!
ঠিক সেই সময়ের সেই ঝকঝকে সকালে কাশফী আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনাকে কিছু কথা বলবো।আপনি কি জানেন সাজ্জাদের সাথে আমার বিয়েটা কেন ভেঙ্গে গেল?”
আমি মাথা নাড়লাম।আমার মুখে তখন কেবল রান্না করা গরুর মাংশ।আমি তা চিবাতে চিবাতে বললাম, “জানার দরকার নাই। প্রয়োজনও নাই”।
কাশফী বললো, “আপনার মত ছন্নছাড়া মানুষের অবশ্য জানার আগ্রহ থাকারও কথা না।তবুও আমি আপনাকে বলি।সাজ্জাদকে আমি হলুদের আগের দিন ফোন করে একটা ভয়ংকর সত্যি কথা বলেছিলাম।ওকে বলেছিলাম যে আমার কখনো বাচ্চা কাচ্চা হবেনা।এটা কি আপনি জানতেন?”
আমি কাশফীর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললাম, “ভয়ংকর ব্যাপার তো! আমি তো ভাবছিলাম আমার অনেকগুলা বাচ্চা কাচ্চা হবে।আচ্ছা ব্যাপার না।দত্তক নিয়ে নিবো। কিন্তু তুমি তো বললানা পরোটা কেমন হয়েছে?”
কাশফী আমার দিকে খুব বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগে আব্বা ডাইনিং রুমে ঢুকলো।আব্বা ডাইনিং রুমে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার এক পুরনো বন্ধু আজকে ফোন দিছিলো।ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক।ওর নাম আজগর হাসান।তুমি কি তাকে চেনো?”
আমি মাথা নাড়ি।আমতা আমতা করে বলি, “আব্বা উনি আমার থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন”।
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “তুমি তো কখনো বলোনাই যে তুমি ছাত্র ভালো ছিলা”।
আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, “জ্বি আব্বা খুব ভালো তো ছিলাম না ঠিক।তবে আপনিও ওভাবে জিজ্ঞেস করেন নাই তো”।
আমি ভাবলাম আব্বা তার প্রিয় হারামজাদা গালিটা আমাকে দেবেন।কিন্তু আমার অবাক করে দিয়ে আব্বা বললেন, “কাছে আসো আব্বা।তুমি তোমার ডিপার্টমেন্টে ফাস্ট হইছো এটা জেনে এই পৃথিবীতে আমার থেকে বেশি খুশী কেউ হয়নাই।তোমার মা উপর থেকেও এত খুশি হয়নাই।আমি তোমাকে সারাজীবন অকর্মণ্য ভাবছি, এইজন্য নিজেই এখন লজ্জা পাচ্ছি”।
আমি চোখ বড় বড় করে একবার কাশফীর দিকে তাকাচ্ছিলাম আরেকবার আব্বার দিকে। একসময় বললাম, “আমি তো ফাস্ট হইতে চাইনাই।এখন কি আজগর স্যার আমাকে লেকচারার বানাইতে চায় নাকি?আমি তো রাজী না!”
এরপর আব্বা তার প্রিয় গালিটা আমাকে দিয়ে নাস্তা শুরু করলেন।আমিও মনের দুঃখে বাসার ছাদে গিয়ে পাশের বাসার সুন্দরী তমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।এই মেয়ের সাথে আমি অনেক ছোটকাল থেকেই টাঙ্কি মারি।ওদের ছাদ আর আমাদের ছাদ এত কাছাকাছি যে লাফ দিয়ে পার করা যায়।তমাকে ভালো লাগার কারণ সে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা পড়ে।রংটা আমার খুব পছন্দ। আমি যখনই চিটাগাং শহরে আসি আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছাদে উঠে এই মেয়ের ঢং দেখা।আমি কেবলা টাইপ লুক নিয়ে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু আফসোস সে এমন ভাব দেখায়! আজকেও কেবলা কেবলা ভাব নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম।একটু পর মেয়ে ছাদেও আসলো।আজকেও জানি কথা হবেনা।তবুও ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম সুন্দরী তমাকে আর ভালো লাগতেছেনা।আজকে প্রায় সাত আট মাস পর তার সাথে দেখা হলো।ভালো লাগাটা আর কাজ করতেছেনা কেন বুঝলাম না।তার থেকে কাশফীকে একটু গুতাগুতি করলে মনে হয় উত্তম হবে।
কাশফী বারান্দায় বসে রেলিং ছুয়ে ছিলো।সন্ধ্যায় ওর বাবা মার আমাদের বাসায় দাওয়াত।আমি এই উপলক্ষ্যে সকাল থেকে নানান প্রজাতির বাজার সদাই করেছি।আমি হাসিমুখে কাশফীর পাশে দাঁড়িয়ে বলি, “ভালো আছো?”
মেয়ে আমার দিকে তাকালোও না।আমি চুপ করে হাসি মুখে নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।একটু পর সে বললো, “আমি কখনো আপনাকে বিয়ে করতে চাইনাই।আপনার সাথে কোনদিক দিয়েই মিলেনা আমার।কিন্তু আমার সমস্যা জানলে আপনার মত Moron প্রজাতির ছাড়া আর কেউ আমাকে বিয়েও করবেনা।আমি একটা জিনিস তাই ঠিক করেছি কি জানেন?”
আমি হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলাম, “কি?”
কাশফী বললো, “আমি আপনাদের সুন্দর ছাদটা থেকে একদিন খুব সকালে লাফ দিবো।আমার ছোটকাল থেকে খুব আকাশে ওড়ার ইচ্ছা।অনেকবার বাসার ছাদের একদম শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাত উচু করে আমি পাখির মত উড়তে চাইতাম।আমার মনে হতো আমি যদি একদিন ছাদ থেকে এমন হাত উচু করে লাফ দেই তাহলে ঠিকই উড়তে উড়তে আকাশে ভেসে বেড়াতে পারবো”।
আমি কাশফীর পাশে চেয়ারে বসলাম।তাকে বললাম, “দেখো আমি জানি আমার মত একজন মানুষকে বিয়ে করে তুমি যথেষ্ট দুঃখ পাচ্ছো।কিন্তু আমি এমনই।আমি ছোটকাল থেকে সব কিছুকে হালকা ভাবে নেই।যদি না নিতাম তাহলে এতদিনে অভিমানে মরে যাবার কথা ছিলো।তুমি কি একটু খেয়াল করে দেখবে আমি কেমন করে বড় হয়েছি? আমাকে কি কখনো কেউ একটু যত্ন করেছিলো, বাবা যখন রাগ করে মারতো তখন কেউ কি পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলো বাচ্চা ছেলেটাকে কেন মারছেন? আমি যখন স্কুলে প্রত্যেক বছর পরীক্ষায় প্রথম হতাম আমাকে কখনও কেউ একটাও কমিকস বই কিনে দেয়নাই।আমি এইসকল অগ্রাহ্য অবহেলাকে তুচ্ছ করেছি, তাদেরকে কখনো মনে লাগাই নাই। পরিবার কি দেখিনি, সংসার কি অনুভব করিনাই।কিন্তু আমি তোমার সাথে বিয়ের রাতে একটা প্রতিজ্ঞা করেছি নিজের কাছে।সেটা হলো, তোমাকে কখনো আমি কষ্ট দেবোনা।চেষ্টা করবো একটা পরিবার দিতে।ঘটনা হলো তোমার আমাকে পছন্দ হয়না।তাই আমি জানতে চাই কি করলে তুমি এমন আকাশে পাখি হয়ে উড়ার চেষ্টা নিবেনা?”
কাশফী মুখ শক্ত করে বললো, “আপনি আমার সাথে কখনো কথা বলবেন না।আপনি কথা বললে, সামনে আসলে আমার সহ্য হয়না”।
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “কথা দিলাম। আমি আর তিনদিন পরেই ঢাকা যাবো।তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যেতে হবে, উপায় নাই।সেখানে তুমি তোমার মত, আমি আমার মত থাকবো।আমার আব্বা যতদিন বেঁচে আছে আমি তাকে কোন রকম কষ্ট দিতে চাইনা।তাই একসাথে থাকার একটা নাটক করা ছাড়া আমার উপায় নাই।বুঝাতে পারছি?
কাশফী কিছু না বলে উঠে চলে গেলো।আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম।এত্ত কঠিন কঠিন কথা বলা খুবই কষ্টকর।
ঢাকাতে ছোট্ট একটা বাসা ঠিক করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ছিলো, কিন্তু আমার কিছু আমার মতই ছন্নছাড়া বন্ধু বান্ধব আছে যারা আমাকে এই ব্যাপারে ব্যাপক সহায়তা করলো।সব ঠিকঠাক করে আমি কাশফীকে নিয়ে আসলাম আমার অগোছালো বাসায়।আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম সে আমার এই চুন খসে পরা বাসা দেখে কি বলে, কিন্তু পরে ভাবলাম এইসব ভাবাভাবির বেল নাই।কাশফী আমার বাসা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেও পরে আর কিছুই বলেনাই।আর হ্যা আমি তার কথা রেখেছি।তার সাথে আমি কখনও কথা বলিনা, একেবারেই না।শুধু বন্ধু বান্ধব বাসায় এলে একটু নাটক করি।
একটা ব্যাপার আমি নিয়মিত করি। প্রতিদিন সকালে তার জন্য আমি আমার বিখ্যাত চিকন পরোটা আর ডিম ভাজি করে রাখি। কখনো কখনো আবার গোশত রান্না করি।কাশফী তেমন কিছু খায়না অবশ্য।সেও একটা কাজ নিয়মিত করে।কান্নাকাটি।একদিন ঘুম থেকে উঠে আমি দেখলাম সে আমার আগে উঠে বসে আছে।নিজেই আজকে নাশতা বানাচ্ছে।আমি হুরমুর করে উঠে বসে গায়ে একটা জামা গায়ে দিয়ে রান্নাঘরে এসে বললাম, “আমি বানাচ্ছি।সমস্যা নাই”।
কাশফী বললো, “আপনি প্রতিদিন কষ্ট করেন, আজকে নাহয় আমি নাস্তা বানালাম।আমারও কোন সমস্যা নাই”।
আমি হাসিমুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম।সে একটু পর বললো, “কিছু বলবেন?”
আমি দাত বের করে বললাম, “বহুদিন ধরে মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।তুমি কি জাহিদ সাহেবের সাথে প্রেম করতা?”
কাশফীর হাত থেকে রান্নার খুন্তিটা পড়ে গেলো।আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?”
আমি ওকে দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, “ইয়ে মানে আমাকে সেদিন জাহিদ সাহেব ফোন করে বললো তুমি কেমন আছো, সব ঠিকঠাক আছে কিনা”।
কাশফী মাথা নিচু করে বললো, “আপনি কি বলছেন?”
আমি এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, “বলছি যে তুমি একদম ভালো নাই।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করোনা, মুখে ক্রিম মাখোনা, চোখে কাজল দাওনা।আর আমাকে দুই চোখে দেখতে পারোনা।এইসব বলার পর লোক মনে হইলো খুব খুশি।আমাকে ভাই ডেকে বললো, একদিন শর্মা হাউজে আমাকে নিয়ে শর্মা খেতে খেতে গল্প করবে”।
কাশফী রান্নাঘর থেকে হেটে চলে গেলো গজগজ করতে করতে।আমি শুনতে পেলাম সে মিনমিন করে বলছে, “ইবলিশ, খবিশ, ফাজিল”।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম গালিগুলা কাকে দিলো।আমাকে না উল্লুক বেটা জাহিদকে।তবে যে যাই বলুক, আমি জাহিদ সাহেবের সাথে পরবর্তী শুক্রবারে শর্মা খাওয়ার কার্যকরী প্ল্যান করে ফেললাম।
জাহিদ সাহেবের সাথে শর্মা খাওয়া নাহলেও বছরখানেক পর একদিন কাশফী ম্যাডামের সাথে ঠিকই শর্মা খেতে গেলাম।রাপা প্লাজার থেকে আরেকটু সামনে শর্মার একটা অসাধারণ রেস্টুরেন্ট যার নাম আপাতত পাঠককে জানাতে পারলাম না বলে দুঃখিত।কাশফী শর্মা খেতে আসলো কারণ সেদিন ছিলো আমার জন্মদিন।আমি তাকে অনেক কাচুমাচু মুখে সকালে যেয়ে বললাম, “ইয়ে মানে একটা অনুরোধ করি?”
কাশফী আমার দিকে না তাকিয়ে বললো, “জ্বী বলেন”।
আমি বেশ অসহায় দৃষ্টিতে বললাম, “তুমি তো আমার বন্ধুর মত তাই ভাবলাম তোমাকে আজকে একটা ট্রিট দেই।উপলক্ষ আমার জন্মদিন”।
কাশফী কেন রাজী হলো আমি জানিনা। সেদিনই হঠাৎ করে বাসায় আসার পথে সে একটা অদ্ভুত কথা বললো। সি.এন.জির ভো ভো আওয়াজ আর বাহিরে ঝমঝম বৃষ্টি মধ্যে সে বললো, “আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না আমি জাহিদ সাহেবের সাথে প্রেম করতাম কিনা। আমি আসলেও প্রেম করতাম তার সাথে।আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনাই তাকে ছাড়া।বিয়ের চারমাস আগে পরিচয় হলো হঠাৎ করে, এত্ত সুন্দর করে কথা বলতো।আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে শুনতাম।আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা তার সাথে কেটেছে।আমি একসময় আর তাকে লুকাতে পারিনাই আমার দুর্বলতা।আমি তাকে যখন বললাম, আমার কখনো বাচ্চাকাচ্চা হবেনা তখন সে কত সুন্দর করে আমাকে বললো কোন সমস্যা নাই।কেন তবুও এমন করলো বলতে পারেন?”
আমি বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললাম, “বিশাল খারাপ লোক।এইজন্যই আমি তার সাথে শর্মা খেতে যাই নাই”।
কথাটা বলার পর মনে হলো, ভুল জায়গায় ভুল কথা হয়েছে।আমার তাকে সান্তনা টাইপ কিছু বলা উচিত ছিল।যাইহোক কাশফী আর সেদিন কিছু বলেনাই।আমার রুমে এসে দেখি আমার জন্য সে সুন্দর একটা গিফট দিয়েছে।আমি গিফট প্যাকেটটা কেন যেন খুললাম না।বিছানায় যেয়ে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম।চোখ ভেঙ্গে যাচ্ছে ঘুমে, কিন্তু কেন যেন সেই রাতে আমার আর ঘুম হলোনা।আমার কানে বাজছে তখন কাশফীর কথাগুলো।মেয়ের কথাগুলো পুরা ভেতরে আঘাত করেছে।
আজকাল সকালে আমি উঠার আগে কাশফী ম্যাডাম ঘুম থেকে উঠে পড়েন।তিনি আমার জন্য মোটা মোটা পরোটা বানান।মাঝে মাঝে তার সাথে থাকে খোসা মাখানো ডিম, অথবা অর্ধসিদ্ধ অভিজ্ঞ গরুর গোশত।আমি কখনো ভুল করেও এইজন্য প্রতিবাদ করিনা।তবে চা টা আমি নিজেই বানাই।কাশফী কেন যেন আমার চা খুব পছন্দ করে।আজকে সকালে চা খেতে খেতে বললাম, “অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য খুলনা থাকতে হবো।তোমাকে যদি কালকে চিটাগাং রেখে আসি সমস্যা হবে?”
কাশফীর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো, “খুব ভালো হবে।অনেকদিন আমার শহরটাকে দেখিনা”।
কাশফীকে চিটাগাং নামিয়ে দিয়ে আমি খুলনা শহরে চলে গেলাম।খুলনায় আমার সবচেয়ে ভালো লাগে যা তা হলো লটপটি।আমি সকাল বিকাল রাত সব সময়ই লটপটি খাওয়ার উপর থাকলাম।হঠাৎ একদিন বাবার ফোন এলো।আমি ফোন ধরার সাথে সাথেই বললো, “হারামজাদা বউ ফালায় গেছো এক সপ্তাহ আগে।একটা খোজ নিছোস?”
আমি মুখ শুকনা করে মিথ্যে করে বললাম, “প্রতিদিন রাত জেগে কথা বলি তো আব্বা।সে আমাকে মাঝে মাঝে গান শুনায় আপনারা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে”।
আব্বা প্রচন্ড রেগে আমাকে বললো, “চড় দিয়ে মুখের নকশা বদলায় দিবো।আমার সাথে মশকরা করিস।কালকে এসে তোর বউ নিয়ে যাবি।খুলনা যা আর ঘানা যা, বউ নিয়া যাবি”।
আমার মনে হচ্ছিলো আব্বা আমাকে সামনে পেলে সত্যি এখন চড় মারতেন।আমি ভয়ে চিটাগাং এর টিকেট কেটে ফেললাম।যাওয়ার পথে আমার কলিগকে বললাম, “ভাই বিয়া করছেন?”
আমার কলিগ মুখ গোমড়া করে বললো, “করছি ভাই”।
আমি হাসিমুখে তাকে বললাম, “তাইলে মরেন এখন।বাই বাই”।
চিটাগাং এ এসে কাশফীকে বললাম, “খুলনা যাবে?”
কাশফী মাথা নেড়ে বললো, “নাহ।যাওয়ার ইচ্ছা নাই, কিন্তু আব্বা আপনাকে অনেক বকা দিবে এই জন্য যাবো”।
আমার কেন যেন বেশ খুশি খুশি লাগছিলো।নিজেকে মনে হচ্ছিলো বিবাহিত বলদ।এইটা ভাবাতেও কোন উজবুকের এত আনন্দ হতে পারে তা কখনো ভাবিনাই। সমস্যা একটাই, খুলনায় আমার কোন অফিসিয়াল কাজ নেই আসলে।আমার দুই একটা কলিগ বউ থেকে ভাগার জন্য খুলনা ট্রিপের প্ল্যান করেছিলো।আমার অবশ্য কাশফী থেকে ভাগতে হবে এমন কোন ইচ্ছা ছিলোনা।আমি ফান করতে গিয়েছিলাম যদিও ফান শব্দটা কি আমি বুঝতাম না।আমার স্মার্ট কলিগরা ভালো বুঝতো।এখন যেহেতু কাশফী ম্যাডামকে নিয়ে যাচ্ছি, তাই সব ফান খান বাদ। তবে একটা অসাধারণ জায়গা আমি তাকে দেখাতে চাই।আমি জানিনা সেখানে যেয়ে সে আমার মতই শান্তি শান্তি বোধ করবে কিনা।
আমি খুলনার জন্য বাসে উঠতে উঠতে কাশফীকে বললাম, “তোমাকে একটা নদী দেখাবো।রুপসা নদী।ফাটাফাটি একটা জায়গা।তবে এই নদী দেখতে হবে গভীর রাতে।রুপসা ব্রিজের উপর দিয়ে হালকা বাতাসে হাটতে হাটতে তোমাকে অসাধারণ একটা কবিতা শুনাবো”।
কাশফী আমার দিকে না তাকিয়ে হাসিমুখে বললো, “হোটেল ঠিক করা আছে? আমি হোটেল থেকে কোথাও বের হতে চাচ্ছিনা আসলে”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হোটেল পুরাই ফাস্টক্লাস।সকালে চিকেন তন্দুরী আর আনারসের জুস খেতে খেতে খুলনা শহরের নীরবতা ভোগ করবে।জোস একটা ফিলিংস হবে”।
কাশফী খুব আস্তে আস্তে বললো, “আমার এত ফিলিংস হয়না”।
আমি, কিছুই বলিনাই।
খুলনা শহরে যখন পৌছালাম তখন সূর্য উঠেনাই।কাশফী দেখলাম জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।বাসের জানালায় কুয়াশার চাদরে ঢাকা।এই দৃশ্যটাও অদ্ভুত লাগলো।আমি ঘুম ঘুম চোখে বললাম, “কিছু খাবে?”
কাশফী হাত নেড়ে বললো, “পানি দরকার ছিলো।আপনি কি সাথে পানি এনেছেন?”
আমি দাত বের করে বললাম, “মিসটেক হয়ে গেছে।পানি নেই।তবে ব্যবস্থা করছি দাড়াও”।
বাস থেকে নেমে আমি সোজা টয়লেটে গেলাম।তারপর আশেপাশে উকিঝুকি মারলাম পানি কোথাও পাওয়া যায় কিনা।হোটেল তাজমহল নামে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে এগিয়ে গেলাম।হোটেলে যেয়ে খিদা লেগে গেলো।কিন্তু উপায় নাই, সময়ও নাই।তাই একটা দ্বিগুণ দামে পানির বোতল কিনে যখন বাসের কাছে যাচ্ছিলাম তখন দেখি বাস প্রায় চলা শুরু করেছে।আমি বাসে দৌড়িয়ে উঠে পানির বোতলকে ওয়ার্ল্ডকাপ ট্রফির মত ধরে কাশফীর কাছে নিয়ে গেলাম।কিন্তু কাশফীর চেহারার দিকে তাকিয়ে খুব হতভম্ব হলাম।তার মুখ প্রায় রক্তশূণ্য।আমি আমতা আমতা করে বললাম, “পানিটা ভালো।ব্র্যান্ডের বোতল।উপরে প্লাস্টিক দিয়ে ভালোভাবে আটকানো।কোন চিন্তা নেই”।
কাশফী আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে।আমার না হঠাৎ করে মনে হলো আপনি বাসে উঠতে পারবেন না”।
আমি দাত বের করে বললাম, “আরেহ না।আমি ছোটকাল থেকে চলন্ত বাসে স্পাইডারম্যান স্টাইলে লাফ মেরে উঠে পড়ি”।
কাশফী খপ করে আমার হাত ধরে বললো,” চুপ করেন।বেশি কথা বলবেন না।আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম জানেন।আমার মনে হচ্ছিলো আপনার সাথে আর কখনো দেখা হবেনা।আপনি আমার পাশে বসে থাকেন।কোথাও যাবেন না”।
আমার কান দিয়ে এসব কথা শুনে গরম ধোয়া বের হচ্ছিলো।আমি মিন মিন করে বললাম, “ইয়ে তুমি কি আমাকে ভালোবাসা ভালোবাসা করো?”
কাশফী আমার হাত ছেড়ে দিলো।একটু পর আবার হাত ধরলো। তারপর বললো, “জানিনা”।
খুলনায় কাশফীকে নিয়ে আমি রুপসা ব্রিজে গভীর রাতে একদিন হাটলাম।যদিও সে তালবাহানা করে বহুবার আমার হাত ধরতে চেয়েছিলো, আমি কোন সুযোগই দেইনাই।লজ্জা লাগে আসলে।যদিও সে আমার বউ কিন্তু আমার মনে হয় বউ নিয়ে হাত ধরে- “হোক তোমার হুপিং কাশি, তবুও ভালোবাসি” টাইপ গান গাওয়ার মত ম্যাচুরিটি আমার এখনও হয়নাই।আমি আসলে এখনও বউ জিনিসটা কি সেটাতেই ধাতস্থ হতে পারি নাই। সমস্যা হলো বিশাল ম্যানগ্রোভ বন দেখে ফিরে আসার পরে। হোটেলে যেদিন ফিরলাম সেদিন ছিলো রবিবার ১৮ই ডিসেম্বর।গাড়িতেই হঠাৎ করে আমার শরীর কেমন করে যেন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।হোটেলের বিছানায় শুয়ে তো রীতিমত কাপতে থাকলাম রাতে।পাশের বিছানায় কাশফী খুব ক্লান্ত থাকায় গভীর ঘুমে ছিলো।আমি সারারাত জেগে উদভ্রান্ত হয়ে গেলাম।সেই সময়টার কথা আমার খুব বেশি মনে নেই।কারণ আমার খুব একটা তখন বোধ শক্তি ছিলোনা।এটা মনে আছে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কাশফী আমাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছিলো।আমার গায়ে হাত দিয়ে তার মিনমিন করে কান্নার আওয়াজে আমি নিজেও ভয় পেয়েছিলাম।আমি তার হাত ধরে বললাম, “আল্লাহগো আমি কি মারা যাইতেছি?”
আমার অবশ্যই এইরকম একটা কথা তাকে বলা ঠিক হয়নাই।একা একটা মেয়ে অপরিচিত একটা শহরে মুমূর্ষু স্বামীর মুখ থেকে এমন কিছু কখনোই আশা করেনা।কাশফী ম্যাডাম কিছুক্ষণের মধ্যে বুদ্ধি করে রিসিপশনে ফোন দিয়ে একজন ডাক্তার ব্যবস্থা করে ফেললেন।ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখেই তার ব্যাগ থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র বের করলে আমি জ্বরে কাপতে কাপতে বললাম, “ভাই আমার জ্বর হইছে,থার্মোমিটার বার করেন।প্রেশার ঠিক আছে কোন সমস্যা নাই”।
পিছন থেকে কাশফী ধমক দিয়ে বললো, “চুপ করো।মুখ থামেনা কখনো তোমার”।
আমি চুপ মেরে গেলাম এবং বিশাল বিশাল নামের কিছু ভারী ওষুধ ম্যাডামের ভয়ে খেয়ে নিলাম।ডাক্তার সাহেবের কথায় যা বুঝলাম তা হলো আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে।এটা ভয়ংকর একটা অসুখ যার চিকিৎসা বিশাল জটিল।
কাশফী এরপর অসাধারণ একটা ভুল কাজ করলো।সে আমার বাবাকে ফোন করে এমন ভাবে ভয় দেখিয়ে আমার অসুখের কথা বললো যে আমার বাবা আট ঘন্টার মধ্যে কেমন করে যেন খুলনা হাজির হয়ে গেলো।আমাকে দেখে তিনি প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, “অসুখ বাধাইছোস কেমনে?”
আমি চিচি করে বললাম, “আব্বা সুন্দরবনের হাওয়া খেতে যেয়ে মশা কামড়ায় দিছে”।
আব্বা আমাকে তার প্রিয় গালিটা দিয়ে কাশফীকে এই সেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।আমি কাপাকাপি করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনা।সেই ঘুম সহজে আর যেন ভাঙ্গতেই চাইলোনা। আমার শুধু একটু পরপর চারদিক সবুজ সবুজ লাগে।সারারাত মশার স্বপ্ন দেখি।তিন দিন পর কোন এক গভীর রাতে আমার মনে হলো আমি একটু সুস্থ বোধ করছি। চোখ খুলে দেখি কাশফী আমার পাশে বসে আছে।আমি হাসিমুখে বললাম, “আপেলের জুস খেতে মন চাচ্ছে”।
কাশফী বললো, “আচ্ছা একটু অপেক্ষা করেন।আমি দেখি পাওয়া যায় কিনা”।
আমি ওর হাত ধরে বললাম, “নাহ পাশে বসে থাকো।তোমাকেই আপেল আপেল লাগতেছে”।
কাশফী মুখে হাত দিয়ে হেসে বললো, “আপনি কি সবসময় এমন থাকবেন?”
আমি পাশ ফিরে শুয়ে বলি, “তোমাকে কেমন যেন আম্মা টাইপ লাগতেছে।আম্মাকে কখনও দেখিনাই যদিও। যাই হোক, আমি কেমন আমি নিজেও জানিনা।কেমন থাকবো তাও জানিনা।তোমার আমাকে অনেক অপছন্দ হয় কাশফী?”
কাশফী আমার কথার উত্তর না দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখতে দেখতে বললো, “আপনি কখনও কারোও প্রেমে পড়েছেন?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “এই জিনিসটা আমি এখনও বুঝলাম না।বুঝার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয়না।আমার কাছে বেশি জরুরী কি জানো?”
কাশফী মাথা নেড়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।আমি বিশাল ভাব নিয়ে বললাম, “এই যে আমার এখন ইচ্ছে করতেছে তোমাকে একটা আগডুম বাগডুম প্রেমের কবিতা শুনায় পাশে বসে থাকতে -এই ফিলিংসটা বেশি জরুরী।এটা একদম ভিতর থেকে অনুভব করতেছি।বিশ্বাস করো”।
কাশফী খুব আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “এভাবে কেউ ভালোবাসার কথা বলে!”
আমার ভাব ভেঙ্গে গেলো।নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। আমি আসলেও তো জানিনা ভালোবাসার কথা কেমন করে বলতে হয়।কাশফীর সাথে কেমন কেমন করে যেন বিয়ে হয়ে গেলো। এক বছর আট মাস ধরে সংসার করছি, কিন্তু কখনও ভাব ভালোবাসার কথা আদান প্রদান হয়নি।তবুও তো একসাথে থাকা হলো, পাশাপাশি বাস করা হলো।আমি কাশফীকে চোখ বড় বড় করে বললাম, “একটা কথা বলি।তোমার সাথে এতদিন ধরে একসাথে থাকি।প্রতিদিন তোমাকে দেখি কিন্তু প্রতিবার একটা ধক করে ধাক্কা লাগে বুকে তোমাকে দেখলে।এই জিনিসটা কি প্রেম ভালোবাসা?”
কাশফী অনেকটা সময় নিয়ে ভাবতে ভাবতে বললো, “ঠিক জানিনা।আপনি ঠিক বলেছে। সবকিছু জানার আসলেও প্রয়োজন নেই।আপনার পাশে থাকতে এখন ভালো লাগে।মনে হয় আমি ঠিক আছি।মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি যদি হারিয়ে যান তাহলে আমাকে কেউ অদ্ভুত বোকা বোকা রকম কথাগুলো বলবেনা।এই কথাগুলো না শুনলে মনে হয় এখন আর ভালোও লাগবেনা”।
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম, “তোমাকে নিয়ে তো তাহলে এখন কবিতা লিখা দরকার। কাগজ কলম পারলে একটু ব্যবস্থা করো। মাথায় খালি কবিতা আসতেছে”।
কাশফী কোথাও গেলোনা, আমার পাশে চুপ করে বসে আমাকে দেখতে থাকলো।ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিলো ও আমাকে নতুন করে দেখছে।