ভোররাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে গেলো তখন আবির ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে।মেজাজটা খারাপ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা আবিরের পশ্চাতে একটা লাথি কষালাম।আবির থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারপর মিচকি হাসি দিয়ে ফোন হাত দিয়ে ঢেকে বললো, “দোস্ত আজকে ওর জন্মদিন।একটু কানটা কম্বল দিয়া ঢাইক্যা ঘুমায় যা”।
আমি ওর পশ্চাতে আরেকটা লাথি কষিয়ে সুন্দর করে ওর কথামত কম্বল দিয়ে কান ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।চেষ্টা চেষ্টাই থাকলো, কিন্তু ঘুম আর আসলোনা।একসময় মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখলাম ভোর সাড়ে চারটা।বিশাল জোরে একটা হাই তু্লে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।এখন সময় হয়েছে শীতের কনকনে ভোরে কুয়াশার স্বাদ অন্তরে ধারণ করার।হঠাৎ করে মনে হলো আবিরের মত আমার যদি কেউ থাকতো! খারাপ হতোনা।হয়তো আমিও তখন লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতাম, আমিও হয়তো গভীর রাতে আবিরের মত ফ্যাসফ্যাস করে কথা বলতাম।আচ্ছা কার সাথে কথা বলতাম?অনেকগুলো চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম।সবশেষে বুঝলাম, ঘটনা খারাপ।আমার দ্বারা হবেনা।
সকাল পৌণে আটটায় আমি যখন কোনরকমে নাস্তা গিলছি গোগ্রাসে তখন আফসার আমার সামনে বসে দাত বের করে বললো, “দোস্ত আজকে সকালে ক্লাস করমুনা”।
আমি ওকে বিরক্ত হয়ে বললাম, “কেন তোমার কি আবিরের মত নতুন গার্লফ্রেন্ড হইছে?ডেটিং করতে যাইবা?”
আফসার তার দন্ত আরো বিকশিত করে বললো, “দোস্ত ঠিক ধরছোস।আমি কবিতার প্রেমে পড়ছি।আজকে বিশ্ববিদ্যালয় কবিতা সংঘে আমার কবিতা পাঠ করতে হইবো।তুইও চল।কাল সারারাত বিদ্রোহী কবিতাটা মুখস্থ করলাম।আজকে ছন্দে ছন্দে আবৃত্তি করবো”।
আমার বন্ধু আফসার একজন অতি বিশিষ্ট গাধা।বেশ কিছুদিন আগে সে প্রিয়ন্তীর কাছে বিশাল একটা ছ্যাকা খেয়েছে।এরপর থেকে তার একটাই ভালবাসা – সাহিত্য।সে প্রায়ই ভয়ংকর ভয়ংকর সব সাহিত্য রচনা করে আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়।দেখা গেছে এক গভীর রাতে সে আমার রুমের দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করে বলবে, “একটা টাটকা সনেট লিখছি।একবার শুনে দেখ দোস্ত।বুকে শান্তি পাইতেছিনা তোকে না শুনানো পর্যন্ত”।আমি তার সনেট, ধ্রুপদী সাহিত্য সবই শুনি।বন্ধু বলে কথা।
ঠিক সাতটা ঊনষাট মিনিটে ক্লাসে পৌছালাম।ক্লাস যেয়ে দেখি সবাই OP-Amp নিয়ে পড়ছে।আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম।আজকে কি এটার ক্লাসটেস্ট ছিলো?আরে তাই তো!! আজকে সোমবার, প্রথম দুইটা চ্যাপ্টারের উপর ক্লাসটেস্ট।এমন করে ভুলে গেলাম কেন?কিছু যে পারিনা তা না।কিন্তু ২০ পাওয়ার মত তো প্রিপারেশান নেই।চারটা ক্লাসটেস্টের মধ্যে তিনটা হয়ে গেছে।এটা শেষ ক্লাসটেস্ট এই কোর্সের।আগের তিনটা আমার খুব ভালো হয়নাই।ভাবছিলাম শেষটা দিয়ে মার্কস কাভার করবো।হায় সব শেষ! এমন করে ধরা খেলাম।এসব ভাবতে ভাবতে ফাহিমের পাশে বসলাম।করুণ চোখে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দোস্ত ইয়ে মানে আজকে ভাবতেছিলাম তোর থেকে একটু হেল্প নিয়ে পরীক্ষাটা দিয়েই দেই”।
ফাহিম আমার দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে বলে, “দোস্ত আমি তো কিছুই পারিনা আজকে।আমি তো ভাবলাম তোর থিকা হেল্প নিবো”।
আমি ফাহিমকে কিছু না বলে চুপচাপ ওর পাশে বসে পড়লাম।আমি জানি ওর এইসব কথার কোন বেল নাই।পরীক্ষা আরম্ভ হলে ওর খাতা এমনিতেই ইকুয়েশন আর সার্কিটে ভরে যাবে।
পরীক্ষা শেষ হলে আমি আমার প্রিয় লাল গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে ভার্সিটির সাথে লাগানো লেকের পাড়ে গিয়ে দাড়ালাম।আজ একজনের কথা খুব মনে হতে লাগলো।আমি তখন নটরডেম কলেজে কেবল ভর্তি হয়েছিলাম।বিজ্ঞান মেলায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তার সাথে আমার পরিচয় হয়।মিতুর সাথে আমার ফোনে অনেক কথা হতো।আমার কলেজ লাইফের একটা খুব সুন্দর সময় কেটেছিলো তার সাথে।আমি তাকে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভাবতাম।সে ভাবতো কিনা জানিনা।আমাদের সম্পর্কটা যে আসলে কি ছিলো আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।ও বুঝেছিলো কিনা তাও জানিনা।
আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলো ছিলো ওর সাথে ধানমন্ডির রাস্তায় শীতের বিকেলে হেটে বেড়ানো দিনগুলো।আমরা হাটতাম, শুধু হাটতাম।এটা সেটা হাবিজাবি কতকিছু নিয়ে গল্প করতাম।একদিন হঠাৎ করে সে আমাকে বিষণ্ন হয়ে বলেছিলো, “আমার একটা রোগ হয়েছে”।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বলো আমাকে কি হয়েছে!”
মিতু সুন্দর করে হেসে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাটে।আমি চুপ করে ছিলাম।একসময় তাকে বললাম, “তোমার কখনো মনে হয় তুমি অনেক একা?”
মিতু মাথা নাড়ে।আমাকে বলে, “মনে হবে কেন এটাই সত্যি”।
আমি হাসতে হাসতে বলি, “আমরা সবাই আসলে একা।ক্ষনিকের জন্য কেউ একজন পাশে এসে দাড়াবে।কিন্তু একসময় দেখবে আশেপাশে আর কোন মানুষের উষ্ণতা নেই”।
মিতু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, “কি ভয়ংকর! তুমি এমন ভাবুক হয়ে গেলে কবে?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।ওটার শব্দটা এতটা কটু ছিলো যে মিতু মনে হলো খুব ঘাবড়ে গেছে।এমনকি আমাকে এরপর সে অনেকক্ষণ খুচিয়েছিলো আমার কি হয়েছে জানার জন্য।সেদিন আমি প্রথম বুঝেছিলাম মেয়েটাকে আমি আমার পাশে সবসময় দেখতে চাই।এটাও বুঝেছিলাম, ব্যাপারটা কখনো সম্ভব নয়।এই কথাটা ওকে বলার মত সাহসটা আমার নেই।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর আমি মিতুর একটা চিঠি পেয়েছিলাম।ওর বান্ধবী যখন আমাকে চিঠিটা দেয় আমি একটু বিরক্ত হয়েছিলাম।এই আধুনিক যুগে চিঠি দেয়ার মত নাটকীয়তা না করলেও চলতো।চিঠিতে মিতু শুধু দুটো বাক্য লিখেছিলোঃ
“প্রিয় অর্ক,
আজ রাতে বাবা মার সাথে আমি দেশের বাহিরে চলে যাবো।দুঃখিত আগে বলতে পারিনি”।
ব্যস এরপর আমি কখনো আর মিতুর দেখা পাইনি।আজকে হৃদয় কাপানো ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে আমার ওর কথা খুব মনে হলো।শেষ যেদিন দেখা হয়েছিলো ও একটা হালকা নীল চাদর গায়ে জড়িয়ে ছিলো।আমার গায়ে ছিলো এখন যে লাল গেঞ্জিটা পড়ে আছি ঠিক সেটাই।ডুবন্ত লালচে সূর্যের প্রতিচ্ছবি লেকের জলে একটা অদ্ভুত মোহ তৈরী করেছিলো।আমি জানিনা আমার চোখটা কখন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো।আমি মনে মনে বললাম, “এভাবে কেউ ছেড়ে চলে যায়?”
নিজের উপরও বেশ রাগ পেলো।দুটো বছর আমরা এক সাথে কত শত গল্প করেছি।একজন আরেকজনের মনের খবর রেখেছি, তার যত্ন নিয়েছি।অথচ একটাবার তাকে আমার ভালো লাগার কথা জানাতে পারতাম না? হয়তো ব্যাপারটা তখন এমনটা হতোনা।
গভীর রাতে যখন একা একা হেটে হলে ফিরছিলাম তখন খুব চিৎকার চেচামেচি শুনতে পেলাম।আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি কি হচ্ছে।দৌড়িয়ে যখন হলের সামনে পৌছালাম তখন আশেপাশে শুধু ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।আমি হতভম্ব হয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে থাকলাম।সিড়িতে রক্তাক্ত কিছু অর্ধচেতন দেহ পড়ে আছে।আমার কিছু বন্ধু রহমান, ফয়সাল ওদের অবস্থা দেখলাম খুব করুণ।আমি আমার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে।দেখলাম আমার রুমের পাশেই সবচেয়ে বেশি ভীড়।রুমে ঢুকে দেখি আবির ঘুমিয়ে আছে তার সারা মুখে লাল রক্ত নিয়ে।আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তার মাথার একপাশটা কে যেন থেতলে দিয়েছে।মুখ দিয়ে গোঙ্গানীর মত কিছু একটা বের হয়।কিছু বলতে চাচ্ছি, কিন্তু পারলাম না।আমি আবিরের পাশে গিয়ে বসি।ওর গায়ে কে যেন ওরই বিছানার চাদরটা সেপটে দিলো।আমি ওর চোখের দিকে তাকাই।ভয়ংকর একটা ভয় ওর সারা চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।এই ভয়ের অনুভূতি আমাকেও যেন মনে হলো গ্রাস করলো।আমি জানি জনম জনম আমাকে এই ভয় তাড়া করবে।এর থেকে আমার নিস্তার নেই, একেবারে নেই।আমার পাশে আফসার আর ফাহিম চুপ করে বসে আছে।আমি আমার বন্ধু আবিরকে চিৎকার করে বলি, “দোস্ত তুই যত ইচ্ছা যার সাথে ইচ্ছা রাত জেগে কথা বল।আমি তোরে আর কিছু বলবোনা।একটু গাটা ঝাড়া দে।দোস্ত এমন করে চইলা যাইসনা।ওঠ শালা, ওঠ”।
আমার চার বছরের রুম মেট, যার সাথে জীবনের সবকিছু শেয়ার করছি আজ সে কোথায় উধাও হয়ে গেলো আমি বুঝতেই পারলাম না।আমার বুঝতে ইচ্ছাও করছিলোনা।এভাবে কেন মানুষগুলো চলে যায়।কেউ একবার বিদায়টাও নেয়না।আমি চিৎকার করে কাদতে থাকি।আমার বন্ধু আবির আমার এত আপন কেউ ছিলো তা আগে কখনো বুঝিনি।আজ তার চলে যাওয়া বুঝিয়ে দিলো আমাদের হৃদয়ের সর্বাঙ্গ এই আপন মানুষগুলোর ভালোবাসা দিয়ে গড়া।কারো একটু হারিয়ে যাওয়া বা দূরে চলে যাওয়া যেন হৃদয়ের একটা অংশ খসে পড়া।যে এমন কাউকে হারায়নি সে এই যন্ত্রনা কখনো কি বুঝবে?না, কখনোই না।
আবিরের বাবা খবর পেয়ে রাতের মাঝেই চলে এলো।তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে।তিনি ছেলের দিকে একবারও তাকাতে পারছিলেন না।আমরা সবাই তাকে ঘিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।উনি লাশ নেয়ার ব্যবস্থা করছিলেন।লাশ নিয়ে যাওয়া হবে আবিরের ছোট্ট রাজশাহী শহরে।হলগেটে তখন একটা সাদা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে।আমি আঙ্কেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমাদের ক্ষমা করবেন, আমরা কেউ কিছু করতে পারিনি।ওকে ওরা কেন মারলো তাও জানিনা।আমাদের আঙ্কেল মাফ করে দেন”।
আমার দিকে তাকিয়ে আঙ্কেল বললেন, “তোমরা কি করবা বাবা?দোষটা ওরই।আমার বড় ছেলেটা রাজনীতি করতে যেয়ে সারাজীবনের মত পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে আছে।আর একটা ছেলে জীবনটাই দিয়ে দিলো।এত্ত করে বুঝাইছি পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করবানা।কিন্তু তারপরো সে নিশ্চয়ই রাজনীতি করছে।একটাবার ভাবলোনা আমাদের ও ছাড়া আর কেউ নেই।একটাবারও ভাবলোনা”।
আমি মূক হয়ে ওর বাবার কথা শুনছিলাম।ওর বাবার মুখ তখন এতই কঠিন হয়েছিলো আমি কিছু বলে উঠতে পারিনি।আমি শুধু দেখলাম আমার জানের বন্ধু আবিরের নিষ্প্রাণ দেহটা নিয়ে একটা মাইক্রো ছুটে যাচ্ছে।সবাই তাকিয়ে দেখছি আমাদের রোমান্টিক বন্ধুটা কিভাবে আস্তে আস্তে বিন্দুর মত হারিয়ে যাচ্ছে।কারোর কিছু বলার ছিলোনা।কারো না।
রাতের বেলা ফাহিম আমার কাছে চোখ মুখ শক্ত করে এলো।আমার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে বললো, “ও তো রাজনীতি করতোনা তাহলে ওকে মারলো ক্যান?”
আমি বিছানায় শুয়ে আড়চোখে আবিরের খালি বিছানার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।কিছু বলতে ইচ্ছা করছেনা।তবুও ফাহিমকে বললাম, “দোস্ত ওরে যখন মারলো তখন আমরা কেউ পাশে ছিলাম না।ও খুব ভয় পাইছিলো তাই না?”
ফাহিম আমার দিকে দাত চিবিয়ে বলে, “আমরা কি এমনি এমনি ছাইড়্যা দিবো?আমি খবর নিছি এই কাজটা রাতুলের।সরকারী দলের পোলাপাইন যখন হলে আসে মারধর করতে তখন রাতুল নাকি আমাদের রুমে ঢুকছিলো চাপাতি নিয়া”।
আমি ফাহিমের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলি, “রাতুল তো ভার্সিটি ছেড়ে দিছে।ও এখন এই কাজ কেন করবে?”
ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ভার্সিটি ছাড়ছে।দল তো ছাড়েনাই।দোস্ত একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকেনা। আমাদের হলের কয়েকজন মাত্র রাজনীতি করে, বিরোধী দল করে।আমরা তো সাধারণ ছাত্র।আমাদেরকে ধইর্যার ধইর্যাি ওরা মারলো কেন?তুই জানিস, আমাদের জুনিয়র আতেল টাইপ ছেলেটা যে আমার কাছে পড়া শিখতে আসতো ওরে চারতলা থেকে ফেলে দিছে।ওর থেতলানো মাথাটা নিজ চোখে দেখছি।আমার আপন ছোট ভাইয়ের মত ছিলো।মাত্র তিনমাস ভার্সিটিতে ঢুকছে। এই বাচ্চা পোলাটা কি রাজনীতি বুঝে।ওকে মারলো কেন?”
আমি বিছানা থেকে উঠে বসি।ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বলি, “৭১ এর আগে এন.এস.এফ থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় আসছে সবাই শুধু আমাদেরকেই মারে।আমরা চুপ করে চোখে চশমা আর কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পড়তে আসি।হঠাৎ করে অনুভব করি কে যেন ঠিক বুকের মাঝখানে একটা কোপ দিয়ে দিলো, অথবা একটা পোড়া বুলেটের গন্ধ আমার শরীরের কোন এক কোণে।এভাবে আমরা মরছি, এভাবেই আমরা মরবো।কেউ আমাদের বাচাবেনা বুঝছিস।কেউ না।কিন্তু এবার নিজেদের বাচতে হবে।কেউ তার হাতটা তুলে দাড়াক আর না দাড়াক আমি এবার সামনে গিয়ে দাড়াবো।আমি প্রতিবাদ করবো, আমি ওই কুত্তার বাচ্চাগুলোর সামনে গিয়ে দাড়াবো।এভাবে আর মরতে পারবোনা।অনেক মরছি”।
ফাহিম আমার কাধে হাত দিয়ে বলে, “আমিও দাড়াবো।আমরা সবাই দাড়াবো।আমাদের আবিরকে ওরা মেরে ফেলছে।আমরা কি ওর এমন বন্ধু ছিলাম যে ওর জীবনটা কুত্তাগুলো নিয়ে নিলো আর আমরা শিখন্ডীর মত দাঁড়ায় দাঁড়ায় হাততালি দিবো? আর কতদিন এইরকম নগ্ন ভয় নিয়ে আমরা মরবো?আমিও ওদের সামনে দাড়াবো, ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবো, তোদের মাঝের পশুটাকে একটু দেখি তো?”
পরদিন ক্লাস যেয়ে দেখি থমথমে অবস্থা।আমাদের ক্লাসের দশ পনেরোজন খুবই আহত হয়েছে।তিন চারজন হাসপাতালে আছে।সকালে একজন মারা গেছে।যে মারা গেছে তার নাম ছিলো খোকন।শুনেছি খোকনের মা সারারাত ঢাকা মেডিকেলে ছিলো।খোকনকে পুরোটা সময় বুকের মাঝে আগলিয়ে রেখেও বাচাতে পারেন নাই।আরো জানলাম খোকনের মা ধানমন্ডীর একটা বাড়িতে কাজের বুয়া ছিলেন।তার স্বামী অনেক আগেই তাকে রেখে পালিয়ে গেছেন।এই একটা মাত্র সন্তান নিয়ে খোকনের মা যে বিশাল সংগ্রাম করেছেন পৃথিবীতে বেচে থাকতে তা কারো আর বুঝতে বাকি ছিলোনা।আমরা এমন মায়েদের কথা বেশিদিন মনে রাখিনা।মাঝে মাঝে পেপার পত্রিকায় এদের বিলাপ শুনি, হয়তো একটু চুকচুক আওয়াজ করি।তারপর সব ঠান্ডা।সেদিন পেপারে পড়লাম এক পরিবার হাহাকার করে বলছে, “তোরা কারে কাইড়্যা নিলি রে?”
এই প্রশ্নটার উত্তর দেয়ার মত কেউ নেই এদেশে।আমাদের বিশিষ্ট ক্ষমতাসীনেরা এই কথাগুলো শুনবেন, নাক দিয়ে একটু হয়তো ঘোৎঘোৎ আওয়াজ করবেন।তারপর পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সফরের প্রস্তুতে নেবেন।সাবাস আমাদের নীতিবোধ, আমাদের মূল্যবোধ এবং মনুষত্ব্যবোধ(?)।
প্রথম ক্লাসটা শেষ করে আমরা সবাই এক হয়ে দাড়ালাম।সবাই গতকালকের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।আসলে ঠিকমত রাগে কেউ কথা বলতে পারছিলাম না।একসময় মিজান বললো, “আজকে ক্লাস শেষে আমরা ভিসির বাসভবনের নিচে গিয়ে দাড়াবো।এইভাবে আর কতদিন?আমি বিচার চাই, এই অত্যাচারের বিচার চাই।যেই কুকুরগুলা এই কাজ করছে তাদেরকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো দেখা চাচ্ছে তার জবাব চাই”।
রাফি কাশতে কাশতে বললো, “বুঝলাম।কি লাভ হবে?ভিসি স্যার নিজেই তো একটা ভীতুর ডিম।তারে বইল্যা কি লাভ?আমাদের শিক্ষাটাই নষ্ট হয়ে গেছে।আমি তুই এবং একশোজন যতই ফাল পাড়ি ওরা চুপ করে থাকবোনা।ওরা আমাদেরকে আরো মারবে, আরো খুন করবে।আজকে তুই আমি আন্দোলন করলাম, অনশন করলাম, পুলিশের মাইর খাইলাম তাতে কিছুই কমবোনা।বরং দেখবি, দুইদিন পর আমাদেরই ভার্সিটি থেকে বাহির কইরা দিবো।এটাই এখন সিস্টেম, নষ্ট সিস্টেম”।
আমরা সবাই রাফির দিকে তাকিয়ে থাকি।কথাটা একটুও কি মিথ্যা বলছে? মিজান বললো, “বুঝলাম কিছু হবেনা, বুঝলাম কারো বিচার হবেনা।তো কি এইভাবে চলতে থাকবে?আবিরের মত আমরা একজন একজন কইর্যা মরবো?তারপর কাপুরুষের মত ভয়ে ভয়ে একটা একটা কইর্যাা দিন পার করবো।এটা কোন হিসাবের কথা?এতদিন এভাবে চলছে, এবার এইভাবে চলবেনা।কিছু করতে হবে।নিজে যদি মরতে হয় মরবো।তবুও কুত্তাগুলোরে ছাড়বোনা।যারা আবিরের মত অসহায় হয়ে বাচতে চাসনা তারা ক্লাস শেষ করে নিচে দাঁড়ায় থাকবি।সবাই একসাথে ভিসির বাসার নিচে দাড়াবো”।
মিজানের কথামত আমরা সবাই ক্লাস শেষ করে যখন এক সাথে হাটছি তখন সরকারী দলের কিছু ছাত্র হঠাৎ আমাদের সামনে এসে দাড়ালো।এর মধ্যে ভার্সিটির সরকারী ছাত্রদলের সভাপতি গুলজার ভাই ছিলেন।তিনি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা কই যাও?ভিসির বাড়িত যায়া কি করবা?”
ফাহিম একটু সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “কেন আপনাদের সমস্যা কি?”
গুলজার ভাই হেসে ফাহিমের পাশে দাড়ালো।তারপর ঠাস করে ওর গালে একটা বিশাল চড় কষালো।আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।এরপর আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “বেয়াদ্দপী কইরোনা বাচ্চারা।তোমাদের কাছে আমি স্যরি বলতে আসছিলাম।চলো ক্যান্টিনের ভিতরে বসি।তোমরা কয়জন আছো? বিশ পচিশজন সবাইরে ক্যান্টিনে আজকে খাওয়ামু।চলো আমার সাথে।কিছু আলোচনা করি”।
আমরা ফাহিমের এভাবে চড় খাওয়া দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিলাম।গুলজারের পেছন পেছন আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে যখন বসি তখন ফাহিম আমাদের সাথে ছিলোনা।ও কোথায় গেছে জানিনা।গুলজার ভাই ক্যান্টিনে সবাইকে বসতে বলে নিজে সামনে গিয়ে দাড়ালো।রাতুল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।এই ছেলেটা আমাদের ক্লাসের ছিলো।প্রথম বছরেই সরকারী দলের রাজনীতিতে যোগ দেয় এবং প্রতি টার্মে সে এক দুই বিষয়ে ফেল করতে শুরু করে।একসময় পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।বহুদিন পর আজকে তাকে প্রথম দেখলাম।আবিরের মুখটা মনে পড়তেই রাতুলের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমি তাকালাম।কিভাবে যেন নিজেকে তবুও শান্ত করে রেখেছিলাম।গুলজার আমাদের কাছে এগিয়ে বলতে থাকে, “কাল তোমাদের হলে মিরাজদের পোলাপাইনরে মাইর দিতে গেছিলাম।এই পোলাপাইনগুলো আমাদের ভার্সিটির কলংক।They were like stigma in the Lily. আমরা প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি করি।আমাদের ম্যানিফেস্টে কি লিখা আছে তোমরা কি জানো? ভার্সিটিতে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সকল অপ্রগতির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।বিরোধী দলের ছেলেগুলা হলো অপ্রগতি।দুঃখজনকভাবে তোমাদের মত কিছু সাধারণ ছেলে পেলে আহত হইছে।হাসপাতালে গেছে দু একটা। আমার ছেলেপেলের আসলে মাথাটা ঠিক ছিলোনা।সামনে যারেই পাইছে কোপায়া দিছে।কিন্তু এইটা তো এতো সিরিয়াস কিছু না যেই জন্য তোমরা ভিসির কাছে দৌড়াইতেছো! তাই না?”
আমরা হতভম্ব হয়ে পশুটার দিকে তাকালাম।কারো মুখে কোন ভাষা নাই।গুলজার আমাদের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন।নিজেই আবার বললেন, “এইভাবে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত লাফালাফি করা বাদ দিয়ে নিজ নিজ পড়াশোনায় মন দাও।নাইলে ওই দেখো তোমাদের ওই বন্ধুর মত অবস্থা হইবো”।
আমরা দেখলাম ক্যান্টিনের পিছনের দিকের দরজা দিয়ে সরকারীদলের কিছু ছাত্র ফাহিমকে টেনে নিয়ে আসছে।ফাহিমের সারা মুখ ফুলে আছে মারের আঘাতে।ওর হাটু থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।ওর যে কোন জ্ঞান নেই এটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।গুলজার ঠিক আমার সামনে এসে দাড়ালো।আমার কাধে হাত দিয়ে বললো, “কেন যে তোমরা বেয়াদ্দপী করো! আমার সাথে এমনে কথা বলার সাহস পাও কোথা দিয়্যা?কারও কিছু বলার থাকলে হাত তুলো।তার হাতটা ভাইঙ্গা এরপর কথা শুনবো”।
আমি হাত তুলে দাড়ালাম।একবার ফাহিমের দিকে রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে গুলজারের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “গুলজার ভাই আপনি কোন জাতের কুকুর একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
ক্যান্টিনে তখন পিনপতন নীরবতা।আমি গুলজারের দিকে আরো এগিয়ে গেলাম।তার একদম কাছে দাড়িয়ে আবার বললাম, “আপনারে দেখেই মনে হয় আপনি কুকুর প্রজাতির একজন সম্মানিত সদস্য।একটু বলেন তো, আপনার জাতটা কি স্পেসিফিক্যালী?”
গুলজার ভাইয়ের মুখ দিয়ে রাগে ত্থুতু বের হতে লাগলো।আমার কাছে আস্তে করে এগিয়ে গেলো।তার হাতে তখন চাপাতি।আমার ভয় লাগছেনা।একটুও না।মনে হচ্ছিলো এই ব্যাপারটা অনেক আগে হওয়া দরকার ছিলো।এক বছর আগে যখন আমাদের খুব প্রিয় বন্ধু অভিককে মেরে ফেলে তখনই এমন কিছু হওয়া দরকার ছিলো।আমার ভিতরে তখন আগুন জ্বলছে।এই আগুন কাউকে ভয় পায়না।আমাকে চাপাতিটা দেখিয়ে বললো, “হ আমি কুত্তা।আর এইটা আমার দাত।এখন তোমারে সবার সামনে একটা কোপ দিবো।সবাই খাড়ায় খাড়ায় দেখবো।এই হিজুগুলা একটাও তোমার জন্য আগায় আসবোনা।এখান থিকা যাওয়ার আগে সবাই তোমার পশ্চাতে আমার কথা মত একটা কইর্যা লাথি মাইর্যা যাবো”।
কি হলো বুঝতে পারিনাই।হঠাৎ করে ঘাড়ে একটা প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম।আমি মাটিতে পড়ে গেলাম।মনে হচ্ছিলো মারা যাচ্ছি।এমন প্রবল যন্ত্রণা আর মৃত্যুর ভয় আমাকে আর কখনো গ্রাস করেনি।আমি মনে হয় কিছুক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম।যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আশেপাশের সবকিছু ঘুরছিলো চড়কির মত।টের পেলাম আমাকে গুলজার ক্রমাগত লাথি মারছে।আমার কেন যেন একটুও ব্যাথা লাগছিলো না।আমার আবিরের কথা মনে হতে লাগলো।সে বলতো, “দোস্ত ২০১৩ তে পাশ করমু।ওর মধ্যে একটা চাকরী জোগাড় করে ২০১৪ তে বিয়া করমু।২০১৬ এর মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ায় তোরে চাচ্চা বানায় দিমু ইনশাল্লাহ”।
আচ্ছা আবিরকে নিয়ে ওর বাবা যখন চলে যায় তখন কি আমরা একটাবার ওর বাবাকে বলতে পারতাম না, ও কোন রাজনীত করতোনা।ও আপনাদের সভ্য ভদ্র আদর্শ ছেলে ছিলো।ওর জিপিএ সবসময় ৩.৫ এর উপরে ছিলো প্রতিটি টার্মে।আমি কোন শক্তিতে উঠে দাড়িয়েছিলাম আবার জানিনা।আমি আবিরের জন্য, খোকনের জন্য, অভিকের জন্য এবং এই দেশের সকল সাধারণ ছেলেদের জন্য উঠে দাড়িয়েছিলাম।আমি অনেক কষ্ট হলেও আমার সব বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চিৎকারে করে বললাম, “আমার কথা শোন সবাই।এই কুত্তাগুলো সারাজীবন আমাদের কামড়ে গেছে, আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নির্যাতন করেছে।আবির, খোকনের বাবা মায়ের মত এরা আমাদের বাবা মাকেও একদিন কাদাবে।আমি যদি আজকে মারা যাই, সবার জন্য কথা বলতে গিয়ে মারাও যাই, তোরা কেউ চুপ করে থাকিস না।কুকুরকে লাথি মারতে হয়, তাদেরকে ভয় পেয়ে পিছু যেতে হয়না।তোরা আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করে থাকিস না।এদেরকে ছেড়ে দিসনা”।
গুলজার তার চাপাতিটা আরো উচু করে আমাকে মারতে চায়, আমার কাধ দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে।আর একটু পর হয়তো আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না। প্রিয় দেশটা, প্রিয় বাবা মাকে মনে করতে থাকলাম।একদিন হয়তো সবাই জানবে আমি একটা সত্য কথা বলতে যেয়ে, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম সবার থেকে।কিন্তু আমার কথা শুনে নিশ্চিত আরো অনেকে এগিয়ে আসবে।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।একটা ভয়ংকর আঘাতের অপেক্ষা তখন আমার সমস্ত সত্ত্বায়।
আচমকা কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি মিজান গুলজারের সামনে দাঁড়িয়ে কাপছে।একসময় সে গুলজারকে বললো, “আজকে একটা মহান দিন রচনা হবে।আজকে আবির, খোকনের মত সাধারণ ছেলেগুলা কথা বলবে।আজকে কিছু কুকুর গোত্রীয় জীবকে কবর দেয়া হবে”।
মিজানের সারা দেহ কাপছে।সবার দিকে তাকিয়ে বললো, “ক্যান্টিনের সব দরজাগুলো লাগা।অনেকদিন কুত্তা পিটানো হয়না”।
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।সেদিন আর কি কি হয়েছিলো আমার কিছুই মনে নেই।পরে জেনেছিলাম গুলজার আর তার সাথের কিছু ছেলেপেলে প্রচন্ড আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।রাতুল নামের একটি ছেলেকে কোথাও খুজে পাওয়া যায়নি।
সেই ঘটনার পর এক মাস আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলাম।আমার হাতের এক পাশ চিরজীবনের মত অবশ হয়ে গিয়েছিলো।একদিন সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় আমার কাছে একটা ফোন আসে।ফোন ধরতে একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম।আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে?”
মেয়েটা অনেকক্ষণ কিছু বলছিলোনা।একসময় আমতা আমতা করে বললো, “আমি আর আবির বন্ধু ছিলাম।আপনার কথা আমাকে আবির অনেকবার বলেছে।আমি অনেক কষ্ট করে আপনার নম্বরটা ম্যানেজ করেছি।ওর একটা ডায়েরী আমার কাছে আছে।অনেক আগে আমাকে পড়তে দিয়েছিলো।আপনি কি কষ্ট করে ডায়েরীটা আমার থেকে নিয়ে ওর বাবা মা কে বুঝিয়ে দেবেন?”
আমি ইরিনার থেকে ডায়েরীটা বুঝে নিয়েছিলাম।ইরিনা আমাকে জানালো, আবিরকে মেরে ফেলার আগে যখন হলে হত্যা তান্ডব চলছিলো তখন আবির ওকে কাদতে কাদতে ফোন দিয়েছিলো।ইরিনাকে বলেছিলো, ওর বাবা মাকে যেন জানানো হয় ও তাদের অনেক ভালোবাসে।ওর সাহস নেই তাদের সাথে এখন কথা বলার।আবির অনুরোধ করেছিলো যে ওর বাবা মা যেন জানতে পারে, ও কখনো নোংরা রাজনীতি করে নাই।
আমি খুব বুঝতে চাচ্ছিলাম আবিরের মনে তখন কি চলছিলো যখন ও ইরিনাকে ফোন করেছিলো।হঠাৎ করে মানুষ হিসেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো।খুব অসহায়।
আবিরের বাবার সামনে আমি ওর ডায়েরীটা নিয়ে বসে আছি।ওর বাবা-মা দুজনের চোখে কালি পড়ে গেছে।হয়তো উনারা রাতে ঘুমাতে পারেন না। আমাকে আবিরের বাবা জিজ্ঞেস করলো, “আবিরের কি শুনাতে চাচ্ছো বলো তো?”
আমি ডায়েরীর পাতা খুলে তাদেরকে শুনাই আবিরের লিখা একটা ডায়েরীর পাতাঃ
“আজ ১৯শে জুলাই, আম্মুর জন্মদিন।আম্মু আমি তোমাকে একটু আগে শুভ জন্মদিন জানিয়েছি।কিন্তু আমার অনেক মন খারাপ।কারণ তোমার হাতের পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে।এমন এমন বিশেষ দিনে তুমি কি সুন্দর করে রান্না করো।আমার খুব সেই খাবারগুলোর গন্ধ নিতে ইচ্ছা করছে।
কাল রাতে বাবা আমাকে আবার বকা দিয়ে বলেছে আমি যেন কোন রকম রাজনীতি না করি ভাইয়ার মত।বাবা কেন বুঝেনা আমি তাদেরকে অনেক ভালোবাসি।এভাবে ভুল না বুঝলে হয় না?আমি কখনো তাদেরকে কষ্ট দিয়ে এমন কিছু করবোনা।
বাবা মার থেকে এত দূরে বাস করে পড়াশোনা করতে আর ইচ্ছা করেনা।মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে তাদের কাছে চলে যাই”।
আবিরের বাবা আবিরের মার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি আমার ছেলেটাকে অনেক বকা দিতাম?”
আবিরের মা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে থাকেন।তার মুখে কোন ভাষা নেই।যে মা তার আদরের সন্তানটিকে এমন করে হারায় তার মুখে শব্দ আসতে পারে কি?
আমার ইঞ্জিনিয়ারিং জীবনের লাস্ট টার্ম ফাইনাল আজকে শেষ হলো।অনেক কষ্টে পরীক্ষা দিতে হয়েছে।আমার শারীরিক ও মানসিক দুই অবস্থায়ই খারাপ ছিল।আমি আমার লাল গেঞ্জীটা পরে আবার লেকের পারে দাঁড়িয়ে আছি।মিতু এখন কি করছে ভাবছি।আজ খুব ইচ্ছা হচ্ছে ধানমন্ডী ৯ নং এ ১২১/বি বাড়িটার সামনে আবার হেটে যাই।মিতুর বাড়ির সামনে গেলে মিতুর গায়ের গন্ধ আবার হয়তো পাবো।
আমি সত্যি সত্যি ওর বাড়ির সামনে গেলাম।তিনতলায় উঠে কলিং বেল টিপলাম বেশ কিছুক্ষণ।যখন ভাবছিলাম চলে যাবো ঠিক তখনি কেউ একজন দরজাটা খুললো।একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা।আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে খুব বিস্মিত হলাম।এটা অবশ্যই মিতুর মা।কিন্তু ওরা তো দেশে নেই।মিতুর মা আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে কেন যেন বললো, “ভেতরে আসো।তোমার নাম অর্ক তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম।ঘরের ভেতরে ঢুকে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতাবোধ আমাকে গ্রাস করলো।ওর মা আমাকে সোফায় বসতে বলে আমার পাশে বসে বললেন, “আমি জানতাম তুমি একদিন আসবে।মিতু আমাকে বলেছিলো, তুমি আসবে”।
আমি ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম মিতু এই পৃথিবীতে নেই।কোথাও ওর মিষ্টি গন্ধটা আর চাইলেও খুজে পাওয়া যাবেনা।আমি ওর মায়ের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে বললাম, “ও আপনাকে আমার কথা বলেছে?”
মিতুর মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ওকে যখন চিকিৎসার জন্য আমরা বাহিরে নিয়ে যাই তখন ও খুব কাদতো।আমি জিজ্ঞেস করিনি কেন।শেষের দিকে ও কথা বলতে পারতোনা সেভাবে।আমাকে তবুও অনেক কষ্ট করে তোমার কথা বলেছিলো।আমাকে বলেছিলো তুমি ওর জন্য অপেক্ষা করো।ও এটা জানে।মারা যাওয়ার দুদিন আগে ও আমার হাতে তোমার জন্য একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিলো।আমি গত পাচ বছর চিঠিটা তোমার জন্য রেখে দিয়েছিলাম।একটু বসো আমি চিঠিটা নিয়ে আসি”।
মিতুর মায়ের সামনেই আমি চিঠিটা খুললাম।চিঠিতে অনেক আকিবুকি করা।শুধু একটা বাক্য আমি বুঝতে পারলাম।ও লিখেছে, “আমি আবার আসবো”।আমি চিঠিটায় হাত বুলাতে থাকি।ওর মা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “কি লিখেছে চিঠিতে?আমার কথা ওর বাবার কথা কিছু বলেনি?”
আমি মাথা নাড়ি।ওর মাকে বলি, “ও লিখেছে ও আবার আসবে আপনাদের কাছে”।
মিতুকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছিলো আমি সেখানে ঘন্টা দুই ধরে দাঁড়িয়ে আছি।অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু আমি কবরস্থান থেকে যেতে পারিনা।আমার চোখ দিয়ে জল পড়া থামছেনা অথচ মুখে একটা আত্নতৃপ্তি।এই আত্নতৃপ্তি ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধটা খুজে পাওয়ার।আমি কবরের মাটিতে হাত দিয়ে থাকি।আমি ওকে বলি, “তোমার আসবার জন্য আমিও অপেক্ষা করবো”।
আশেপাশের মানুষজন আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।তারা অবাক হয়ে খেয়াল করে একটা উঠতি বয়সের তরুণের দুচোখ ভরা পানি অথচ মুখ ভরা প্রশান্তির হাসি।এমনটা তারা খুব বেশি দেখেনি।