১৯৪০ সালের এক অদ্ভুত শান্ত সময়ে নূরজা বেগমের নিকাহ হয় আসফাক মিয়ার সাথে, জোর করে দেয়া বিয়ে। কারণ ১২ বছরের নূরজা বেগম ২২ বছরের আসফাক মিয়াকে দুচোখে দেখতে পারতোনা।আসফাক মিয়া ছিলো তাদের বাড়ির গৃহশিক্ষক।আসফাক মিয়ার পরিবারের কথা কেউ কিছু জানেনা, কাউকে সে কিছু বলেওনা।কোন একদিন লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার ছোট্ট গ্রাম সোনাদির মাঝে তার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়।বন্য নদী তিস্তার এক পারে সে বসে বসে বই পড়ছিলো।গ্রামের আক্কাস মোল্লা অনেকক্ষণ তাকে খেয়াল করে, এরপর হাত দিয়ে ডাকে।আসফাক মিয়া ভয় লজ্জা সব সঙ্গে নিয়ে আক্কাস মোল্লার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।
আক্কাস মোল্লা খুটিয়ে খুটিয়ে আসফাক মিয়াকে লক্ষ্য করে, এরপর দাড়িতে হাত বুলিয়ে শুদ্ধ ভাষায় জিজ্ঞেস করে, “কোথা থেকে আসা হইছে বাজান”?
আসফাক মিয়া কিছু বলেনা, মাথা নাড়ায় শুধু লজ্জায়।
আক্কাস মোল্লা একটু বিরক্ত হলো।তার ইচ্ছা হচ্ছিলো পানের পিক সরাসরি আসফাক মিয়ার মুখে মারে।বহু কষ্টে নিজের ইচ্ছা দমন করে সে আসফাক মিয়ার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে, “আইসো আমার বাড়িত আইসো, হামরা বাড়ি আজিক বিয়ে হচ্ছি”।
সেইযে আসফাক মিয়া আক্কাস মোল্লার বাড়ি আশ্রয় নিলো, দু বছর পেড়িয়ে গেলেও সে আর কোথাও যায়নি।আক্কাস মোল্লার বড় মেয়ে, মেজ মেয়ের বিয়ে থেকে শুরু করে ছোট্ট পাচ বছরের ছেলের পুকুরে ডুবে মরে যাওয়ার সব কিছুর সাক্ষী আসফাক মিয়া।আক্কাস মোল্লারই সবচেয়ে ছোট মেয়ে নূরজা বেগম আসফাক মিয়ার কাছে লজিং পড়তো।নূরজা প্রায় দিন আসফাক মিয়ার কাছে বসে গল্প শুনতো নানান দেশের, নানান রঙ্গের।আসফাক মিয়াকে সে একদম পছন্দ করতোনা।কেমন যেন একটা বিরাট চশমা পড়তো, আর বড়ই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো।নূরজা যখনই মুই, হামারা এমন ভাষা ব্যবহার করতো, আসফাক মিয়া তার চশমা খুলে রাগ করে বসে থাকতো।তখন নূরজা বেগম রাগ ভাঙ্গাতে নানান ছড়া গান গাইতো।আসফাক মিয়া গুনগুন করে কি ভাষায় কি কি সব আবোলতাবোল সুর করে গান গাইতো যেন মাঝে মাঝে।নূরজা আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতো মনোযোগ দিয়ে।একদিন আসফাক মিয়া নূরজাকে পাকড়াও করে একটা গান শিখিয়ে দেয়, ইংরেজী ভাষার গান।মাত্রই দু লাইন শিখে নূরজা, ওটাই সে তার বাবা মা, বোন আর খেলার সাথীদের শুনিয়ে শুনিয়ে অবাক করে দেয়।
কোন একদিন আক্কাস মোল্লা তার বউয়ের কাছে বলে, “হামার বেটির নিকাহ করাই দিতাম চাই হামনের আসিনে, কিতা কও?”
রহিমন বিবি মাথা নাড়ে, না নেড়েও উপায় নাই।তার জামাইকে সে যমের মত ভয় পায়, অথচ তার বিবাহ ৩০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু আক্কাস মোল্লা কোনদিন তার সাথে একটুও গলা উচু করে কথা বলেনি।কখনো দ্বিতীয় বিয়ের কথাও চিন্তা করেনি।প্রতি হাটবারে আক্কাস মোল্লা রহিমন বিবির জন্য এক আনার বাতাসা নিয়ে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেয়।রহিমন বিবি লজ্জার মাথা খেয়ে বাতাসা লুকিয়ে লুকিয়ে মুখে দেয় স্বামীর সামনে।আক্কাস মোল্লার বুকে অনেক ঠান্ডা বাতাস বয় যখন এভাবে প্রকান্ড লজ্জা নিয়ে তার বউ বাতাসা খায়।একদিন রহিমন বিবি জিজ্ঞেস করে, তার জন্য আল্লাস মোল্লা বাতাসা নিয়ে আসে কেন?আক্কাস মোল্লা কিছুই বলেনা।গভীর রাতে কোন একদিন উঠোনের ধারে আক্কাস মোল্লা মাথা নিচু করে কেমন করে যেন বসে ছিলো।রহিমন বিবির বুকটা খান খান হয়ে যায়, জীবনে সে যে কাজ করেনি সেদিন সেটাই করলো।স্বামীর পাশে বসে তার কাধে হাত দিয়ে মুখপানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পান খাইবাম?”
আক্কাস মোল্লা তার বউয়ের হাত ধরে বলে, “হামার মাতায় হনেক বাতাসা খাতিম চাইতো।আব্বায় না দিতো।মাজানরে বড় দিকবার শখ লাগিম”।
কোন এক আশ্বিনে সত্যি সত্যি নূরজার সাথে আসফাক মিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো।নূরজার কান্নাকাটি দেখে তার মা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলে, “অং করিসনা”।
ছোট্ট নূরজা তার সব খেলার সাথী ছেড়ে বিয়ে বসে যায়, তার কিশোরী মনে তখন তার নিজ হাতে বানানো ছোট্ট পুতুলের জন্য কত শত অভিমান।এই পুতুলটাকে সে প্রতিরাতে কত্তবার বুকে জড়িয়ে বলেছে, “তুই হামার বিয়া করবি?” এই বিশাল চশমা পড়া আসফাক আলীকে সে বিয়েই করতে চায়না, একদমই না।
বাসর রাতে আসফাক আলী নূরজাকে বলে, “বাড়ী যেতে মন চাচ্ছে।আমার সাথে যাবে?”
নূরজা আসফাক আলীর সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে, নাহলে লোকটা রাগ করে।সে মাথা নেড়ে বলে, “না যাবুনা”।
আক্কাস মোল্লা যখন জানলো আসফাক আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং তার বাবার বাড়ি সে সময়ের বৃহত্তর ঢাকা শহরে তখন সে একটুও অবাক হলোনা।সে আগেই বুঝেছিলো এই ছেলে অনেক শিক্ষিত।আক্কাস মোল্লার মনটা বেজার হলো যখন আসফাক আলী বললো সে নূরজাকে এখানেই রেখে যাবে। পরে সব গুছিয়ে নিয়ে তাকে নিয়ে যাবে।আক্কাস মোল্লা মাথা নাড়ে, কিছু বলেনা।
আসফাক আলী যখন চলে যাচ্ছিলো, তখন নূরজা তার খেলার সাথীদের সাথে তিস্তার উদভ্রান্ত স্রোতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলো।চারপাশে ভয়ংকর রোদ, কিন্তু নদীর পারটা কেমন মন খারাপ করা শীতল হয়ে আছে।হলদে ডানার চিল আর হরিয়াল পাখির আনাগোনায় মুখরিত তিস্তায় এক অদ্ভুত সময় তখন বয়ে চলছিলো নদীর স্রোতের সাথে।ঠিক সে সময় রহিমন বিবি এসে নূরজাকে বলে, “তুর জামাই যায়গা, দেকা করি আয়”।
নূরজা কিছু বলেনা, প্রচন্ড অভিমান হয় তার। তার বদ স্বামী আরেকবার জিজ্ঞেস করতে পারতোনা তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা।এমন কেন মানুষটা।এর থেকে তার পুতুলগুলা কত ভালো, যখন ইচ্ছা তাদের সাথে থাকা যায়, খেলা করা যায়, সাজিয়ে গুছিয়ে বিয়ে দেয়া যায়।নূরজা বেগম রাগ করে তার মাকে বলে, “পারবাম না”।
এরপর ভৌদোড় দেয়, তিস্তাকে পেছনে ফেলে সে আসফাক মিয়ার কাছে ছুটে যায়।আসফাক মিয়ার কাছে যেয়ে বলে, “আমারে রাখি যাবা”?
আসফাল মিয়া বলে, “হা”।
অভিমানে রাগে নূরজা বেগম হাতের পুতুল ছুড়ে মারে আসফাক মিয়ার মুখে। আসফাক মিয়ার চোখের চশমা পড়ে ভেঙ্গে যায় বউয়ের ভালোবাসার আঘাতে।ঝমঝম ট্রেনের থার্ডক্লাস কামরার দরজা ঝুলে যখন আসফাক মিয়া আর নূরজা বেগম আক্কাস মোল্লা আর তার বউ রহিমন বিবির থেকে বিদায় নিচ্ছিলো, তখন তাদের মধ্যে এক স্নিগ্ধতা কাজ করছিলো।আসফাক আলী চশমাহীন প্রায় অন্ধ চোখে একটা হাত নাড়াচ্ছিলো আর একটা হাত দিয়ে নূরজাকে ধরে রেখেছিলো।মেয়েটা বড়ই অশান্ত, কখন আবার ছু্টে পালিয়ে যায় অথবা কোন অদ্ভুত কর্ম করে বলা যায়না।এই হাত আর ছাড়া যাবেনা, জীবনেও না।
নূরজা বেগম পুরনো ঢাকার যে হিন্দু এলাকায়(বউবাজার) তার স্বামী আসফাক আলীকে নিয়ে থাকতো, সেখানে আর কেউ ছিলোনা।আসফাক আলীর মা মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই।আসফাক আলীর কট্টর মুসলিম পিতা নবাব আলীমুদ্দি খা তার ছেলের জ্ঞানচর্চায় কখনো বাধা না দিলেও খুব বেশি পছন্দও করতোনা।যখন সে তার ছেলের বিয়ে ঠিক করে, তার ছেলে আসফাক তখন পালিয়ে যায় নবাববাড়ী ছেড়ে।আলীমুদ্দি খা কষ্ট পায়নি, একেবারেই না।সে জানতো এমন কিছু একটাই হবে।ছেলেটা তার মায়ের অভ্যাস পেয়েছে।আলীমুদ্দি খানের স্ত্রী তাকে একদমই পাত্তা দিতোনা, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেয়নি।আলীমুদ্দি খা তাই সবসময় তার স্ত্রীকে খুব ভয় পেয়েছে, সবসময় ভেবেছে তার স্ত্রী তাকে ফাকি দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে একদিন।তার বিশাল ছমছমে ঐতিহ্যময় বাড়িতে সে একা বাস করবে, সম্পূর্ণ একা।একা থাকতে সবাই ভয় পায়।আলীমুদ্দি খাও ভয় পেয়েছিলো।তাই যখন তার সন্তান পালিয়ে যায়, সে খুব বেশিদিন সেই ভয় নিয়ে বাচতে পারেনি।
আসফাক মিয়ার স্ত্রী নূরজা ওই ছমছমে বাড়িতে একা একা বাস করে, রাত দিন গুনগুন করে গান গায়।কিন্তু সেই গান কেউ শোনার নাই, শুধু মাঝে মাঝে আসফাক মিয়া তার বিদ্যা চর্চার ফাকে ফাকে নূরজার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শোনে।মন দিয়ে শোনে।তার বড্ড ভালো লাগে নূরজার আপন মনে সুর নিয়ে খেলা করার ব্যাপারটা।আসফাক আলী বুঝতে পারে সে তার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছে।কিন্তু সেই সময়ে একথা বলার সাহসিকতা সে রাখতোনা।
তাদের আট বছরের সংসারে দুটি ফুটফুটে ছেলে হয় যার মধ্যে একজন ছিলো প্রতিবন্ধী।এটা নিয়ে আসফাক আর নূরজার কোন দুঃখ ছিলোনা।আসফাক তার দুই ছেলেকে কখনো কাছে ডেকে নিতোনা।দূর থেকে আদর করতো।ছোটকাল থেকে সে তার বাবা মা কারো আদর পায়নি তাই হয়তো সে আদর করতেও শেখেনি।শুধু যখন রেডিও শুনতো অথবা কলের গান তখন দুই ছেলেকে দুপাশে বসিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতো।রাতে যখন ঘুমাতে যেতো সবাই, আসফাক মিয়া তার দুই বাচ্চাকে ঘুমের ঘোরে জড়ায় ধরে চুমু খেতো।মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে নূরজা আর বাচ্চাদের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন খুজতো।
হঠাৎ করে কোন রকম পূর্বলক্ষণ ছাড়াই একদিন সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়।নূরজা পাগলের মত প্রলাপ বকে আসফাকের এহেন অবস্থা দেখে।আশেপাশের সব চাকরবাকর তাকে বুঝাতে চায়, কিন্তু সে কিছুই বুঝতে চায়না।আসফাক যে তার সবচেয়ে আদরের পুতুল, ওকে ছাড়া বাচবে কি করে?আসফাক মিয়ার জ্ঞান ফিরে আসলে সে তার স্ত্রীকে খোজে, দুই সন্তানকে খোজে।নূরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার চশমাটা ভেঙ্গে দিছিলা কেন?”
নূরজা এখন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে।কাদতে কাদতে বলে, “ওটা তোমাকে ভাল লাগতোনা”।
আসফাক মিয়া আচ্ছা বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, রেখে যায় শুধু তার গোপন সব ভালোবাসা।অনেকে ভেবেছিলো নূরজা এরপর হয়তো ভেঙ্গে পড়বে, কিন্তু তা হয়নি।নূরজা শক্ত হৃদয়ে হাল ধরে সংসারের, তার দুই আদরের ছেলের।আসফাক আলীর বিশাল সম্পত্তির প্রতি তার কোন লোভ ছিলোনা।সে ওসব খেয়ালও রাখতোনা।তার মনোযোগ ছিলো আদরের দুই সন্তানের জন্যই শুধু।মাঝে মাঝে শুধু মনে হতো সোনাদির কথা, তিস্তা পারের ওই হলদে চিলের কথা।রাতে বারবার তার মায়ের বাড়ির বাতাবি লেবুর গন্ধ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেতো তার।২১ বছরের নূরজার মন ছটফট করতো নাড়ির টানে, তিস্তা পাড়ের মাটির সোদা সোদা গন্ধ তার হৃদয়কে আকড়ে রেখেছিলো।অনেক কিছু ভেবে একসময় সে সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাবে আবার তার প্রিয় ছোট্ট গ্রামে।১৯৪৯ সনের মাঝামাঝির দিকে যখন পশ্চিম জার্মানী তাদের সংবিধান নতুন করে প্রণয়নে ব্যস্ত, অথবা বিবিসি তাদের আগমন বার্তা সবাইকে জানান দেয় সেই সময় তরুনী নূরজা শহুরে বেড়াজাল ভেদ করে সোনাদি নামে এক আদুরে ঝিরিঝিরি হাওয়ার ছোট্ট গ্রামে ফিরে আসে।সঙ্গে তার দুই কলিজার টুকরা – আশরাফ ও আলীউল।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের গল্পে যাওয়া যাক।আশরাফ এরই মধ্যে তার মা নূরজাকে না বলে একদিন বাসা থেকে পালিয়ে চলে যায় যুদ্ধে।পালিয়ে যাওয়ার কারণ তার মা তাকে কোনদিন যুদ্ধে যেতে দিবেনা।২৫ বছরের তরুণ আশরাফ যুদ্ধে যাওয়ার ৬৫ দিনের মধ্যে শহীদ হয় চিটাগাং সমুদ্র বন্দরে।দিনটি ছিলো আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ, সারা দেশে তখন থমথমে মৃত্যুর গন্ধ।সেক্টর দশের খালেদ ও আশরাফ বিখ্যাত অপেরেশন জ্যাকপটের(যা চট্রগ্রামে সংগঠিত হয়েছিলো) দুই সহযোদ্ধা তখন একের পর এক পাকিস্তানী জাহাজে বোমা ফেলছে।একসময় খালেদ আশরাফকে বললো, “একটু থামো”।
আশরাফ চুপ করে বসে পড়ে খালেদের পাশে।হঠাৎ করে খালেদ চিৎকার করে কাদতে থাকে।আশরাফ খালেদের কাধে হাত রাখে। তাকে বলে, “খালেদ ভাই ভাবী আর আপনার বাচ্চা ভালোই আছে।আমি বেচে ফিরতে পারলে নিজে আপনাকে নিয়ে ভাবীর রান্না খাবো।টোকনকে কোলে নিয়ে গান গাইবো।বহুদিন গান গাইনা বুঝলেন, কতদিন হয়ে গেলো মাকে দেখিনা।আমার অসুস্থ ভাইটাকে নিয়ে মা কি আমার উপর রাগ করে আছে নাকি জানিনা”।
খালেদ কাদতে কাদতে বলে, “তোর ভাবীকে একটা টাকাও দিয়ে যাইতে পারিনাইরে ভাই।আমার ৪ বছরের বাচ্চাটা কি খায় আল্লাহ মাবুদ জানে।সুমনা ওর বাবার বাড়ি কি যেতে পারছে নাকি তাও জানিনা।যা কিছু হোক, আমার বাচতেই হবে”।
আশরাফের চোখে জল ঝিকমিক করে।খালেদকে বলে, “খালেদ ভাই যদি বাচতে না পারি আপনি দয়া করে আমার মায়ের কাছে যায়েন।মাকে বলবেন তার ছেলে প্রতিদিন নামায পড়েছে, অনেক যুদ্ধের মধ্যেও সে মার সেলাই করা শার্টটা যতন করে গায়ে দিয়েছে।একটুও কোথাও ছিড়েনি”।
খালেদ মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, “বলবো”।
খালেদ যখন প্রচন্ড জ্বর আর একটা রাইফেল নিয়ে আশরাফের বাসায় আসে তখন নূরজা কুরআন শরীফ পড়ছিলো দুরুদুরু বুকে।আলীউল চুপ করে শুয়ে শুয়ে শুনে, সে কথা বলতে পারেনা।খালেদ দরজার বাহিরে আস্তে করে টোকা দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।দুদিনের আগে তার আর জ্ঞান ফেরেনি।যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে দেখতে পেলো তার মা তার কপালে হাত বুলাচ্ছে।চোখ বুজে হঠাৎ করে বুঝলো, কিছু একটা ভুল হয়েছে।তার মা বহু আগেই মারা গিয়েছিলো একদিন হঠাৎ করে।
কোন একদিন পুকুর পারে খালেদকে নিয়ে যখন তার মা রান্নার পানি নিচ্ছিলো, হঠাৎ করে পিছলিয়ে পড়ে গেলো।ব্যস সেখানেই শেষ।তার বাবা তিনমাস পর নতুন বিয়ে করে।নতুন মা তাকে অনেক ভালোবাসতো, নিজের ছেলের মত দেখতো।কি করে যেন নতুন মাও তিন বছর পর মারা যায়।এরপর সে আর কোন মাকে পায়নি।
খালেদ যখন ভরদুপুরে ঘুম থেকে জেগে উঠলো, সে মনে করতে পারলো আশরাফের কথা।আশরাফকে কবর দেয়ার সময় সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ছিলো।কবর দেয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি খালেদের শরীরে লেগে থাকা আশরাফের রক্তগুলো ধুয়ে মুছে দিলো।খালেদ আশরাফের কবরের সামনে চুপ করে বসে বসে ভাবছিল তার পরিবারের কথা।সুমনা এখন কই আছে?কি করছে?
নূরজা খালেদের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “বাবা এখন ঠিক আছো?”
খালেদ উঠে বসে, মাথা নাড়ায়।নূরজা বেগমের দিকে তাকিয়ে ভাবে তার ছেলের কথা কি করে বলবে।কিন্তু তাকে তো বলতেই হবে।সে শান্ত কন্ঠে বলে, “আমি আশারাফের বন্ধু”।
নূরজা বেগমের হাতের বাটি পড়ে যায়, চোখ দিয়ে অশ্রুর বাণ বয়ে যায়। খালেদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার কলিজার টুকরাটা কি আছে?”
খালেদ মাথা নাড়ায়, “আম্মা কাইদেন না।ও আছে এই মাটিতেই, ওরে কেউ কখনো মরে যাইতে দিবেন না।আপনি দেখে নিয়েন।একবার দেশটা স্বাধীন হইতে দেন, আমি ওর গল্প জনে জনে সব্বাইরে জানাবো।আপনি শান্ত হোন”।
কোন মাকে এসময় কে শান্ত করতে পেরেছে? আলীউল প্রতিবন্ধী, কিন্তু সে বুঝতে পারে তাই ভাই আর নেই।বোবা কান্নায় সে তার মায়ের কাছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে যায়।মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, “ভাইয়া নাই?”
নূরজা বেগম মাথা নাড়ে শুধু।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদে।ওই কান্না হয়তো আমরা দেখতে পাই, কিন্তু মায়ের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয় সন্তান হারানোর ওটা কি আমরা কখনো বুঝতে পারি?খালেদও বুঝতে পারেনা, শুধু চোখ দিয়ে খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ে।তার যাওয়ার সময় হয়েছে, বিদায় নিতে হবে।পায়ের এক পাশে গুলি লেগে সে প্রায় পঙ্গু হয়ে গেছে।এই যুদ্ধের ভয়াবহতায় তার হৃদয়ের প্রায় অংশই বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, আজকাল সে শুধু বুলেটে লেগে থাকা রক্তের গন্ধ পায়।খালেদ ঠিক করে, কালই সে রওনা দিয়ে দেবে।তাকে ঢাকা যেতে হবে সুমনাকে খুজতে।আচ্ছা ওরা কি এখনো আগামসী লেনের ২৭ নম্বর বাড়িতে আছে?খালেদের মাথা ঘুরে, সে শুয়ে পড়ে আবার।
সন্ধ্যার দিকে খালেদের ঘুম ভেঙ্গে যায় মিলিটারী বুটের ঠকঠক আওয়াজে।চোখ মেলে সে দেখতে পায় ভয়ংকর ফর্সা এক জানোয়ারের মুখ।আশেপাশে আরো দুটো জানোয়ারের পদচারণা লক্ষ্য করে সে।খালেদের হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি।সে আশেপাশে তাকিয়ে নূরজা বেগমকে খুজছিলো।মাথা ডানপাশে ঘুরিয়ে দেখতে পেলো নূরজা বেগম আলীউলকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে।এক রাজাকারকেও দেখতে পেল খালেদ।এই রাজাকারের নাম মইত্যা রাজাকার।সোনাদি গ্রামের সবাই তাকে প্রবল ভালোবাসতো।ভালোবাসার কারণ মইত্যা রাজাকার খুব সুন্দর করে পুথি পড়তে পারতো।যখন কমলা সুন্দরীর পুথি গুনগুনিয়ে সে সবাইকে শোনাতো লোকজন চোখ বড় বড় করে শুনতো, কেউ বা কাদতো কমলার দুঃখ সইতে না পেরে।মিলিটারী গ্রামে হানা দেওয়ার পর থেকে মতি মিয়ার চালচলন বদলে গেছে, সে এখন বিহারী ভাষায় কথা বলে, গান গায়।পাক জানোয়ার দেখলে উর্দু ভাষায় বলে, “সাব আচ্ছা হ্যায় হাল?”
মতি মিয়া পাকসেনাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “ইয়ে সাব আচ্ছে লোক হ্যায়।কোয়ি মুক্তি নেহি হ্যায়”।
ক্যাপ্টেন হায়দার আলী মুচকি হাসি দিয়ে নূরজা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, “আম্মাজী আপকা এক বেটা মুক্তি থা, ও মার গায়া?”
নূরজা কিছু বলেনা, তার চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ে।সে ভয়ে ভয়ে আলীউলকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
হায়দার আলী আলীউলকে দেখিয়ে বলে, “ইয়ে আপকা দুসরা বেটা হ্যায়?বাতে নেহি কারতে?”
নূরজা বেগম ভয় পেয়ে গুমড়িয়ে কেদে ফেলে।আজকে যদি এই ছেলেকেও হারাতে হয় তবে সে কি নিয়ে বাচবে?
মতি মিয়া হায়দার আলীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তো চালে সাব।ইস গাও মে কোয়ি মুক্তি নেহি হ্যায়।সাব আচ্ছা হায়”।
হায়দার আলী ভয়ংকর চোখে মতি রাজাকারের দিকে তাকায়।মতি মিয়ার চালাকি সে ভালোই ধরতে পেরেছে।এই গ্রামে আসার পথ থেকে মতি মিয়া তাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছে এই বলে যে এই গ্রামে কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই।সে চট করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।সকাল থেকে একটাও গুলি খরচ হয়নি তার।তার প্লাটুনের সৈন্যরাতো তাকে কাপুরুষ ভাববে যদি একটাও কাফের না মারতে পারে।সে আস্তে আস্তে হেটে ঘরের বাহিরে বের হয়ে আসে।চাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “উস আওরাতকো ছোড়কে সাবকো মার দো।মাতিকে সিনেমে দো গুলি চাহিয়ে”।
হায়দার আলীর দুই সৈন্য মাথা নাড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে।খালেদ তখন বিছানার উপর বসে আছে।সে সুমনার কথা ভাবে, টোকনের আদুরে মুখটার কথা ভাবে।তারপর সে দেখতে পায় দুই পাক জানোয়ার তাদের বেয়নেট উচিয়ে ধরেছে আলীউলের সামনে। নূরজা বেগম চিৎকার করে কাদে।এক সৈন্যের পায়ে ধরে আকুতি জানায়, এক মায়ের তার সন্তানকে বাচানোর আকুতি।খালেদের মাথায় দ্রুত চিন্তা ঘুরে।ভাঙ্গা পা নিয়ে সে ধপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বিছানার নিচে ঢুকে পড়ে।এরপর কেউ কিছু বুঝার আগে দুটি গুলির আওয়াজ শোনা যায় যা নিখুতভাবে দুই পাক জানোয়ারের বুকের মাঝে ছেদ করে বেরিয়ে যায়।খালেদ খোড়াতে খোড়াতে বেরিয়ে আসে বাড়ির বাহিরে।হায়দার আলী হতচকিত হয়ে তখন মুখে সিগারেট ঝুলিয়ে আছে।খালেদের চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নাই।খালেদ খুব দ্রুত হায়দার আলীর কাছে পৌছিয়ে তার রাইফেলটা তাক করে মাথা বরাবর।হায়দার আলী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।মতি মিয়া তখন খালেদের পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলছে, “হালায় এখন ইন্দুরের লাহান কাপতেছে”।
হায়দার আলী আসলেও কাপছিলো, সে বুঝতে পারছিলোনা কি করবে।এই তো মৃত্যু তার সামনে।খালেদ ভাঙ্গা গলায় বলে, “One day this country will be independent, one day the people of this country will breath in the air.But you Pakistani bitches will never be able to breathe in your lifetime.The curse of life will never stop haunting you”
শুকনো বাতাসে একটা গুলির আওয়াজ হয়, হায়দার আলী গড়িয়ে পড়ে মাটিতে।তার সারা মুখে প্রচন্ড যন্ত্রণার চিত্র দেখে খালেদের আরো ঘৃণা হয়।সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘরে ঢুকে।নূরজা বেগমের পাশে যেয়ে বসে।নূরজা বেগমকে বলে, “আম্মা কিচ্ছু হয়নাই।সব ঠিক আছে।এখন গোছগাছ করেন তাড়াতাড়ি, আমার সাথে ঢাকায় যাবেন।সময় বেশি নাই, তাড়াতাড়ি ভাগতে হবে”।
যুদ্ধের বাকি চার মাস নূরজা বেগম ঢাকার আগামসী লেনের ২৭ নং বাড়িতে যেয়ে থাকে।ওটা খালেদের বাড়ি, কিন্তু খালেদ তাদের সাথে থাকেনা।খালেদ নাওয়া খাওয়া ফেলে তার ভাঙ্গা পা নিয়ে যুদ্ধের শ্বাপদশঙ্কুলতা ভুলে গিয়ে তার আত্নার বাধন খুজে বেড়ায়, কোথাও সে তাদের খুজে পায়না।কোথাও না।সুমনা আর টোকন যুদ্ধের ভয়াবহতায় হারিয়ে গেছে নাকি সে বুঝে উঠতে পারেনা।মাঝে মাঝে সে তার বাসায় এসে ওদেরকে খুজে।নূরজা বেগম খালেদকে বোঝায়, সান্তনা দেয়।কিন্তু খালেদ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।সে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে রাস্তায় যায়, হঠাৎ হঠাৎ রাস্তায় বসে পড়ে।গড়াগড়ি খায়, কান্না করে চিৎকার করে।তখন যুদ্ধ চলছে, তখন মানুষ মৃত্যর গন্ধ বাতাসে শুকে বেড়াচ্ছে।খালেদের সরব কান্না কেউ দেখতে পায়না, কেউ না।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর চারদিকে যখন নতুন পাখির ডাক শোনা যায় খালেদ তখন বাসায় ফিরে আসে।জানুয়ারীর ২২ তারিখের এক সন্ধ্যায় যখন খালেদ তার বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন মাগরিবের আযান দিচ্ছে।খালেদ দরজা ঠকঠক করার আগেই নূরজা বেগম দরজা খুলে দেয়।খালেদকে দেখে সে হাসে, তার হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে।খালেদের মাথায় হাত দিয়ে বলে, “বাবা তোমার মাথাটা একটু ঠান্ডা করে বসো।আজকে তোমার একটা বিশেষ দিন।একবারে উত্তেজিত হয়োনা।ওই দেখো তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে”।
খালেদ আস্তে আস্তে মাথে তুলে তাকায়।তার সামনে সুমনা আর টোকন দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে।টোকন, তার আদুরে ছেলেটা মায়ের আচল ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে তার বাবাকে দেখছে।টোকন কি একটু ভয় পাচ্ছে নাকি খালেদ জানেনা।খালেদ হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে।সুমনা খালেদের কাছে ছুটে আসে।তার চোখে অশ্রু টলমল করে অভিমানের কাব্য লিখে।সুমনা তার সবচেয়ে কাছের মানুষের সবচেয়ে কাছে যেয়ে বলে, “তুমি কেন আসোনি আমাকে খুজতে?”
খালেদ তখন কিছু শুনতে পায়না।সে দু হাত বাড়িয়ে রাখে সুমনা আর তার সন্তানের জন্য।কেউ তার কাছে আসেনা এক পলকের জন্য।একটু পর খালেদের বুকটা ভরে যায়,তার আত্না পূর্ণ হয় কাছে মানুষের গায়ের গন্ধে।কত যুগের কত অপেক্ষা শেষ হয় এই আবদ্ধ বাহু গাথুনীতে তা কি কেউ বুঝতে পারে?নূরজা বেগম চেয়ে চেয়ে এই পবিত্র ভালোবাসার রুপ দেখে।তার চোখ দিয়ে অন্যরকম অশ্রু বয়ে যায়।নামাজের সময় চলে যাচ্ছে, তাই সে নামাজে বসে।নামাজ শেষ মোনাজাতে হাত তুলে পরম করুণাময়কে জিজ্ঞাসা করে, “আমার সন্তানকে ভালো রেখেছো কি খোদা?”
নূরজা বেগম আবার ফিরে আসে তিস্তার পাড়ে।তার জীবনের শেষ সময়টুকু এইখানেই সে কাটিয়ে দিতে চায়।বিকেলের মিঠা হাওয়ায় সে তিস্তার শোভিত রূপ উপভোগ করে।হঠাৎ করে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় সে তার স্বামী আসফাক আলীর গন্ধ শোকার চেষ্টা করে।বৃথা চেষ্টা।সেই কত কত বছর আগে তার প্রিয় মানুষটিকে সে হারিয়েছে, এরপর তার আদরের সন্তানটাও কোথায় যেন আজ।স্মৃতির পাতায় সে হাতড়ে বেড়ায় তার ভালোবাসার মুখগুলিকে।যারা তিস্তার পাশ দিয়ে হেটে যেতো, তারা অবাক হয়ে এই বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকতো।জ্বলজ্বলে চোখে এই বৃদ্ধা বিশাল পাকুড় গাছের নিচে বসে কি যেন খুজতো।কেউ তার কাছে যেতোনা।
নূরজা বেগমকে খালেদ একটা চিঠি দিয়েছিলো, আশরাফের চিঠি।আশরাফ এই চিঠিটা তার মাকে লিখেছিলো।নূরজা বেগম চোখে দেখতে পায়না ঠিকমত, তবুও সে বারবার শত কষ্ট হলেও চিঠিটা পড়ে।আশারাফের চিঠিতে লিখা ছিলোঃ
“মা আমার মা, তোমাকে কত ভালোবাসি আমি তা এই দূরে এসে বুঝতে পারি।মা একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি কখনো, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম।সে ভালোবাসতো কিনা জানিনা।মেয়েটার নাম ছিলো নাসরিন।আমি তাকে একটা বিশাল চিঠি লিখে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম।মা জানো, মেয়ে ওই চিঠি পেয়ে আর আমার সামনে কখনো আসেনি।আমাকে দেখলে দূর থেকে কেমন করে জানি হাসতো, তারপর ভেগে যেত।
মা আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো।আমি তোমাকে বলার সাহস পাইনি, আর বললে তুমি কি আমায় আসতে দিতে যুদ্ধে?মা এই যুদ্ধে যদি অনেকের মত হারিয়ে যাই, তাহলে শুধু একটা কষ্টই থাকবে মনে।তোমার কোলে আর শুয়ে থাকতে পারবোনা, তোমার মাখানো ভাত খেতে পারবোনা।মা আমি এখন ঠিকমত দু বেলা খেতে পাইনা, কিন্তু যখন খাই তখন বারবার মনে করি যে এই ভাতটা তুমি রাধছো, তখন আমার পেট ভরে যায় মা ওই পোকায় ভরা ভাত খেয়েও।মা বিশ্বাস করো এই যুদ্ধটা করি তোমার জন্য।স্বাধীন দেশের লাল সূর্যের ছায়া যখন তোমার প্রিয় তিস্তার জলে পড়বে তখন তোমার থেকে বেশি কে সুখী হবে বলো তো?মা আমার ভাইটাকে দেখে রেখো, ওকে অনেক মনে পড়ে।ওকে যেভাবেই হোক একটা গান শিখায় দিয়ো, দেশের একটা গান।আমি ফিরে আসতে চাই মা, যুদ্ধ আর ভাল লাগেনা।তোমাদের পাশে বসে আমি আবার দুপুরে পেট ভরে ভাত খেতে চাই, তোমার কোলে শুয়ে শুয়ে ছোটকালের গল্পগুলো আবার শুনতে চাই।মা কবে ফিরে আসতে পারবো আমি জানিনা।কিন্তু হয়তো সেটা বেশি দেরী নেই।আমি ফিরে আসবো মা তোমার কাছে দেখো”।
নূরজা বেগমের মনে এই চিঠি পড়ে আশার উদ্রেক হয়।এই বুঝি তার ছেলে ফিরে এলো, এই তো তার দুরন্ত ছেলেটা মনে হয় দৌড়িয়ে তার দিকেই দু হাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে। নূরজা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিস্তার পাড়ে বসে তার ছেলের জন্য সিন্ধুসম ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করেছে।সূর্য ডুবেছে, আবার হাজির হয়ে প্রভাত রাঙ্গিয়েছে।কিন্তু দেশের সূর্যসন্তান তার মায়ের বুকে ফিরে আসতে পারেনি।আসুন মাকে ভালোবাসা জানাই।
********************************************************************
বিশাল ঝামেলা করে গল্পটা লিখা শেষ করলাম। শেষ করতে পারলাম বলে যারপরনাই খুশি।গল্পটা লিখার সময় বারবার মনে হয়েছে, ওই সময়টা কি ধরতে পেরেছি? উত্তর পেয়েছি না না এবং না।সেই স্নিগ্ধ সময়টা উপলব্ধি করার সামর্থ্য আমার মত ছোট্ট লেখকের নেই বোধহয়।তবুও আশা রাখি একদিন হয়তো পারবো।আমি সেই একটি বিশেষ দিনের অপেক্ষায়।