ফাহিম নাকি আমাকে বেদম খোঁজা খুঁজিতেছে। পাইতেছে না;এমন বক্তব্য বেটার। আমি অবশ্য গত রমজানে বিরাট এক কাজে মত্ত ছিলাম। সাধারণভাবে উহাকে বলা যায় গবেষণা। সৈয়দ মুজতবা আলীর গবেষণা নহে। তাহার ভাষায় বাঙালীর গবেষণা মানে তিনখানা বই সামনে লইয়া একখানা বই লিখিয়া ফেলিলেই গবেষণা হইয়া যায়। আমি অবশ্য সেই রকম গবেষণা করি নাই। আমি করিয়াছি সরেজমিনে গবেষণা। ইহা নিয়া থিসিস করিব। এমনই ইচ্ছা আছে সুযোগ পাইলে এই বিষয়েই পিএইচডি করিয়া ডক্টরেটটা হাতাইব। কানে কানে বলিয়া রাখি, এই কারণে ফাহিমকে সাথে নেই নাই।
বাঙালীর রমযান। হ্যাঁ, আমার গবেষণার বিষয় এইটা। এই গবেষণাতে নামিয়া আমি যেইসব তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা অনেকের কাছে পুরাতনই মনে হইবে। ব্যাপারখানি হইল,জামা-প্যান্টে তো পকেট থাকেই। সবাই জানে, ব্যবহার করে। কিন্তু এই পদ্ধতিটাও তো কোন না কোন ব্যাটা আবিষ্কার করিয়াছে। তাই না? মানুষ সেই জন্মের পর হইতেই অক্সিজেন গ্রহণ করিয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড বর্জন করে। তথ্যখানি আবিষ্কার হওয়ার আগেও এই কাজ করিত,পরেও করে। তাহারপরেও যাই ব্যাটা ইহা আবিষ্কার করিয়াছে তাহার মূল্য তো আর কম নয়। আমার গবেষণার ধরণটাও মোটামুটি এই রকমের।
আমার গবেষণার বিষয় ছিল রমযানে বাঙালীর সংযম। সত্যি বলতে কি,এই জাতির সংযম দেখিয়া আমি হতভম্ব। এই জাতির সংযম বড়ই আশ্চর্য প্রজাতির। সংযম করিয়া কিভাবে তাহা পোষাইয়া লইতে হয় এই ব্যাপারে বাঙালীর ধারে-কাছে কেউ আছে বলিয়া মনে হয় না। বিশেষ করিয়া বাঙালী নারীদের সারাদিন কাটিয়া যায় রান্নাঘরে। সেই সকাল হইতে যে ইফতারী বানাইবার চিন্তা আর প্রক্রিয়া চলিতে থাকে তাহাতে নামাজ-কালাম সব শিকায় উঠে। নামাজ-কালামের সময় তাহাদের নাই। আবার ইফতার সারিয়াই সাহরীর প্রস্তুতিতে তার রাত গড়ায় বহুখানি। বসিয়া যে একবার আল্লাহর নামখানা লইবে সেই ফুরসৎ হইবার ঘটনা আমার রাডারে ধরা পড়ে নাই।
রমযান বলিয়া কথা। ইফতার-সাহরীও তো রোযার অনুষঙ্গ। কিন্তু আমি এইবার গবেষণায় নিশ্চিত হইলাম, ইফতার-সাহরী লইয়া বাঙ্গালী রমণীরা এত ব্যস্ত থকে যে, তাহদের শতকরা ৯৮% ইফতারী ও সাহরীর দোয়া পড়া ও নিয়ত করিবার সুযোগ পায় না। এমনই তাহদের ব্যস্ততা! যাহাই হোক, ইহা তো গেল আয়োজন আর আয়োজকের কথা। আর খাদকদের দেখিলে কোনভাবেই মনে হয় না যে, ইহা সংযমের মাস। বরং মনে হয় এই মাসের তুলনায় অন্য মাসগুলি বরং বেশি সংযমের ছিল। সামনে পাঁচ পদের শরবত-পানীয়, ছয় পদের ফল, সাত পদের চপ, বুট,মুড়ি, ফিরনী,হালিম; সব মিলাইয়া তাহাদের কিঞ্চিত আয়োজন! মানে আইটেম ১৫/২০ খানা দেখা না গেলে পেট ভরুক আর না ভরুক মন কিছুতেই ভরে না। মনে হয় সংযমের মাসে এত কষ্ট করিয়া রোযা রাখিবার কোন মানে আছে। আর সাহরী। তাহেতে মাছ-গোশত,ভাজি,ভর্তা,ডাল,ঘি,দুধ, কলা ইত্যাদির ছড়াছড়ি না থাকিলে, ছোট-খাট বিবাহের আয়োজনের মত না মনে হইলে ইহাকে সাহরী নাম দেওয়াটাই বৃথা। প্রয়োজনে অনেকে আযানের পরেও খাইয়া সাহরীর সার্থকতা পূর্ণ করিয়া ছাড়ে। তাহাদের খানাপিনা দেখিলে মনে হয় সামনে বড়সড় জাতের কোন বিপর্যয় আসিতেছে। মাস ছয়েক আর কোন খানাপিনা পাওয়া যাইবে না অথবা পাওয়া গেলেও খাইবার ফুরসৎ পাওয়া যাইবে না। রমযানের প্রথম দিন কেউ এই প্রকারের খানাপিনা দেখিলে মনে করিবে অন্তত সারা মাসের জন্যই বোধ হয় সাহরী খাওয়া হইতেছে। সেই মহান লক্ষ্য নিয়া খাইয়া ফেলা। কিন্তু দিন পার হইবার আগেই ইফতারিতে সেই ১৫/২০ আইটেম। বাঙালীর রমযান বিষয়ক খানাপিনা সংক্রান্ত সংযম বলিয়া কথা। :-&
এই গবেষণায় আরেকটি অবাক হইবার মত তথ্য পাইলাম। তাহা সোনার পাথর বাটি নহে। তাহা হইল পিয়াজু, বুট ,মুড়ি। আমি অবাক হইয়া ভাবি, বাঙালীকে এই পদের ইফতারী খাওয়া শিখাইল কে বা কাহারা?! পিয়াজু,বুট,মুড়ি না খাইলে বাঙালীর ইফতারী হয় না। রোযাটা যেন তাহাদের খুলিতেই চায় না। এক ইফতার মাহফিলে ছোলাবুট কিছুটা টান পরায় এমন অবস্থা হইল যেন বিবাহের আসর হইতে কনে পালাইয়া গিয়াছে। এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড।
যাহা থিসিসে আলোচনা করিতেছিলাম, রমযানের সংযমের কথা। সংযমের ইফতারী যে কত শাহী হইতে পারে তাহা চকবাজার,বেইলী রোড,কলাবাগান ইত্যাদি এলাকায় গেলে অনুমান করা যায়। আর কিঞ্চিত অনুমান করা যায় রমযান মাসে দুধ সাপ্লাইয়ের গাড়ি দেখিলে, আর কিছুটা বিস্তারিত দেখা যাইবে বাজারে। ৫ টাকার বেগুন ১০০ টাকা, তবুও কাস্টমারের অভাব নাই। এত দামে তরকারী, মাছ, গোশত; মাগার পরের দিনের জন্য কিছুই তো পড়িয়া থাকে না। কী আজব একখানা দেশ! কী আজব তাহার রমযানীয় সংযম!!
ঈদের মার্কেটিয় সংযম নিয়াও একখানা অধ্যায় আমার গবেষণায় আছে। তবে আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি তাহেতে যে পরিমাণ বিষয়বস্তু আছে তাহা নিয়া অনায়াসে পাঁচ-পাঁচখান থিসিস হইয়া যাইতে পারিবে,এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ব্যাপক তাহা। সামান্য কথায় উহাদের আলোচনা এইভাবে আনা যায় যে, অনেক পরিবারেই একেকজনকে ৫/৭টার কম পোশাক দেওয়ার অর্থ তাহাকে চরমভাবে অবহেলা ও অপমান করা। কারো কারো ক্ষেত্রে তো ইহার সংখ্যা ২৫ও ছাড়াইয়া যায় অবলীলায়।
ঈদ মার্কেটিংকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। ইফতারপূর্ব মার্কেটিং, ইফতার পরবর্তী মার্কেটিং। মার্কেটিংও আমাদের দেশে চলিতেছে আজব এক সিস্টেমে। দাম শুনিয়া অনেকে বেজার হইয়া পড়ে। পোশাক কিনিতে চায় না। না, না। দাম বেশি হইবার কারণে নহে। দাম কম হইবার কারণে। এত কম দাম দিয়া পোশাক কিনিলে সাবার কাছে কি গল্প করা যাইবে! ফলে ৫০ টাকার এক গজ কাপড় দিয়া বানানো ফতোয়া ৪০০-১০০০ টাকায় কিনিতেছে অবলীলায়। শাড়ির মূল্যতো তার ১২ হাতের সীমানা পার হইয়া যে কোথায় চলিতেছে তাহা ধারণা করিয়া বেড় পাইবে এমন সাধ্য কাহার? আর জামার কথা বাকি কি বলিব? কোথায় জামা, কেবলই কড়কড়ে টাকার ছড়াছড়ি। এত্তো টাকা! এইগুলি গুনিবার সাধ্য আমার মত গরীব-সরীব লোকদের কোথায়? স্রেফ অক্কা পাইবার যোগাড়। ধারণা করিয়া বলিতেছি না। একদিন আমি একটু ট্রাই করিয়াছিলাম, দেখিলাম আমার যোহরের ওয়াক্তেই ইফতার করিবার যোগাড় হইয়াছে। মার্কেট হইতে দৌড়াইয়া বাহির হইয়া রোযাটাকে কোনমতে রক্ষা করিয়াছিলাম। ফলে শেষ দিকে দামী গ্লাস লাগানো মার্কেটগুলোতে একটু কমই যাইতাম। গবেষণাকর্ম যাহাই হউক রোযাটাকে তো আগে বাঁচাইয়া রাখিতে হইবে। দায়টাতো আমারই। আপাতত ইহাই হইল রমযানীয় পোশাকীয় সংযম বা ঈদীয় মার্কেটীয় সংযম।
অবশ্য তাহারা যে সংযম পালন করে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি ঈদের দিন। ঈদের সারাটা দিন তাহারা আমার কানের পর্দা যেই হারে ফাটাইয়াছে ইংলিশ আর হিন্দী গান দিয়া, চোখের পর্দা ফাটাইয়াছে বাহারি পোশাক দিয়া, তাহাদের খানাপিনা করিবার আর তাহা নষ্ট করিবার বাহার দেখিয়া আমার মনে হইয়াছে তাহারা আমার চক্ষুর অভ্যন্তরে অঙ্গুলি প্রেরণপূর্বক বুঝাইয়া দিয়াছে,বুঝ ব্যাটা; রমযানে কত সংযম পালন করিয়াছি। একা ভাবিয়াছি 'আগিলা রে আগিলা কত ভালা আছিলা'। সত্যই তো ইহার তুলনায় তো তাহাদের সংযমের মাত্রা তো রমযানে অনেক বেশিই ছিল।
আসলে অসুবিধাটা হইয়াছে আমার, আমি একা একা গিয়াছি গবেষণা করিতে। যদি ফাহিম থাকিত তাহা হইলে বোধ হয় এতটা সমস্যা হইত না। ভবিষ্যতে অবশ্য একাকী থিসিস করিতে যাইব না। ফাহিমকে সাথে লইব।