নগণ্য কাঠের চেয়ারটিকে মহাআরামের রকিং চেয়ার বানাইয়া তাহাতে ফাহিম তাহার বিখ্যাত 'দোল' খাইতেছে। আমি তাহার কাছে অবস্থান নিলাম। খানিক পর বলিলাম, দোস্ত রমজান তো আসিতেছে। কি চিন্তা করিতেছিস?
জিনিসপত্রের দাম বাড়িবে হু হু করিয়া। কোন কিছুতেই হাত দেওয়া যাইবে না। কিন্তু পেট তো বসিয়া থাকিবে না। সুতরাং হাত দিতেই হইবে। আবার হাত দিলে বরফ দেয়া মাছ ধরিলে কিংবা ফ্রিজে রাখা দুধের দাম জিজ্ঞাসা করিলেও হাত কিংবা অন্তর পুড়িবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। কাঁচা মরিচের যেই ঝাল বাহির হয় তখন, আর বেগুনের কদর যে কি পরিমাণে বাড়িয়া যায় তাহা তো তুইও জানিস। সেই কারণেই কি করিব ভাবিতেছি। আর সেই হিসেবেই প্রস্তুতি নিতেছি।
আর ?
প্রস্তুতি নিতেছি ঢাকার যানজটে কি করিব সেই বিষয়ে । কারণ রমজানে ঢাকা শহরে ৬ ঘণ্টা বাদ দিয়ে বাকি ১৮ ঘণ্টাই যানজটে আটকা পড়িয়া থাকিবে। সুতরাং কিভাবে সেই যানজটে না এড়াইয়া এবং নিজেকে তাহার সঙ্গে সহনশীল করিয়া তোলা যায় সেই প্রস্তুত নিতেছি।
আর?
আরও প্রস্তুতি নিতেছি রমজান মাস আসিলেই কেউ কেউ চরম ভণ্ডামি শুরু করেন। তাহারা সারাদিন ভরপেট খাইয়াও বড় বড় ইফতার মাহফিলের নামে চরম অপব্যয় করিয়া অগ্নিমূল্যের বাজারে আরো খানিকটা ঘি ঢালিয়া দেন। আর ইফতার মাহফিলে আল্লাহ রাসূলের নাম না নিয়া তাহাদের অব্যক্ত যত কথাই সবই ঢালিয়া দেন। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে এই রকম কিছু দাওয়াত পাইয়াই যাই, তাহা হইলে কিভাবে সামলাইব সেই বিষয় নিয়াও কিঞ্চিত চিন্তিত আছি।
আর...?
আর রমজান মাসে তো শয়তানকে আটকাইতে রাখা হয়, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। ছোট বেলাতে এই কারণে শান্তিতেই দিন কাটাইতে পরিয়াছিলাম। কিন্তু ইদানীং বোধ হয় শয়তান রোযার মাসের জন্য মানুষের মধ্যেই তাহার স্পেশাল কিছু শাগরেদ তৈরি করিয়া গিয়াছে। আর সেই চেলারা রমজানের সংযম বাদ দিয়া, বেপর্দা হইয়া রাস্তাঘাটে-মার্কেটে যে কি পরিমাণ ঘুরাঘুরি করে তাহার ভিতর দিয়া কিভাবে যে পথ চলিব, মাসখানা কিভাবে কাটাইব ইহা নিয়াও প্লান-প্রোগ্রাম করিতে হইবে ভাবিতেছি।
শেষ?
আরে না, রোযার মাসটা কোনভাবে কাটাইবার পরই যে ঈদের দিন বিকট শব্দে হিন্দি-ইংরেজি গান আমাদের কর্ণগুলিকে ফাটাইবার চরম প্রতিযোগিতার নামে তাহাদের এই প্রতিযোগিতা হইতে নিজেদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বিকল্পহীন মাত্র দুইখানা কর্ণকে কিভাবে বাঁচাইয়া রাখিব সেই বিষয় নিয়াও কম চিন্তিত নই। বাঁচিতে হইলে ইহারও একখানা প্রোগ্রাম এখনই করিয়া ফেলিতে হইবে।
তাহার পর আর কিছু?
হ্যাঁ, কয়েক বছর ধরিয়া লক্ষ্য করিতেছি, রমজান মাস আসিলেই আমাদের টেলিভিশনগুলিতে উপস্থাপিকা খবর পাঠিকারা মাথার উপর সামান্য পরিমাণে কাপড় উঠাইয়া দেন। ইহাতে আমাদের কোন কিছু যাইত আসিত না। কিন্তু তাহাদের কয়েক বছরের শিডিউল খেয়াল করিয়া দেখিলাম তাহাদের এই মাথার কাপড় দিবার বিনিময়েই বোধ হয় ঈদের দিন হইতে ৫ দিন ৭ দিন ধরিয়া বিশাল অনুষ্ঠান দিয়া ঘরবাড়িগুলিকে একখানা মিনি সিনেমা হল বানাইবার প্রতিযোগিতা চালান। ইহা কিভাবে কি করা যায় সেই বিষয়েও তো কিছু চিন্তা করতে হয়।
আর...?
হ্যাঁ, এই রকম আরও কিছু আছে। রমজান মাস আসিলেই আমাদের বিনোদন জগতে শুরু হয় বিরাট ও বিশাল মাত্রার প্রচারণা- পবিত্র ঈদে শুভমুক্তি পাইবে...ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষয়টা তো তুই বুঝিতে পারিতেছিস। রমজানে আর ঈদকে তাহারা তাহাদের এই কাজের জন্য 'পবিত্র' বানাইতেছে।
ইহারও তো একখানা গতিক করিতে হয়। তাই কি করা যায় এই নিয়া ব্যস্ত আছি।
আর...?
হ্যাঁ, আরো রহিয়াছে। বছরে দুই একবারই বাড়িতে যাওয়া হয়। বাসওয়ালা,লঞ্চওয়ালারাও সুযোগ বুঝিয়া সারা বছরের ইনকামের কাজটা তখনই মিটাইয়া ফেলিতে চায়। সেই চরম ও পরম মুহূর্তে নতুন আরেকখানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে টিকিটখানা তুলনামূলক সহজে ও সুলভে সংগ্রহ করা যায় সেই বিষয়েও একখানা ফাইল তৈরি করিতে হইবে,
আর কিছু?!
হ্যাঁ, রমজান মাসে মাঝে মধ্যেই অনিয়মিত শৌখিন নামাজিদের ধাক্কায় মসজিদে জায়গা পাওয়া মুশকিল। এমনই অবস্থা তাহারা সৃষ্টি করে যে, যদি জায়গা পাইতেই হয়, তাহা হইলে এক ঘণ্টা আগে গিয়া সিট লইতে হইবে। ইহাও আমার বর্তমান চিন্তা-ভাবনার একখানা কর্নার দখল করিয়া আছে।
আর?!!
হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কিছু ধনবান তাহাদের ধনের ফ্রি বিজ্ঞাপন দিবার জন্য জাকাতের লুঙ্গি, শাড়ি, বিতরণের ঘোষণা দেন। তাহাদের বিজ্ঞাপন হইয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞাপন শেষে দেখা যায় কীটপতঙ্গের মতো কিছু মানুষ মরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। জাতিকে এই ভণ্ডামি হইতে রক্ষা করিবার কোন পথ আছে কিনা তাহা চিন্তা করিবার ভাব তো আমারও কিঞ্চিত রহিয়াছে।
এবার তো তাহা হইলে শেষ?
আরে না, এত সহজেই শেষ হইবে কিভাবে?মাঝেমধ্যেই তো আতঙ্কে থাকিতে হয় ঘুমের মধ্যেই ঈদ কি আগাইয়া আসে, নাকি পিছাইয়া যায়। সেই সাথে রমজান কি আদতে ২৯ খানা, নাকি ৩০ খানা, নাকি ৩১ খানাই রাখিতে হইবে, তাহা নিয়াও মাঝেমাঝে কিছু টেনশন রাখিতে হয়।
তাহার কথা শুনিতে শুনিতে আমি নিজেই ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। বলিলাম, ফাহিম তোর এই সব চিন্তা-ভাবনা তো রমজান মাসকেন্দ্রিক। তাই না?
আলবত তাই।
আচ্ছা ফাহিম, রোজার নিয়ত যে করিতে হইবে, তোর নিজের রোজা রাখিতে হইবে, সেই বিষয়ে কি কোন চিন্তাভাবনা আছে তোর?
আরে বেদনা তো সেইখানেই। রোজা নিয়া আর চিন্তা করিতে পারিলাম কই? দোস্ত আমার জন্য খানিকটা দোয়া করিস তো যেন শেষ মুহূর্তে গিয়া রোযার নিয়ত করিতে ভুলিয়া না যাই।
আবার দোল খাওয়া শুরু করিল ফাহিম। আমি বাহির হইয়া আসিলাম। সত্যিই তো, রমজান আসিলে সাথে সাথে এতগুলি চিন্তাও মাথায় আসিয়া উপস্থিত হয় যে, রোজার কথাই চিন্তা ভুলিয়া যাইতে হয়। সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমার মুখ দিয়া ফের উচ্চারিত হইল, হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!