নিতুকে কখন প্রথম দেখি মনে নেই। সম্ভবত আলম ভাইয়ের দোকানে চা খেতে খেতে তাকে দেখেছিলাম। নিশ্চিত নই কারণ মানুষের মন রহস্যময়। কাউকে নিয়ে একটানা ভাবতে থাকলে এক ধরণের কৃত্রিম স্মৃতির জন্ম হয়। বেশিরভাগ মানুষ সে স্মৃতির অসারতা ধরতে পারে না। আমি পারি কারণ আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র।
মানুষ হিসেবে আমাকে খুব সাহসী বলা যাবে না। কথাবার্তা কম বলি বলে আশেপাশের মানুষ আমাকে বেশ অহংকারী মনে করে। তাদের ভুল ভাঙ্গানোর তেমন ইচ্ছেও আমার নেই। জীবনের কোন বিষয় নিয়ে আমার খুব একটা উচ্ছ্বাস নেই। কেবল বিকেলে আলম ভাইয়ের দোকানে নিয়ম করে বসা ছাড়া। রাস্তার দিকে যখন ঘন ঘন তাকাই তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন দ্রিম দ্রিম করে। ঠিক চারটা দশে মোড়ের বাঁক পেরিয়ে হেঁটে আসে নিতু। আমি ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি। তার সময়ের নড়চড় হয় না।
মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার অনেক বিপদ। এলাকার মানুষের কড়া দৃষ্টি থাকে ছাত্রদের উপর। পান থেকে চুন খসলেই তাদের পিন্ডি চটকানো হয়। বিশেষ করে এলাকার সুন্দরীদের ব্যাপারে তো কথাই নেই। বন্ধু রোমান কবি মানুষ। তার প্রিয় কবি আবার কাজী নজরুল ইসলাম। গুরুর অনুপ্রেরণায় কী না সে নিয়ম ভাঙ্গতে চেয়েছিলো। মেস মালিকের মেজ মেয়েকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলো একশো চোদ্দ লাইনের কবিতা। ফলাফল তাকে ‘সাইজ’ করে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো পাড়ার ভাইয়ারা। নিতুর বাবা এলাকার বেশ প্রভাবশালী মানুষ। পাড়ার মোড়ে তার মেয়েকে প্রোপোজ করলে হয়তো আমাকেও হাসপাতালে পাঠানো হবে। কাজেই ভালোবাসা মনে পুষে বিকেলের অপেক্ষা করাটা ছিল বুদ্ধিমানের কাজ।
এভাবেই হয়তো বিকেলগুলো কেটে যেত। কাকপক্ষীকেও জানতে দিতাম না বুকের ভেতর জন্মানো ভালোবাসার কথা। একদিনের কথা। দোকানে বসে চার-পাঁচ কাপ চা গেলার পরও নিতু এলো না। চিন্তিত হলাম। ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে চারটা। আরো এক ঘন্টা বসে থেকে মেসে ফিরে গেলাম। নিজেকে বোঝালাম নিশ্চয়ই কোথাও বেড়াতে গেছে সে। কাল বিকেলে ফিরবে।
রাতের বেলা খেতে পারলাম না। বুয়ার রাঁধা অখাদ্যে পানি ঢেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভালো হলো না। সকালের ক্লাসটা মিস হলো। ভার্সিটি গিয়ে কী হবে? আমার মাথায় কেবল ঘুরঘুর করছে নিতুর মুখ। ছোট ছোট পদক্ষেপে তার হেঁটে আসার ছবি। আগে আগে গিয়ে বসলাম আলম ভাইয়ের দোকানে। নেই! আজকেও সে নেই। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। দোকানের বেয়ারা ছোকরাটাকে অকারণে বকাবকি করলাম। আছাড় দিয়ে ভাঙলাম চায়ের কাপ। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো। রুমমেট নাহিদ ব্যাপারটা খেয়াল করলো। শরীরের অবস্থা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এই ছেলেটাকে আমি বেশ পছন্দ করি। কিন্তু নিতুর কথা তাকে বললাম না। কী দরকার! এই প্রেমের কথা শুনলে নির্ঘাত মুখ টিপে হাসবে ছেলেটা। তারপর খবরটা ছড়াবে ইতিউতি। গা জ্বালানো মন্তব্যে শেষে ক্যাম্পাসে টেকাটাই দায় হয়ে যাবে।
এক সপ্তাহ কেটে যাবার পরও নিতু এলো না। আমি রীতিমতো জ্বর বাধিয়ে বসলাম। তিনবেলা প্যারাসিটামল খাই আর বিকেলে বসে থাকি মোড়ের দোকানে। বন্ধুবান্ধবেরা কানাকানি করতে লাগলো। কে যেন বাড়িতে খবরও দিয়ে দিলো। দাদী ফোন করে কান্নাকাটি করতে লাগলো। মা মরা ছেলে আমি। দাদীই মানুষ করেছেন। তাঁর ধারণা আমাকে নির্ঘাত জ্বীনে ধরেছে। হুলাশুগঞ্জের সেকেন্দার হুজুরের পানিপড়া বোতলে ভরে পাঠিয়ে দিলেন।
নিতুর কথা আর গোপন রাখতে পারলাম না। মাঝরাতে তাকে দেখতে পেলাম। লাল রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরে সে হেঁটে আসছে মেসের উঠোন পেরিয়ে। মুখে একটা অস্ফুট হাসি। যেন বনলতা সেনের মতো এসে বলবে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?” নিতু কাছাকাছি আসতেই আমার চারপাশটা কেমন দুলে উঠলো। পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো অকস্মাৎ। জ্ঞান ফিরে দেখি ঘরের লাইট জ্বালানো। আমার চারপাশে অনেকগুলো উদ্বিগ্ন মুখ। আমার মাথার নিচে পলিথিন বিছিয়ে নাহিদ মগ ভর্তি করে পানি ঢালছে। কেউ কেউ মাথায় হাত রেখে জ্বর মাপার চেষ্টা করলো। স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে আস্তে আস্তে উদ্বিগ্ন মুখেরা বিদায় নিলো। জ্বরে ছটফট করছি আর নাহিদ মাথায় পানি ঢেলেই চলছে। চারপাশে কোন শব্দ নেই। সময়টা যেন স্থির হয়ে আছে।
“নিতু কে ভাই?”, নীরবতা ভাঙে নাহিদ। চমকে উঠি তার কথায়।
“নিতু নিতু বলে ডাকছিলেন অনেকবার। তাই বললাম।” অগত্যা পুরো ঘটনা তাকে খুলে বলতে হলো। মুখে একটা মুচকি হাসি ঝুলিয়ে নাহিদ আমার কথা শুনে গেল। একবারের জন্যও আমাকে থামালো না। “তাহলে এই ব্যাপার!”, অবশেষে বললো সে। “এই জ্বর তো ওষুধে সারবে না। আচ্ছা আজকে লম্বা একটা ঘুম দেন। কালকে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।” বুকের উপর থেকে খুব ভারী কিছু একটা যেন নেমে গেল। অনেক রাত পর নির্বিঘ্ন ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরের দিন ঘুম ভাঙ্গলো বেলা করে। জ্বর সেরেছে। ততক্ষণে নাহিদ সকালের ক্লাস করে রুমে ফিরে এসেছে। একসাথে নাস্তা করে দুজনে বসলাম কী করা যায় ভাবতে। নাহিদ বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। আধঘণ্টার ভেতর করণীয়ের একটা তালিকা বানিয়ে ফেললাম দুজনে। সমস্যা হলো বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে হবে আমাকে। উপায় নেই। পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া!
তালিকার শীর্ষে আছে নিতুদের বাসায় গিয়ে হাজির হওয়া। মানে বাঘের গুহায় ঢুকে সরাসরি বাঘ কন্যাকে প্রেমনিবেদন করতে হবে। ব্যাপারটা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলাম ততটা হলো না। নিতুদের পাশের বাসায় রোমান টিউশনি করে। তার কাছে শুনলাম নিতুর ছোটবোন মিথিলার জন্য ম্যাথস টিউটর খোঁজা হচ্ছে। একদম মেঘ না চাইতেই জল! গণিতের নাম শুনলে আমার জ্বর আসে। উপায় নেই। মিথিলা হিব্রু শিখলে আমি তাই শেখাতাম।
নিতুদের বাসার সামনে গিয়ে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লাম। কলিংবেল চাপার পর দরজা খুলে দিল তার মা। রোমান পাঠিয়েছে বলতেই ভেতরে আসতে বললেন। বসার ঘরে অপেক্ষা করতে করতে ঘেমে গোসল হয়ে গেলাম। মিথিলা এলো। ক্লাস এইটের গণিত বই নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। অংক করাই আর ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি নিতু এলো। পাশের ঘরে খুটখাট শব্দ হলে ভাবি সে বুঝি হাঁটছে। দুরুদুরু বুকে প্রথম দিন পার করলাম। সারা রাত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে সকালে আবার গেলাম পড়াতে। বসার ঘরে নিতুর বাবা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার সম্পর্কে জেনে তিনি চলে গেলেন রাজনীতির প্রসঙ্গে। তারপর নানা বিষয় স্পর্শ করে কথা গড়ালো সড়ক দূর্ঘটনায়। “এদেশের রাস্তাঘাটে জীবনের কোন নিরাপত্তা আছে?”, তেতো মুখে বললেন তিনি। “এইতো সেদিন আমার বড় মেয়েটা রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ডান পা ভাঙ্গলো। ভাগ্যিস লাফ দিয়েছিল। না হলে যে কী হতো।” রাগে গজগজ করতে করতে নিতুর বাবা উঠে গেলেন।
নিতু অ্যাক্সিডেট করেছে! ওহ মাই গড। পড়ানো শেষে মিথিলা বললো, “স্যার, আজ কিন্তু আম্মু বাসায় নেই। কী যে খেতে দেবো আপনাকে?” না করতে মুখ খুলেছি এমন সময় পাশের ঘর থেকে কেউ বলে উঠলো, “তোমার স্যারকে বসতে বলো মিথিলা। আমি চা নিয়ে আসছি।”
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে এসে তীব্র বেগে স্পন্দিত হতে লাগলো। ক্রাচে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এলো নিতু। সবুজ সালোয়ার কামিজ পরেছে সে। চায়ের কাপটা আমার সামনে রেখে মুখোমুখি বসলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসলো। “মিথিলার পড়ার কী খবর?”, বললো সে। আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। অস্ফুটে বললাম, “এতদিন কোথায় ছিলেন?”