রহস্যময় ফোন.......একটি নির্ঘুম রাত
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
গভীর রাত। সেজুতি শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। ইদানিং প্রায়ই তার এমন হয়। ঘুম আসেনা। বিছনায় মরার মত শুয়ে থাকতে ভারী কষ্ট হয় তার। রুমে আর তিনটা মেয়ে ভোস ভোস করে ঘুমায়। ওদের দিকে তাকিয়ে সেজুতির খুব মন খারাপ হয়। শুধু ওরা নয়, হোস্টেলের সবাই ঘুমায়। দারোয়ান টাও লাঠিতে ভর দিয়ে ঘুমায় ।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সেজুতি। পুরো রাস্তা ফাকা। কোথাও কেউ নেই। লাইট পোষ্টের নিচে দুটো বেওয়ারিশ কুকুর ঘুমিয়ে আছে। আহ ঘুমুতে পারা কত শান্তির! সে যদি এভাবে ঘুমুতে পারতো?
ঘুম না আসা রোগটা তার খুব পুরাতন। স্কুলে দশম শ্রেনিতে পড়ার সময় তার বাবা মতিন সাহেব তার জন্য প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ দেন। অর্নাস শেষ করে রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা ফজলু কে। ফজলু ছিল সেজুতিদের চাচার বাড়ির ভাড়াটিয়া। চিলে কোঠায় ফজলু আর তার দুই বন্ধু ভাড়া থাকতো। সে ছিল খুবই নিরহ গোবেচারা টাইপের ছেলে। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুতে তার তেমন আগ্রহ ছিলনা। পড়ানোর সময় কখনোই তার দিকে তাকাতো না। কথা বলতো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সেজুতির খুব ইচ্ছে হত ফজলু তার দিকে তাকিয়ে থাকুক। একটু আধটু এডাল্ট কথা বলুক।
ফজলুর চেহারা সুরুত তেমন ভাল ছিলনা। গায়ের রং ছিল কালো। ডান চোখ সামান্য ট্যারা। শরীরটাও খুব পাতলা গড়নের। পড়ার বাইরে সে কখনোই গল্প করতো না। রোবটের মত মুখ মলিন করে বসে থাকতো।
সেজুতি তার জন্য অনেক সেজে গুজে থাকতো। অকারনেই ফজলুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কখনো কখনো মুখস্ত পড়াও ভুলে যেত। ইচ্ছে করতো ফজলুর হাতটা ধরে থাকতে। কিশোরী মনে তারে নিয়ে কত স্বপ্ন যে দেখতো সে। টিভিতে রোমান্টিক নাটক দেখার সময় সেজুতির ইচ্ছে হত ফজলু স্যার তার হাত ধরে বলুক“এই মেয়ে তুমি এত সুন্দর করে তাকাও কেন? আমি যে তোমার প্রেমে পড়ে যাবো!”
একবার সেজুতি তার অংকের খাতায় লিখে রাখলো, ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি। কি আর্শ্চয্য ফজলু তা খেয়াল করলো না।
তারপর সেজুতি আরেকটু সাহসী হল। সে ঠোটে লিপিষ্টিক লাগিয়ে একটা সাদা কাগজে অনেক বার চুমু খেল। সাদা কাগজে সেজুতির পুরু ঠোটের ছবি ভেসে উঠলো। লজ্বা লাগলো দেখে সেজুতি বুকের জামার ভিতর লুকিয়ে রাখলো সেই কাগজ খানি সারা দিন।
বিকেলে ইংরেজি বইয়ের ভেতর কাগজটা রেখে দিল। ফজলু স্যার ইংরেজি বই ধরতেই সেজুতি পানি খাবার কথা বলে অন্য ঘরে চলে গেল।তার বুকের ভেতর ধরফর করে উঠল। রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছিল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষন পর ফিরে এসে দেখলো ফজলু স্যার মুখ কালো করে বসে আছে। তাকে খুব বিধস্ত দেখাচ্ছিল। ফজলুর শুকনো মুখ দেখে সেজুতির খুব কষ্ট হয়। তার ইচ্ছে করে ফজলুর হাত ধরে বলতে , এই ছেলে কি হয়েছে তোমার? কেন এত দুঃখি তুমি? আমার হাতটা ধর দেখ তোমার পৃথিবীটা কেমন বদলে দেই আমি!
পরের দিন সারাটা প্রহর তার কাটলো আতংঙ্কে। বিকেলে ফজলু স্যার আসবেতো?
সেজুতি ঠিক করলো, নাহ, স্যারকে আর বিব্রত করবে না।
ঠিকই যথা সময়ে ফজলু স্যার পড়াতে এসেছিল। তবে সেদিনই ছিল তার শেষ পড়ানো। তাকে খুব অসুস্থ লাগতে ছিল। সেজুতি খেয়াল করলো ঠোটের ডান পাশে কেটে গিয়েছে। গালটাও ফুলাফুলা। ফজলু স্যারকে দেখে তার বুকের ভেতর কিযে কষ্ট হয়। ভালবাসার মানুষের জন্য এত মায়া লাগে তা সেজুতি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারে।
সেজুতি বলে, আপনার কি হয়েছে স্যার?
ফজলু স্যার বলে, গতকাল গ্রাম থেকে খবর এসেছে আমার মায়ের শরীর খারাপ। কালকে সেজন্য খুব আপসেট ছিলাম। হয়ত ভুল করেই তোমার ইংরেজি বইটা নিয়ে যাচ্ছিলাম…।
ভুল করে কেন নিবেন স্যার? আমিইতো বললাম প্রশ্ন দাগিয়ে দিতে।
ও আচ্ছা।
তারপর?
যাবার সময় তোমার বড় ভাই আনিসের সাথে দেখা হল গেটের কাছে। সে আমার সাথে সৌজন্য মূলক কথা বলার এক পর্যায় বইটা হাতে নিয়ে খুলতেই একটা সাদা কাগজ রাস্তায় পড়লো। সেখানে .. .! যাইহোক । তোমার ভাই তখন কিছু না বললেও রাতে আমাকে বাসায় গিয়ে খুব বকা-ঝকা দিয়েছে। সামান্য গায়েও হাত দিয়েছে। তাতে আমার দুঃখ নেই। তুমি হয়ত ইচ্ছে করে বইর মধ্যে ওটা রাখনি। কিন্তু আজ সকালে তোমার চাচা বলছে আমি যেন আজকে দিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেই। এখন কোথায় যাব আমি?
আজকে পড়াতে আসিনি আমি, তুমি খুব ভাল মেয়ে। তোমার মেধা খুব ভাল। তোমার বাবা মায়ের ইচ্ছে তোমাকে ডাক্তার বানাবে, তুমি ভাল করে পড়াশোন করিও।
ফজলু স্যার চলে গেল। সেজুতির বুকের ভেতর কিযে কষ্ট হতে থাকে তা বোঝানো যাবে না। গলার কাছে কান্না জমাট বেধে থাকে। সে কাদতে পারেনা। ফজলু স্যার সন্ধার আগেই চিলে কোঠার বাসা ছেড়ে দিয়ে ছিল। ফজলু স্যারের সঙ্গে তারপর আর দেখা হয়নি সেজুতির।
তখন অনেক দিন সেজুতির রাতে ঘুম হত না। জেগে থাকতো। কেদে বুক ভাসাতো। অনুশোচনা হত। তখনি প্রতিজ্ঞা করে ছিল আর কোনদিন কাউকে ভালবাসবে না সে।
ভালবাসলে শুধু কষ্ট পেতে হয়। ফজলু স্যারের কথা ভুলতে বসে ছিল সেজুতি। কতগুলো বছর কেটে গেছে। স্মৃতির খাতায় আরো অনেক ঘটনা জমা পড়েছে। জীবনতো বহমান নদীর মত। শুধু বয়ে চলে। রাত শেষ হয় দিন শুরু হয়, আবার.. । প্রতিটি দিন যায় নতুন ঘটনা ঘটে জীবনে। সেজুতি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে আসে।
না, সেজুতি ডাক্তার হতে পারেনি। সরকারী কোন মেডিকাল কলেজে সে চাঞ্জ পায়নি। তার বাবার চাকুরী শেষে যে টাকা জমানো ছিল ব্ড় ভাই তা নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে লস খেয়ে সব শেষ। পুরাতন বাড়ি ভাড়ার টাকা আর পেনশন দিয়ে চলছে সংসার। সেজুতির মাষ্টাস ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। হোস্টেলে থাকে সে। জীবন কোথায় কারে নিয়ে যায় তার ঠিক নেই।
মোবাইল ফোনটা কেপে উঠে হঠাৎ করেই। ডিসপ্লেতে আননোন নাম্বার। রিসিভ করতেই সেই পরিচিত কণ্ঠ। কেমন আছেন?
কে বলছেন?
কেন না চেনার ভান করছেন।
দেখুন আমি ভনিতা করতে জানি না। আর সেই বয়সটাও এখন আমার নেই। আমি স্কুলে পড়া কিশোরী নই অথবা কলেজের প্রথম বর্ষের কোন তরুনী।
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে। সেই হাসির শব্দে সেজুতির মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করে ফোনটাকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে। কেন যে ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে ছিল সে? নিজেকে অভিসাপ দেয় সেজুতি। এই অচেনা মানুষটা বিভিন্ন নাম্বার থেকে তারে ফোন দিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলছে।
লোকটার সাহস দেখে অবাক হয়ে যায় সেজুতি।
ঠিক সাত দিন আগে তারে ফোন দিয়ে ছিল রহস্যময় মানুষটা। বলেছিল, শোনেন সেজুতি, আমি আপনার সব খবর রাখি। আপনি আজ পড়েছেন আকাশি রংয়ের সেলোয়ার কমিজ। আপনার সামনে পড়ে আছে হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প বইটা। কি ঠিক বলেছি না?
সেজুতি বিস্ময়ে থ হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হয়নি। একমাস পরে আমার পরীক্ষা। আমার টেবিলে কেন গল্প উপ্যনাসের বই থাকবে?
ফোনের ওপাস থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে। সেই হাসি যেন বলে সেজুতি তুমি এত মিথ্যে কথা বলতে পারো!
ঠিক আছে আপনার মিথ্যেকে সত্য ধরে নিলাম। এবার আপনাকে একটা সিরিয়াস কথা বলি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। কি বলেন?
বলে কি লোকটা? বিয়ে? মাথা ঠিক আছেতো? নাহ এই সব ফালতু লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কি জানি কোন টাউট-বাটপার হতে পারে।আজকাল মোবাইল ফোনে অনেক ক্রাইম হচ্ছে। সহজ সরল মেয়েদের সুন্দর সুন্দর কথা বলে ভুলিয়ে- ভালিয়ে নানা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।
সেজুতি শীতল গলায় বলে, শোনেন আপনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে কল দিয়ে বিরক্ত করেন। আমি নিছক ভদ্র মেয়ে বলেই এতদিন কিছু বলিনি। আপনার সাহষ দেখে আমি বিস্মিত। আপনী দয়া করে আর ফোন দিবেন না।
ঠিক আছে ফোন দিবনা। তবে আপনাকে সাত দিন পরে একবারের জন্য ফোন করবো। আমি জানতে চাইব আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? আপনার হৃদয়ের ভেতর এমন কেউ কি আছে যারে আপনি ভুলতে পারেন নি?
আজ আমার দেওয়া সাত দিনের আলটিমেটাম শেষ। এবার বলুনতো আপনি কি ভাবলেন?
না। আমার হৃদয়ে এমন কেউ নেই। শীতল গলায় উত্তর দেয় সেজুতি।
তাহলে রাতে আপনি ঘুমুতে পারেন নি কেন?
ওহ ফোন বাজার সাথে সাথে ধরেছি বলে ভাবছেন আমি রাতে আপনার জন্য ঘুমুতে পারিনি? শ্লেস ভরা কণ্ঠে উত্তর দেয় সেজুতি।
না। আমি লক্ষ করছি আপনি বারান্দা দিয়ে হাটাহাটি করেন। জানালার পাশে আপনার ছায়া দেখা যায়।
কি যা তা বলছেন?
ঠিক আছে আমি আর ফোন দিবনা। আপনি খুশি?
হ্যা আমি খুশি।
লাইন কেটে যায়।
সেজুতির খুব অস্থির লাগে। কে এই মানুষটা?
১২টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন