শিউলি সিদ্ধান্ত নিলো সে চুমু খাবে। সম্ভব হলে চুমুর চেয়ে আরও বেশি এগিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ আগে মাত্রও তার মাথায় এই চিন্তা আসলো। এবং বেশি কিছু ভাবল না। সাথে সাথেই সে রাসেলকে মুঠোফোনে এসএমএস করলো।
“ koi tui? kal basay thakbi? ami asbo”
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো শিউলি । ফিরতি এসএমএসের অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর একটি এসএমএস এলো। মোবাইলের কম্পনের সাথে সাথে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো।
“ hmm thkbo. kintu keno? kono dorkar?”
শিউলি কিছু লিখতে চাইলো না। ইচ্ছে করলো মোবাইলটি বন্ধ করে দিক। কিন্তু পরে হঠাৎ করে সে কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে গেলো। “ না , লিখতেই হবে। আর না, এর অবসান চাই, বেশি চিন্তা করা যাবে না, চিন্তা করলেই সমস্যা”
মনে মনে কথা গুলো বলেই সে এস এম এস লিখল।
“ hmm dorkar. toke ekta jinish upohar dibo”
ফিরতি এস এম এস—“ tai naki ? ki jinish?
“toke chumu khabo” কিছুটা কম্পিত হাতে শিউলি লিখল এস এম এস টা।
তার হাত পা কাঁপতে থাকলো। মাথায় শূন্যতা অনুভব করলো। নিজেকে ভার শূন্য মনে করলো। সে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়।
টেবিলে একটা টেবিল লাইট জ্বলছে। কিন্তু সেই আলো তার কাছে খুব উৎকট মনে হল। নিভিয়ে দিয়ে সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। দু একটা জানালা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
সেই রাতটিও কি এমন ছিল? সেরাতেও সে কি এমন ভাবে বসে ছিল না? যে রাতে সে প্রথম জানতে পারে সেই কথা। শুধু কি সেই রাতে? নাকি বছরের পর বছর ধরে এমন অসংখ্য রাত সে এভাবে বসে বসে কাটিয়েছে। কি জন্য বসে ছিল? বা আছে? কেন তার মনে অন্য কেউ কখনও জায়গা করে নিতে পারলো না? নাকি সে কখনও অন্য কারো জন্য দরজা খুলে নি? রাসেল তো তাকে ভালবাসেই। রাসেল জানে সে প্রবালকে ছেড়ে তার কাছে যাবে না, কখনও অন্য কারো কাছে যাবে না, তবুও সে তাকে ভালোবাসে? কেন ভালোবাসে? এমন নিরর্থক ভালোবাসার কি মানে? যখন সে জানে সে কখনও আমাকে তার প্রেমিকা হিসেবে পাবে না, কখনও প্রিয়তমা রূপে আমাকে কাছে নিয়ে তার বুকে স্থান দিতে পারবে না, কখনও সে আমার বুকে তার জন্য কম্পিত হৃৎস্পন্দন অনুভব করবে না, যেভাবে আমি কখনও তার কম্পিত হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে চাই না।
এতো না না , তার পরও কেন এই অবুঝ ভালোবাসা? নাকি এই সত্যিকারের ভালোবাসা? পাবো না জেনো ও নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যাওয়া। কোন আশা না রেখে শুধু ভালোবেসে যাওয়া।
অদ্ভুত!! আমি রাসেলের ভালোবাসাকে নিরর্থক বলছি? তবে আমার ভালোবাসা কি? আমি জানি প্রবাল আমাকে ভালোবাসে না। তার জীবনে অনেক মেয়ে আছে। কয়েকমাস পর পর সে তার প্রেমিকা পালটায়।
তারপরও তো আমি তার কাছে ফিরে যাই বার বার। অথবা আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই, আমিই একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছি যেখানে প্রবাল ছাড়া কোন গন্তব্য দেখি না।
এমন তো না যে আমি আগে কখনও জানতাম না যে প্রবালের জীবনে অন্য কেউ নেই। অনেকবার অনুমান করেছি । কিন্তু আজ এমন হল কেন? কেন মুষড়ে পড়েছি? কেন আমি ঘৃণা অনুভব করছি, কেন আমি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছি? কেন মনে হচ্ছে কিছ যদি করতে পারি তবেই আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো।
শিউলি বিছানা থেকে উঠলো। বাতি জ্বালাল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে সে পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছে।
শিউলি , তুমি কি দেখতে কুৎসিত?
না আমি কুৎসিত না। আমার চেহারাটি সুন্দর, আমার শারীরিক অবয়ব আকর্ষণীয়, আমার বক্ষের উচ্চতা , কোমরের সুরুত্ত, নিতম্বের গড়ন সবই সুন্দর। আমার একটি উচ্চতর ডিগ্রী আছে, আমি একটি বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতম কর্মচারী। যেখান থেকে আমি মাসে মাসে বেশ বড় সর অঙ্কের টাকা পাই।
শিউলি, তুমি কি প্রবালের প্রতি সৎ?
হ্যাঁ, আমি প্রবালের প্রতি সৎ। সে ছাড়া আমি কখনও অন্য কাউকে নিয়ে চিন্তা করি নি।
শিউলি, প্রবাল কিন্তু চিন্তা করেছে।
হ্যাঁ, জানি।
শিউলি , তোমার মধ্যে কি কোন কমতি আছে, কোন অপূর্ণতা আছে , কোন বিশেষ দোষ আছে যার জন্য তুমি একজন অসৎ স্বামীর সাথে দিনের পর দিন থাকছ?
না আমার মধ্যে কোন দোষ নেই, কোন অপূর্ণতা নেই, কোন বিশেষ দোষ নেই।
শিউলি, তবে তুমি কেন অসৎ কাউকে ভালোবেসে নিজেকে বঞ্চিত করছো? কেন নিজেকে ছোট করছো?
আমি এতদিন বঞ্ছিত করেছি নিজেকে, অপমানিত করেছি নিজেকে। আর না।
শিউলি, তুমি কি সত্যি বলছ, আর না?
হ্যাঁ আমি সত্যি বলছি। আমি এর অবসান ঘটাবো। আমি কালই রাসেলের কাছে যাবো।
শিউলি, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি রাসেলের কাছে যেতে পারবে না। কারণ তুমি প্রবালকে এখনো ভালোবাসো।
না আমি আর প্রবালকে ভালোবাসি না।
শিউলি , তুমি নিজেক নিজে মিথ্যা বলছ। নিজের সাথে প্রতারণা করছো।
না আমি প্রতারণা করছি না। আমি প্রতারণা করছি না।
শিউলি এক কাপ চা বানাল। কাপ আর মোবাইল নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সে জানে মোবাইল অন করলেই রাসেলের মেসেজ পাবে। এবং এও জানে মোবাইল বন্ধ দেখে রাসেল উদ্বিগ্ন হবে। যেহেতু আমি তাঁকে কখনও এমন মেসেজ দিবো বলে সে কখনও চিন্তাও করতে পারে নি।
এখনই কি মোবাইলটি অন করবো? আর একটু দেরি করি। আর একটু উদ্বিগ্ন হোক কেউ আমার জন্য।
শিউলি খুব শান্ত ভাবে চা শেষ করলো। যেন তাঁর জীবনে কিছুই হয় নি। কিন্তু শিউলি জানে তাঁর জীবন ভীষণ ভাবে খুব কুৎসিত নোংরা এক হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
শিউলি মোবাইল অন করলো। সাথে সাথেই মোবাইলটি দুবার কেঁপে উঠলো। রাসেল কি দুটো মেসেজ দিয়েছে?
প্রথম এস এম এস টি অন করেই শিউলি স্থব্ধ হয়ে বসে পড়লো। তাঁর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তীব্র এক আক্রোশ তাঁকে ভেতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। ঘৃণার প্রচণ্ডতা তাঁকে নিঃসাড় করে দিলো।
প্রবালের এস এম এস।
“hey babe ki koro? khub klanto. saradin meeting korchi. tumi khaicho?”
শিউলি নিজেকে শান্ত করলো। মেসেজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল “হ্যাঁ প্রবাল, তুমি তো ক্লান্ত হবেই। সারাদিন কারো সাথে শুয়ে শুয়ে থাকলে তো মানুষ ক্লান্ত হয়”।
প্রবাল তুমি হয়তো জানো না তুমি এখন যে হোটেলে আছো সেটার ম্যানেজার আমার বন্ধুর স্বামী। তুমি যে প্রতি মাসে তামান্নাকে নিয়ে ওই হোটেলে যাও সেটা আমার খুব ভালো করে জানা। এবং প্রতি মাসে তোমার হোটেলে অবস্থান কালে এমন এস এম এস আমাকে এই দুর্ধর্ষ যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি দিয়েছে। অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে নিজেকে বুঝিয়েছে “ অন্য কারো সাথে থাকলে কি হয়েছে, আমাকে তো মনে রেখেছে। এই আমার জন্য যথেষ্ট”
কিন্তু আজ আর পারছি না প্রবাল। আজ যখনই শুনেছি তুমি তামান্নার সাথে আছো আমি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। বাস্তবতা আজ এমন ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে যে আজ কোন অবাস্তব যুক্তি আমাকে তোমার দিকে ধাপিত করছে না। আজ আমি তোমাকে ঘৃণা করছি। তীব্র ভাবে তোমাকে অবজ্ঞা করতে চাচ্ছি।
রাসেলের যে একটা মেসেজ এসেছে , তা শিউলীর অনেকক্ষণ পর মনে পড়লো। সাথে সাথেই পড়া শুরু করলো।
“ are you serious?”
হ্যাঁ আমি সিরিয়াস। আমি সত্যি রাসেল কে চুমু খাবো। মনে মনে এই কথাগুলো বলে সে বাথ রুমে ঢুকলো। ইচ্ছে করলো বাথটাবে সারারাত শুয়ে থাকতে। কিন্তু সে দুঘণ্টার স্নান সেরে ধীরে ধীরে শরীর থেকে পানি মুছতে লাগলো। সে তাঁর শরীর থেকে সব ক্লান্তি সব কষ্ট সব যন্ত্রণা সব জ্বালা মুছতে লাগলো। সর্বোপরি প্রবালের সব চিহ্ন যেন চামড়ার মতো লেগে আছে তাঁর শরীরে। যা সে হাজার ঘষেও তুলতে পারছে না। সে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। তাঁকে আজ বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। সত্যি কি স্নিগ্ধ লাগছে?
নগ্ন শরীরে শিউলি বিছানায় গেলো । তাঁর শরীর বিছানার কোমলতা অনুভব করলো। সে রাসেলকে মেসেজ করলো।
“ i will come at 10 am. n im serious”
শিউলি মোবাইলটা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো। এবং খুব আশ্চর্য ভাবে সে রাতে তাঁর খুব ভালো ঘুম হলো।
শিউলি একটা সি এন জি নিলো। বনশ্রী এসেই শিউলির হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। ইচ্ছে করলো এখনই নেমে পড়ুক ট্যাক্সি থেকে। অথবা তীব্র কোন জ্যামে পড়ুক, যাতে চার পাঁচ ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়। অথবা এমন হোক রাসেলের বাসায় গিয়ে দেখুক বাসায় তালা। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। মোবাইল বেজে উঠলো। রাসেলের ফোন।
“ হ্যালো, কই তুই? সত্যি কি আসছিস?”
“ হুম আসছি, আর কিছুক্ষণ”
“ওকে তাড়াতাড়ি আয়, আমি অপেক্ষা করছি”
শিউলির নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেন আমি খুশি হতে পারছি না, কেন আমি চাইছি না রাসেলের বাসায় যেতে। সি এন জি তে উঠার আগ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। এখন কেন এমন অস্থির লাগছে? কেন মনে হচ্ছে আমি কোন নোংরা আবর্জনায় দিকে যাচ্ছি?
সি এন জি ঠিক জায়গায় এসে থামল। তিনতলা থেকে রাসেল তাকিয়ে আছে। তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে সারারাত ঘুমায় নি। শায়লা দাঁড়িয়ে রইলো। যেন তাঁর পা আজন্ম পঙ্গু। সে কখনো হাঁটতে শিখে নি। এমন সময় তাঁর মোবাইল বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার। অপরিচিত নাম্বার দেখলে সাধারণত সে ফোন ধরে না। কিন্তু আজ মনে হল এর চেয়ে শান্তিদায়ক আর কিছু হতে পারে না এই মুহূর্তে। এই অপরিচিত নাম্বারের কল ধরার জন্য সে খুব ব্যাকুলতা অনুভব করছে।
“হ্যালো শিউলি কই তুই? আমি জুথি। কাল্ তোর বাসায় আমি আমার মোবাইল ফেলে এসেছি। তুই কি বাসায়? আমি আসব”
“ হ্যাঁ আমি বাসায় যাচ্ছি, তুই আয়”
শিউলি কোনদিকে না তাকিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো ।
আবার তাঁর মোবাইল বেজে উঠলো। প্রবালের ফোন। শিউলি থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ইচ্ছে করলো মোবাইলটি ছুঁড়ে ফেলে দিক। সে একবার পিছনে ফিরল। রাসেল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একা, বিষণ্ণ, ক্লান্ত, বিহ্বল, হতবাক এবং দুঃখী...
শিউলি মোবাইলটি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলো দিলো। এবং খুব দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। তাঁর হাঁটতে হবে। অনেক হাঁটতে হবে। অনেক পথ এখনো বাকি হাটার... কিন্তু সে তাঁর গন্তব্য জানে না। শুধু এটুকু জানে এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পাবে...............।