প্রায় দেড়শো বছর পরের কথা। দিল্লীর সম্রাট শাহজাহানের পুত্র এবং বাংলার সুবাহদার শাহ্ সুজা জানতে পারলেন তার ক্ষমতালিপ্সু ভাই আওরঙ্গজেব আরেক ভাই দারাশিকোকে হত্যা করে তার দিকে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ধেঁয়ে আসছে। আরাকান রাজাদের সাথে তার সখ্যতা আগে থেকেই ছিলো। আরাকান রাজারাও মুঘলদের খুশি রাখার জন্য মুঘলীয় পদবী ব্যবহার করত নামের শেষে, এমনকি সোনার মোহরের আরাকান রাজাদের অনেকে পবিত্র কালেমা খোদাই করেছিলো। তাই এই বিপদে আরাকান রাজা সান্দা-র সাহায্য কামনা করলেন তিনি। ভূলুয়া (বর্তমান নোয়াখালী) হয়ে আরাকানের রাস্তা ধরে এগুতে থাকলেন, সাথে ছিলো হাজারের অধিক পালকি বহর আর ডজন ডজন উট ভর্তি স্বর্ণ আর রাজকীয় ঐশ্বর্য্য। পথিমধ্যে নৈশ্ব্যর্গিকতায় ভরা একজায়গায় সেরে নিলেন ঈদের নামাজ (বর্তমানের ডুলা হাজরার ঈদগাহ)। বাসিতাং নদী (বর্তমানে নাফ নদী) পার হয়ে আরাকান রাজ্যে প্রবেশ করলেন তিনি, কিন্তু রাজা সান্দা তার কথা রাখেনি। লোভের বশে শাহ্ সুজার মেয়ে গুলরুখকে ধর্ষন করে এবং উষ্ট্রবোঝাই রাজকীয় ঐশ্বর্য্য হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করে রাজা সান্দা থুধাম্মা। বহু মোঘল সৈন্যেরা পালিয়ে যাবার সময় গণহত্যার শিকার হয়, শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে শাহ্ সুজা বঙ্গোপসাগড়ের পাড় পর্যন্ত আসতে পারলেন, সাথে আছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া কিছু বিশ্বস্ত সহযোগী আর রক্ষা পাওয়া কিছু সম্পদ, যাই কিনা ছয় উট বোঝাই। আত্মহত্যা করেছে তার মেয়ে গুলরুখ, মারা গিয়েছে ছেলেরা আরাকানিদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে। এখন আর কিছুই চাওয়ার নাই তার শুধু প্রতিশোধ নেয়া ছাড়া। কিন্তু পেছনে ধাওয়া করে আসছে বিশাল আরাকানী বাহিনী আর সামনে সুবিশাল সমুদ্র, এখন কোথায় যাবেন তিনি? ঠিক এসময় সাগরের তীর ঘেঁষে ভেসে এল একটি জাহাজ, যাদের বিরুদ্ধে সবসয়ই তিনি লড়ে গেছেন, আজ তারাই হয়তো রক্ষা করতে পারে তার জীবন, হার্মাদ!
এঘটনার দু'দশক পরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহ্ আরেকটি প্রস্তুতী নিয়েছিলেন আরাকান রাজ্য দখলের, কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যুদ্ধে হেরে যাবার পর তার ভাই বাহাদুর শাহ-কে ফাঁসিতে চড়ান বার্মিজ রাজা সুদুর্মা। আজম শাহ্ ও বাহাদুর শাহের স্ত্রী পরীবানু-কে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে হাত বেঁধে নৌকায় ফুটো করে ছেড়ে দেয়া হয় নাফ নদীতে। সৌভাগ্যক্রমে তারা সাঁতরে কূলে উঠতে সক্ষম হয় আর সে অঞ্চলটির নাম ছিলো কঙ্কাদ্বীপ যার বর্তমান নাম শাহপরী দ্বীপ বা সিনমাবুয়্য। মগ দস্যু কানু তক্কে তক্কে ছিলো। মোঘল যুবরাজ আর আরেক যুবরাজের স্ত্রী-কে হাতে পেয়ে তার আর খুশির সীমানা রইলো না। মুক্তিপন স্বরুপ বহুস্বর্ন মুদ্রা লুটে নিয়ে এল তার আস্তানা (বর্তমান ইনানী বীচের কাছে) কানুরাজার গুহায়। কিন্তু সে ভূলে গিয়েছিলো সেই অদৃশ্য শক্তির কথা, হার্মাদের সর্দার সেবাস্তিয়ান গনজালভেজ!
শতাধিক বৎসর পরের ঘটনা। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের কাছে খবর পৌছুলো আরাকান রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রচুর রাখাইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার পালঙ্কীতে (বর্তমানের কলাতলী, কক্সবাজার) অভিবাসন করছে। তার ওপর দ্বায়িত্ব পড়ল এই অভিবাসন প্রকৃয়া সহজতর করার। রাখাইনরা সেই কক্স সাহেবের নামানুসারে সেই এলাকার নাম রেখে দিলো কক্সবাজার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেড়া কক্সবাজারের একটি পাহাড়ের ওপর দাড়িয়ে রাখাইনদের কুটির বানানোর কাজের তদারকী করছেন আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। কতই না উপকথা, কুসংস্কার আর গুজবে ভরা আছে এই এলাকা। শত-শত বৎসর ধরে চলতে থাকা পার্তুগীজ জলদস্যু হার্মাদদের নিয়ন্ত্রন করা এতটা সহজ ছিলো না, মুঘলরাও পারেনি। হার্মাদদের হাত থেকে পোর্ট গ্র্যান্ডেকে (বর্তমানে চট্রগ্রাম) ফিরে পাওয়াটা যেন স্বপ্নাতিত ছিলো। তস্কর হার্মাদ আর মগ লুটেরারা মিলে ফ্রাঁ জোন করতে চেয়েছিলো, কত্ত বড় স্পর্ধা? বাংলার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাতো তাদের অত্যাচারে গ্রাম শুন্য হয়ে গিয়েছে, যেটা কিনা এখন বাঘে ভরা জঙ্গলে রূপ নিয়েছে (বর্তমানে সুন্দরবন)। সামনের যে দ্বীপটি, সোনাদিয়া, ওখানে নাকি একবার এডেন থেকে ছেড়ে আসা সোনা বোঝাই জাহাজ আছড়ে পড়েছিলো, আর তাই ও দ্বীপের নাম সোনাদিয়া। হার্মাদরা সব সোনা লুট করে নাবিকদের মেরে ফেলেছিলো, কিন্তু সেই সোনা কোথায় নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলো পার্তুগীজ সেই জলদস্যুদের দল? দিল্লীর রাজপুত্র শাহ্ সুজা-কে বাঁচানোর হিস্যা হিসেবেও তারা নাকি ছয় উট বোঝায় স্বর্ণ অলঙ্কার আর রাজকীয় কোষাগারের জহরত লুটে নিয়েছিলো। কিন্তু সেগুলো তারা পর্তুগালেও নিয়ে যেতে পারেনি, কিছু অংশ খুব সস্তায় ওলন্দাজ, ফরাসী, আর্মেনীয় আর ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি করলেও অধিকাংশের নাকি হদিশ পাওয়া যায়নি, তাহলে কোথায় রেখেছিলো ঐশ্বর্য্যগুলো? অথবা সেই মগ দস্যু কানুরাজার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সম্পদ গুলোও নাকি তারা এ অঞ্চলের কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, আরও কতশত ঘটনা আছে তার ইয়াত্তা নেই। হার্মাদদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি ইউরোপিয়ান বানিজ্যিক জাহাজ গুলোও। তবে কি জনশ্রুতিতে যা শোনা যায় তাই সত্যি? ওগুলো এখানেই কোথাও সুরক্ষিত ভাবে লুকিয়ে রাখা আছে? হিজ হাইনেস ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানীর বড় লাটের ইচ্ছে বার্মা আক্রমন করা, কিছুদিনের মধ্যে তা করাও হবে। তাদেরই গুপ্তচর মারফত শোনা কথা, সিনমাবুয়্য বা শাহপরি দ্বীপের আরও দক্ষিনে নাকি আরেকটি ছোট দ্বীপ আছে, যেখানে মালাক্কা থেকে আগত দারুচিনি বোঝাই একটি জাহাজ একবার বিদ্ধস্ত হয়ে পাড়ে এসেছিলো। তাদের-ই বেঁচে যাওয়া এক নাবিকের মুখে শোনা হার্মাদদের মূল আস্তানা আর ওদের সর্দার সেবাস্তিয়ান গনজালভেজের ঘাটি সন্দীপ হলেও তারা তাদের লুট করা সব মালামাল ওখানে রাখতো না, নিজেদের মধ্যেই চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে, আর কখন আরাকানিজরা এসে সন্দীপ দখল করে ফেলে তার কোন নিশ্চয়তা আছে? সেগুলো নাকি ছিলো সেই দারুচিনি দ্বীপে আর ওখানের মাটির নিচেই নাকি তারা পুঁতে রেখেছিলো হাজার হাজার লাখ লাখ টাকার লুট করা সেই অভিশপ্ত সব গুপ্তধন!!! গুপ্তচর মারফত আরও শুনেছেন তিনি, সেই নাবিকের নিজের হাতে আঁকা একটি নকশা আছে বার্মার রাজা বোদ্ধাপায়ার কাছে, তার দাদার বাপ নাকি সন্দীপ আক্রমন করে সেবাস্তিয়ানের কল্লা নেয়ার সাথে সাথে এ নকশাটিও পেয়েছিলেন, কিন্তু কেউই শত চেষ্টা করেও কোন মর্মোদ্ধার করতে পারে নি। কক্সের দৃষ্টি এখন সেই নকশার দিকে। যদি কোনভাবে গুপ্তধন হস্তগত করা যায় তাহলে লর্ড খেতাব জুটে যাওয়া কঠিন কিছু হবে না।
১৭৯৯ সাল, কক্স সাহেব খবর পেলেন তার গুপ্তচর বার্মা রাজ বোদ্ধাপায়ার কাছ থেকে দারুচিনি দ্বীপের সেই গুপ্তধনের নকশা চুরি করে ফিরবার সময় নাফ নদীর মোহনায় সলীল সমাধি ঘটে। চোখের সামনে স্বপ্নের অপমৃত্যু সইতে পারলেন না হিরাম কক্স, অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনিও মারা যান আর হারিয়ে যায় রাজকীয় ঐশ্বর্য্যের শেষ চাবিকাঠি। কিন্তু যুগযুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে আরাকান রাজার অত্যাচারের কথা, মুঘলদের সাথে তাদের যুদ্ধের কথা, মগ দস্যু কানুর কথা, হিরাম কক্সের কথা আর- পার্তুগিজ জলদস্যু হার্মাদের কথা; শুধু লুকিয়ে থাকা এই গুপ্তধনের কথাটি ছাড়া।।
হার্মাদ শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ ‘আরমাদা’ থেকে যার মানে যুদ্ধজাহাজ। হার্মাদের সেই গুপ্তধন থাকুক আর নাই বা থাকুক সাগরকন্যা সেইন্ট মার্টিনের অপার সৌন্দর্যের কথা শুধু শুনেই এসেছি বহুকাল ধরে কিন্তু চাক্ষুস দেখার সুযোগ হয়নি কখনও। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল বড় বোন-দুলাভাই, ভাই-ভাবী (সব্বাই কাজিন) ও তাদের একদঙ্গল পোলাপান নিয়ে কক্সবাজার ও সেইন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাবে, সাথে আমারও যেতে হবে। না করার প্রশ্নই আসেনা।
সাগর আর আকাশ, দুটোই যেখানে সীমাহীন।
দূর একাকী আমি, সাগরের ঢেউ গুনছি।
দুইদিন কক্সবাজারে থেকে এরপর দুইদিন সেইন্টমার্টিনে থেকে পরবর্তিতে আবার দু’দিন কক্সবাজার, এইছিলো আমাদের প্ল্যান। স্বভাবতই কক্সবাজার থেকে সেইন্টমার্টিনের প্রতিই আমার আগ্রহটা বেশী ছিলো, আর আমি যে উদ্দেশ্যে সেইন্টমার্টিন যাব তার জন্য দু’দিন যথেষ্ট। কক্সবাজারে দুদিন কাটানোর পর সকাল-সকাল মাইক্রো নিয়ে মেরিন ড্রাইভের পথ ধরে শুরু হল সেইন্টমার্টিন যাত্রা, ক্রুজ ধরার উদ্দেশ্যে।
জাহাজের ঘাটের পার্শ্বেই, অপূর্ব নাফ নদীর ওপার থেকে সাঁতরে আসা কিছু মহিষ।
এপারে নাফ নদী আর ওপারে বঙ্গোপসাগর, মাঝে পাহাড় আর পাহাড়ী পথ। অপূর্ব, তাই না?
দূর থেকে ওপারে বার্মার আকিয়াব পর্বতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মোঘল অথবা বৃটিশরা যদি এই আরাকান অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিরাজ করাতে পারতো তাহলে হয়তো ওই অঞ্চল বাংলাদেশের একটি অংশ হিসেবে থাকতো।
এলবাট্টস পেলাম না, গাং চিলেই সই!
একই সাথে চলমান পাশের স্টিমারটি।
বিশ্বাস করুন, এটা ক্যারিবিয়ান কোন দ্বীপ নয়, স্বয়ং সেইন্টমার্টিন। দ্বীপে নামার ঠিক পরপরেই জেটিতে বাধা ছিলো নৌকাটি।
মাঝিদের সরঞ্জাম। এই দ্বীপের মূল জীবিকা হল মৎস সম্পদ আহরণ।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সবথেকে মজার বিষয়টি হল, এ দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। শুধু মাত্র হোটেল বা রেস্টুরেন্ট গুলোতে বিকেল ৫ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত ডিজেল জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত দেয়া হয়। সেজন্য অবশ্য আশির্বাদ স্বরূপ অনেক পর্যটক দিন থাকতেই চলে যায়, কারন যত পর্যটক, তত প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণ। কোরাল রীফকে নষ্ট করার জন্য মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। অস্বীকার করব না, আমি নিজেও দুদিন থেকেছি, কিন্তু এটা প্রথম ভ্রমন সেইন্টমার্টিনে, তাই বিবেচনা করা যেতে পারে, কি বলেন? বাংলাদেশে আমি এত অপার সৌন্দর্য্য আমি খুব কম অবলোকন করেছি। কিন্তু ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিনের মত ক্ষান্ত দিতে হল। সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামী কাল সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সূর্যদয় অবলোকন শেষে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখবো।
সেইন্টমার্টিনের সূর্যোদয়; হঠাৎ করে ফ্রেমে ইয়ো টাইপের এক মেয়ে ঢুকে পড়লো (সাথে বয়ফ্রেন্ড না থাকলে হয়তো ছবিটি তাকে উপহার দেয়া যেত, হা হা হা)।
শুরু হল আমার দারুচিনির দ্বীপ অভিযান। ভাবছিলাম যদি একটা মেটাল ডিটেক্টর থাকতো আর সঙ্গি-সাথী বেশি থাকতো তাহলে গুপ্তধন (!) খুঁজে পেতে খুব সহজ হত।
ভোর হল আর কুকুরদের আনন্দ দেখে কে?
সাথে মোবাইল ফোনে জিপিএস ট্র্যাকার ছিলো বলে একা একা যেতে সাহস পাচ্ছি, কারন জোয়ারের সময় কিছু কিছু এলাকা নাকি তলিয়ে যায়। আমার ভয় ছিলো ছেড়া দ্বীপ পর্যন্ত হেটে যাবার পর যদি জোয়ার এসে আটকে যাই, তাহলে কেলেঙ্কারী হবে, হাজার হলেও সাতার পারি না আর এ দ্বীপে এই প্রথম! আল্লাহর নাম নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম দারুচিনি দ্বীপে জলদস্যুদের গুপ্তধনের আস্তানা খোঁজায়।
আগে কি জলদস্যুদের জাহাজগুলোও এভাবে উঠিয়ে রাখা হত?
প্রবাল আর সাগরের সঙ্গম।
এটা হয়তো কোন হতভাগা নাবিকের স্বর্ণবোঝাই জাহাজের অংশবিশেষ! (আসলে, সমুদ্রের সীমানা নির্ধারনের জন্য অথবা সমুদ্রের গভীরতা বুঝানোর জন্য যে বয়া ব্যবহৃত হয় এটা হল সেই বয়া)।
বিচের পাড় গুলোতে বালুর চেয়ে মৃত কোরাল আর খোলসের আধিক্য বেশী।
দ্বীপে আমার অবস্থান জানান দিচ্ছিলো প্রতি নিয়ত।
সেন্টমার্টিন দ্বীপটি মোটামুটি তিনভাবে বিভক্ত। উত্তরপাড়া (যেখানে মানুষের সর্বাধিক সমাগম, আর একদিনের ট্যুরিস্টরা শুধু ওই অংশটি দেখে বলে, এত নাম শুনেছি সেন্টমার্টিনের, কিন্তু আহামরিতো কিছু না)। গলাচিপা বা মধ্য অংশ, যেখানে দুপার্শ্বের সাগরের মধ্যবর্তী দুরত্ব হবে গজ পঞ্চাশেক বড়জোর (জিপিএস এ আমার অবস্থান ঠিক ওখানে দেখাচ্ছে)। আর দ্বীপের সবচেয়ে নিঝুম আর অফুরন্ত সৌন্দর্য্যের আধাড় দক্ষিণপাড়া। সেখান থেকে ভাটার সময় হেঁটে হেঁটে ছেড়াদ্বীপ পর্যন্ত যাওয়া যায়।
স্থানীয় বালিকা অনুরোধ করল তার ছবি তুলে দেয়ার জন্য।
সেইন্টমার্টিনের সবথেকে উচুস্থান ডেল পয়েন্ট থেকে।
আমি যখন যাচ্ছিলাম তখন ভাটা চলছিলো, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই জোয়ার এসে পড়বে, তাই ছেড়া দ্বীপের খুব বেশী ভেতরে যাবার সাহস পাইনি। ভাটার শুরুতে খুব মজার একটি বিষয় হয় এখানে। জোয়ারের সময় প্রচুর হাঙরের বাচ্চা, স্টিং রে, স্টার ফিস, স্কুইড, অক্টোপাস আরও বহু সাগরের প্রানী পাড়ের খুব কাছে চলে আসে, ছোট ছোট খানা-খন্দের মাঝে এসে লুকিয়ে পড়ে কিন্তু ভাটার শুরুতে ওগুলো আটকা পরে যায়।
আটকে পড়ে মরে থাকা একটা কন্টক যুক্ত ব্লাবার ফিস বা পটকা মাছ।
কিছুদুর এগিয়ে ছেড়াদ্বীপের মাথায় গিয়ে দেখি এক বুড়ো আর সাথে একটা ছেলে ছোট একটা গর্তের সামনে দাড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি ওখানে কিছু হাঙ্গরের বাচ্চা আটকা পড়ে আছে, আর ২-১ টা ডাঙায় খাবি খেয়ে মরার অপেক্ষা করছে।
ওরা আমাকে বললো, স্থানীয় ভাষায় এর নাম ক্যাঁক মাছ, কারন এই মাছ ক্যাঁক ক্যাঁক করে আওয়াজ করে। আমি ডাঙ্গার মাছটিকে তুলে পানিতে ফেলার কথা বলতেই ওরা সাবধান করে দিয়ে বললো, এদের মতন খারাপ মাছ নাকি আর কোথাও নাই, কামড়ে মানুষ খেয়ে ফেলে। আমি ওদের কথা না শুনে হাঙ্গরের লেজ ধরে পানিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতেই সেটা বেঁকে গিয়ে আমাকে কামড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কথায় আছে না, এরা কখনও পোষ মানে না।
[
বন্ধুদের দেখা পেল শেষ পর্যন্ত হাঙ্গরের বাচ্চাটি। আশা করা যায় পরবর্তী জোয়ার আসতেই এগুলো পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে!
ঘাপটি থেকে মারা একটা স্টিং-রে দেখাও পেলাম।
একটু আগে যে বুড়োর কথা বললাম সে দেখি ছেড়াদ্বীপ থেকে বেশ মাছের পসরা সাজিয়ে এনেছে। সাথের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম এখান থেকে মূল দ্বীপে যাবার উপায় কি? স্থানীয় ভাষায় যা ও বললো তার বড়জোড় বিশ ভাগ আমি বুঝতে পেরেছি। বয়ষ্ক মানুষটি উপলব্ধি করতে পেরে বললেন ছেলেটিকে গাইড হিসেবে নিয়ে যেতে। জিপিএস স্যাটেলাইট থেকে লোকেশন দেখালেও ভাটার সময় জেগে ওঠা পথা বা আগত জোয়ারের সময় কোন পথ ডুবে যাবে, সেটা তো আর দেখায় না। তাই সাত-পাঁচ ভেবে দেখলাম লোকাল একটি ছেলেকে গাইড হিসেবে নিলে এদিক থেকে যেমন উপকার হবে, আবার দ্বীপবাসী সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারবে যেটা অনেকেই আমরা জানিনা, ভাগ্য ভালো থাকলে গুপ্তধনের সন্ধানও দিতে পারে, হা হা!
বুড়োর ধরা মাছ আর কাকড়া-চিংড়ী
আমার গাইড, নাম সাফুল্লা (সাইফউল্ল্যাহ)। আমাকে পেয়ে সে মহাখুশি। আমার কাছ থেকে যে টাকা পাবে সেটা দিয়ে সে নাকি নতুন জামা কিনবে। তার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। সৎ বাবা তাকে দিয়ে গৃহস্থলীর কাজকর্ম করায় কিন্তু পড়তে দেয় না। আমি তাকে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করার উপদেশ দিয়ে এলাম। সাফুল্ল্যার পেছনেই যে বাড়িটি দেখছেন, সম্ভবত এটাই বাংলাদেশের সর্বদক্ষিনের আবাসস্থল। সর্বোউত্তরের টা দেখার খুব ইচ্ছে আছে সামনে।
এতক্ষন আমি হেঁটে এসেছি সমুদ্র সৈকতের পাঁড় ঘেঁষে। পথিমধ্যে এক রিসোর্টের মালিক বলেছিলেন, দ্বীপের দক্ষিনে একটা মিঠাপানির লেইক আছে নাম ‘মুরল’ লেইক, ওখানে যেতে। কোরালের প্রাচীর ধরে হাটতে হাটতে পেয়ে গেলাম সেই অপূর্ব মুরল লেইক।
কোরালের প্রাচীর ধরে হাটছিলাম। আমার পায়ে ট্র্যাকিং শ্যু ছিলো বলে কিছু হয়নি কিন্তু সাফুল্লার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো এর ওপর দিয়ে খালি পায়ে যেতে। ও বলল সাবধানে দেখে দেখে হাঁটতে, কারন পাথরের ভেতর দিয়ে মাঝে মাঝেই নাকি বিষাক্ত সাপ দেখা যায়, একটু আগেই সে একটি দেখলো। ভাবছি, হাওয়াই দ্বীপে যদি সাপ না থাকে, তাহলে এই দ্বীপে সাপ এল কিভাবে? সামুদ্রিক সাপ কি ডাঙ্গায় থাকতে পারে?? নাকি এটাও জলদস্যুদের কীর্তি? তাদের গুপ্তধন পাহারা দেয়ার জন্য সাপ ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলো দ্বীপে?
মুরল লেইক, পরিস্কার স্বচ্ছ টলটলে পানির আঁধার।
তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। সাফুল্লার কাছে শুনলাম তার জন্মাব্দি কখনও সেইন্টমার্টিনে ঝড়-ঝাপ্টার কথা শোনেনি। জন্মের আগে নাকি খুব ঝড় হয়েছিলো একবার (সম্ভবত ৯১ সালে), তখনও নাকি খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি এ দ্বীপ। মুরল লেইক পার হয়েই সাফুল্লাকে ছেড়ে দিলাম। পেটপুরে ডাবের পানি খেয়ে আবার হন্টন শুরু।
একটি মজার বিষয় লক্ষ করলাম, যদিও দ্বীপের সবাই বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠীর কিন্তু ওখানের মেয়েরা বার্মিজদের মতন পোশাক পড়ে। সাধারনত তারা ঘরের আঙ্গিনায় সবজি চাষ অথবা গৃহস্থলীর কাজে একটু বাইরে আসে, তখনই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। ছেলের পোশাক সাধারনত লুঙ্গি আর শার্ট। দোকানে চা খেতে বসে ব্যপারটা আরও পরিষ্কার হলো। বার্মিজ আর বাংলাদেশী উভয়েই বার্মিজ পোশাক পড়ে, কিন্তু তাদের পার্থক্য করা যায় এভাবে, বাংলাদেশীরা (বাঙ্গালী, রাখাইন, মারমা) লুঙ্গি বা সারং তাদের শরীরের উপরিভাগে পরিহীত বস্ত্রের নিচে পড়ে কিন্তু বার্মিজরা (বার্মিজ নাগরীক যারা পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসে), লুঙ্গি বা সারং শরীরের উপরিভাগে পড়ার বস্ত্রের (শার্ট বা ইয়ানবন) এর ওপরে পরে (অর্থাৎ ইন করে পড়ে)। সেইন্ট মার্টিনে আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করলাম, আর তা হল, নিরাপত্তা। আমি মুল্যবান সামগ্রী আর টাকা সহ পুরো দ্বীপ চষে বেড়িয়েছি একা একা, কিন্তু কেউ ভূলেও কখনও জিনিসগুলোর দিকে লোভের দৃষ্টিতে তাকিয়েও দেখেনি। ভালো লেগেছে দ্বীপবাসীর আন্তরিকতায়।
শুটকি বিক্রয়ের স্থান।
বহু ঘুড়াঘুড়ি হল, এবার খাওয়ার পালা। দুপুরে চারটি কোনমতে খেয়ে রাতের জন্য মাছের বার-বি-কিউ খাব বলে ভাবলাম।
আর সবাই মুরগী হাবি-জাবি খেলেও সাগরের পাড়ে এসে যদি মাছ না খাই, তাহলে কি আর আশ মেটে? একটা রূপচান্দার অর্ডার দিলাম। পরোটা আর রূপচান্দার বার-বি-কিউ, সেরকম স্বাদ!
মাছ ধরার ট্রলার, আচ্ছা, জলদস্যুদের জাহাজ গুলো এর থেকে কতগুণ বড় ছিলো?
এবারে ফেরার পালা এই দারুচিনির দ্বীপ থেকে। দ্বীপের মূল প্রাকৃতিক সম্পদ, কোরাল রীফ। এর মুল্য হার্মাদের লুকানো গুপ্তধন এর থেকেও অনেক অনেক বেশী। কিন্তু প্রতিনিয়ত জাহাজ-ট্রলার থেকে পড়া বিষাক্ত তেল, দ্বীপে থেকে যাওয়া মানুষের বর্জ্য, এ সবকিছু প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য হুমকীস্বরূপ।
এই ছবিটিতে দেখুন, মানুষের কর্মকান্ড প্রকৃতিকে কিভাবে বিনষ্ট করছে। ছবিটি সেইন্টমার্টিনের উত্তরাংশ থেকে তোলা, যেখানে ট্যুরিষ্টের সমাগম বেশী। ছোট্ট মাছটির ছবি তুলতে গিয়ে দেখি কে বা কারা বিস্কিট খেয়ে তার মোড়ক ফেলে রেখেছে। তাই আপনাদের সবার কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা নিজেরাও কখনও লিটারিং করবেন না অথবা কাউকে করতে দেখলেও এর প্রতিবাদ করবেন, সে যে-ই হোক না কেন। স্মোকিং যদি করেন তাহলে ফিল্টারটি নিজের কাছে রেখে দিন, পরে মূল ভূখন্ডে ফিরে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন দয়া করে।
দ্বীপে গিয়েই দেখেছিলাম নৌ মহড়া চলছে ওই এলাকায়। বিভিন্ন দেশের প্রায় ১৩টি সামরিক জাহাজ এর সমন্বয়ে গড়া এই সামরিক মহড়া।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজ।
নাফ নদীর মোহনার ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে নাসাকার দেয়া কাটাতাড়ের বেড়া আর ওয়াচ টাওয়ার। প্রায় প্রতি এক কিলো পরপর ওয়াচ টাওয়ারের আধিক্য দেখে মনে পড়ল, সামরিক শাসকেরা তাদের বহিঃস্থ নিরাপত্তা(!) নিয়ে যতটুকু ভাবে, ততটুকু যদি দেশের মানুষদের কথা বিবেচনা করতো, তাহলে দেশগুলোর এ পরিস্থিতি এর হত না।
টেকনাফের কাছে এসে পাহাড়ের কোলে হেলে পড়া সূর্যাস্ত উপভোগ করতে লাগলাম সবাই।
ফিরে এলাম আবার কক্সবাজার, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। পরদিন ঠিক করলাম ফিশারিজ ঘাঁটে গিয়ে দেখবো আসলে ট্রলারে ধরা মাছগুলোর শেষ পরিনতি কি হয়?
শ’য়ে শ’য়ে ট্রলার আসছে তাদের ধরা মাছগুলো নিয়ে এখানে বিক্রীর উদ্দ্যেশে।
[
কেটে-কুটে রাখা হাঙ্গরের ফিন। ফিনের স্যুপ খেতে বেশ লাগে। হাঙ্গরের মাংস খেতেও অবশ্য মন্দ লাগে না!!
নিচের ছবির একটা মাছেরও নাম জানি না, কেউ কি আছেন যারা বললে পারবেন এগুলো কি মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম বললে বুঝবো না অবশ্য, আমি জীববিজ্ঞানে বরাবর-ই কাঁচা ছিলাম।)
আমার দুঃখ হল, আমারা বাঙ্গালীরা সী-ফুডের নাম শুনলেই নাক কুঁচকে উঠি। অথচ সমুদ্রে আছে বিশাল খাদ্যের সম্ভার কিন্তু আমাদের বাবুয়ানা আর হামবড়া ভাব দেখলে মনে হয় যেন সমুদ্রের খাবার সব অচ্ছ্যুৎ। হার্মাদ দস্যুতা করে কত লক্ষ কোটি টাকার স্বর্ণ ঐশ্বর্য্য লুট করেছিলো এ অঞ্চল থেকে, আমার জানা নেই কিন্তু এ অঞ্চলে যে পরিমান ‘হোয়াইট গোল্ড – সী ফুড (লবস্টার, স্কুইড, অক্টোপাস, ক্র্যাব)’ আছে, তা লক্ষ কোটি টাকারও অনেক অনেক গুণ বেশী। শুধু দরকার একটি সঠিক দিকনির্দেশনা ও সাহসী পদক্ষেপ। সামুদ্রিক খাবার আমাদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলাটা খুবই জরুরী ভবিষ্যতের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলার লক্ষ্যে।
চিংড়ি, টুনা (সুরমা মাছ), কাকাড়া, স্কুইড আর অক্টোপাস; দেশের সাদা স্বর্ণ। হার্মাদের ঐশ্বর্য্য যেখানে ম্লান।
সোর্ড ফিস (আরও বড় গুলো নাকি আগে কাঠের জাহাজ ফুটো করে দিতো)।
সবশেষে ঘুড়ি উৎসবে উড়ানো বিশালাকার বেলুনের ছবি দিয়ে শেষ করছি আমার ভ্রমণ কাহিনী, জয় বাংলা।
সেইন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড আমাদের দেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ। একে রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আমাদের সবার। একটু সচেতন ভাবে যদি আমরা চলি তাহলে হয়তো এ দ্বীপটি রক্ষা পাবে। শেষ বয়সে গিয়ে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রোমাঞ্চকর সব গল্প বলতে পারবো নাফ নদীর তীর ঘেঁষে সেইন্টমার্টিনের পথে যেতে যেতে। কিন্তু আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে আমাদের কর্তৃক নিঃসৃত বর্জ্য ধ্বংশ করে দেবে পানির নিচে জমে থাকা কোরালের ইকো-সিসটেম আর ক্ষয় হতে হতে ধীরে ধীরে সমুদ্রের অতল গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এই দারুচিনির দ্বীপ, হয়ে থাকবে শুধুই ইতিহাস। একই কথা ইনানি আর কলাতলি বীচের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা কেউই চাইনা সেই বীচ গুলোর পরিনতী পতেঙ্গার মতন হোক, চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে বর্জ্যের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিনত হতে যাচ্ছে যে অঞ্চলটি। ঘুরে বেড়ান কক্সসাহেবের বাজার আর হার্মাদ জলদস্যুর আস্তানা। খুঁজে বেড়ান গুপ্তধন (পেলে আমাকেও একটু ভাগ দিয়েন, হা হা)। শুধুমাত্র খেয়াল রাখবেন, আপনার কারনে যেন অন্য একটি প্রাণীর জীবন সংহারের মধ্যে না পড়ে।
[বিদ্র। পোষ্ট খুব বেশী বড় হয়ে যাবার জন্য দুঃখিত, দু'খন্ডে লিখলে পোষ্টের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছিলো।]