প্রযুক্তিকে সঠিক সময় গ্রহন না করে পিছিয়ে পড়াটা বর্তমানে আত্মহত্যার-ই সামিল। তুরস্কের এত বৃহৎ অটোম্যান সম্রাজ্য ভেঙ্গে খান-খান হওয়ার পেছনের অন্যতম কারন ছিল তৎকালীন নব্য প্রযুক্তি গ্রহনের উন্ন্যাসিকতা। যা হোক,বিদ্যুৎ শক্তির অভাব বর্তমানে প্রকট আকার ধারন করেছে। আমাদের বিদ্যুৎ শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস, যার অধিকাংশই নব্য সম্রাজ্যবাদী কিছু কম্পানীর কাছে দায়বদ্ধ (কারন বাপেক্সকে সুপরিকল্পিত ভাবে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে)। গ্যাসের হিটিং ভ্যালু কম হওয়ায় এটা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গ্যাসের সবচেয়ে ইনএফিসিয়েন্ট কাজগুলির মধ্যে অন্যতম। আর গ্যাস বিভিন্ন সার প্রস্তুতির কাঁচামাল, গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়া মানেই সারের দাম তথা চাউল সহ শস্যের দাম আরও কি পরিমান বাড়বে, সেটা কল্পনা করতেও ভয় হচ্ছে। তাই আমাদের বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বিকল্প ব্যাবস্থা নেয়া উচিত। বায়োডিজেল সম্পুর্ণ সমাধান নয়, কারন এতে বর্ধনশীল ফসল বা ডিজেলের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজ বা জেনম ব্যবহৃত করা হয় যা উক্ত জমিকে সম্পুর্ণরূপে উর্বরতাশুণ্য করে দেবে যা হবে এই ধরিত্রী ও মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জিঘাংসামূলক কাজের মধ্যে একটি, যার কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ব্রাজিলে শুরু করে দিয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ খুবই ব্যয়বহুল ও আমাদের মতন বর্ধিষ্ণু কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অপর্যাপ্ত। তাই এখন সবদিক বিবেচনা করে একটি এফিসিয়েন্ট পথ খোলা আছে আর তা হল পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। প্রশ্ন উঠতে পারে এটাতো অনেক ব্যয়বহুল, একদম ঠিক; কিন্তু বাজারে গিয়ে একটু বেশী খরচ করেও কেন ভালো জিনিসটা কিনি? কেন সস্তায় সেলেরন না কিনে একটু বেশী খরচ করে হলেও ইন্টেলের প্রসেসর কিনি? উত্তরটা আমরা সবাই জানি, তাই না। সরকার বায়ুসেনা গণের জন্য শত হাজার কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় দিবসের প্যারেড গ্রাউন্ডের ওপর দিয়ে বিমানের ডগ-ফাইট দেখার জন্য যদি মিগ-২৯ বিমান কিনতে পারেন তবে একটি প্রয়োজনীয় সেক্টরে টাকা বিনিয়োগে সমস্যা কোথায়? তাই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়ার জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুত গ্রহন করা অতি জরুরী, কারন ডিসিশান নেবার পর থেকে প্ল্যান্টের ফিজিবিলিটি টেস্ট, প্রসেস লাইসেন্সিং, ভ্যান্ডরদের মেশিনারীজ সাপ্লাই ও কমিশনিং-স্টার্টআপ করতেই ৩-৪ বছর লেগে যায়। এছাড়া দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশানের জন্য কোন ভোল্টেজ ফ্ল্যাকচুয়েশান ছাড়া আনইন্টারাপ্টেড বিদ্যুতের সরবরাহ করার জন্য পারমানবিক শক্তি অপরিহার্য। এপ্রসঙ্গে বলা যেতে পারে উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ যাদের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের বৈভব আমাদের দেশের মতন নয়। তাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রচুর পরিমানে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। তাই আমাদের এই সম্পদকে অপ্টিমাইজ ওয়েতে কাজে লাগাতে হবে। তাই তাদের পারমানবিক প্রযুক্তি গ্রহন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যাবশ্যকীয় নয়, যতটা না আমাদের।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমরা কি এত বৃহৎ ও রিস্কি প্ল্যান্ট চালাতে পারব? আমি স্বরণ করিয়ে দিতে চাই আমাদের ছেলেরাই বিদেশে গিয়ে রিসার্চ ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যে সাফল্য দেখায় তা কি আমরা জানিনা? জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতি এতটাই অনাস্থাপূর্ণ আমরা? ইন্টেলের বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত প্রসেসর নিজের পিসিতে ব্যবহার করেও আমরা নিজেদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি? দুঃখজনক। আমাদের দেশে প্রচুর ভালো ভালো প্রকৌশলী আছে আমাদের দৃষ্টির আবডালে (যেমনঃ জামিলুর রেজা স্যার -যমুনা সেতুর ডিজাইনে ওনার অবদানের কথা প্রায় সবাই জানি)। কেউ যদি দেশের কোন সার কারখানা ভ্রমন করেন তাহলে আমাদের প্রকৌশলীদের দক্ষতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকবেনা, কিন্তু সরকারের উচিত হবে তাদের দেশের জন্য কাজ করার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়া যাতে তারা বিদেশমুখী না হয়।
তৃতীয় প্রশ্ন, পারমানবিক বর্জ্যের কি হবে? সেটার জন্য কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে যারা পারমানবিক বর্জ্য ট্রিটমেন্ট করে। আবার এটাও আশঙ্কা করা স্বাভাবিক, চেরনবিলের মতন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু? আসলে, প্রযুক্তি এই গত দু'দশকে অনেক এগিয়েছে, এখন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের ফুয়েল রডের স্থলে পিবল বেড রিয়াক্টর ব্যবহার করা হয় যা একশত ভাগ নিরাপদ। আমরা তো আর নিউক্লিয় জ্বালানী পরিশোধন বা উৎপাদনের কোন কৌশল হস্তগত করতে চাচ্ছিনা, আর বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানী ব্যবহৃত হয় তা দিয়ে কোন ভাবেই উইপনস গ্রেডের জ্বালানী প্রস্তুত সম্ভব নয়, তাই এদিক থেকে আমরা সম্পুর্ণ নিরাপদ।
তর্ক-বিতর্ক থাকবেই, কিন্তু এর মধ্যে থেকেই এগিয়ে যেতে হবে, কারন সামনেই আছে সোনালী ভবিষ্যত। কিন্তু রূপপুরের পরমাণু প্রকল্পের মতন কোন অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে যেন এ উদ্যোগ -ও যেন ব্যর্থ হয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৪৮