আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অণন্য ঘটনা আর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির স্রেষ্ঠ সন্তান । তাদের ই একজন হলেন মুক্তিযুদ্ধকালিন ১১ নং সেক্টরের অধিনস্ত বৃহত্তর ময়মনশিং জেলার ‘রহমতুল্লাহ কোম্পানি’র অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রহমতুল্লাহ। জন্ম :১৯ ফেব্রু ১৯৪৩ ,শেরপুর । তিনি ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টম্বর শেরপুরে "জাতীয় শিক্ষা কমিশন" রির্পোর্ট বাতিল আন্দোলনে সে সময়ের ” শেরপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি” হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিশাল জনসমাবেশে গণ আন্দোলনের ডাক দেবার জন্য গ্রেফতার ,চরম পুলিশী নির্যাতনের শিকার ও কারা জীবনশুরু এবং ১৯৬৩ সালের ১৫ মার্চ কারামুক্তি লাভ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে লাহোরে বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষনা ও বাস্তবায়নের দাবি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সহ সারাদেশে ব্যাপকহারে গ্রেফতার অভিযানের শুরু হয় । প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রহমতুল্লাহ পুনরায় গ্রেফতার হন । ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থানেও কারাবরন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন শেরপুর আওয়ামী লীগ এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। উত্তাল মার্চ'৭১ এ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের দায়িত্বপালন এবং পরবর্তিতে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে ১১ নং সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রথমে গেরিলা , পরে সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নেন। উল্লেখযোগ্য হল :কামালপুর অপারেশন যেখানে সেক্টর কমান্ডার মেজর (পরে কর্নেল , ৭৬ সালে ফাসি দেয়া হয় ) আবু তাহের বীর উত্তম ও রহমতুল্লাহ কোম্পানিসহ মুক্তিবাহিনীর একাধিক কোম্পানি , মেজর জিয়া বীর উত্তম (পরে জেনারেল , রাস্ট্রপতি , ৩০ মে ৮১ সালে অভ্যুথানে নিহত ) 'র নেতৃত্বে জেড ফোর্স এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক সরকার তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। উল্লেখ্য, শেরপুর শত্রুমুক্ত হয় ডিসেম্বর ৬ তারিখে এবং যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল অরোরা কে মুক্তাঞ্চলে তিনি ই অভর্থনা জানান এবং নির্দেশ মোতাবেক পরদিন জামালপুর পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য নান্দিনায় এম্বুস করেন । ১৯৭২ সানে ২২ ফেব্রুয়ারী তত্ কালীন মিত্রবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল নাগরাকে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সংবর্ধনাদান করা হয়। ১৯৭২ সানে ২৮ ফেব্রুয়ারী তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি (সি এন সি) জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরিত “স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র” মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরনপুর্বক নিজ নিজ কর্মে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে ময়মনসিংহ (খাগডর বি ডি আর )মাঠে ভাষনদান করেন। ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর নানা কর্মকান্ড ও অত্যাচার কে কেন্দ্র করে পার্টির সাথে মতবিরোধ এর প্রেক্ষিতে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করেন । যাহোক , বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রহমতুল্লাহ এর সাথে আলাপের ভিত্তিতে নিম্নে তার মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক কিছু ষ্মৃতি , কিছু কথা পত্রস্থ করা হল:
অপারেশন নালিতাবাড়ি
১৭ ই নভেম্বর ১৯৭১। ৩ জন সহযুদ্ধাসহ ছদ্ধবেশে রেকি প্যাট্রলে নালিতাবাড়ি (বর্তমান শেরপুর জেলার অন্যতম থানা ) পৌছলাম । নালিতাবাড়ি সদর ও তার আশপাশ ঘুরলাম। বিকেল হল। সারাদিন ছিলাম উপোষ । পেটে কোন দানাপানি পরে নি । আমাদের হাতে শুধু ধান কাটার কাচি। পাক বাহিনী’র টহল লক্ষ্য করলাম। সন্ধা ঘনিয়ে এল । এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম একটি জীপ গাড়ি থেকে কয়েকজন পাক সেনা অস্ত্রসমেত নেমে কাচা সরু পথে একটি বাড়িতে যাচ্ছে। এমন সময় আমার সহকর্মী শাহজাহান হঠাৎ বলে বসল স্যার তাড়াতাড়ি জীপে (পাকবাহিনী’র জীপটি ) উঠুন । এই গাড়ি নিয়ে যাব। আমি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার ছিলাম , ড্রাইভিং জানি সুতরাং কোন চিন্তা নাই । যেই কথা সেই কাজ । শাহজাহান দৌড়ে গাড়িতে বসেই ষ্ট্রার্ট দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করলো । পাক বাহিনী যখন বুঝতে পারলো তখন আমরা রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে । তবুও তারা অনবরত গুলি ছুড়তে লাগল । আল্লাহ’র অশেষ রহমতে গাড়িসহ আমরা মেঘালয় রাজ্যের চিচিং পাড়া ক্যাম্পে পৌছলাম । পরদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ‘স্বাধিন বাংলা বেতার কেন্দ্র’’ থেকে এইবীরোত্বপুর্ন ঘটনা প্রচার করা হয় .
রনাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম রোজার ইফতার পালন
মিত্রবাহিনীর কর্নেল রাও নির্দেশ দিলেন, সকাল ৮টায় বিশেষ ট্রেনিংয়ে তুরা ( ভারত) যেতে হবে। তখন ভোর ৫টা। সেদিন ছিল পয়লা রমজান। আগেই সাহ্রী খেয়ে নিয়েছি। সব যোদ্ধাকে প্রস্তুত হতে আদেশ দিলাম। যথাসময়ে ১০/১২টি ট্রাক এসে পড়ল। তুরা পার হওয়ার পর ইফতারের সময় হলো, ট্রাকেই আছি। কারো কাছে ইফতার করার মতো কোনো খাবার,এমনকি পানি পর্যন্ত ছিল না। আমার পকেটে সিগারেট ছিল, অগত্যা তা দিয়েই ইফতার (তখন জানতাম না এটি ইসলাম সমর্থন করে কিনা)। আমাদের সঙ্গে ইপিআর রফিক অবশ্য ধুমপান করেন না বিধায় কলেমা পাঠকরতঃ আল্লাহর নামে ইফতার করলেন। তুরা ট্রেনিংয়ের স্থানটির নাম এখন মনে করতে পারছি না। তবে তুরা জেলা সদর শহর পেরিয়ে আরো ৪/৫ ঘন্টা ট্রাক যাওয়ার পর একটি স্কুলের সামনে ট্রেনিং কমান্ডার যাত্রা স্থগিত করলেন। এখানে খাওয়া-থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। ট্রেনিং কমান্ডার বললেন, সময়মত খাদ্য আসবে। সারাদিন রোজা রাখা, ইফতারের পর ক্ষুধা বোধ করলাম। চারদিকে শুধু পাহাড়- জঙ্গল- অন্ধকার ভাগ্য ভালো, স্কুলে হারিকেন জাতীয় বাতি ছিল। রাত যখন ১০টা তখন রুটি-ডাল আসলো সবাই খেয়ে নিলাম। এভাবেই কাটল মুক্তিযুদ্ধকালে রমজানের প্রথম দিন।
আলেমদের রাজাকার হিসেবে ভুমিকা ও তাদের বিচার প্রসঙ্গ
শিশুকাল থেকেই ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল আমার, প্রতিদিন সকালে কোরআন পড়াছিল নিয়মিত। আমাদের স্কুলের আরবী শিক ফজলুর রহমান সাহেব খুব পরহেজগার আলেম ছিলেন। তিনি জামাতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তৎকালিন জাহানে নও পত্রিকা বগলে করে বিতরণ করতেন। তখন আমার রাজনৈতিক চেতনা ছিল না বা রাজনীতি বুঝার জ্ঞান হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই শ্রদ্ধেয় আরবী শিক ফজলুর রহমান জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির হয়ে বর্তমান জামাতের সহকারী সেক্রেটারী আলবদর কামরুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন বলে শুনেছি। তিনি শেরপুরের অন্যতম মতাধর ব্যক্তি এবং মানুষ হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত। শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি এবং ইসলাম প্রচারক আলেম হয়ে মানুষ হত্যা করায়; ভারত থেকেই তার প্রতি আমার চরম ঘৃণা জন্মিল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে তাকে ধরার জন্যে বহুচেষ্টা করেও ধরতে পারিনি। যদি আমার হাতে ধরা পরতো তবে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে তাকে আমি কি শাস্তি দিতাম তা হয়ত কল্পনাও করতে পারতো না। অথচ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার তারমত ঘৃণীত এবং খুনি ব্যক্তিদেরও সাধারণ মা ঘোষণা করলো। শেখ মুজিবের ঘোষনায় দেশের মানুষ হতবাগ। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। জামালপুর মুক্ত করে কামাল খান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বহু মানুষ হত্যাকারী, ধনসম্পদ লুটকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের বাড়ী ও মাদ্রাসা ঘেরাও করলাম। তিনি পলাতক। লুটের মাল উদ্ধার করে জামালপুরের এস ডি ও এর হেফাজতে দিলাম। আমাকে এস ডি ও সাহেব প্রশংসা করলেন এবং মাল্য দান করলেন। সরকারের সাধারণ মার আওতায় খুনী আবদুল্লাহ ইবনে ফজল (ফজল মুন্সী) বোমাবাজ শায়খ আবদুর রহমানের পিতা’র কোন শাস্তি পেতে হলো না।১৯৬৬ সাল। তখন আমি ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র। কলেজের কাশ শেষে বড় মসজিদে নামাজ আদায় করতাম। ইমাম সাহেব মুসল্লীদের ইসলাম শান্তি ধর্মের বয়ান করতেন। তার মুখের বয়ান শুনে আমি মুগ্ধ। যতদিন ময়মনসিংহ ছিলাম ততদিন জুম্মার নামাজ সেই ইমামের সহিত আদায় করে নেক্কার হয়েছিলাম বলে বিশ্বাস। বড় মসজিদের দু’তলা, তিন তলার উন্নয়নের কাজ শুরু হলে ইমাম সাহেব বলতেন “যে একটি ইট বা এক ঝুড়ি বালি এই মসজিদ নির্মাণের কাজে নিচ থেকে উপরে উঠাইবে সে আল্লাহর দয়ার উচ্চাশন বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে এবং বেহেস্তবাসী হবে।” আমি অনেকদিন অনেক মাস ইটা বালি দূর থেকে মাথায় করে মসজিদের দ’ূতলা, তিন তলায় উঠায়েছি। মনে হতো ইমাম সাহেবের কথায় আমি বেহেস্তবাসী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐ ইমাম সাহেব নিজ হাতে স্বাধীনতার পরে বহু লোককে হত্যা করেছেন বলে শুনেছি। তারপর ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখে আমি যখন আমার বাহিনী নিয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছলাম এবং তাকে খোঁজ করলাম সে তখন পলাতক। মানুষ হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। মজিব সরকারের সাধারণ মা ঘোষনার প্রেেিত সেই খুনী ইমামের কোন শাস্তি হলো না।
মুজিব বাহিনী প্রসঙ্গ
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থানার ঘাগড়া এলাকায় একটি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানী কমান্ডার সহ কিছু সংখ্যক যোদ্ধা প্রাণ হারায়। তৎপর জানিতে পারিয়াছি সেখানে কোন পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয় নাই। ২৪/২৫ জন রাজাকার ছিল মাত্র। মেজর জগজিৎ সিং (নানাজি) সহ আমরা অত্যন্ত চিন্তায় পড়িলাম, কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যে অস্ত্র আছে তাহাতে এমন তি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তারপর ২য় সপ্তাহে শ্রীবর্দি থানার একস্থানে অনুরূপ যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হইল এবং আহত হইল ১০ জন। তৎপর ৩য় সপ্তাহে মেজর জিয়ার ( সাবেক প্রেসিডেন্ট) জেড ফোর্স ক্যাপ্টেন তাহেরের ( কর্ণেল তাহের) প্লাটুনসহ আমরা ও মিত্র বাহিনী একত্রে কামালপুর পাক বাহিনীর ক্যাম্প এ¤বুস করে আক্রমন করি। উক্ত যুদ্ধে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অভূতপূর্ব তি সাধিত হয়। প্রায় শতাধিক মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সদস্য প্রাণ হারায় এবং অনেকে আহত হয় । তৎপর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে নালিতাবাড়ী থানার পানি হাতার যুদ্ধে প্রায় কামালপুরের অনুরূপ তি সাধিত হয় এবং উক্ত মাসের ৩য় সপ্তাহে মেঘালয়ের ঢালো বি, এস, এফ এর উপর পাক হানাদার বাহিনী আক্রমন করিয়া মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর প্রচুর তি সাধন করে অথচ বি,এস,এফ ক্যাম্পের পার্শ্বে মুক্তি বাহিনীর ৩টি কোম্পানী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
এমতাবস্থায় মিত্র বাহিনী ও আমরা অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িলাম। এই সময় মিত্র বাহিনীর ১১নং সেক্টরের কমান্ডার সান্দসিং (বাবাজি) এর মাধ্যমে জানিতে পারিলাম ইষ্টার্ণ কমান্ড মেজর জেনারেল অরোরা নির্দেশ দিয়াছেন নিজ নিজ কোম্পানীর ভিতরে শত্র“ নিহীত আছে কিনা তদন্ত করিয়া মিত্র বাহিনীর নিকট রিপোর্ট পেশ করিতে। তদন্তে বুঝিতে পারিলাম আমাদের সাথেই যুদ্ধে লিপ্ত মুক্তি ও মিত্র বাহিনী ছাড়া আরো একটি বাহিনী আছে। যাহাদের নাম করণ ছিল মজিব বাহিনী বা বি,এল,এফ। ইহারাই উপরোক্ত ঘটনা গুলির জন্য দায়ী। তাহাদের নেতা শেখ মনি। শেখ মনি এই বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠাইয়া দিতো এবং বলিয়া দিতো যেন আমরা তাহাদের রিক্রুট করি। যাহারা এই আহ্বানে সাড়া নিয়া নিজের কোম্পানীকে শক্তিশালী বলিয়া মনে করিয়াছিল তাহারাই তিগ্রস্ত হইয়াছে। তদন্তের সমস্ত বিবরণ সান্দসিংহ (বাবাজি) কে অবগত করিলাম। (এই সমস্ত ঘটনা সকলেরই জানা আছে। আমরা যতটুকু জানিয়াছি তাহাতে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা মজিব বাহিনীর চক্রান্তে শহীদ হইয়াছে। তাহাদের সাথে ময়মনসিংহ সহ অনেক স্থানে মু্িক্ত বাহিনীর সরাসরি গুলি বিনিময়ও হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় শেখ সাহেব ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল ও রংপুর হইতে’৭২ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে তাহাদের নিকট থেকে অস্ত্র জমা গ্রহণ করেন।) তাহার মাধ্যমেই ১৫ই নভেম্বর নির্দেশ পাইলাম চুড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে। মেজর জেনারেল আরোবা ও মেজর জেনারেল নাগরা ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যকে মিত্র বাহিনীতে নিয়োগ করিয়াছেন। রাশিয়ার দেওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর নিকট অর্পিত হইয়াছে। এ অস্ত্রের সাহায্যেই আমরা শক্তিশালী পাক বাহিনীর উপর ঝাপাইয়া পড়িলাম। যাহার ফলে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পাক বাহিনী পরাস্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিল।
শেরপুর মুক্ত !আলবদর কামারুজ্জামান পালালো , পদার্পন করলেন জেনারেল অরোরা , জামালপুর এম্বুস করতে এগিয়ে চলল মুক্তি
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও আমাদের ক্যম্পে এসে নির্দেশ দিলেন সন্ধা ৭টায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমন করতে হবে। তার নির্দেশ শুনে আমার কোম্পানির যোদ্ধারা কিছুটা ভড়ঁকে গেল । কারণ, কিছুদিন আগে উক্ত ঘাঁটি আক্রমন করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে ।
যা হোক, দেশ স্বাধিন করতেই হবে যে কোন মুল্যে, পিছুপা হলে চলবে না । আমি সকলকে একত্র হতে আদেশ দিয়ে ব্রিফিং দিলাম । সবাই “জয় বাংলা ” বলে অপারেশনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল । সন্ধায় কর্নেল রাও এসে আমাদের প্রস্তত দেখে খুশি হলেন ।
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে পৌছলাম । আঁধার রাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় । বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী শেল মারা শুরু করল । আর আমরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল । ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাস।
সকালে বাংকারের ভিতরে দেখলাম সম্পুর্ন নগ্ন মা -বোনদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশুন্য ফ্যাকাঁসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে “পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান?", “তারা কি মানুষ নাকি নরপশু ?", “তারা কুকুরের চেয়েও কি নিকৃষ্ট জীব? ” । ১৭/১৮ জনকে জীবন্ত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জা ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে বীরঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে আসলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ ।
সারারাত ঘুম জাগা তাই দুপুরের খানা খেয়ে সকলকেই বিশ্রাম করতে আদেশ দিয়েছি। যারা রান্নার কাজে দায়িত্বে আছে তারা রান্না করছে। হঠাত্ বাঁশীর হুইসেলে ,সকলেই হতবাক। অফিসার জানাল ,সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রস্তুত করতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলেই প্রস্তুত হলাম। তিনি আমাদেরকে ডালো বারাঙ্গা পাড়া মিত্র বাহিনীর ঘাটিতে যেতে বললেন। রাতের জন্য রান্না প্রায় শেষ। অনেকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ফেলে সকল মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা হলাম। মনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই; পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা , তবুও আনন্দ, সম্মূখযুদ্ধে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী মুক্ত দেশে শান্তিতে থাকবে। এই বুক ভরা আশা নিয়ে স্বদেশের মাটির দিকে দ্রুত যেতে থাকলাম। ডালো বারাঙ্গা পাড়ায় কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর বাউরামারী হয়ে নন্নী পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাউরামারী নন্নী হয়ে প্রথমে ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগর পাক বাহিনীর ঘাটি আক্রমন করার । শেরপুরের পথে নন্নীতে আমার ছোট বোন রৌশন আরার বাড়ী। বোনসহ এলাকার মুক্তিপাগল মানুষের কি আনন্দ-মুক্তিবাহিনী এসেছে। রৌশন আরা আমাকে সমস্ত যোদ্ধার সামনে দেখে চিনে ফেললো, অশ্র“ সজল নয়নে শুধু বল্লো-সকলেই একটু দাঁড়াও। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই বস্তায় বস্তায় চিড়ামুড়ি-গুর নিয়ে আমাদের কে বিতরণ করলো। খাবার এর পর আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের যেতে হবে ঝিনাইগাতী হয়ে শেরপুর। রাত ৮ ঘটিকায় ঝিনাইগাতী পৌছলাম। হঠাত্ মোবারক ও প্লাটুন কমান্ডার বকর নামে দু'জন সহযোদ্ধা আমাকে অনুরোধ করে বলল-স্যার এখান থেকে অতি নিকটে আমাদের বাড়ী। আপনার নিকট অনুরোধ, মাত্র ১০ মিনিটের জন্য সকলকেই নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলুন ,সময়মত শেরপুর পৌছতে কোন অসুবিধে হবে না। আমরা মোবারকের বাড়ী কালিনগর গেলাম। মোবারকের পিতামাতা আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামের লোকদের কি আনন্দ! আমাকে না জানিয়ে না বুঝতে দিয়ে বিরাট বড় একটা ষাড় গরু জবাই করে ফেললো !
চারিদিকে রান্না শুরু হলো। রাত ২ টার মধ্যেই খানা-পিনা শেষ করে আবার রওয়ানা হলাম শেরপুর সদরের দিকে। পথে আহাম্মদ নগর পাক বাহিনীর শক্ত ঘাটি। আমরা পৌঁছার আগেই হানাদার পাক বাহিনী ঘাটি ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘাটিতেই শত শত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে এনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করেছে। ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামান (ভারতে থাকতেই শুনেছি , জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির ফজলুর রহমান কামারুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন ) এর বাড়ী ঘেরাও করলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাক বাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে । সকাল ৭ঘটিকায় শেরপুর শহরে পৌঁছালাম। শেরপুর শহরেই আমাদের বাড়ী। খবর পেয়ে শ্রদ্ধেয় বাবাজান দারগ আলী পার্কে আসলেন। একে একে সকলের সাথে দেখা হলো। মা আমাকে দেখে আবেগে বিহব্বল হয়ে প্রায় বাকশূন্য হলেন। শুধু দেখা হলো না স্ত্রী নূরজাহানের সাথে। সে তখন তাদের গ্রামের বাড়ীতে ছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের আনন্দ দেখে আমি আবেগের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই হেলিকপ্টার আসলো। পদার্পণ করলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ আরোরা। আমার বাহিনীসহ হাজার হাজার মুক্তি বাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানাল।
মুহুর্তেই আদেশ হলো আজ বিকাল ৫ ঘটিকায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। জামালপুর এম্বোসের জন্য আমার বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হলো-যাতে হানাদার বাহিনী রেলওয়ে যুগে পালাতে না পারে।
জামালপুর মুক্ত করে কামাল খান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বহু মানুষ হত্যাকারী, ধনসম্পদ লুটকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের (ফজল মুন্সী ,বর্তমানে বোমাবাজ কথিত শায়খ আবদুর রহমানের পিতা) বাড়ী ও মাদ্রাসা ঘেরাও করলাম। তিনি পলাতক। লুটের মাল উদ্ধার করে জামালপুরের এস ডি ও এর হেফাজতে দিলাম। আমাকে এস ডি ও সাহেব প্রশংসা করলেন এবং মাল্য দান করলেন।
এভাবে ৪ঠা ডিসেম্বর পানিহাতা, নালিতাবাড়ী, ৫ই ডিসেম্বর বাওরামারী, ঝিনাইগাতী, ৬ই ডিসেম্বর শেরপুর, ৭ই ডিসেম্বর জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুর শত্রু মুক্ত হলো। ইতিপূর্বেই কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম টাঙ্গাইল মুক্ত করেছেন। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক- হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মনের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে উড়ল বিজয়ের নিশান ।