#রহস্য গল্পঃগেস্ট হাউজ
#নুরুন নহর লিলিয়ান
এই তো কয়েক দিন আগের কথা ।অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং প্রচন্ড নিঃসঙ্গতা নিয়ে সাকিয়া গেস্ট হাউজের করিডোরে বসেছিল ।চারপাশের পরিবেশের মানুষের মন মানসিকতা, তাদের অসহযোগিতা এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাঁকে হতাশ করে তুলে ছিল ।
চট্টগ্রামের এক কেমিক্যাল গবেষণাগারের গেস্ট হাউজে তাদের কয়েক মাসের অস্থায়ী জীবন । কয়েক মাস আগেই স্বামীর সাথে আমেরিকা থেকে ফিরেছে ।বিজ্ঞানী স্বামীর কর্ম সূত্রে তাকে অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে । বার বার তাকে নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন গড়তে হয়েছে । বেছে নিতে হয়েছে নতুন কোন জীবিকা । চট্টগ্রামের পাহাড়ে কেমিক্যাল গবেষণাগারটি হওয়ায় সাকিয়ার জন্য জীবনটা বেশ দুর্বোধ্য । কারণ এর আগে কখনও সে পাহাড়ি জীবন যাপন করেনি ।স্বামী দেশে ফিরে একটি সরকারী গবেষণাগারের কেমিক্যাল রিসার্চ বিভাগে যোগ দেয় । কাজ শুরু হয় চট্টগ্রামের এক পাহাড়ের সরকারী এরিয়ায় ।
অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে গেলেও জীবনের বাস্তবতা অনেক বেশি নিষ্ঠুর । আবার নতুন করে জীবন সাজানো । নতুন করে চাকরি খোঁজা । নতুন করে বন্ধু খোঁজা । মনে মনে ভাবে গবেষকদের বিয়ে করতে নেই । তাদের পেশাগত জীবনের বৈচিত্র্যতা পাশের মানুষটার জীবন বিদগ্ধ করে তোলে ।আর সেই বিচিত্র বিদগ্ধ জীবন সকলের জন্য এক রকম অভিজ্ঞতা দেয় না ।
অর্থহীন জীবনটা নিয়ে প্রতিদিন মনের বিরুদ্ধে গিয়ে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । তখন সাকিয়া শুধু জীবনের কঠিন বাস্তবতা ভুলে থাকতে বই পড়তো ।আর অতীতের কিছু মূল্যবান সুখ স্মৃতির কথা মনে করে সময় কাটাতো।
এমন একদিন নিস্তব্ধ দুপুরে সাকিয়া বারান্দার করিডোরে বসে বই পড়ছিল । হঠাৎ সেদিন ঠিক মধ্য দুপুরে দুটো ছোট বাচ্চা মেয়ে গেস্ট হাউজের করিডোরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল । তাদের মধ্যে একজন সাকিয়া কে দেখে অবাক হল । আর ভয়ে চিৎকার দিল ।বাচ্চা মেয়েটি কান্না করতে করতে বলল ," তুমি ভুত! তুমি ভুত! এই গেস্ট হাউজে একটা ভূত আন্টি ছিল । সে কিছুদিন আগে ফাঁসি দিয়ে মরে গেছে । "
তারপর মেয়েটি পাশের মেয়েটির হাত ধরে কান্না করতে করতে চলে গেল । সরকারী কোয়াটারের এই ছোট্ট মেয়েটির কথায় সাকিয়া একটু ভয় পেল ।সেই সাথে কিছুটা অপ্রস্তুত ও হল ।তাকে দেখে হঠাৎ মেয়েটির এমন কান্নায় মনে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হতে লাগল ।
নিজের বিজ্ঞানী স্বামী কে জিজ্ঞেস করে হাসির পাত্রে পরিনত হতে চায় না । তাই একদিন ক্যাম্পাসে অনেক কে জিজ্ঞেস করল । কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিল না । গেস্ট হাউজে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অতিথি আসে । আবার কাজ শেষে চলে ও যায় । আর গবেষণাগারের কর্মকর্তা- কর্মচারী ও পরিবর্তন হয় । আর কেউ জানলেও গেস্ট হাউজের বদনাম হবে ভেবে প্রশাসনের ভয়ে এরিয়ে গেল ।
কিন্তু কৌতূহলী মন দমে যায় না ।সে গবেষণাগারের ক্যাম্পাসে হাটতে বের হয় । কেয়ার টেকার এবং স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞেস করে । কিন্তু কোন এক অদ্ভুত রহস্যে সবাই বিষয়টা এড়িয়ে যায় ।
শুধু কেয়ার টেকার জামাল বলল ," ম্যাডাম , ভাল মন্দ প্রকৃতির সব জায়গায় আছে । কেউ কেউ দুই এক সময় অদ্ভুত কিছু দেখতেই পারে । এটা মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ । আর না মানলেই নিজের ভেতরে আর বাইরের দুনিয়ায় ও সমস্যা তৈরি হয় ।"
সাকিয়া কেয়ার টেকার জামালের কথা বুঝল না । তবে এটা অনুভব করল কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কারও কাছেই থাকে না ।
তবে একটা কথা প্রচলিত আছে প্রকৃতির কাছ থেকে কোন কিছুই হারায় না । মানুষ যাই করুক প্রকৃতি তা নিরব সাক্ষী হয়ে থাকে ।তারপর আর ও কয়েক মাস । সাকিয়ার গবেষণাগারের ভেতরেই কয়েক জনের সাথে ভাল বন্ধুত্ব হয় । সেই সাথে ফেসবুক এবং পুরনো বন্ধুদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয় ।
এরমধ্যে দুই একজন সাথে বিদেশ ফেরত সাকিয়ার হৃদ্যতা বাড়ে । সাকিয়া তাদের খুব দ্রুত আপন করে নেয় । নিজের ভেতরের দুঃখ কষ্টের আর অর্জন আনন্দের কথা ভাগা ভাগি করে ।
তাদের একজন বিজ্ঞানী ডঃ সাহাদাতের স্ত্রী নিশিতা । সাকিয়ার স্বামীর জুনিয়র । অল্প সময়ে ভাল সম্পর্ক হলে ও অদ্ভুত কারনে নিশিতা একটু হীনমন্য হিংসুট মহিলা । ভাল একটা সম্পর্ক চললে ও মনে মনে নিশিতা একদম সাকিয়াকে সহ্য করতে পারে না । কিন্তু সাকিয়া কিছুতেই বুঝতে পারে না । শুদ্ধ আত্মার মানুষের সব সময়ে প্রকৃতি দ্বারা পরিচালিত হয় । বিপদ আপদে প্রকৃতি তাকে রক্ষা করে । ভাল রাখতে আনন্দের উপকরণ খুঁজে দেয় ।
নিশিতার কাছেই জানতে পারে একজন মহিলা অবিবাহিতা মহিলা বিজ্ঞানী এই গেস্ট হাউজে আত্মহত্যা করেছিল । নিশিতা ইচ্ছে করেই বলেছিল যেন সাকিয়া ভয় পায় ।আমরা একসাথে বসবাস করে ও অনেক মানুষের নেতিবাচকতা বুঝতে পারি না । কিন্তু প্রকৃতি ঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে দেয় ।
তারপর বেশ কিছু দিন পর । একদিন ঠিক দুপুরের পর । তখন ঘড়িতে তিনটা বাজে । সাকিয়া চা খেতে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চায়ের পানি গরম করতে দিল । এমন সময় মনে হল পাশের রুম থেকে কেউ বের হচ্ছে । সাকিয়া দরজা খুলল । কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না । ফিরে এসে চায়ের কাপে চা নিল । এক কাপ ময়লা থাকায় অন্য কাপে চা নিয়ে খেতে লাগল । চারিদিকে রহস্যময় নিস্তব্ধতার আয়োজন । শরীরে ভেতরের অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেল আচমকা । শির শির বয়ে যাচ্ছে রক্ত প্রবাহ শরীরে । দিনে দুপুরে একটু ভয় লাগা কাজ করতে শুরু করল মনের ভেতরে ।
সাকিয়া চা খেতে খেতে মনে মনে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে।হঠাৎ তাঁর মনে হল সে বর্তমান থেকে অনেক পেছনের সময়ে চলে গেছে । তাঁর ছোট্ট বেলার বান্ধবি চৈতি তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলছে ," আরে গাধা নিঃসঙ্গতায় পড়ে নিজের সব সুখ আর সফলতা বলে যাচ্ছিস । তোর সামনে আর পাশে ভয়ংকর শয়তান । আর মনের অজান্তে সেই শয়তানের কাছে নিজের সুখ রাখতে দিস! "
হঠাৎ সাকিয়ার ঘোর কাটে । নিজের কাছেই নিজে চমকে উঠে । আমরা মানুষরা কাছে থেকেই কাছের মানুষের ক্ষতি করি । অন্যের ভাল থাকা সহ্য করতে পারি না । প্রকৃতি সহায়ক থাকলে তৃতীয় চোখ আর ইন্দ্রিয় অনুভব করতে পারে ।যে কোন উপায়ে সাবধান করে দেয় ।
পুরো বিষয়টা ভাবতে ভাবতে একটা বিষয় দেখে তাঁর বুকটা ধুক করে উঠে । আরেকটা কাপে অবশিষ্ট অর্ধেক চা । আর টি ব্যাগটা এমন করে রাখা মনে হল এতোক্ষণ সত্যি সত্যি কেউ তাঁর সাথে কথা বলেছে ।
কিন্তু নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারল না । পুরো ঘটনাটাই মনে এক রহস্যময়তার সৃষ্টি করল । আর একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাঁর মধ্যে ছেয়ে যেতে লাগল।আমরা জীবিত চোখে যা না দেখি কিন্তু নিঃশব্দ প্রকৃতি আমাদের ভেতরের সব কিছু খুব গভীর ভাবে দেখে । সৎ আত্মাকে যে কোন অভিশাপ থেকে রক্ষা ও করে । বাস্তবতা ভীষণ কঠিন । সবাই কে সব কিছু বিশ্বাস করাতে যেতে নেই । এমন কি নিজেকে ও । শুধু সত্যটুকু মেনে নিতে হয় ।
পরম বিশ্বস্ত মানুষটাও যে কোন সময়ে মনে মনে ভয়াবহ শত্রুতার বীজ বপন করতে পারে । নিজের মনের সব টুকু সব জায়গায় উন্মোচন করা ঠিক না ।সাকিয়া নিজের ভেতরের ভুল গুলো শুধরে নেয় । আর ভাল মন্দের পার্থক্যটুকু অনুধাবন করে । মনের ভেতরের অন্য একটা মানুষ চোখের সামনেই চলাচল করে । কিন্তু তাকে সবাই বুঝতে পারে না । তাকে সবাই দেখে না ।
শূন্য একটা দৃষ্টি নিয়ে সাকিয়া বিকেলের বিস্তীর্ণ খোলা নীল আকাশের দিকে তাকায় । আর যা রহস্য ছিল তা রহস্যের জায়গায় রয়ে যায় । আজ ও পৃথিবী সহস্র প্রশ্ন আর উত্তরের কাছে ভীষণ রকম অসহায় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৪