বিজ্ঞানীর বেডরুম
নুরুন নাহার লিলিয়ান
আমি এবং আমার স্ত্রী নুশমা যে রুমটায় ঘুমাই সেটা পূর্ব পশ্চিম মুখী । দক্ষিন দিকে একটা বারান্দা আছে । যে বারান্দা দিয়েই আমাদের রুমটায় যেতে হয় ।বারন্দার সাথেই একটা কাঁঠাল গাছ আছে । উত্তর এবং দক্ষিন দুই দিকেই জানালা । আমরা উত্তর দিকে মাথা দিয়ে ঘুমাই ।এই উত্তর দিকে ও বেশ অনেক গাছ গাছালি আছে । সেই গাছে অনেক গুলো কাক নিয়মিত থাকে ।
আমরা একটা সরকারী গবেষণাগারের আবাসিক ভবনে থাকি । পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের তিন তলায় আমাদের বসবাস।গাছ গাছালি পশু পাখিদের নিয়ে ছিম ছাম নিরিবিলি পরিবেশ ।
আমি সাইদুল একজন কেমিক্যাল বিজ্ঞানী ।বলা যায় সুগন্ধের কারিগর ।নতুন নতুন সুগন্ধ আবিস্কার করি ।পারফিউম বা সুগন্ধি নিয়ে গবেষণা করি ।লোকে বলে আমি অন্তর্মুখী । আমি সত্যি অন্তর্মুখী কিনা জানি না । তবে কথা বলার চেয়ে আমার নিজের ভুবনে কথাদের সাথে ঘুরতেই আমার ভীষণ ভাল লাগে ।
আমার স্ত্রী নুশমার সাথে আমার প্রেমের বিয়ে । একদম অন্যরকম অদেখা প্রেম । বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে দেখিনি । আমি তখন গবেষণার কাজে সুইজারল্যান্ড । আমার এক ল্যাব মেট বন্ধুর সহকর্মী ছিল নুশমা ।
একদিন সেই বন্ধু নুশমার ছবি ইমেইল করে জানাল ," বিয়ের জন্য ভাবতে পারিস । "
তারপর অনেক দিন কাজের ব্যস্ততায় আর এই বিষয়ে কথা হয়নি । একরাতে ল্যাবে কাজ করছিলাম । এই তো ফ্লেভার ফ্রাগনেন্স নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখছিলাম । আর ইমেইল চেক করছিলাম । অনেক ইমেলের ভিড়ে নুশমার ছবিটা কেমন জীবন্ত লাগল । তখন হয়তো রাত দুটো হবে । হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘ্রান আমাকে কেমন আচ্ছন্ন করে রাখল । নিজের যৌক্তিক চিন্তা থেকে সরে গেলাম । নুশমাই আমার মগজের নিউরনে আঠার মতো লেগে রইল । বাবা মা পাঠিয়ে ছিলাম মেয়ে দেখতে । তাঁরা সুন্দরি পাত্রী হাত ছাড়া করবে না তাই আংটি পড়িয়ে এসেছিল । মা বাবার পছন্দের পর্ব শেষে আমি ও স্কাইপি আর মোবাইলে কথা বলা শুরু করি ।আর এমন করেই আমাদের মোবাইল এবং স্কাইপির সহযোগিতায় বিয়ে হয়ে যায় ।
বিয়ের প্রায় ছয় মাস পর আমি নুশমা কে দেখি । সুইজারল্যান্ডের এক এয়ারপোর্টে। নুশমা শব্দের অর্থ সুগন্ধি । আরবি শব্দ থেকে এসেছে । নুশমার চেহারাটা কোন দামি সুগন্ধির মতোই আকর্ষণীয় । যে কারও কাছেই মনোগ্রাহী। যে কোন মানুষের মন ছুঁয়ে যাবে । আর আমি তো নব বধুকে দেখে অস্থির হয়ে গেলাম ।
প্রথম রাতেই একটা অদ্ভুত চেনা ঘ্রান আমি নুশমার কাছ থেকে পাই । ঠিক সেই রাতের ঘ্রানটা ।যখন ওর ছবিটা ইমেইলে প্রথম দেখেছিলাম । কিন্তু অনবরতই ব্যস্ততার স্রোতে সব কৌতূহল ভেসে গেছে ।
এখন আমার পাশেই আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে । তাকে ঘিরে আছে সেই অদ্ভুত ঘ্রানটা ।আমি নুশমাকে জড়িয়ে ধরিনি । কাছে ও ডাকিনি । আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি নুশমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে ।যখন ওই ঘ্রানটা আচ্ছন্ন করে রাখে তখন নুশমার চেহারাটা একদম অন্য রকম লাগে । এখনও অন্য রকম লাগছে । রক্তাভ মুখে ঘন কাল চুলের ছায়া । মনে হয় কাল্পনিক গল্পের জীন পরীদের মতো ।
ওর অবয়বে হাজার ও রঙের মিশ্রতা । আমি নিজে একজন ফ্রাগনেন্স গবেষক হওয়ার পর ও এই নিজের স্ত্রীর গায়ে জড়িয়ে থাকা ঘ্রানটা আমি আবিস্কার করতে পারিনি ।অনেক অনেক ভাবে আমি বুঝার চেষ্টা করেছি । ঘ্রানটা যখন আসে নুশমা একদম চুপ হয়ে যায় । ওর বলা অনেক কথাই আমার জীবনে সত্যি হয়ে যায় ।যেন মনেহয় আমার জীবনের মানচিত্র খুব গোপনে নুশমার কাছে গচ্ছিত আছে ।বিয়ের পর আমরা অনেক দেশ ঘুরেছি । ইউরোপের অনেক দেশেই সংসার পাতার চেষ্টা করেছি ।
কিন্তু আমার বিদেশে সংসার স্থায়ী হয়নি । সব জায়গায় নুশমা ভয় পেতো । ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠত । হঠাৎ রেগে যেতো ।অনেক জায়গায় মানসিক রোগের ডাক্তার দেখিয়েছি । কোন কিছুতেই কিছু হয়নি । লোকে আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখে প্রশ্ন করবে বলে নিজেদের সমাজ থেকে দূরে থেকেছি । আমার মতো বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ ও পীর ,ফকিরের কাছে গিয়েছি । দেশে ফিরে আমার পোস্টিং ছিল খাগড়াছড়ি । সেখানে এক পাহাড়ির কাছে বলেছিলাম । সে কিছু অচেনা শেকড় আর কবিরাজি ওষুধ দিয়েছিল । আর বলেছিল বাসস্থান পাল্টাতে ।অনে
এক বছর হয় আমরা ঢাকায় বসবাস করছি।বিয়ের অনেক বছর পর হয়তো নুশমা ঘুমাচ্ছে ।কি গভীর ঘুম !মাথার কাছে উত্তর দিকের গাছে কাক গুলো ডাকছে।এই গভীর রাতে ও কিছুক্ষণ পর পর কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠছে।আমি দেখি নুশমার পাশে অবিকল নুশমার মতো অন্য কেউ শুয়ে আছে ।আমার দিকে পলকহীন ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে ।
আমি ধিরে ধিরে অনুভব করলাম ।আমি ঘেমে নেয়ে উঠছি । আমার বেড রুমে এয়ারকন্ডিশনর চলছে।এখন নভেম্বরের শীতের হাওয়া বইছে । তবুও আমি অনবরত ঘেমে উঠছি । আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল। আমি বাকহীন বধির হয়ে যেতে লাগলাম । নুশমা কে ছুঁয়ে দেখে পরীক্ষা করার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললাম ।
আমার দীর্ঘ দিনের বিজ্ঞান চর্চা আর জ্ঞান তুচ্ছ হয়ে যেতে লাগল ।পৃথিবীর রহস্যের কাছে আমার সব জ্ঞান ম্লান হয়ে যেতে লগল ।আমি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গেলাম । আমার সামনে অন্য অস্তিত্বের ব্যাখ্যাহীন এক মানবী শুয়ে আছে । কি অপার্থিব মায়া তাঁর সমস্ত অঙ্গ জুড়ে । আমার সমস্ত ঘর অন্য এক ঘ্রানে মাতোয়ারা হয়ে আছে । আর আমার সমস্ত বিশ্বাসের দিকে তীর ছুঁড়ে মারছে ।আমার বিশ্বাস এবং জ্ঞানের জগতটা ভেদ করে নতুন কিছু স্পর্শ করে যাচ্ছে ।
জানি সকালের সূর্যের আলোয় সব ফিকে হয়ে যাবে। নুশমা প্রানবন্ত হাসি নিয়ে আমার কাছে এসে বসবে । সকালের নাস্তা তাড়াতাড়ি খাওয়ার তাগিদ দিবে । কিন্তু কোনদিন আমার এই অভিজ্ঞতার কথা জানবে না । আমার দেখা পৃথিবীর এই প্রশ্নাতীত রহস্যের খবর শুনবে না । দৃশ্যমান আমাদের জীবন আর বেঁচে থাকার মধ্যেও অন্য এক জীবন বেঁচে থাকার গল্প জানা হবে না । তবুও আমরা সব কিছু মেনে নিয়ে পরস্পরকে ভালোবেসে বেঁচে থাকব । কিছু রহস্য না হয় থাকুক একান্ত একার ।
স্বামী স্ত্রীর বেডরুমের গল্প গুলো সেখানকার বাতাসেই মিশে থাকুক । একান্ত বিশ্বাসের জগতটাও নিজের মধ্যেই লুকানো থাকুক । জ্ঞান , বিজ্ঞান আর বিশ্বাস নিজেদের ভিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে মানব জীবনে বিরাজ করুক ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২১