মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙেগ গেল।ঘড়িতে রাত তিনটা চার মিনিট। গেস্ট হাউজের বাইরের গেটে মনে হচেছ পাখি ডাকছে। খুব ছোট পাখির বাচ্চাটা খুব কষট পাচেছ। পাশেই আমার বর ঘুমাচ্ছে। ও একবার চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার ঘুম আসছিল না। আমি জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখি আনসার বাহিনীর লোক পাহাড়া দিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে বার বার বাঁশি ফু দিচ্ছে। চিটাগাং বিসিএসআইআর গবেষনাগারটির গেস্ট হাউজটা পাহাড়া দিতেই কয়েকজন লোক প্রয়োজন । সেখানে আজ রাতে মাত্র তিন জন। তবে মেইন গেটে কয়েকজন আছে।তবুও কেমন যেন একটা আতংক কাজ করছে। থেমে থেমে পাখিটা ডেকে যাচেছ। কাল রাতে পাশের রুমের নতুন সায়েন্টিস্ট নিলাঞ্জনার দুই মাসের বাচ্চাটা এবোরসান করতে হলো। ফোনে খুব চিৎকার করে কান্না করছিল। বাচ্চাটার নাকি হার্টবিট ছিল না। বিকলাঙ্গ কিংবা মৃত বাচ্চা হওয়ার ভয়ে ডাক্তার এবোরসান করে দিল। নিলাঞ্জনার পিএইচডির ডিফেন্স এখনো ও বাকি। সামনের জুলাইতে ফাইনাল। এর মধ্যে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের বৈজ্ঞানিক পদের চাকরিটা হয়ে যাওয়াতে দেশে ফিরেছে একমাস আগে।দেশে বিদেশে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে কে জানতো বনলতা কিংবা জঙ্গল আলী মা ডাকার জন্য পেটের মধ্যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে। নিলাঞ্জনার স্বামী চীনে গবেষনা করছে। খবরটা শুনে ভীষণ খুশী হয়েছিল নিলাঞ্জনার স্বামী। পছন্দমত একটা আইফোন পাঠিয়ে দিল এক দেশে ফেরা বাংলাদেশীর সাথে। দুজনে মিলে ঠিক করে ছিল যদি ছেলে হয় নাম রাখবে জঙ্গল আলী আর মেয়ে হলে রাখবে বনলতা। নিলাঞ্জনা আর ওর স্বামী দুজনেই বোটানির ছাত্রছাত্রী। এখন সে বিষয়ের উপরেই দুজন চীনে গবেষনা করছে। হঠাৎ মা হওয়ার সম্ভবনা পিএইচডি ডিগ্রী নেওয়ার পথে কিছুটা জটিলতা ও তৈরী করেছিল। এই শরীরে প্লেন জার্নি একদম নিষেধ । গত চার বছর একটি ডিগ্রী নিতে অনেক কষট করেছে। সঠিক সময়ে ডিফেন্স দিতে না পারলে ডিগ্রী ও হবেনা। গত দুই মাস শুধু সে বনলতা কিংবা জঙ্গল আলীর কথাই ভেবেছে।ছেড়ে দিতে চেয়েছে বৈজ্ঞানিক পদের চাকরি আর ডিগ্রী ও ।একজন মা তার পেটের সন্তানের জন্য সব ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। নিলাঞ্জনা ও প্রস্তুত ছিল সব কিছু মেনে নেয়ার তবুও যদি বনলতা কিংবা জঙ্গল আলীর কোল জুড়ে আসে। মাতৃত্বই পৃথিবীর সব মেয়ের পূর্ণতা। কিন্তু নিয়তি বলেও কিছু কথা আছে যা মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে। তিন দিন আগে খুব ভোরে পাশের রুম থেকেই মোবাইলে ফোনে কাদতেঁ লাগলো। আমি ঘুম চোখেই ওর রুমে দৌড়ে গেলাম। রাতে নাকি টয়লেটে সাপ দেখেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ফজর নামাজ শেষে অনুভব করলো কিছু একটা বের হয়ে আসছে রক্তের স্রোত হয়ে। আমরা পাশের ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার ওষুধ দিল আর কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু নিয়তির খুব কঠিন বাস্তবতায় দুই দিন আগে বিকেলে আবার রক্তের স্রোত। সে রক্তের স্রোতে নিলাঞ্জনার বনলতা কিংবা জঙ্গল আলীর কাছ থেকে মা ডাক শোনার স্বপ্ন টা ও ভেসে গেল। সকালে হাসপাতালে ফোন দিলাম নিলাঞ্জনার কাছে। ও জানাল যে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে ওর মা, বাবা,বড় বোন সবাই এসেছে। ঠিক দুপুরেই নিলাঞ্জনা সবাইকে নিয়ে গেস্ট হাউজে ফিরে এল। কিন্তু নিলাঞ্জনার সাথে বনলতা কিংবা জঙ্গল আলীও আর এল না। জড়িয়ে ধরে নিলাঞ্জনা খুব কাঁদছিল। কেনো দুই মাসের গল্প হয়ে পেটে এসেছিল! কতো রকমের গল্প ছিল তাদের ঘিরে। আজ থেকে আর কোন গল্প হবে না তাদের নিয়ে।আমি রুমে দু:খ মন নিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আমার কানে শুধু বাচ্চা পাখিটার চি চি ডাক। মনেহল কোন এক বিমূর্ত মানুষের আত্মা যে পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিল। আমাদের কোন ভুলে আবার সে না ফিরার দেশে ফিরে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০০