somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মনোজ বসুর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু। বাংলার মাটি, মানুষ, আকাশ, জলপাই রংয়ের গাছ গাছালি, গঙ্গা পদ্মার শব্দ নৈশব্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মনোজ বসু। কাহিনী নির্মাণে যেমন তিনি সফল, কাহিনী বর্ণনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর ভাষা সরল, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী, কিন্তু জড়তা নেই কোথাও। সে ভাষা পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে, কাহিনীর শেষপর্যন্ত তাকে না পৌঁছিয়ে ছাড়ে না। রঙ্গ, ব্যঙ্গ, বীররস, করুণরস প্রভৃতি ব্যঞ্জনার এত বেশি সমাবেশ এখানে ঘটেছে যে, পাঠককে অবাক হতেই হয় মনোজ বাবুর শিল্পরুচির বহর দেখে। যাঁরা তাকে বনজ মোষ বলে একসময় বিদ্রুপ করতেন, তাঁদের কপালেও চোখ উঠে যেতে পারে বৈ কি! তবে এটা ঠিক, মনোজ বসুকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে চিনতে হলে ভুলি নাই নয়, পাঠককে যেতে হবে তাঁর পরিণত বয়সের লেখা জলজঙ্গল, নিশিকুটুম্ব, সেই গ্রাম সেইসব মানুষ, প্রভৃতি উপন্যাসের কাছে, যেখানেই মূলত ফুটে উঠেছে মনোজপ্রতিভার শিল্পকুসুম। প্রসঙ্গত ‘নিশিকুটুম্ব’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। নানা ভাষায় এটি অনূদিত এবং চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু ১৯৮৭ সালের আজকের দিনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ। আজ তার ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মনোজ বসুর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।


মনোজ বসু ২৪ জুলাই ১৯০১ সালে যশোর জেলার ডোঙ্গাঘন্টা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামলাল বসু। মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান তিনি। সম্পদ-সম্পত্তি বলতে যা বোঝায় তা ছিল না তাঁদের। গ্রামে তাঁদের ছিল বংশ গৌরব ও প্রচুর খ্যাতি। তাঁর ঠাকুর দাদার লেখার অভ্যাস পিতা রামলাল বসুর মধ্যেও ছিল। তিনি ভাল কবিতা লিখতে পারতেন। দুই পুরুষের সাহিত্যচর্চার সঞ্চয় ছিল মনোজবসুর লেখক হওয়ার পাথেয়। মনোজ বসু সাত বছর বয়সেই বঙ্কিম বাবুর লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। জীবনে দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও কখনও থেমে থাকেনি মনোজ বাসুর সাহিত্যচর্চা। মনোজ বসুর সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবন র্চায় একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছিল। জীবন অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে সাহিত্য চিন্তার প্রতিফলন।জগৎ ও জীবনের রূপকার মনোজ বসু তাঁর লেখনীতে বিচিত্র রামধনু এঁকেছেন, সৃষ্টি করেছেন রোমান্টিক সাহিত্য জগৎ। ১৯০৯ সালের জুন মাসে মাত্র আট বছর বয়সে লেখক মনোজ বসু হলেন পিতৃহীন। তখনও পাঠশালার গন্ডি শেষ হয়নি। পিতার মৃত্যুর পর তিনি কাকার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন। লেখক হওয়ার সাধ, স্বপ্ন, বাসনা সব কিছুর উপর পড়ল যবনিকা। এক নিদারুন অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রথমে নিজ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে মনোজ বসু উচ্চ লেখাপড়া শেখার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। কোলকাতায় এসে তিনি কলকাতা রিপন কলেজিয়েট হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯১৯ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর তিনি খুলনার বাগেরহাটে এসে বাগেরহাট কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই তিনি ১৯২২ সালে এফএ পাস করে আবার কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি সাউথ সুবার্বন কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকেই তিনি ১৯২৪ সালে বিএ পাস করেন। কলেজে ছাত্র থাকা কালীন মহাত্মা গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে আইন পড়া শুরু করলেও অর্থনৈতিক কারণে পড়া বন্ধ করতে বাধ্য হন। যোগ দেন শিক্ষকতায়। ভবানীপুর সাউথ সাবারবন বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। পরে পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যচর্চার জন্য শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করেন এবং তিনি ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’ নামে প্রকাশনী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ‘বাঘ’ গল্পটি সম্পর্কে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। গুরু সদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলার শক্তি’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে, তিনি পত্রিকাটি সম্পাদনাসহ ‘সাহিত্যের খবর’ পত্রিকাটিও সম্পাদনা করতেন। তিনি বাংলা সাহিত্য আকাদেমির সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম এবং কলকাতার নিখিল ভারত লেখক সম্মেলন ও নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। গ্রন্থ প্রকাশনা ব্যবসায় তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রন্থ প্রকাশনার সাথে সাথে তিনি নিজেই উপন্যাস লেখা শুরু করেন। মনোজ বসুর সমস্ত সাহিত্যকর্মের মূল ভিত্তি হলো তাঁর নিজ জন্মভূমি ডোঙ্গাঘাটা ও তার আশপাশ এলাকা। ভুলি নাই’র কাহিনীও ডালপালা গজিয়ে মহীরূহ হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলকে ঘিরেই। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে দেশ, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি সমস্যা ও গ্রাম বাংলার নিসর্গ ও গ্রামীন মানুষের জীবনাচরণ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। গ্রামীন মানুষের জীবনাচরণ কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর উপন্যাসের মূল ভিত্তি। সমকালীন সমাজব্যবস্থা, দেশের রাজনীতি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের আলেখ্য তাঁর সাহিত্যে নিপুণভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব শিল্পকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আত্মস্বার্থহীন মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি তাঁর গল্প-উপন্যাসে তিনি অত্যন্ত নৈপুণ্য ও আন্তরিকতার সাথে অংকন করেছেন। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই তিনি অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় প্রতিটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এর জন্যই তাঁর গল্প উপন্যাসগুলো প্রতিটি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মনোজ বসুর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো, উপন্যাসঃ ভুলিনাই (১৯৪২), সৈনিক (১৯৪৬), জলজঙ্গল (১৯৫১), বৃষ্টি বৃষ্টি (১৯৫৭), আমার ফাঁসি (১৯৫৯), রক্তের বদলে রক্ত (১৯৫৯), মানুষ গড়ার কারিগর (১৯৫৯), রূপবতী (১৯৬০), বন কেটে বসত (১৯৬১), নিশিকুটুম্ব (১৯৬৩), পথ কে দেখাবে। গল্পগ্রন্থ: বনমর্মর (১৯৩২), নববাঁধ (১৯৩৩), দেবী কিশোরী (১৯৩৪), পৃথিবী কাদের (১৯৪০), একদা নিশীথ কালে (১৯৪২)। নাটকঃ প্লাবন, নতুন প্রভাত, রাখিবন্ধন ও শেষলয়। মনোজ বসু ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তাঁর লিখিত ‘ভ্রমণ কাহিনীঃ , ‘চীন দেখে এলাম’, ‘সোভিয়েতের দেশে দেশে’, ‘নতুন ইউরোপ নতুন মানুষ’, ‘পথচলি’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ হিন্দী, ইংরেজী, গুজরাটি, মারাঠা, মালয়ালাম ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গ্রন্থ চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি সরূপ স্বদেশে ও বিদেশে লেখক পেয়েছেন অভাবনীয় স্বীকৃতি ও পুরস্কার। ‘একাডেমী পুরস্কার’ ও ‘নরসিংহদাস’ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয় প্রদত্ত ‘শরৎচন্দ্র পদক ও পুরস্কার’ অমৃত বাজার পত্রিকা প্রদত্ত ‘মতিলাল ঘোষ’ পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৮৬ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ মনোজ বসু। আজ তার ৩২তম মৃত্যুবাার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মনোজ বসুর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৫৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×