ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। আধুনিক, সংস্কারবর্জিত, শিল্পসম্মত ও রুচিশীল এক চলচ্চিত্র-ভাষার সূচনা করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। নিজগুণে এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন সমসময়ের চিত্রভাবনার ৷ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী। দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার ১২টিই বিভিন্ন শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর গোটা জীবন সৃজনশীল রূপান্তরের কাজ করেছেন খুব দক্ষ হাতে ৷পরিচিত কোনো গল্প থেকেও যদি ছবি বানিয়েছেন, তাও হয়ে উঠেছে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এক ট্রান্সক্রিয়েশন। তাঁর নান্দনিক বোধ, তাঁর রুচিশীল, মার্জিত উপস্থাপনা, সবকিছু চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থীদের অনুসরণ করার যোগ্য ৷ ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি হীরের আংটি। দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান। ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে হীরের আংটি, অন্তরমহল, আবহমান, রেইনকোট, উনিশে এপ্রিল, নৌকাডুবি, চিত্রাঙ্গদা প্রভৃতি। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে তার। ‘আবহমান‘ চলচ্চিত্রের জন্য সর্বশেষ ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ব্যাক্তিগত জীবনে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। তিনি নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষ করেছেন। ২০১০ সালে একটি জনমত জরিপে ‘দশকের সেরা বাংলা চলচ্চিত্রকার’ নির্বাচিত হন ঋতুপর্ণ। তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন এই নির্মাতা। ২০১৩ সালের ৩০ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন এই বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯৬৩ সালের ৩১ অগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তার পিতার নাম সুনীল ঘোষ। তার পিতা মাতা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা এবং মা ছিলেন চিত্রকর। সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন। কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে শ্যুটিংয়ে যেতেন তিনি। ওই বয়সেই ক্যামেরা চালানো, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য লেখার হাতেখড়িও হয়ে যায়। চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন কলকাতার একজন "অ্যাডভারটাইসমেন্ট কপিরাইটার"। ১৯৮০-র দশকে বাংলা বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বেশ কিছু জনপ্রিয় এক লাইনের শ্লোগান লিখে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় কলকাতায় ইংরেজি ও হিন্দি বিজ্ঞাপনগুলি বাংলায় অনুবাদ করে চালানো হত। ঋতুপর্ণ বাংলায় স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপনী শ্লোগানের ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্ট বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপনদুটি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। কোনো কোনো সমালোচকের মতে, (বিজ্ঞাপনী চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে) দর্শকদের কাছে আবেদন পৌঁছে দেওয়ার এক বিশেষ দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, যা তাঁর ছবি বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে জনপ্রিয় করে তোলে।
বিজ্ঞাপন জগত ছেড়ে প্রথম ছবি করেছিলেন হীরের আঙটি। ছবিটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। এটি ছিল ছোটোদের ছবি। এতে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী, মুনমুন সেন প্রমুখেরা। আর তারপরেই উনিশে এপ্রিল। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ১৯৯৫ সালে উনিশে এপ্রিল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়। এটি ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম জাতীয় পুরষ্কার এনে দেওয়া চলচ্চিত্র। উনিশে এপ্রিলের পরে দহন, উৎসব, চোখের বালি, অন্তরমহল, সব চরিত্র কাল্পনিক, নৌকাডুবির মতো একের পর এক ছবি তৈরি করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যার প্রত্যেকটি ছবিই সতন্ত্র,অনবদ্য। তাঁর ১২ টি চলচ্চিত্র জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে। এছাড়াও পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরষ্কার এবং সম্মান। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ছবিও নির্মাণ করেছেন তিনি। ঐশ্বরিয়া রাইকে নিয়ে প্রথমবারের মতো তৈরি করেন হিন্দি ছবি ‘রেইনকোট’। ইংলিশ লেখক ও’ হেনরির ছোটগল্প ‘দ্য গিফট অব মেজাই’ অবলম্বনে নির্মিত রেইনকোট ছবিটি ২০০৪ সালে বেস্ট ফিচার ফিল্ম বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ২০০৭ সালে বিখ্যাত লেখক শেকসপিয়রের অনুসারী এক অবসরপ্রাপ্ত থিয়েটার কর্মীর জীবনী নিয়ে তৈরি করেন ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’। ইংরেজি ভাষার এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন। অভিনয় জীবনে ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি কথা দেইথিল্লি মা কু-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। এর পর ২০১১ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবির বিষয় ছিল সমকামিতা। ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়। কর্মজীবনে টেলিভিশনে ঋতুপর্ণ দুটি সেলিব্রিটি চ্যাট শো সঞ্চালনা করেন। এগুলি হল ইটিভি বাংলার এবং ঋতুপর্ণ এবং স্টার জলসার ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি। একটি অনুষ্ঠানে মীর ঋতুপর্ণ ঘোষকে নকল করে মস্করা করার পরে নিজের টেলিভিশন অনুষ্ঠান ঘোষ এন্ড কোম্পানীতে আহ্বান করে মীরের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। এটি কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করে। গানের ওপারে অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্টরাইটারও ছিলেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ফিল্ম ম্যাগাজিন আনন্দলোক সম্পাদনা করেন।
২০১৩ সালের ৩০ মে তাঁর কলকাতার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে। তাঁর দুই পরিচারক দিলীপ ও বিষ্ণু তাকে বিছানায় অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পান। প্রতিবেশী নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত ডাক্তার নিরূপ রায়কে খবর দেন। তিনি এসে ঋতুপর্ণ ঘোষকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে ঋতুপর্ণের বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্র অবলম্বনে সত্যান্বেষী'র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর অমোঘ হাতছানি তাকে শেষ ছবিটির সফলতার আনন্দ উপভোগ করতে দিল না। ছবিটি অসমাপ্ত থাকার কারনে চিত্রাঙ্গদাই হয়ে রইল তাঁর শেষ চলচ্চিত্র। পূর্বে পুরুষদের পোষাক পড়লেও মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি মহিলাদের পোষাকই পরতেন। এজন্য তাঁকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা তামাশা করলেও তিনি নিজের চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসেন নি এবং নিজের শর্তেই জীবন কাটিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে যাঁরা মজা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি তর্কও করেছেন।
শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না। বরং জেন্ডারকে একমাত্র মহান শিল্পীরাই অতিক্রম করে যেতে পারেন। যেটি অতিক্রম করতে যে মহত্ব, মানবিকতা, বিপুল বিস্তারিত যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়, তা বরাবরই ছিলো ঋতু পর্ণের। তিনি নিজেই বলেছিলে ‘শিল্পীকে যে তার জেন্ডার অতিক্রম করে যেতে হয় সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। সামাজিক লিঙ্গ আমার পরিচয় নয়। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না, এটা বাবা-মা, ই আমাকে শিখিয়েছিলেন।’ তাঁর মৃত্যুতে অগণিত চলচ্চিত্রপ্রেমী যেমন আজ শোক পেয়েছেন, তেমনই সমকামী ও হিজড়াদের সংগঠনগুলি বলছে তারা হারালেন স্বজনকে, যিনি নিজের লেখা, ছবির মাধ্যমে বারবার তাঁদের মতো মানুষদের খাটো করে দেখানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন। প্রত্যেক প্রজন্মের একজন মহিরূহ প্রয়োজন, যাঁর দিকে প্রচুর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায়৷ যাঁর থেকে অনেক কিছু শেখা যায়, যাঁর ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যায় সংকটের সময় ৷ ঋতুপর্ণ ছিলেন সেই মহিরূহ ৷আজ এই গুণী চলচ্চিত্রকারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
একটি ছবি হাজার কথা বলে
আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন
অদ্ভুতত্ব.....
অদ্ভুতত্ব.....
আমরা অনিয়ম করতে করতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, অনিয়মকেই নিয়ম আর নিয়মকে অনিয়ম মনে হয়। নিয়মকে কারো কাছে ভালো লাগে না, অনিয়মকেই ভালো লাগে। তাই কেউ নিয়ম মাফিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের কালো রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অধ্যাপক ইউসুফ আলী !
অধ্যাপক ইউসুফ আলী মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন।
উনি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক। ৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য হন। ৬৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য,... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি
ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার দশটা ইচ্ছে
প্রত্যেক রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে হয়-
যদি সকালটাকে দেখতে না পাই। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিস কি? তাহলে বলব মানুষের বেচে থাকা। মরে গেলেই তো... ...বাকিটুকু পড়ুন