খ্যাতনামা আধুনিক রুশ সাহিত্যের স্থপতি কবি আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন, যাকে রাশিয়ান প্রধান জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। আলেক্সান্দর পুশকিন প্রেম বিষয়ক কবি হিসাবে জগদ্বিখ্যাত। সমসাময়িককালে তিনি শুধু রাশিয়ান হিসাবেই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতে অত্যন্ত শক্তিমান কবি হিসাবে স্বীকৃত। রুশ সাহিত্যে পুশকিনের আসনের সঙ্গে তুলনীয় ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপীয়র, জার্মন সাহিত্যে গোয়টে ও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আসন। কথাসাহিত্যিক ও সমালেচক ভ্লাদিমির নাবোকভ বলেছেন, "সব কটি রুশ সম্রাটের রাজত্বকাল মেলালেও পুশকিনের কবিতার একটি পঙক্তিরও যোগ্য হবে না"। মূলতঃ কবি হলেও তিনি নাটক, গল্প, মহাকাব্য, উপন্যাসও লিখেছেন। মাত্র আটত্রিশ বৎসর আয়ুষ্কালে তিনি রুশ ভাষা ও সাহিত্যে একাধারে আধুনিক কাব্যভাষা, বাস্তববাদ, গদ্যকাহিনী, ট্রাজেডি, কাব্যনাট্য প্রভৃতির জনক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। পুশকিন ছিলেন রাজতন্ত্র বিরোধী। রাশিয়ান রাজতন্ত্রে জারের রাজনৈতিক পুলিশের কঠোর প্রহরায় প্রকাশনা যখন কঠিন ছিল, তখনই নিজের জনপ্রিয়তম নাটক বরিস গদুনভ রচনা করেন। পুশকিন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে সম্রাট প্রকাশ্যে কিছু করার সাহস পাননি, কিন্তু আমৃত্য তার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি গোপনে কবির ব্যক্তিগত দাম্পত্য সম্পর্কের চিঠিপত্রও খুলে খুলে পড়ত। তাকে নাস্তিক হওয়ার জন্য নির্বাসন দণ্ডও ভোগ করতে হয়েছিল কিছুকাল। রাশিয়ান রোমান্টিজম এর প্রদর্শক হিসাবে স্বীকৃত পুশকিনের ২১৪তম জন্মদিন আজ। ১৭৯৯ সালের আজকের দিনে তিনি রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহন করেন। আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিনের জন্মদিনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা।
(শিশু আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন)
আআলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন ১৭৯৯ সালের ২৬ মে জার শাসিত রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা সের্গিয়েই-এর পরিবার ছিল অন্তত ছ’শ বছরের পুরনো রুশ প্রাচীন অভিজাত বংশগুলোর একটি। আর মা ছিলেন সম্রাট পিওৎর ভেলিকি- যাকে আমরা পিটার দ্য গ্রেট হিসেবে জানি, তার অতি ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য রাজন্য আব্রাহম গানিবালের দৌহিত্রী। তদনীন্তন খান্দানি পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী বাড়িতে ফরাশি গর্ভনেস রাখা হয়েছিল পুশকিনের জন্য। বাড়ির ফাইফরমাশ খাটার জন্য ছিল জার্মন চাকরবাকর, ইংরেজ পরিচারিকাও ছিল। আর ছিলেন আরিনা নামের দাই মা। যার মুখের ঘুমপাড়ানি ছড়া, গল্প ইত্যাদি শুনে শুনে সাধারণ রুশী জনজীবন ও মানুষজনের ভাষা বিষয়ে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। জীবনীকারগণ বলেছেন, পুশকিন ফরাশি জানতেন ফরাশিদের মতোই, জার্মন, ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পারতেন, গ্রিক ও লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্য উত্তমরূপে পাঠ করেছিলেন এবং সমকালীন ইউরোপীয় ও মার্কিন কবি সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। পুশকিনের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে কিশোর বয়সেই। মাত্র পনের বছর বয়সে প্রথম তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। রুসলান ই লুদমিনা (রুসসান ও লুদমিলা) নামে কাহিনীকাব্য ১৮২০ সালে প্রকাশিত হলে তখন থেকে উদায়মান যুগান্তকারী কবি হিসেবে পূর্বসূরী কবিকুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তী দশ বছর নানা ধরনের কবিতা রচনা, কবিতা ও কাব্যভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও উদ্ভাবনায় ব্যাপৃত থাকেন। পরে তাঁর মন যায় গদ্য রচনার দিকে- গদ্যকাহিনী নির্মাণ, ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণা ইত্যাদি। তাঁর লেখা রচনার প্রায় সবই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়া ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, পোলিশসহ আরো অনেক ভাষায় তাঁর লেখা ভাষান্তরিত, অনূদিত হয়েছে। অনুবাদ করা শক্ত হলেও পুশকিনের রচনা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতেই থাকবে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘ইয়েভেজেনি ওনেজিন’। উপন্যাসটি রুশ সাহিত্যের একটি মাইল স্টোন হিসেবে চিহ্নিত। এই উপন্যাসে তিনি সর্বপ্রথম বাস্তব কাহিনী-ভিত্তিক উপন্যাস রচনার দিক নির্দেশনা প্রদর্শন করেন। এ কারণে পুশকিনকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের স্থপতি তথা প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ম্যাসেঞ্জার অব ইউরোপ’ নামে কবিতার বই। তাঁর আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘রাশিয়ান অ্যান্ড লুইডম্যান’। আলেক্সান্দর পুশকিনের বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো বিশ্বসাহিত্যের উপর তাঁর প্রচন্ড দখল। তিনি রাশিয়ান কবিতা বিশ্ব দরবারে যথার্থরূপে হাজির করেছেন। পুশকিন এর সময়কে রাশিয়ান কবিতার স্বর্ণসময় বলা হয়। রাশিয়ার তখন ছিলো রাজতন্ত্র। পুশকিন ছিলেন রাজতন্ত্র বিরোধী। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে পুশকিনকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে বন্দী করে নির্বাসনে পাঠানো হয় দক্ষিণ রাশিয়ার একটি দুর্গম অঞ্চলে। রাশান নাট্যকার হিসাবে অ্যান্তন চেখভ সর্বসেরা হলেও পুশকিন এর নাটকগুলোও সমাদৃত। তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন এবং তার সাংবাদিকতার বিষয় ছিল সাহিত্য। রুশ ভাষায় তাঁর যে সংবাদপত্র তিনি সম্পাদনা করতেন তার বাংলা নাম হতে পারে সমসাময়িক সাহিত্য।
পুশকিনের অসংখ্য কবিতা তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। রাশিয়ান রোমান্টিজম এর প্রদর্শক হিসাবে স্বীকৃত পুশকিন এর “আমি তোমাকে ভালবাসতাম, সম্ভবত এখনও ভালবাসি” I loved you, and I probably still do কবিতাটি একটি শক্তিশালী ভালবাসার কবিতা হিসাবে সমাদৃত। এ কবিতায় একজন প্রেমিকাকে ভালবাসার কথা বলেছেন। যাকে প্রেমিক ভালবাসতেন, দূরে সরে যাবার পরও ভালবাসেন। কখনও কখনও তিনি প্রেমিকার ভালবাসার আবেগনাভুতি স্মরণ করেন। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে উল্লেখ করেন যে তার ভালবাসা প্রেমিকার জন্য বিড়ম্বনা বয়ে আনবে না। কবি তার প্রেমিকার জন্য কোন দুঃখ/যন্ত্রণার কারণ হতে চান না। কবি কোন আশা ছাড়াই তার প্রেমিকাকে ভালবাসতেন। এতে ঈর্ষা ছিল, সঙ্কোচ ছিল, কিন্তু আশা ছিল না। এ ভালবাসা ছিল অত্যন্ত শক্ত ও সত্য। যদি ঈশ্বর দয়া করেন তবে আবারও ভালবাসা হতে পারে।
I LOVED YOU AND I PROBABLY STILL DO
কবিতাটি লিখেছেন Alexander Sergeyevich Pushkin
ইংরেজি অনুবাদ করেছেন Genia Gurarie
I loved you, and I probably still do,
And for a while the feeling may remain...
But let my love no longer trouble you,
I do not wish to cause you any pain.
I loved you; and the hopelessness I knew,
The jealousy, the shyness - though in vain -
Made up a love so tender and so true
As may God grant you to be loved again.
ভালবাসতাম কবিতাটির বঙ্গানুবাদঃ
ভালবাসতামঃ আলেক্সান্দর পুশকিন
তোমাকে ভালবাসতাম, বোধকরি এখনো বাসি
সে দীপশিখাটি নিভেনি আজো, অবশ্য
এটা আমার ভেতর এখন এতো শান্তভাবে জ্বলছে যে
তোমার বিব্রত বোধ করার কোনো কারণ নেই।
নীরবে প্রতিদানহীনভাবে তোমাকে চেয়েছিলাম
খুব ঈর্ষা হতো কখনো, কখনো শরমিন্দা,
ঈশ্বর যেন তোমাকে এমন একজন মিলিয়ে দেন
যে তোমাকে ভালবাসবে ঠিক আমারই মতো
সন্তর্পণে ও বিশ্বস্ততায়।
পুশকিনের ব্যক্তিগত জীবন খুব সুখের ছিল না। তিনি বিবাহ করেছিলেন নাতালিয়া ইভানভনা গনচারভা নামের এক ডাকসাইটে বহুবল্লভা সুন্দরীকে। প্রাক বৈবাহিক দিনগুলোয় কবির বোহিমীয় জীবন, পানাসক্তি ও লাম্পট্য ছিল সুবিদিত। কিন্তু বিবাহোত্তর কালে তিনি সংসারী, পত্নীগতপ্রাণ, সুখী হতে চেয়েছিলেন। সন্তানও হয়েছিল কয়েকটি। কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাবে কে? জর্জ দঁত্যা নামের জনৈক ফরাশি কবি-স্ত্রীর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা পাকিয়ে তুললেন যে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য ভদ্রলোককে ডুয়েলে আহ্বান না করে পুশকিনের গত্যন্তর থাকল না। প্রখর আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন পুশকিন ২৯টি দ্বন্দ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন। ১৮৩৭ সালে ধোপা খানার খালের ধারে বারো নম্বর বাড়ীর উঠোনে ফরাসি সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিক জর্জ চার্লস ডি হিপোরেনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে মারাত্মক আহত হন পুশকিন। জানা্ যায় হিপোরেন কবিপত্নী নাতালিয়া পুশকিনাকে বলাতৎকার করতে চেয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ১৮৩৭ সালের ০৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে রাশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতনামা কবি আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন তার সেন্ট-পিটার্সবার্গের মইকা সড়কের নিজ বাস ভবনে পরলোক গমন করেন। সেই থেকে আলেক্সান্দার পুশকিনের স্মরণে পুরো রাশিয়া জুড়ে তাঁর মৃত্যুদিবস পালিত হয়। আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন অকালে মারা গেলেও আজো তিনি আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক বলে স্বীকৃত। শুধু রাশিয়ায় নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আলেক্সান্দর পুশকিনের প্রায় ২০০ স্মৃতিমূর্তি আছে। রাশিয়ায় প্রধান জাতীয় কবি আলেক্সান্দর পুশকিনের আজ ২১৬তম জন্মবার্ষিকী। রাশিয়ার শেক্সপীয়র নামে খ্যাত আধুনিক রুশ সাহিত্যের স্থপতি আলেক্সান্দর পুশকিনের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
আলেক্সান্দর পুশকিন সম্পর্কে আরো জানতে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৫ সকাল ১১:৩২