মনির মামার মন খুব খারাপ, খারাপ বলতে খুবই খারাপ। আমি উনার বাসায় ঢুকেই উনার মন খারাপের চেহারা দেখে একটু অস্বস্তি ফিল করতে লাগলাম। উনি ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। সাধারণত কেউ মন খারাপ করে থাকলে আমি তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারিনা। অন্য দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি সমস্যা মামা মন খারাপ কেনো? উনি কোনো জবাব দিলো না! বাসার ভিতর থেকে মামী তার ছেলেকে বেধড়ক পিটাচ্ছে। মামাতো ভাইয়ের কান্না শুনে ভিতরে গেলাম, মামীকে বললাম এত মারার কি হলো, রাগ কমান, শান্ত হউন। আমাকে বলুন সাকিব কি করেছে এত মারছেন কেনো ওকে!
বিছানার উপর সাকিবের পরীক্ষার ড্রয়িং খাতা যেটাতে সে একটা ছবি এঁকেছে। একটা লোক একটা মহিলার উপর শুয়ে আছে এমন কিছু। এরপর ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগেনি আর আমার। আসার সময় মামাকে বললাম বাচ্চা বড় হয়েছে তাকে আলাদা রুমে রাখেন আর নিজেরাও একটু সতর্ক হউন।
আমি হলে গিয়ে সিনামা দেখিনি খুব একটা। আমার এইচএসসি পরীক্ষার শেষ সাবজেক্ট দিয়ে সেদিনই হল থেকে বাড়ি চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হটাৎ কি মনে করে হলে গিয়ে ছবি দেখার ইচ্ছে জাগলো। সবকিছু ঘুচিয়ে রেখে সিনামা দেখার জন্য বের হলাম। তখন নোংরা ছবি চালানোর জন্য অনেক হল বন্ধ করে দিয়েছিল ফখরুউদ্দিন সরকার। আমাদের এখানেও দুইটা সিনামা হলের মধ্যে একটা সিনামা হল বন্ধ করে দেয়। যে সিনেমা হলটিতে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম সেটা গিয়ে বন্ধ দেখতে পাই। তাই অন্য সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঐখানে যাওয়ার পথে আমাদের জেলা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস পড়ে। আমি হেটেই যাচ্ছিলাম। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে এসে আমি আমাদের পাশের বাড়ির শরীফ কাকাকে দেখতে পাই। উনি অফিসের ভিতর থেকে জমিলা দাদিকে নিয়ে বের হচ্ছেন। আমি উনাকে দেখে লুকানোর চেষ্টা করি আর উনি আমাকে দেখে লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। আশেপাশে খুব বেশি দোকানপাট না থাকায় উনি জমিলা দাদিকে নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন।
আমি তখনও কিছু বুঝতে পারিনি, আমার মাথায় আসেনি উনি কেনো আমাকে দেখে লুকানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। যাক এর তিন বছর পর আমি একদিন ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলাম, গিয়ে শুনতে পেলাম শরিফ চাচাদের বাড়িতে সালিশ বসেছে। শরিফ চাচার দুই ছোট ভাই উনাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছেন। উনাকে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক বলে মারার জন্য বারবার তেড়ে আসছে। পরে জানতে পারলাম জমিলা দাদি মারা যাওয়ার পর জমিজমা ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে দেখা যায় জমিলা দাদি নাকি উনার নামে ৮শতক জমি লিখে দিয়ে যান!
আমরা যেবার এসএসসি পরীক্ষা দিই সেবার মোটামুটি পরীক্ষা সহজই হচ্ছিল। আমি ফার্স্ট বয় ছিলাম আমাদের সে ব্যাচের। পরীক্ষা নিয়ে আমার বাড়তি কোনো টেনশন কাজ করছিল না। আমার সামনে আমাদের স্কুলের একটি মেয়ের সিট পড়ছিল। মেয়েটির নাম শারমিন। সে পড়ালেখায় একেবারেই কাঁচা। লাজুক প্রকৃতির মেয়ে ছিল। আমিও তখন মেয়েদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে খুবই লাজুক ছিলাম। মেয়েটি লজ্জার জন্য আমাকে কিছুই বলতে পারছিল না। আমার খাতার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। আমি তাকে আমার খাতা দেখার জন্য কিছুই বলছিলাম না। আবার তাকে সাহায্যও করছিলাম না। সে হয়তো চাচ্ছিল আমি তাকে আমার খাতা দেখার ব্যাপারে অভয় দিই কিন্তু আমি সেরকম কিছুই বলছিলাম না। একাউন্টিং পরীক্ষার দিন আমি প্রায় আধাঘন্টা আগে আমার লেখা শেষ করে বসে আছি। কি মনে করে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে এখনো সাদা খাতা নিয়ে বসে আছি। আমি এই প্রথম তার সাথে কথা বললাম, বললাম আমার খাতা দেখে লেখ। আমি মেলে ধরছি। সে লিখতে লাগলো। এরপর বাকি সব সাবজেক্ট সে আমার খাতা দেখে লিখলো।
আমার রেজাল্ট পাওয়ার পর আমি শারমিনের রেজাল্ট দেখতে লাগলাম। দেখলাম শারমিন ফেল করেছে। কয়েকদিন পর মার্কশিট আসলে আমি ওর মার্কশিট দেখি। দেখলাম একাউন্টিং এর পরের সব সাবজেক্টে শারমিন ভালো ভাবেই পাশ করেছে। বাকি গুলো সে পাশ করতে পারেনি। এরপর থেকে নিজের মধ্যে আমার প্রচন্ড অনুশোচনা আসে! এখনো এই ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১১:২৯