কাতার। মধ্য-প্রচ্যের ধনকুবের দেশ। আজ এখানে ঈদের দ্বিতীয় দিন। এক বন্ধুর সাথে গেলাম ‘মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া বাংলাদেশী স্কলারশীপদ্বারী’ ছাত্র-বন্ধুদের দেখতে। যাওয়ার আগে ক’জন ভাইকে জানালাম। ফোনে আমরা আসছি শুনে, তাদের খুশি কে দেখে অবস্থা! যায়ের বা যিয়ারাতকারী হিসেবে আমরা তেমন উল্লেখ যোগ্য কেউ নয়। তারপরও আমরা যাচ্ছি শুনে তারা খুশি। একজনতো আমাদের অপেক্ষায় রীতিমতো অনেক আগে থেকে গেইটে দাড়িঁয়ে! ভালভাবে পথ জানা নেই, তাই পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল। সামান্য দেরি। তারপরও তা তাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। যাক সে কথা, শেষ পযন্ত আল্লাহ তা'য়ালার রহমতে নিরাপদে পৌঁছলাম। চারিদিকের পরিস্কার পরিচন্ন, উন্নত পরিবেশ সহজে যে কারো নজর কাটে । নতুন হোস্টেল। নতুন ব্যবস্থাপনা। সবকিছুর সুন্দর ইন্তেজাম। দেখে যে কেউ সহজে মুগ্ধ হবে। ভেতরে গেলাম। একে একে সবার সাথে দেখা হতে থাকলো। তাদের দেখে মনে হল আমাদের আগমনে তারা বেশ খুশি। কতগুলো হাসি-খুশি ও হৃদয়-চঞ্চল ছেলে। দেখে খুব ভাল লাগার মতো। নিচতলার ’ভিজিটর রুমে’ আমরা বসলাম। প্রবাস জীবনে একে-অপরের সাথে দেখা হলে যা হয়। কোন ভূমিকা ছাড়া মূল আলোচনায় এসে যাওয়া। কথা শুরু হল। কেমন আছো? বাবা-মা কেমন আছেন? দেশের খবর কি? সবার সাথে কথা হলো কিনা? আরো কতো কথা। এসব মজলিসে সাধারণত বিষয় পরিবর্তনের কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম থাকে না। সে নিয়মেই কথা হচ্ছে। একটু পরপর একেকজন আসছে আর ঢ়ু মারছে আলোচনায়। মুখ থেকে মুখে কথা পার হয়ে যাচ্ছে। যেন পরিক্ষার নির্ধারিত সময়। পার হয়ে গেল আর পাওয়া যাবে না। ফেল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এরকম এক আনন্দগন পরিবেশে কথা হচ্ছিল। বেশ হাসি-খুশি পরিবেশ। তবে একটা বিষয় জিজ্ঞেস করলে সবাই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তাদের মন যেন হারিয়ে যায় নিকট বা দূরের কোন অতীতে। জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু মুখে কথা আসতে চায় না। মুখে হাঁসি ভাব আনার চেষ্টা করে কিন্তু অনিচ্চা সত্তেও চেহারায় কেমন যেন একটা ‘হাহাকার’ ভাব চলে আসে। হেসেই জবাব দিচ্ছে কিন্তু সে হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে একরাশ বিসন্যতা। কথা-বার্তায় বেশ চঞ্চল মনে হলেও এখানে এসে কেমন যেন হেরে যাচ্ছে। আর পারছে না। মন যেন আর সায় দেয় না। এ যেন জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা। যা প্রবাস জীবনেই হয়। কতই বা আর বয়স হবে তাদের। পনের থেকে বিশ? বেশ ক’টি নতুন চেহারাও দেখলাম। লাজুক প্রকৃতির ছেলে। কথা বলতে কেমন যেন বাঁধা পড়ছে! থেমে থেমে কথা বলছে। অন্যের সাহায্য নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। যেন ‘বাইবা’র মতো কখন শেষ হবে সে অপেক্ষায় আছে। বাস্ততে কিন্তু তা নয়। বোঝা যাচ্ছে তারাও বেশ আনন্দিত। তাদেরও কথা চালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লাজুকতা এসে বারবার মাঝ পথে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে। বলেছিলাম আজ ঈদের দ্বিতীয় দিন। আল্লাহ তা’য়ালার বছরে দুটি ঈদের বিধান রেখেছেন। বান্দাদের আনন্দ-খুশি উৎযাপনের জন্য। তাই ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজনদের মিলন মেলা। আনন্দ-খুশিকে ভাগাভাগি করার উত্তম সময়। ঈদ মানে চেনা অচেনার বাধ ভেঙে সকলকে আপন করার সফল চেষ্টা। এ ছেলেগুলোকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাদের কাছে ঈদের খুশির সময়টা এক রকম ‘বোঝা’ মনে হচ্ছে। এমন বোঝা যা তারা পেলতেও পারছে না আবার ধরতেও পারছে না। যা তাদেরকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের দিকে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে হারানো স্মৃতিগুলো। এ ঈদ আনন্দকে তারা উপভোগের চেষ্টা করছে দূর-নিকট অতীতের স্মৃতিগুলে দিকে তাকিয়ে। বর্তমানটাকে ভুলার এ যেন এক ব্যর্থ চেষ্টা।
কাতারে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্যামিলিগুলোর সংখ্যা খুব একটা নগন্য নয়। হাজার পাচেঁকতো হবেই। অন্যান্যদের মতো তারা অনেকে বিশেষ মূহুর্তে নিজ দেশকে খুবই মিস করেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরও পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের ঈদগুলো মোটামুটি কাটে। অধিকাংশের গাড়ি আছে। চাইলে মূহুর্তে যে কোন জায়গায় যেতে পারেন। যেমন ইচ্ছা খেতে পারেন। দুঃখ-কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। কিন্তু অন্যরা? তারা কেমন কাটাচ্ছে তাদের ঈদের সময়? বিশেষত এই ছোট-ছোট ছেলেগুলো কিভাবে কাটছে তাদের ঈদ? এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হোস্টেল কতৃপক্ষ তাদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। ভ্রমনের ব্যবস্থা করেন। আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠান বা কতৃপক্ষ এ রকম 'রকমারি ব্যবস্থা' নেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু এতো সব কাতারের সরকারি ব্যবস্থা। তাই বলে, আজ ঈদের দিনও কি বাংলাদেশিদের কোন দায়িত্ব নেই? বিশেষত বাংলাদেশী যেসব প্যামিলি এখানে আছে তাদের কি কোন দায়িত্ব নেই? শুধু দেশিয় আলোচনাগুলোতে সুফ-সুফ করে দেশের জন্য মায়া-কান্না দেখালেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয় যায়? তারা কি পারেন না, বছরে কমপক্ষে দু’বার হলেও এ ছেলেগুলোর খবর নিতে? কেমন আছে তারা? কেমন কাটছে তাদের ঈদ? নিজেদের ছেলে-মেয়েদের ঈদ খুশির ব্যবস্থা করতে তারা কি বহুদিন আগে থেকে উঠে-পড়ে লাগেন না? মার্কেট থেকে চসে বেড়ান না? এসব সন্তানদের মায়েরা কি তাদের সন্তানদের পছন্দের খাবার-পড়ার জন্য বস্ত সময় কাটান না? তাহলে? এই যে, হাজার মাইল দূরে মা-বাবাকে ছেড়ে কিছু ছেলে এখানে এসে হোস্টেলে বসবাস করছে, তাদের জন্য সামান্য মওসুমি ব্যবস্থা করতে তাদের মন চায় না?
এখানে হোস্টেলে পনের থেক বিশজন ছেলে মাত্র। এ ছেলেগুলোর এক বেলা খাবরের ব্যবস্থা করতে কতো টাকা আর লাগবে? কিন্তু এ সামান্য খরচে কতো সহজে তারা এতোগুলো ছেলের ঈদ উপভোগের ব্যবস্থা করতে পারেন! তারা কি তা জানেন? অদৈ তারা কি সে চিন্তা করেন? নাকি তাদের সে চিন্তার সময় আছে! বিদেশ মানে কি সারা বছর টাকার পাহাড় গড়ার হিসেব করা। কি হবে এসব টাকায়? যে টাকা থেকে সামান্য একটি অংশ বাবা-মা ছেড়ে হাজারো মাইল দূরে পড়ে থাকা নিজ দেশের ছেলেদের জন্য খরচ হয় না। এ টাকা দিয়ে জাতি আর কি উপকৃত হবে? টাকার পাহাড় গড়ে টাকার ‘ধনী’ হওয়া যায় বঠে। বাস্তব ধনী হওয়া যায় বলে মনে হয় না। আর টাকা দিয়ে দুনিয়ায় সামান্য আহল্লাদি করা যায় বটে। তবে এসব টাকায় আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি মিলে বলে মনে হয় না। যে টাকা তাঁর বান্দাদের সুখে-দুঃখে কাজে আসে না, সে টাকা কখনো তিনি পচন্দ করেন বলে কখনো মনে হতে পারে না।
নিজ আত্মীয়ের নাম প্রচারে বলছি না। বরং বাস্তব অভিজ্ঞার কথা বলছি। কাতারে আমার ছোট মামা ও ভাইয়া থাকেন। ইহসান ভাইয়া এখন দেশে। তিনি থাকলে ঈদের এ ক’দিন আমার মতো ভিনদেশীদের পেছনে পড়ে থাকতেন। মনকে উজাড় করে দিতেন। কোথায় যাওয়া যায়? কি খাওয়া যায়? কিভাবে খাওয়া যায়? কখন খাওয়া যায়? আমাদের নিয়ে তার এসব ব্যস্ততা দেখে আমরা রীতিমতো হাসা-হাসি করি। বেশ ক’জন বন্ধুতো জোর গলায় বলেন- ‘আমাদের ঈদ হবে ইহসান ভাই দেশ থেকে এলে।‘
আমার ছোট মামাও অনেকটা সে রকম। ঈদের দিন ‘ইউনির্ভাসিটি হোস্টেলে’ যে ক'জন বাংলাদেশী ছাত্র আছে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। আবার পরের দিন যাওয়ার জন্য খুব বলেছেন। এক বেলা খেয়ে খুশি মনে আমরা চলে আসলাম। মনে হলো ঈদটা সার্থক হয়েছে। কতো টাকা তাঁর খরচ হলো! অতচ ক’জন ছেলে আমরা খুশি মনে ফিরে আসলাম। তিনি একা মানুষ তাই সব বাংলাদেশী ছাত্রকে দাওয়াত দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হলো না। হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি সে চেষ্টা করতেন।
কিন্তু অন্যরা কোথায়? তাদের উপর কি কোন দায়িত্ব নেই। এ রকম তো নয় যে, এখানে বাংলাদেশি পরিবারহীন ছাত্ররা পড়াশুনা করে তা কেউ জানেন না।
সামান্য টাকায় বাংলাদেশি হোটেলে খুব সুস্বাদু 'দেশীয় খাবার' পাওয়া যায়। তাই বলে ঈদের দিন বাংলাদেশি হোটেল থেকে কিনে খাব? তাহলে অন্যদিনের সাথে ঈদের পার্থক্যটা কোথায়?
আসার মূহুর্তে এক ভাইয়ের কথা-শুনে চোখে পানি আসে অবস্থা। এক কোনে ঢেকে জিজ্ঞাসা করলাম- কি মন খারাপ করেছ মনে হচ্ছে?
সে যা বলল তা শুনলে অন্তত মেয়েরা চোখের পানি রাখতে পারবেন না!
খুব ইচ্ছা হয়েছিল, প্রত্যেকের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলি। একটু চেষ্টা করি তাদের মনের কিছু কথা শুনার। যাতে মনটা একটু হালকা হয়। এ দুনিয়ায় সবকিছু ইচ্ছা করলেই কি উপাই হয়? নিজের গাড়ি নেই। গেলাম অন্য এক ভাইয়ের সাথে। তার সাথে ছিল ছোট-ছোট ছেলে। তাদের মা ছেলেদের জন্য দুঃচিন্তা করছেন! তাই তারাহুড়া করে চলে আসতে হলো। .....
চলে এলাম। প্রবাসি ছেলেগুলোকে রেখে এলাম। ফেলে এলাম। সাথে নিয়ে এলাম কিছু বিষাদময় অভিজ্ঞতা। যা স্মৃতিপটে জায়গা করে নিয়েছে আপন শক্তিতে।
(সাথে তাদের কিছু ছবি ছিল। আপলোড ওয়াইটের চেয়ে ভারি বলে ডাউনলোড হলো না)