পাঙ্গু। এক রহস্যময় দৈত্য অথবা এক দেবতার নাম। চাইনিজ মিথ অনুযায়ী যার হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল আমাদের এই ভালবাসার পৃথিবী এবং সমগ্র সৌরজগতের। এই মিথের সাথে অন্যান্য দেশে প্রচলিত মিথের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও পাঙ্গু টিকে আছে বইয়ের পাতায় কিংবা শিল্পীর চোখে কিংবা সন্তানের কান্না থামাতে ব্যস্ত কোনো মমতাময়ী মায়ের মুখে।
মিথ অনুযায়ী শুরুতে ছিল শুধুই অন্ধকার। ছিল এক আকারহীন জড়পিণ্ডবৎ অবস্থা। পাঙ্গু ছিল সেই অন্ধকারের রাজত্যে একটি সুরক্ষিত ডিমের ভিতরে। সেখানে পাঙ্গু ছিল ঘুমন্ত অবস্থায় এবং তার শরীর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যে কত লক্ষ কোটি বছর কেটে গেল তার কোনোই ইয়ত্তা নেই। পাঙ্গুর ঘুমও ভাঙ্গলো না, শারীরিক বৃদ্ধিও বন্ধ হল না। একসময় সে এতটাই প্রকাণ্ড হয়ে উঠল যে নরম ডিমটি আর তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চাপ সহ্য করতে পারল না। ফলাফল ডিমটি ভেঙ্গে গেল প্রচন্ড শব্দে। ডিমের খোসার প্রধান অংশসমূহ ভেসে ভেসে চলে গেল উপরের দিকে, যা একসময় পরিনত হল আমাদের পরম প্রার্থিত স্বর্গে। আর বাকী অংশসমূহ পতিত হল নিচের দিকে এবং একসময় পরিনত হল এই সুন্দর পৃথিবীতে ও সীমাহীন আকাশে।
পুরো ঘটনাই পাঙ্গু সচক্ষে অবলোকন করল এবং ভালোবেসে ফেলল নিজের সৃষ্ট পৃথিবী ও স্বর্গকে। সাথে সাথে ভয়ও পেল যদি পৃথিবী ও স্বর্গ আবার এক হয়ে যায়!
সেই ভয় এবং ভালবাসা থেকে পাঙ্গু দাঁড়িয়ে গেল স্বর্গ এবং পৃথিবীর মাঝখানে। প্রত্যেকদিন সে বাড়তে লাগল দশফুট করে। আর দশফুট করে দূরত্ব বাড়তে লাগল স্বর্গ এবং পৃথিবীর। এভাবে কেটে গেল আরো আটারো হাজার বছর। একসময় পাঙ্গুর মনে হল যে সৃষ্টি নিরাপদ। অতঃপর ক্লান্ত পাঙ্গু ঘুমাতে গেল। যে ঘুম আর কোনোদিন ভাঙ্গেনি।
আকাশ এবং পৃথিবী একত্রে
পাঙ্গু মারা গেল এবং তার মৃত শরীর যেন দায়িত্ব নিল পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করার। যে সূর্য্যের সন্তান হিসেবে আমরা স্বীকৃতি দেই আমাদের লালসবুজ পতাকা এনে দেওয়া পূর্বপুরুষদের। যে চাঁদের সৌন্দর্য্যের মাঝে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি সদ্য সাবেক হওয়া অতিপরিচিত কোনো মুখকে। সে সূর্য্য এবং চাঁদের উৎপত্তি পাঙ্গুর চোখ থেকে। হয়ত পাঙ্গু আমাদের এই স্বাধীনতার তৃপ্তি এবং মনে জমে থাকা বিষাদ উপলব্ধি করতে পারে!
হয়ত পাঙ্গু আমাদের অসীম ভালবাসা দেখে মুচকি হাসে যখন সবুজ ঘাসে বসে একটি তাজা কদম ফুল গুজে দেই প্রেয়সীর চুলের খোঁপায়! কারন ঘাসের উৎপত্তি পাঙ্গুর শরীরের লোম থেকে। হয়ত পাঙ্গু আমাদের জন্য ব্যথিত হয়, যখন কোনো উচু পাহাড়ে উঠে মনে জমে থাকা সব কষ্ট উগরে দিতে চাই চিৎকার করে। কারন পাহাড়ের উৎপত্তি হয়েছে পাঙ্গুর মধ্যশরীর থেকে। উৎপত্তি!
যে মেঘের সাথে আপনি আপনার অভিমানের সম্পর্ক খুজেন, সে মেঘের উৎপত্তি পাঙ্গুর নিঃশ্বাস থেকে। যে বজ্রের শব্ধ শুনলে আপনি ভয় পান, যে আলো ছাড়া আপনি অন্ধকারের মর্ম বুঝতেন না, সেসবের উৎপত্তি পাঙ্গুর কণ্ঠস্বর থেকে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ নামক যে চার দিক্ আমরা বানিয়েছি, এর উৎপত্তি পাঙ্গুর হাত-পা থেকে। মধুসূদনের কপোতাক্ষ নদের উৎপত্তিও পাঙ্গুর রক্ত থেকে।
এই অজস্র তারা এসেছে পাঙ্গুর চুল থেকে। মহামূল্যবান পাথর, খনিজ এসেছে হাড় এবং দাঁত থেকে। এ বাংলার যে মাটিতে পাকিদের পুঁতে রাখা মাইন সরাতে গিয়ে রাশিয়ান সৈন্যরা পা হারিয়েছিল, সে মাটি এসেছে পাঙ্গুর রক্ত মিশ্রিত মাংস থেকে।
চারিদিকে শুধু পাঙ্গু আর পাঙ্গু। এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীতে পাঙ্গুর অবদানের শেষ নেই। তাই সে ঠাই পেয়েছে অনেকের অন্তরে। আজও হয়ত আমার মত কেউ কেউ আবহাওয়ার সাথে পাঙ্গুর মন মেজাজের সম্পর্ক খুঁজে।
আর আজ পাঙ্গুর মন খারাপ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৩:২৮