এই মুভিটিকে নিয়ে দর্শকদের বিপুল আগ্রহের কারণ ছিলো মূলত তিনটি:
এক.
মুভিটির ষোড়ষ শতাব্দীর ঐতিহাসিক প্লট। মুসলিম মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর এবং হিন্দু রাজপুত প্রিন্সেস যোধা বাঈর বিয়ে পরবর্তী প্রেম কাহিনীর চিত্রায়ন অবশ্যই আগ্রহ জাগাবার মতোই। রাজনৈতিক মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিয়ে হয় দুই ভিন্ন কালচারের আকবর ও যোধার।
দুই.
ডিরেক্টর আশুতোষ গোয়ারিকার, যিনি এর আগে উপহার দিয়েছেন লগান : ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ইনডিয়া (২০০১) এবং স্বদেশ : উই দি পিপল (২০০৪)-এর মতো কোয়ালিটি মুভি। আর এবারই তিনি প্রথমবারের মতো এসেছেন প্রেমের কাহিনী নিয়ে।
তিন.
মুভির মিউজিক ডিরেক্টর মিউজিক মিউজিশিয়ান এর আর রহমান, যার মিউজিক রিলিজের আগেই থেকেই হিট হয়ে যায়! এর আগে যুবেইদা (২০০১) মুভিতে ১৯৫০ সালের মিউজিক উপহার দেয়া এ আর রহমান ষোড়ষ শতাব্দীর আবহে এই মুভিতে কী মিউজিক রাখছেন সেটিও একটি আগ্রহের বিষয় ছিলো। এছাড়া ধুম টু-র চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ফ্লেভারের ঋত্বিক-অ্যাশ জুটি নিয়ে কৌতুহল তো ছিলোই।
এছাড়া মুভিটির ছিলো বিশেষ কয়েকটি দিক। যেমন,
# ডিরেক্টর আশুতোষ গোয়ারিকার দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা ও জয়পুর থেকে ইতিহাসবিদদের একটি রিসার্চ টিম এনেছিলেন মুভিতে তাকে গাইড করার জন্য এবং মুভিতে ঐতিহাসিক সত্য ঠিকমতো বজায় থাকছে কিনা, তা যাচাই করার জন্য।
# মুভিটিতে সিনক্রোনাইজড সাউন্ড (শুটিংয়ের সময়ের লাইভ সাউন্ড রেকর্ড করা) ব্যবহার করার কারণে ডিরেক্টর মুভির সেটে পুরো অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন।
# মুভির আর্ট ডিরেক্টর নিতিন চন্দ্রকান্ত দেশাই তার স্টুডিওতে ঋত্বিক ও ঐশ্বরিয়ার জন্য ছোট ছোট কুড়েঘর বানিয়েছিলেন; কারণ, ডিরেক্টর চেয়েছিলেন, তারা কাজরাটেই থাকুক; প্রতিদিন মুম্বাই থেকে যোগাযোগ করার চেয়ে এটি ছিলো ভালো একটি উপায়। আধুনিক একটি বাসার সব সুবিধার ব্যবস্থা এই কুড়েঘরগুলিতে করা হয়েছিলো। এমনকি ঋত্বিকের স্ত্রী সুজান খান ও ছেলে রেহান এই ঘরে ছিলেন।
# মুভিটিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো কমপক্ষে ৮০ টি হাতি, ১০০ টি ঘোড়া এবং ৫৫ টি উট।
# রাজস্থানের রাজপুত সম্প্রদায় আশুতোষ গোয়ারিকারের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছিলো।
# মুভির "আজিম-ও-শান শাহেনশাহ" গানটির চিত্রায়নে ঋত্বিক ও ঐশ্বরিয়ার সাথে ছিলো প্রায় আড়াই হাজার ডান্স আর্টিস্ট।
# একটি দৃশ্যের জন্য শীষমহল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো প্রায় বিশ লাখ আয়না!
# স্টুডিও ১৮ (ইনডিয়ার মিডিয়া ভিত্তিক কোম্পানি নেটওয়ার্ক ১৮ ফিনক্যাপ এটির হোল্ডিং কোম্পানি) মুভিটির সাফল্য সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলো যে, তারা ৪০ কোটি রূপি বাজেটের এই মুভিটির আন্তর্জাতিক স্বত্ব কিনে নিয়েছিলো বাজেটের দ্বিগুণ দামে, অর্থাৎ ৮০ কোটি রূপিতে।
# ঐতিহাসিক মুভিতে এটিই ঋত্বিকের প্রথম কাজ এবং দর্শক এবারই প্রথম গোফওয়ালা ঋত্বিককে দেখতে পেয়েছে।
তাই অনেক হিন্দী মুভি দর্শকের মনেই প্রশ্ন জমেছে যে, কেমন হলো মুভিটি।
প্রথমেই একটি বিষয় সোজাসুজি বলে ফেলা ভালো, এত সমৃদ্ধ, এত চমৎকার এবং এত জীবন্ত কিছু হিন্দী মুভি দর্শকরা অনেক দীর্ঘ একটি সময় ধরে তাদের মুভি স্ক্রিনে দেখেননি! যেসব বড় বড় মুভি ক্রিটিকস ও শীর্ষ স্থানীয় অভিনেতারা যোধা আকবর দেখেছেন, মুভিটির বিষয়ে তাদের সবার মতামতই প্রায় একই ছিলো। তারা এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, এটি একটি মাস্টারপিস! তাছাড়া এই মুভিটির সাফল্যের আরেকটি কারণ হলো বর্তমান দর্শকরা অনেকেই আকবর ও যোধার প্রেমের বিষয়টি সম্পর্কে ঠিক অবগত ছিলো না। সবাই জানে যে, আকবর ছিলেন মহান একজন সম্রাট, কিন্তু একই সাথে তার মধ্যে যে রোমান্সও ছিলো, সেটি হয়তো অনেকেই এই মুভির মাধ্যমে নতুন করে উন্মোচন করবেন।
তাহলে এবার একটু জেনে নেয়া যাক, মুভির কাহিনী কীভাবে এগিয়েছে। রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য আমের রাজ্যের রাজা ভার্মাল মোঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবরকে প্রস্তাব দেয় তার মেয়ে রাজকুমারী যোধা বাঈকে বিয়ে করার জন্য। সম্রাট আকবর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সময় চেয়ে অবশেষে রাজি হন এই বিয়েতে। বিয়ের আগে যোধা সম্রাট আকবরের কাছে দু’টি শর্ত জুড়ে দিলে, তা পূরণের বিষয়েও আকবর রাজি হন। বিয়ের পরে তাদের দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, আকবরের দাঈ মা মাহামাঙ্গার ষড়যন্ত্র তাদের সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে। তবে এক পর্যায়ে আকবর তার ভুল বুঝতে পারেন। তবে, ভেতরে ভেতরে দু’জনই দু’জনার প্রেমে পড়ে যান। পরবর্তীতে আকবরের ভগ্নিপতি শরিফুদ্দিন হোসেন আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ঘটনা ক্লাইমেক্সে মোড় নেয়। তবে আকবরের জীবন বাচানোর জন্য যোধার চাচাতো ভাই সুজামলের আত্মত্যাগ অনেকের মনেই দাগ কেটে থাকবে। অবশেষে আকবর ও শরিফুদ্দিনের একক যুদ্ধে জয় হয় আকবরেরই এবং বোনের কথা চিন্তা করে শরিফুদ্দিনকে জীবন ভিক্ষা দেন বড় মনের অধিকারী আকবর।
যোধা আকবর-এর কিছু সিকোয়েন্স মুভিটিকে করেছে বিশেষভাবে স্পেশাল। যেমন,
# মুভির সূচনাতে যে যুদ্ধের সিকোয়েন্স দেখানো হয়েছে, তা আপনাকে প্রথমেই মুভির গভীরতা বোঝাতে সাহায্য করবে।
# এরপর নিয়ন্ত্রণহীন হাতির সাথে আকবরের সিকোয়েন্সটি অসাধারণ।
# বিয়ের আগে যোধার দু’টি শর্ত জুড়ে দেয়ার বিষয়টি খুবই ইন্টারেস্টিং। সেই সিকোয়েন্সটির সময় ঋত্বিকের চেহারার অভিব্যক্তি দর্শক দীর্ঘদিন মনে রাখবে।
# খাজা মেরে খাজা গানের শেষদিকে যখন আকবর সয়ং গানের দলে যোগ দিয়ে গানের আবহের সাথে মিশে যায়, সেটি আকবরের মানসিকতার অনেকখানিই প্রকাশ করে দেয়। তাছাড়া এই দৃশ্যটিকে ইনডিয়ান মুভি ইতিহাসের অন্যতাম সেরা একটি দৃশ্য বলেও অভিহিত করা হচ্ছে।
# যখন যোধা নিজেই রান্না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিচেনে মাহামাঙ্গার সাথে যোধার কথপোকথন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মাহামাঙ্গার হিংসা ও ঈর্ষাপূর্ণ মনোভাব যোধার কাছে স্পষ্ট হয়।
# যোধার হাতের রান্না করা খাবার আকবরকে দেবার আগে মাহামাঙ্গা তা যোধাকে চেখে দেখতে বলে যে, সেটি নিরাপদ কিনা। যোধা খেয়ে দেখার পর আকবর বলে যে, যে থালার খাবার যোধা চেখেছে, সেই থালার খাবারই তাকে দিতে হবে, এই সিকোয়েন্সটি ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত।
# বিরতির সময়টিও ছিলো পারফেক্ট, কারণ তখন আকবর ও যোধার মধ্যে সম্পর্কে ফাটল বড় ধরণের ফাটল ধরে।
# বিরতির পর যখন আকবর যোধাকে ফিরিয়ে আনতে আমের যায়, তখন তাকে স্বাগতম জানানোর জন্য যখন অনেকের ভিড়ে আকবরকে খুজে নিতে হয় যোধাকে, সেই সিকোয়েন্সটি মুভিটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
# তার পরের দিন সকালে যোধা ও আকবরের তলোয়ার যুদ্ধের সিকোয়েন্সটি ভালো লাগার মতো।
# "আজিম-ও-শান শাহেনশাহ" গানটি, যেখানে পুরো রাজ্যের প্রজারা আকবরের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রদর্শন করে, কোরিওগ্রাফির বিচারে সেটি মুভির সেরা উপহার।
# ক্লাইমেক্সের আকবর-শরিফুদ্দিনের যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয় "ট্রয়" মুভির ব্রাড পিট ও এরিক বানার যুদ্ধের কথা। তাছাড়া এই মুভিতে ঋত্বিকের যুদ্ধের পোষাক আপনাকে মনে করিয়ে দেবে "ব্রেভহার্ট"-এর মেল গিবসন ও দি লাস্ট সামুরাই-এর টম ক্রুজের কথা।
এ আর রহমানের গানগুলি অবশ্যই তার সবসময়ের গান গুলির চেয়ে আলাদা। ফিল্মের মুডের সাথে গানগুলি অসাধারণভাবে মানিয়ে গেছে। সুরের হিসেবে কাওয়ালি ট্র্যাক খাজা মেরে খাজা, জাসনে বাহারা এবং আজিম-ও-শান শাহেনশাহ অসাধারণ। বিশেষ করে শুধু একজন যে একটি কাওয়ালি গান পরিপূর্ণরূপে গাইতে পারে, সেই কথাটি খাজা মেরে খাজা গানটির মাধ্যমে সার্থকভাবে প্রমাণ করলেন এ আর রহমান। রহমানের নিজের কন্ঠে গাওয়া এ গানটি এক কথায় একটি টাইমলেস ক্রিয়েশন। আর এ আর রহমানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এক কথায় ওয়ার্ল্ডক্লাস এবং এক্সট্রা-অরডিনারি। মিউজিক ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, দুই ক্যাটেগরিতেই যে কোন লেভেলের পুরস্কার তার অবশ্য-প্রাপ্য।
হায়দার আলি ও আশুতোষ গোয়ারিকারের স্ক্রিনপ্লে মুভির প্রথম থেকেই ঝরঝরে। মুভির কোন জায়গায় বোরিং হবার সুযোগ নেই। কে. পি. সাক্সেনার ডায়লগ চমৎকার, যা কিছু কিছু সময়ে এসিডও নিক্ষেপ করেছে। কিরন দিওহানসের সিনেম্যাটোগ্রাফি রীতিমত ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড লেভেলের। বিভিন্ন দৃশ্যে, বিশেষ করে যুদ্ধের দৃশ্যগুলিতে ক্যামেরার মুভমেন্ট অসাধারণ। নিতিন চন্দ্রকান্ত দেশাইয়ের প্রোডাকশন ডিজাইন চমৎকার। যুদ্ধের সিকোয়েন্সে তলোয়ারের যুদ্ধ ও অন্যান্য অ্যাকশনের দৃশ্যে রবি দিওয়ানের অবদান উল্লেখ করার মতো; বিশেষ করে ক্লাইমেক্সের দৃশ্যে ঋত্বিক ও নিকিতিন ধীরের যুদ্ধ মনে রাখার মতো। বাল্লু সালুজার এডিটিং পারফেক্ট। নিতা লুল্লার কস্টিউম ডিজাইন ও বাহারি জুয়েলারি প্রশংসা পাবার যোগ্য। এই মুভির কাস্টিংও যথাযথ। বিশেষ করে মুঘল সম্রাট আকবর-এর রোলটির জন্য যে কাউকেই চিন্তা করা কঠিন। তবে বর্নঅ্যাক্টর ঋত্বিক যেন এই রোলটি করার জন্যই জন্মেছেন! নি:সন্দেহে তার পারফরমেন্স দর্শক অনেক অনেক দিন মনে রাখবে। তেমনি যোধা বাঈ চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ছিলেন অনবদ্য। এমন পারফরমেন্স তো ঐশ্বরিয়া দেবেনই, এ আর নতুন কী! এছাড়াও সনু সুদ (সুজামল), নিকিতিন ধীর (শরিফুদ্দিন), ইলা অরুন (মাহামাঙ্গা), পুনম এস. সিনহা (হামিদা বানু), কুলভূষন খারবান্দা (রাজা ভার্মাল) প্রমুখ অভিনয়শিল্পী তাদের নিজ নিজ চরিত্রে ছিলেন আন্তরিক, প্রাণবন্ত, মানানসই এবং কার্যকরী। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে অমিতাভ বচ্চনের গমগমে কন্ঠ মুভিটিকে দিয়েছে অন্যমাত্রা।
সবশেষে মুভির সার্থক ডিরেক্টর আশুতোষ গোয়ারিকারের মতো করেই বলতে হয়, মাস্ট সি এই মাস্টারপিস মুভি দেখে দর্শক সত্যিই ভুলে যাবে ঋত্বিক-ঐশ্বরিয়াকে!
[পুনশ্চ: লেখাটি "পাক্ষিক রূপালী তারকা" ম্যাগাজিনের ১৫ মার্চ ইসুতে "যোধা আকবর ছবির ইতিকথা" শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে; এছাড়া লেখাটির অরিজিনাল ভার্সন পাওয়া যাবে "দৈনিক যায়যায়দিন"-এর ১৩ জানুয়ারি ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ইসু দু'টির যথাক্রমে "বিয়ের পরে ঐশ্বরিয়া ফিরছেন যোধা আকবর মুভিতে" ও "মাস্টারপিস মুভি যোধা আকবর" শিরোনামের লেখা দু'টিতে।
লিংক:
বিয়ের পরে ঐশ্বরিয়া ফিরছেন যোধা আকবর মুভিতে
মাস্টারপিস মুভি যোধা আকবর
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:১৭