somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

করোনাকালীন ভাবনাঃ পাল্টে যাওয়া সময়ের গল্প

১০ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রথম পর্বঃ "দুঃসময়ের কথা বন্ধুঃ লালু"


আর তিনদিন পরে এক মাস পূর্ণ হবে। বাড়ির ভিতরে বন্দী। এই এক মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে আমাদের দৈনন্দিন নিয়মে। প্রতিদিনের বিরক্তিকর অফিসকে এখন ভালো লাগতে শুরু করেছে, অফিসের পরে বন্ধু, পরিচিতজনের সাথে আড্ডা টা কে মিস করতে শুরু করেছি ভীষণভাবে। বাড়ির ভেতর বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করছি। টুকটাক নামাজ-কালাম পড়ার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি বাচ্চাদের কে বুঝাইতে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে যেখান থেকে আমরা এসেছি। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি কেউ একজন আছেন, যিনিই প্রকৃত মালিক, মালিক আমাদের জীবনের। টোটকা জ্ঞান দিয়ে বুঝালে তারা নিবে না আমি জানি, তাই চেষ্টা করছি বিজ্ঞান দিয়ে, যুক্তি দিয়ে তাদের মনের গভীরে বিশ্বাসের বীজ বপন করতে। ভবঘুরে আমি আজ বাসায় বন্দী। ১৩ বছরের চেষ্টায় আমার বউ যেটা করতে পারেনি, সেই অসাধ্য সাধন করেছে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাস। আমার ভবঘুরে জীবনের দ্বারা আমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে খুব একটা ব্যাপার ছিল না কিন্তু এখানে সমস্যা অন্য জায়গায়। আমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমার পরিবার, আমার আপনজন। আমি আমার নিজের ক্ষতি করতে পারি কিন্তু অন্যের ক্ষতি করার অধিকার আমাকে কেউ দেয়নি। আর তাই নিরুপায় আমি বন্দি করে ফেলেছি নিজেই নিজেকে। কিন্তু কতদিন! গতকাল রাত্রে সারা রাত ঘুম হয়নি। এপাশ-ওপাশ করে, মাঝে মাঝে মোবাইলে কুট কাট করতে করতে, মাইকে ঘোষনা আসলো নিশ্চয়ই নামাজ ঘুম হইতে উত্তম। পর্দার ফাঁক গলিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কানে আসতে শুরু করেছে পাখিদের কিচিরমিচির। বাসায় তখন আমি ছাড়া বাকিরা সবাই গভীর ঘুমে। এই সুযোগ। টুক করে উঠে গেলাম।

মুখের উপর একটা সার্জিক্যাল মাস্ক ঝুলিয়ে, অনেকদিন পর প্রিয় অ্যাডিডাস জোড়ায় পা গলিয়ে সোজা নিচে। বাসা থেকে বেরোনোর গেট বরাবর। এই কাক ডাকা ভোরে আমাকে দেখে বাড়ির দারোয়ান মুখে ঈষৎ হাসি টেনে আর চোখে উৎসুক্য নিয়ে সালাম দিলো। স্যার এত সকালে! হ্যাঁ, শামীম, একটু হাঁটতে যাব! কেউ নাই স্যার রাস্তায়, একদম ফাঁকা! হমম ফাঁকা!

আমার বাসা রাজশাহীর আলুপট্টি। বোয়ালিয়া থানার মোড়ে। সেখান থেকে হাটা দিলাম আলুপট্টি মোড় হয়ে পদ্মার পাড় বরাবর। কুয়াশার চাদর ভেদ করে শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল এই শহরে এখনও কাকডাকা ভোর। কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধতাকে পেছনে ফেলে শহর জুড়ে যেন বিরাজ করছে 'এক অদ্ভুত আঁধার'। কোথাও কেউ নেই, স্তব্ধ, নিরব, শান্ত। হঠাৎই খেয়াল করলাম কেউ একজন আমার পেছন পেছন আমাকে ফলো করছে। পেছন ফিরে দেখলাম একটি দেশি কুকুর একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে আমার পেছনে পেছনে আসছে। কুকুরটি গেটের বাইরে রাস্তার পাশে ফুটপাতে শোয়া ছিল। কুকুরটিকে আগেও কখনো-সখনো দেখেছি। বাসার বাইরে, গেটের পাশে কিংবা সামনের রাস্তায় বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাফেরা করতে। কখনও কখনও রাত্রে বের হলে দেখতাম গেটের বাইরে শুয়ে আছে। আজকে কুকুরটিকে অনেক শুকনো মনে হলো। অনেকটা আপন মনে হলো। আগে কখনো খেয়াল করা হয়নি ওর গায়ের রঙের কম্বিনেশন টা এতো সুন্দর। সামনে এগুতে এগুতে মনে পড়ে গেল হলিউডের একটি সিনেমার কথা। Will Smith অভিনীত "I am a legend" নামক সিনেমাটি তে;
Robert Neville, a scientist, is the last human survivor of a plague (virus attack) in the whole of New York city. He had a German Shepherd as his only companion in that city with no human being!

আলুপট্টি মোড় থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট তিনেকের রাস্তা পেরোলেই কুমোরপাড়া নদীর পাড়। প্রিয় পদ্মা নদী। নদীর পাড়ে বাঁধাই করার শানের উপরে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। অনেকদিন এমন নির্মল বাতাসে গা ভেজায় না। গাছে গাছে পাখিদের নিরুদ্বেগ, নিঃসঙ্কোচ কিচিরমিচির। প্রাণঘাতী COVID-19 একদিন নিশ্চয়ই চলে যাবে, নিয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ প্রাণ তবে এটাও ঠিক পৃথিবীর মানুষকে অনেক ভাবে ঋণীও করে যাবে! জীবন ও জীবিকার তাগিদে, বাস্তবতার বেড়াজালে আমাদের ছিন্নভিন্ন পারিবারিক সম্পর্ক গুলো এখন এক ছাদের নিচে। আলগা হয়ে যাওয়া পারিবারিক সম্পর্কগুলো আবার মজবুত হচ্ছে।

বসে আছি। সামনে পদ্মার তীর ঘেঁষে সবুজের বিছানা আর যতদূর চোখ যায় বিরান মরুভূমি। পানির লেশমাত্র নেই কোথাও। সবুজের বুক চিরে ভোরের মৃদু বাতাস এক অন্যরকম ভালো লাগার নাম। আমার ঠিক পাশেই গুটিসুটি মেরে বসেছে সেই কুকুরটিও। মেঝের উপর মুখটা বিছিয়ে দৃষ্টিটা সামনের দিগন্তে ছড়ানো।

- নিঃশব্দতার আড়মোড়া ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছো?
-- এবার সে আমার দিকে চোখ ফেরাল, আমাকে বলছেন?
- হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি, তুমি আর আমি ছাড়া চারদিক জুড়ে আর তো কেউ নেই!
-- আমাদের আর থাকা না থাকা, আমরা হলাম রাস্তার কুকুর! সহসা আমাদের তো কেউ কুশল জিজ্ঞেস করেনা, তাই একটু আশ্চর্য হলাম। কিছু মনে নিবেন না দয়াকরে।
- না, না আমি কিছু মনে করিনি! তুমি বুঝি আলুপট্টি তেই থাকো?
-- জ্বি, আপনি যেই বাসায় থাকেন তার সামনের গলিতে, রাস্তায় আমাদের বসবাস।
- তুমি আমার বাসাও চেন?
-- চিনবো না কেন? এই মোড়ের সবাইকেই আমরা চিনি? কে কোন বাসায় থাকে, কখন আসে কখন যায়; আরো অনেক কিছুই। প্রত্যেকের প্রকৃত নাম হয়তো জানি না কিন্তু আমরা আমাদের মতো করে প্রত্যেকেরই একটা নাম দিয়ে রেখেছি!
- তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং তো, তা আমারও কি নাম আছে?
-- অবশ্যই আছে, কেন থাকবে না? আপনার নাম কি জানতে চান?
- অবশ্যই জানতে চাই!

-- এবার সে উঠে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বলল, আপনাকে আমরা 'মোটা ভাই' বলে ডাকি! আমাদের তো মানুষের মতো অত বুদ্ধি নেই, তাই আমরা আমাদের ভাষায়, আমাদের মত করে মানুষের নাম রাখি। মানুষ হয়তো আমাদেরকে সমাজের কিংবা মহল্লার অংশ হিসেবে ভাবে না কিন্তু আমরা এই মহল্লার প্রত্যেককেই আমাদের সমাজের এক একজন সদস্য ভাবি, তাদের সুখে আমরাও আনন্দিত হই, দুঃখে আমরাও দুঃখ পাই। আপনারা মানুষ, অনেক বুদ্ধিমান হতে পারেন কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আপনাদেরকে অনেক কিছুই বোঝার ক্ষমতা দেননি যা আবার আমাদেরকে দিয়েছেন।

- মনে হল কেউ যেন গালের উপরে সপাটে চপোটাঘাত করল। তাই তড়িঘড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তুমি আমার সম্পর্কে আর কি কি জানো?
-- জানি বলতে, এই যতটুকু আমরা দেখতে পাই আর কি। যেমন ধরেন আপনি প্রায়ই একটু দেরী করে অফিস যান! আর সকলে যে সময়ে অফিসের জন্য রওনা হয় আপনাকে দেখি তার কিছুক্ষণ পরে বের হতে এবং বের হয়েই আপনার তড়িঘড়ি ছুটে চলা দেখে আমরা হাসি। অফিস থেকে ফেরেন রাত করে। আর সবাই যখন অফিস থেকে বাড়ি ফেরে, আপনি বাড়ি ফেরেন আরো কিছুক্ষণ পরে!

- কিন্তু তুমি কিভাবে বোঝো আমি অফিস থেকে ফিরছি নাকি অন্য কোথাও থেকে ফিরছি!
-- আপনিও দেখি আর দশটা মানুষের মতোই বোকা। অফিস থেকে ফেরার সময় আপনার ঘাড়ে একটি কালো ব্যাগ থাকে, যেটা বাসায় রেখে আপনি পুনরায় বের হন!
- ঠিক বলেছ লালু, মানুষ শুধু বোকা নয় অবিবেচক আর অসহায়ও বটে!

-- কিন্তু মোটা ভাই আমার নাম তো লালু নয়; আমার নাম গোরা। আমার শরীরের বেশিরভাগ সাদা কিনা, তাই জন্য আমার মা আমার নাম রেখেছিলেন গোরা।
-- ঠিক আছে কিন্তু আমি তোমাকে লালু বলেই ডাকবো; অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাসায় একটা কুকুর ছিল। তোমার মতোই দেখতে। পুরোদস্তুর দেশি কুকুর। আমরা তাকে ডাকতাম লালু বলে।

-- কি যে বলেন, আপত্তি থাকবে কেন, আমি হলাম রাস্তার নেড়ি কুত্তা। আপনি আমাকে যে নামেই ডাকেন আমি তাতেই খুশি! মোটা ভাই, আপনি আমাকে তুই করেও বলতে পারেন। তুমি শুনতে কেমন জানি অস্বস্তি অস্বস্তি লাগছে। আমাদেরকে তো সবাই তুই করে বলে, তাই তুমি শুনতে আরাম লাগছে না। আমাদের পাড়ায় মসজিদের দক্ষিণ পাশে যে বাসাটা আছে ওই বাসায় একটি বিদেশি কুত্তা থাকে। সারা গা জুড়ে যেন ধবধবে সাদা তুলো জড়ানো। খুব ন্যাকা। ওই বাসার সবাই ওকে তুমি বলে ডাকে। ওর নাম ম্যাগি। ওই বাসায় একটা ধবধবে সাদা মহিলা থাকে, খুব বজ্জাত টাইপ। বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে বসে প্রায়ই দেখি, গভীর রাত পর্যন্ত ওই আহ্লাদী কুত্তি তাকে কোলে নিয়ে মেয়েটি পায়চারি করছে আর ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে।

লালুর কথা গুলো আমার কানে ঢুকছিল না। সামনের দিকে চেয়ে আনমনে কি যেন চিন্তা করছি। হঠাৎই পরম মমতায় অতি আপন জনের মত জিজ্ঞেস করল, মোটা ভাই আপনার কি মন খারাপ?

-- একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস মুহূর্তেই বাতাসে মিলিয়ে গেল। হুমম, ঠিক ই ধরেছ, মনটা বেশ খারাপ। জানো লালু, আমি এখানে বাসা নিয়ে থাকলেও আমার বাড়ি মূলত এখন থেকে সাত-আট কিলো দূরে কাটাখালীতে। ওখানে আমার বাবা মা থাকেন। ঐখনকার মানুষগুলো, গাছপালা, রাস্তাঘাট সবাই আমার বড়ই আপন, নিজের। অথচ আজ পনেরো দিন ধরে সেখানে যায় না। দম বন্ধ লাগছে। জেলখানার কয়েদির মত আটকা পড়ে আছি একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট। বাড়ি যেতে পারি না, বাইরে বেরুলেই বিপদ, আর্মি, পুলিশ, র্যাব এমনভাবে ঘিরে ধরে যেন সদ্য জেল পলাতক আসামী। বিনা কারণে মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে আমার একদম ই ভালো লাগে না। যদিও জানি ওরা যা করছে আমাদের মঙ্গলের জন্যই করছে। তাই কি আর করা, মেনে নিতে হয় কিন্তু মনে তো নিতে পারি না। যাইহোক বাদ দাও সে সব কথা। তোমার খবর বল, তোমার পরিবারের খবর বল। তোমরা তো বেশ আছো। মুক্ত-স্বাধীন যখন যেখানে ইচ্ছা যাচ্ছ, তোমাদের পায়ে শেকল দেয়ার তো কেউ নেই।

-- প্রশ্নটা শুনে লালু আবার মেঝের উপরে থুতনি বসিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো। মুহূর্তেই যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। মুখ থেকে লম্বা জিভ খানা বের করে দুই বার শ্বাস নিল।

-- পরিবারের কথা আর কি বলব। জানেন কি, আমরা যারা রাস্তার কুকুর, আমরা পৃথিবীতে আসি জন্মদাতার পরিচয় ছাড়াই। সেজন্যই তো আমাদের নামে মানুষকে গাল দেয়া হয়। বাঘও একটা প্রাণী, কুকুরও একটা প্রাণী। অথচ মানুষকে বাঘ বললে কিংবা বাঘের বাচ্চা বললে, মানুষ আহ্লাদে গদগদ হয় অথচ মানুষকে কুকুর বললে কিংবা কুকুরের বাচ্চা বললে। সেটা হয় নিকৃষ্টতম গালি। আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক কুকুর তারা নাইলে শত নিষেধ উপেক্ষা করেও এখান সেখান থেকে কেড়ে কুড়ে খায়, কিন্তু যে বাচ্চাটি সবে জন্ম নিল, নিষ্পাপ মায়ায় ভরা চেহারা, তার কি দোষ? অনেককেই দেখি এসকল ক্ষুদে কুকুরের বাচ্চাদের আদর করে। কিন্তু সেই মানুষটাকে ওই বাচ্চাটার সাথে তুলনা করলে অর্থাৎ কুত্তার বাচ্চা বললে অনেক রাগ করে। জানেন কি কারণে? কারন হলো ওই ফুটফুটে বাচ্চাটার কোন জন্ম পরিচয় নাই। আমরা কুকুর; জন্মই আমাদের আজন্ম পাপ। পরিবার বলতে একটা ভাই ছিল। কোন এক রাত্রিতে রাস্তার উপরে ঘুমিয়ে ছিল এ পাড়ার গলিতে। কুরিয়ার সার্ভিসের ট্রাক হঠাৎ করেই তাকে পিষে দিয়ে যায়। মা বেঁচে আছে, মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে। সারাদিন শুয়ে থাকে আপনাদের বাড়ির পাশেই ফাকা জায়গাটার মধ্যে। কি একটা ভাইরাস নাকি এসেছে। ওই যে বললেন না, আপনাদের পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের পেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই খাবারের খুব অভাব, যে দু একটা খাবারের সন্ধান মেলে, মায়ের বয়স হয়েছে, তাই প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না। অনাহারে থাকতে থাকতে এখন মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছে। মায়ের কথা আর কি বলব, এই আমার কথাই ধরেন। গতকাল সারা দিন কোন খাবার পাইনি, খাবার মেলেনি আজকে রাত্রেও। তার আগের দিন রাত্রে মোড়ের দোকানদার ভোলা দা কিছু বিস্কিট দিয়েছিল। সেখান থেকেই দু'চারটা খেয়েছি কিন্তু তার পর পানির দেখা মেলেনি। বুকের ভেতরটা তাই শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। রাজশাহী শহরের হোটেলগুলো তো আগেই বন্ধ হয়েছে, বন্ধ এখন মসজিদের গেটগুলো, তাছাড়া আমরা তো ট্যাপ ছাড়তে পারিনা। রাস্তার পাশের ট্যাপগুলোতে আর কেউ পানি নিতে আসে না। এই পাড়ার বাসা বাড়ির উচ্ছিষ্ট গুলো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা হতো, সেখান থেকেই চেটেপুটে খেয়ে আমরা আপনাদের গলি, রাস্তা পরিষ্কার রাখতাম। করোনার ভয়ে এখন উচ্ছিষ্ট গুলো সরাসরি চলে যায় সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে করে শহরের বাইরে। নিজের জিভটা ক'দিন ধরে বড় বেশি বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। কারণে অকারণে মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, আর লম্বা থেকে লম্বাতর হচ্ছে। রাত্রে খেয়াল করলে দেখবেন রাস্তায় গলিতে কুকুরের শোরগোল হাক ডাক আর আগের মত নেই। আমাদের শহরে করোনা আসার আগেই হয়তো দেখবেন রাস্তায় রাস্তায় দেশি কুকুরদের লাশের মিছিল। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে এখন সে হাঁপাচ্ছে; আর জিভটা মুখের বাইরে ঝুলে গেছে। কথাগুলো শেষ করেই মাথাটা মেঝের ওপর এলিয়ে দিয়ে আবার সটান শুয়ে পড়ল।

আমি কিছুতেই ওর দিকে তাকাতে পারছিনা। কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যেন চোখের পানিতে শার্টের বুক পকেট ভিজে গেছে। তীব্র একটা অপরাধবোধ আমাকে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে কোন একটা বাড়ি থেকে খাবার ছিনিয়ে নিয়ে এসে তার সামনে মেলে ধরি। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ যতদূর চোখ যায় কোন দোকানপাট খোলা নেই। আমরা দুজনেই নিজ নিজ জায়গায় বসে আছি। কারো মুখে কোন কথা সরছে না। আমি কি করব, কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিনা; কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি। পদ্মার বুক থেকে ধেয়ে আসা ভোরের স্নিগ্ধতায় নিজেকে বড়ই অসহায় আবিষ্কার করলাম।

হঠাৎই লালু উঠে দাঁড়ালো। মোটা ভাই, আপনি একটু বসেন; ওই দূরে মন্দির থেকে পূজারী ভোগের খাবার গুলা বাইরে ফেলে দিচ্ছে। আমি এক্ষুণি আসছি। বলেই সে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু শরীরের অসহযোগিতার কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে থাকলো পূর্বের রাস্তা বরাবর।

পুবের আকাশ জানান দিচ্ছে সূর্য উঁকি দেবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। পাশেই একটি ঝুপড়ি দোকান, একটি পাল্লা খুলে চা এর আয়োজন করছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম তার কাছে চা ছাড়া আর কোন কিছুই নাই। তাই দুটো চায়ের অর্ডার দিলাম। একটি পুরনো পাত্রে কিছু পানি নিয়ে পাশে রাখলাম।

লালু ফিরে আসলো। তার মুখে স্বস্তির ক্ষীণ বলিরেখা দেখতে পেলাম। পাশে রাখা পাত্রের পানিটুকুতে মুখ গুঁজে এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করে দিল। লালুর পানি খাওয়ার দৃশ্য দেখে কোনভাবেই চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। তাই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছি।

চা ওয়ালা: আরেকটি চা কোথায় দিব?
আমি: পাশেই রাখুন।
চা এর দোকানদার চলে গেলে। লালুকে একটা কাপ এগিয়ে দিতেই, শুকনো মুখে হেসে উঠলো। মোটা ভাই আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন আমি একটা কুকুর, তাও আবার পুরোদস্তুর দেশি কুকুর, রাস্তার কুকুর, কেউ কেউ অবজ্ঞা করে বলে নেড়িকুত্তা। এই কাপে চা খেলে মানুষের সম্মান থাকবে? মাটিতে ঢেলে দিন। আমরা দুজন পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছি।

- লালু আমি বলি কি, তুমি বরং একটা কাজ কর। কাটাখালীতে চলে যাও। ওইখানকার মেয়র আমাদের এক বড় ভাই প্রতিদিন রাত্রে কুকুরদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছেন। আমার অফিসের কলিগ ছোটভাই, ইফতেখার তার বন্ধুরা মিলে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্পটে খাবার দিচ্ছে।

-- এইসব মানুষদের জন্য আমরাও দোয়া করি, যদিও আপনারা শুনতে পান না। ইদানিং আমাদের পাড়া থেকেও অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। কিন্তু তার পরেও প্রয়োজনের তুলনাই সেটা একেবারেই অপ্রতুল।আপনারা দিনে তিনবার খান। আমাদের দিনশেষে একবার খেলে কিভাবে চলবে বলেন। আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করুন যে বা যারা তাদেরকে খাওয়াচ্ছে। আমি বরং এখানেই থাকি, যিনি সৃষ্টি করেছেন, দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, আমাদেরকে নিয়ে নিশ্চয়ই তার কোন একটি প্ল্যান আছে। অনাহারে মৃত্যুই যদি আমাদের ভবিতব্য হয়, তবে তাহাই সই। এইটা নিয়ে আপনি মন খারাপ কইরেন না।

সূর্যটা সামনের আকাশ ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে। লালু এক ঝটকায় আমার দিকে তাকালো। মোটা ভাই আপনার আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। বাসার দিকে রওনা দেন।

- কেন, কি হয়েছে?
-- আমরা তো কুকুর, অনেক দূর থেকে শব্দ শুনতে পাই। থানা থেকে গাড়ি গুলো বের হচ্ছে মানুষকে অকারণে বের হওয়া মানুষগুলোকে ঘরবন্দি করতে। পাছে আবার তাদের জেরার মুখে পড়েন, এক্ষুনি রওনা দেন।

- আর তুমি কোথায় যাবা?
-- হা হা হা! আমরাতো বন্দিদশা থেকে মুক্ত! এ মোড়ের অলিগলি, রাস্তাঘাট-ই তো আমাদের বাড়ি! আমি আর কোথায় যাবো বলেন!

আমি আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দিলাম বাসার দিকে... পাশ দিয়ে পুলিশের ইমা গাড়িগুলো সাইরেন বাজাতে বাজাতে পার হচ্ছে.... মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে আপনারা সবাই বাসায় থাকুন... ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন, নিরাপদ দূরত্বে থাকুন.... কিন্তু আমার কানে এসবের কিছুই পৌঁছাচ্ছে না... মনের মধ্যে কেবল লালুর এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে...... বাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে মনের মধ্যে নতুন একটি প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করেছে, আচ্ছা, লালুদেরকে করোনা আক্রমণ করবে না ? ওরা কি তবে করোনা নাকি ক্ষুধা; কোনটার শিকার হবে?

বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ইয়া আল্লাহ, তুমি সবাইকে হেফাজত কর; হেফাজত কর মানুষ সহ সকল প্রাণীকুলকে। নিশ্চয় তুমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই।
------------------------
চলবে... ২য় পর্বঃ "একাকী ল্যাম্পপোস্টের সাথে কিছুক্ষণ"
------------------------
জিয়া রহমান
রাজশাহী।
এপ্রিল ২৪, ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৭
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×