ফয়সাল আহমেদের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয় পারিবারিক ভাবে। আমাদের দুই পরিবার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ফয়সাল সাহেব বাবার বন্ধুর বড় ভাইয়ের বড় ছেলে। রীতিমত পরিবারের বড় বৌয়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি আমাকে চিত্রায়ণ করতে হবে বলে উপর মহল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আমাদের মানে আমার এবং ফয়সাল সাহেবের কাজ হলো লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে হয়ে বড়দের সব কথা মেনে বিয়ের পিড়িতে বসা। যদিও কোনোভাবেই আমরা ছোট ছিলাম না। আমি তখন পড়াশুনার পাঠচুকিয়ে চাকরিতে জয়েন করেছি আর ফয়সাল সাহেব ইউরোপ থেকে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন করে সদ্য দেশে ফিরেছেন।
হুট করে শুনলে কেমন হয় ভেবে আমার মা মাসখানিক আগে থেকে ফোনে বেশি বেশি সানজিদা চাচীদের গল্প জুড়ে দিতে শুরু করলেন। আমিও সরল মনে গল্পে অংশ নিই। হঠাৎ চাচীর ফোনকল। কেমন আছি, কী নিয়ে ব্যস্ত আছি, বাসায় যাবো কবে ইত্যাদি তথ্য আদান প্রদান শেষে মূল প্রসঙ্গে আসেন। মামনি ফয়সাল আমার ভাসুরের ছেলে। ওকে আমি নিজের ছেলের মতোই ভালবাসি। চার মাস আগে পিএইচডি করে দেশে ফিরেছে। ওকে আমরা বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি এবং তোমাকে আমাদের বিশেষ পছন্দ। আমরা অবশ্য দুই বছর আগে থেকেই পারিবারিক ভাবে বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস। ফয়সাল জানে সবকিছু। কিন্তু তোমাকে বলা হয়নি। কারণ ফয়সালের এককথা দেশে এসে সিদ্ধান্ত জানাবে। মা তুমি আর ফয়সাল এই সপ্তাহে একবার দেখা করো। জানি তুমি ব্যস্ত থাকো, তবু সুবিধামত একটা সময় বের করো, ফয়সাল সেই দিন ফ্রি থাকবে। বলে রাখা ভাল, শাহানা চাচী আমার প্রিয় চাচীদের একজন, কী উত্তর দিবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অগত্যা আমাদের দেখা করতেই হলো।
একটা স্বনামধন্য কফি শপে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করানো হলো। যথারীতি আমি যথা সময়ে পৌছে গেলাম, ফয়সাল সাহেব পৌছোলেন মিনিট বিশেক বাদে। নো শাড়ী, নো মেকাপ, নো ঢং। আমি নিজেকে নিয়ে গেলাম। আমি যেমন ঠিক তেমন। দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে যখন সবগুলো মুখ একসাথে আমার দিকে ঘুরে গেল বিষয়টা একটু আনইউজুয়াল লাগলো। দুই সিটের একটা টেবিলে বসে আমি মনোযোগ দিয়ে মেন্যুকার্ড পড়ছিলাম। প্রায় দৌড়ে নায়ক দৃশ্যপটে এন্ট্রি নিলেন।
এটা সেটা টুকটাক কথা, আসতে কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা ধরনের। এবার মূল প্রসঙ্গে আসলেন ফয়সাল। 'আপনার নামটা সুন্দর। এখানে দেখা করতে আসার উদ্দেশ্য হলো একটা গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুমোদন কিংবা নাকচ করতে হবে। বিষয়টা নিয়ে আমার পক্ষ থেকে আসলেই একটা বড় পদক্ষেপ। কারণ গত দুই বছর আমাকে আপনার কথা এতবার এতভাবে বলা হয়েছে যে সেটা রীতিমত আমার চিন্তাসূচির অংশ করে তোলা হয়েছিল। আমার প্রেমপূর্ণ বাসনাকে নিয়ন্ত্রন করে কেবল বার বার তাগাদা পড়ালেখা শেষ করে দেশে আসো। আর আমারও ভাগ্য, আপনার তো এতোদিনে বিয়ে করে ফেলা উচিৎ ছিলো। দেখেন আমি পরিবারের বড় ছেলে, আমার উপর এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের অধিকার বোধের শেষ নাই। আমার না বলা মানা, আমার রাগ করা অনুচিৎ, আমার জন্য স্বার্থসচেতন হওয়া অসম্ভব'। এমন সব আলোচনায় পরিবেশ রীতিমত গুরুগম্ভীর। কফি আসলো সাথে কিছু স্ন্যাকস। খেতে খেতে ফয়সাল সাহেব বলেই ফেললেন, আপনি কি স্বল্পভাষী? ভালো শ্রোতা এটা বলা বাহুল্য। আমার আর ভাল লাগছিলো না। তাই ওয়েটারকে ডেকে বিল নিলাম এবং পরিশোধ করলাম। ফয়সাল সাহেব হার্ট হলেন, বললেন আমি তো আরো এককাপ কফি নিবো। অগত্যা আরো কিছুক্ষন বসতে হলো। এবার ভদ্রলোক সোজা চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি জানি আপনি ফর্মালিটি মেইন্টেন করলেন। মেঝ মার অনুরোধে দেখা করতে এসেছেন এবং আপনার মনোভাব যেটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন সেটাই বলোবৎ রইলো। মানে হলো আপনি বিয়েটা করছেন না। তাই আগবাড়িয়ে বিল দিয়ে দিলেন। ঋণ শোধ করার জন্য আরও একদিন দেখা করার অপশানটা বন্ধ করলেন। ভেরি স্মার্ট লেডি। নন্দিনী খুব কম সময়ে আপনাকে যতটুকু বুঝলাম একটা এডভাইস অবশ্যই দিবো, কখনো আপোষ করবেন না। সবাইকে আপোষ করা মানায় না। যা চান, যেভাবে চান অর্জন করে নিন। আর জেনে রাখুন যে আপোষ করতে শুরু করে, আপোষ তার পিছু ছাড়ে না।
কফি শপ থেকে বেরিয়ে রিকশাতে বসেই ফয়সাল সাহেবের এসএমএস পেলাম। সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ। জীবনটাকে নিজের মত করে যাপন করবেন। ভালো থাকবেন। মাস ছয়েকের মধ্যে ফয়সাল সাহেব বিয়ের পিড়িতে বসেন। পাত্রী সুন্দরি, তখন এমএ করছিলেন। বিয়ের বছরখানিকের মাথায় একসকালে তার মৃত্যু সংবাদটা পাই। হার্টএট্যাক। খেলাধুলা করতে ভালোবাসতেন। ফুটবল খেলার মাঠেই অসুস্থবোধ করছিলেন, হসপিটালে নেয়ার পথে মারা যান। জীবনটা ভীষন রকম কেমন যেন! অনেক দিন বাদে কফি শপটাতে গিয়ে কথাগুলো মনে পড়লো। আজ চেষ্টা করেও ফয়সাল সাহের চেহারা ঠিক মতো মনে করতে পারলাম না। ফয়সাল সাহেবের কথা মনে পড়তেই একটা লাইনই মাথায় ঘুরছে, 'কোন সুখ ফুরায়নি যার, তার কেনো জীবন ফুরায়'।
দূরের বন্ধু সরফরাজের সাথে কথা হচ্ছিল। বললো সময় থাকলে ‘শাদী মে জরুর আনা’ মুভিটা দেইখো। সিজনচেঞ্জের জ্বরে পড়ে অনেকদিন বাদে ঠিক সময় পেয়ে গেলাম। এই বছর প্রথম কোনো হিন্দি মূলধারার সিনেমা দেখলাম যেখানে পেশাদার যৌনক্রিয়া বাদে একটা গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি তো রাজকুমারের ফ্যান হয়ে গেলাম। দূর্দান্ত অভিনয়। এতবেশি বাস্তবের কাছাকাছি যে গুলিয়ে ফেলছিলাম। মুভির ডায়লগগুলো অভিনেতা অভিনেত্রীরা এতখানি ন্যাচারল করে বলেছেন যে দ্বিমত পোষনের জায়গা নেই। একটা অদৃশ্য বাধাও যে কতখানি অভেদ্য হতে পারে দেখলাম। সত্যি বলছি, ‘জীবনে সিনে মে আগ লাগাটা বহুত জরুরি’। কেউ এই আগুন জীবন গড়ার কাজে লাগায়, কেউ বিকিয়ে দেয়ার কাজে। এন্ড দ্যা চয়েস ইজ ইওরস।
সিনেমা দেখা শুরু করলে আমি আবার একটা দেখি না। কমপক্ষে দুইটা সময় পেলে আরো বেশি। এই দফায় দেখেছি ৩টা।
১) শাদী মে জরুর আনা
২) ক্যালেন্ডার গার্ল- রুপালী জগতের হাতছানি, অমসৃন পথ পাড়ি দেয়া ৫টা মেয়ে যাদের সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক মূল্যবোধের গল্প। একটা গল্পে মধুর ভান্ডারকার তুলে এনেছেন।
৩) এক ফালি রোদ- সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা একগবেষকের মাধ্যমে তুলে আনা গল্পে যীশুর অভিনয় সত্যি ভাললাগার মত। মাঝেমধ্যে একটা ব্ল্যাংক এসএমএসের মূল্যও অমূল্য হতে পারে জানা গেল। যীশুর বয়ানে প্রপোজ করার দৃশ্যটুকু নিজ দায়িত্বে বার কয়েক টেনে টেনে দেখেছি।
শেষ করি আজকের ঘটনা বলে। প্রফেসর জামান স্যারের সাথে মিটিং ফিক্সড ছিলো। সিটিং সার্ভিসে করে ঢাবি’র পথে। নীলক্ষেত নেমে রিকশা নিবো। রাপা প্লাজার সামনে আসতেই বাস অর্ধেক খালি হয়ে গেল। পেছনের সীটে বসা ছেলেটার সেলফোন বেজে উঠলো।চমৎকার ভয়েসে হ্যালো বলতেই মস্তিস্কের মনোযোগ সেদিকে চলে গেল। শুরু হলো কথোপকথন,
মেয়েটা- তুমি কি আমাকে কোন এসএমএস পাঠিয়েছো
ছেলেটা- হুম পাঠিয়েছি। রাতে। পেয়েছো?
মেয়েটা- কী লিখছো?
ছেলেটা- কেন পড়া যাচ্ছে না?
মেয়েটা- যাচ্ছে তবুও জানতে চাচ্ছি। মুখে বলো
ছেলেটা- আমি এখন পাবলিক বাসে ইরা। বাসায় থাকলে চিল্লায় চিল্লায় বলতাম।
মেয়েটা- কেন লিখছো?
ছেলেটা- দেখো ইরা বেশ কিছুদিন হলো আমরা অনেক অনেক কথা বলছি। হ্যা স্বীকার করছি প্রথম প্রথম আমাদের মধ্যে ভালোলাগা ছিলো। বিষয়টা এখন আর ভালোলাগাতে নেই। আমরা প্রশ্র্য দিয়ে ইস্যুটাকে সামনে এগিয়েছি। শুধু বন্ধুরা এত কথা বলে না। আর আমার মনে হলো ভালোবাসি জানিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। নতুবা দেরি হয়ে যেতে পারে।আয়েস করে আফসোস করার চেয়ে সাহস করে বলে ফেলা কী ভাল না? তোমার যদি সম্মতি না থেকে তাহলে হবে না। দেখ চেষ্টা না করে হেরে গিয়ে হারিয়ে যেতে আমি রাজি না। তুমি না বললে, আই প্রমিজ রাজ আর কখনো কোনোদিন তোমাকে কল দিবে না, আই মিন বিরক্ত করবো না।
সুপারভাইজার নীলক্ষেত চলে এসেছে বলে জানান দিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বে আমাকে বাস থেকে নেমে পড়তে হলো। কথোপকথনের শেষটা আর জানা হলো না। তবে ইরাবতী আর রাজকুমার সারাদিন মস্তিস্কে রয়ে গেল। দুজন মানুষ নিজের ভালোবাসা প্রকাশে অকৃপন হোক। আগামী বসন্ত আমি নির্দ্বিধায় লিখে দিতে চাই ইরাবতী আর রাজকুমারের নামে। পাটভাঙ্গা শাড়ীতে ইরাবতী হয়ে উঠুক স্বর্গের অপ্সরী, রাজকুমার তার হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরে থাকুক সারাজীবন…
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০০