বাংলাদেশের জনতা দুই ধরনের–
১) আম জনতা
২) কাঠাঁল জনতা
আম জনতা হচ্ছেন তারা, যারা বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘পরিষ্কার মানুষ’। যারা কোনো কিছু পাবে বলে দেশ কে ভালোবাসেননা। ভালোবাসার তাগিদ থেকেই দেশকে ভালোবাসেন। তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেন, টাক্স দেন, দেশকে দুর্নীতি মুক্ত রাখার শপথ নেন আর প্রতি পাচঁ বছর পর পর ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালা বদল ঘটান। প্রতি বার-ই ভাবেন এবার অন্তত ক্ষমতাসীন’রা তাদের কথা ভাববে।
কাঠাঁল জনতা হচ্ছেন তারা, যারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। দেশকে দুর্নীতিতে প্রথম স্থানে নিয়ে যান, পারলে দেশকে বন্ধক রেখে সুইস ব্যাংকে টাকা জমান, ব্যবসার নামে ভেজালে ছেয়ে ফেলেন, টাকা আয় করার জন্য টাকাকে ব্যয় করে বিষ বাজারজাত করেন, বীমার টাকা পাবার জন্য শ্রমি্কদের পুড়িয়ে মারেন, অফিস নামক প্রতিষ্ঠানকে ভাবেন নিজের বাপ দাদা সাম্রাজ্য আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কে ভাবেন চা্রিত্রিক দূষণ জমানোর একাউন্ট।
এবার আসি নব্য এক ধরনের জনতার পরিচিতি নিয়ে। যাদের কে আমি আমার ভাষায় নাম দিয়েছি “তাল জনতা”। এদের কাজ সবক্ষেত্রে সব কাজে তাল দেয়া। আপনি যা কিছুই করেন না কেন, যেখানেই করেন না কেন, যেভাবেই করেন না কেন সবসময়-ই তাদের সমর্থন আপনি পাবেন, যাকে আমি বলি “তাল” পাবেন। নাচের অনুসঙ্গ তবলার তাল আর সব ধরনের অন্যায়ের অনুসঙ্গ সুবিধাবাদী জনতার তাল।
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে; সর্বত্রই আপনি পাবেন এদের সমর্থন। যেমন ধরেনঃ
রাজনীতিতে তাল জনতা না থকলে কি আমরা জানতে পারতাম “আখলাক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র”। তাল জনতা আছে বলেই, যে কোন দলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সবাই গলা বাড়িয়ে বলতে পারেন “বাংলার মানুষ এটা মেনে নিবে না”। আমি মেনে নিবো কি নিবো না সেই সিদ্ধান্ত দেয়ার আপনি কে হে?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত সেটা বলতে গেলে আমি তিন বার ঢোক গিলি। কারন সংখ্যাটা ৫১ । এদের মধ্যে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪০ আর অনিবন্ধিত দলের সংখ্যা ১১। এই সব দলের বেশির ভাগ-ই নাম কাওয়াস্তে দল। যাদের কে ইংল্যান্ডে বলা হয় “প্রেসার গ্রুপ”। যারা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে। এরাই মূলত প্রকাশ্য তাল জনতার কারিগর।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সারা বছরই পাবেন মানব বন্ধনকারী। তারা বিভিন্ন দাবী নিয়ে মানব বন্ধন করেন। গনতান্ত্রিক দেশে সেটা হতেই পারে। তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, এখানে যারা মানব বন্ধনে হাজির হন তারা মূলত টাকার বিনিময়ে আসেন। জন প্রতি দৈনিক ২০০/ টাকা। ঠিক একই ভাবে রাজনৈতিক দলের বিশাল জনাসভা কে সফল করতে দলে দলে যারা অংশ গ্রহন করেন তাদেরও একটা অংশ টাকার বিনিময়ে সমর্থন বিক্রি করা তাল জনতা।
ব্যবসার দিকে গেলে দেখবেন “চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই”। আপনি ফলে ফরমালিন মেশাবেন সেখানেও তাল জনতা পাবেন। গার্মেন্টেস এ অগ্নিকান্ড ঘটাবেন সেখানেও তাল জনতা পাবেন। সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়শিয়া যাবেন, হ্যাঁ সেখানেও তাল জনতা পাবেন।
চাকরি ক্ষেত্র দিকে তাকান। জব সেক্টরে বস যা-ই বলবেন, একটা শ্রেণী থাকবে তারা তাল দিবে। তাল দিয়ে দিয়ে বস এর মনোবল এতটাই বাড়িয়ে দেন যে, “ বস অফিস কে নিজের দাদার সাম্রাজ্য ভাবতে শুরু করেন”। এর পেছনে অবশ্য ব্রিটিশদের কৃতিত্ব রয়েছে। তথাকথিত বস (সবাই নন) এর হাত দিয়ে বছর শেষে চাকুরীজীবীদের আমলনামা দেয়া হয়। এই আমল নামার ডরে আপনারে অফিসে তাল জনতা হয়ে থাকতে হবে। বস লন টেনিস খেললে এই তাল জনতা সেই খেলা উওপভোগ করার জন্য লন টেনিসের পোশাক পরে বল কুড়ানোর জন্য কোর্টে হাজির হন (বস যেভাবে সার্ভ করেন তাতে বল ব্যাক শর্ট না করে কুড়িয়ে ফেরত পাঠাতে হয়)। কেউ কেউ তাল দেয়ায় এত-ই পটু থাকেন যে তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে টেবিল টেনিস খেলার পোশাক পরে আসেন। বসের তো লন টেনিস খেলার পর টেবিল টেনিসও খেলতে ইচ্ছে করতে পারে। অফিসে এসো মিনিট দশেক বসের খ্যাত টাই (জাদুঘরে রাখার মত)এর প্রশংসা করা। কারন ওই-জিনিস তো তার সম্বন্ধি নিউইয়র্ক থেকে পাঠিয়েছে। তার মূল্য আপনাকে বুঝতে হবে। এই সব খ্যাত জিনিস কে প্রশংসা না করলে আপনার রুচিবোধের ১২টা বাজবে কি করে!
এবার আসি তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে। এখানেও সেই একই ফর্মূলা। তেরে তাতা ধা। মানে তাল দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করা। বুদ্ধির বিচারে নয় বরং চাতুর্যের বিচারে মানদন্ডে নির্ধারিত কে কত বড় বুদ্ধিজীবী। এর কে কতখানি সুশীল।
কী ভাবছেন? বেচেঁ গেলেন, আরে আপনি এই চার ধরনের কোনো টাতেই নেই। জ্বী না জনাব। সংসার জীবনেও পাবেন তাল জনতা। বিশ্বাস হচ্ছে না। একটু চোখ কান খোলা রাখুন, পেয়ে যাবেন। ভাগ্নের বেশি টাকা হলে মামা তাল দেয়, দুলাভাই এর বিশাল ভেজাল কারবার থাকলে শালা তে তাল দেই, ভাগ্নির ভালো বিয়ে হলে খালা তাল দেয়। বাসার খালাম্মার গাউছিয়ার শপিং কে কাজের বুয়া তাল দেয়।
এবার আসি, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক প্রসঙ্গে। এখানে তাল জনতার উপস্থিতি তো রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। লাইক কমেন্টের লুতুপুতু। আপনি দুটো ন্যায্য কথা লিখেন কেউ পড়বে না, কারন যা ন্যায্য সেখানে তাল লাগে না। একটা উদাহরণ দেই, আমার ফ্রেন্ডলিস্টের এক জন একবার লিখলো “ আমি আমার জীবনে সাতজন স্বার্থপর মানুষ দেখেছি যার মধ্যে পাচঁজনই নারী”। শতেক খানি লাইক এর বেশির ভাগই নারী। আর কমেন্টে নানাবিধ সমর্থন। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি উক্ত ব্যাক্তিদের কাছে স্বার্থপরতা ডিজার্ভ করেন কিনা সেই যৌক্তিক প্রশ্ন টি কেউ না করেই তাল দিতে শুরু করলো।
ব্লগ প্রসঙ্গ দিয়ে উপসংহার টানতে চাই। এখানে লিখে আপনি যতটা না পরিচিতি পাবেন, লেখাতে তাল দিয়ে তার থেকে বেশি পরিচিতি লাভ করবেন। তাল দিয়ে লিখেন, আপনার মতো সামাজিক জীব ব্লগে আর একজনও নেই। তাল না দিয়ে, অন্যের ছিদ্রান্বেষ না করে লেখার আনন্দে লিখে যান। সেটাই হোক মূল লক্ষ্য। পাঠকপ্রিয় লেখা মানেই যে সেটা ভালো মানের লেখা, সেটা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। আমার কাছে ভালো লেখা সেটাই যেটা লিখে আপনি নিজে আনন্দ পেয়েছেন। হ্যাপি ব্লগিং!!
সমসাময়িক সময়ে, যে কোনো ক্ষেত্রে আপনাকে টিকে থাকতে হলে তাল জনতা’র দলে নাম লেখাতে হবে। ভুলেও সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করবেন না। তাল না দেন অন্তত চুপ করে থাকুন, বোবার কোন শত্রু নাই। এক্কেবারে কেঁচে যাবে গুরু !!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৫৬