somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় রোদ্দুর (গল্প)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
কমলাপুর রেল স্টেশনে বসে আছি প্রায় দুই ঘন্টা। একটা সময় মনে হতে লাগলো আমি অনন্তকাল ধরে বসে আছি। ঠিক এমন সময় একটা ছায়া কাছে আসতে আসতে নিকটতম দূরত্বে এসে দাড়ালো।
- অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি বিরস বদনে বসে আছেন। কোনো সমস্যা?
- নাহ ঠিক আছি।
- সিলেটের ট্রেন আরো ঘন্টা খানিক পরে আসবে। খবর নিয়ে এলাম।
- আপনি কী করে জানেন, আমি সিলেট যাচ্ছি।
- এই প্লাটফর্ম থেকে সিলিটের ট্রেনই ছাড়ে
- আচ্ছা তাই বলেন
- কী ভেবেছিলেন আপনাকে ফলো করছি?
- না আবার হ্যাঁ
- আপনা কে ফলো করছি না বলবে মিথ্যা বলা হবে। গত ঘন্টা খানিক আপনি ১৮ বার ঘড়ি দেখেছেন। ০৩ বার পানি খেয়েছেন আর ২ বার ব্যাগের চেইন খুলে মোবাইল দেখেছেন।
- আরেহ আপনি দেখি রীতিমত গোয়েন্দাগিরি করছেন।
- একদম-ই না। আপনাকে দেখতে হলে তো আপনি যা যা করছেন তাও দেখতে হবে।তাই না? কী নাম আপনার?
- বৃষ্টি
- টিপটিপ না মুষলধারে?
- জ্বী
- না মানে আপনার নাম হওয়া উচিৎ ছিল রোদ্দুর। শীতের রোদ্দুর।
- কেন?
- এই যে আমি বিরক্ত করার পরও আপনি আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন।এই কারনেই আপনি শীতের রোদ্দুর। তাপ আছে উত্তাপ নাই। প্রয়োজনীয়তা আছে, বাহুল্য নাই। সবথেকে বড় কথা প্রত্যাশিত কিন্তু ক্ষণস্থায়ী।
- আপনি?
- ওহ সরি! আমি শামস। আমিও এই ট্রেনেই যাচ্ছি। তবে সিলেট না।।আগেই নেমে যেতে হবে।
- ও আচ্ছা।
- কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা সমস্যা। কোনো সাহায্য করতে পারি?
- আসলে আমার মোবাইল টার ব্যাটারি ডাউন হয়ে সুইচড অফ হয়ে গেছে। বাবা বাসা থেকে চিন্তা করবেন। এদিকে ট্রেনও লেট।
- আপনি চাইলে আমার সেল থেকে বাসায় একটা কল করতে পারেন, যদি আপনার কোনো সমস্যা না থাকে।
- না-না সমস্যা, সেল ফোনটা দিন। অনেক ধন্যবাদ।
- এটা আমার কার্ড। সিলেট পৌছানোর আগে কোন অসুবিধা হলে, সেল নাম্বার লেখা আছে কল দিয়েন। নাটক কিংবা সিনেমা হলে তো পরিচালক সাহেব নিজ ক্ষমতা বলে আমাদের সিট পাশাপাশি করে দিতেন। সেটা তো আর সম্ভব নয়, আর অত সৌভাগ্য নিয়েও আমি আসি নাই। অবশ্য সেজন্যে আমার কোনো আফসোস নাই। সো মিস রোদ্দুর, ভালো থাকবেন। আমাদের ট্রেন চলে এসেছে। হ্যাভ আ নাইস জার্নি।
২.
বেশ খানিকটা ধকলের পর ট্রেনে উঠতেই লম্বা ঘুম। ট্রেনের হালকা দুলনি আর এসি’র শীওতল বাতাসে প্রায় দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটলো। ঘুম ভাংতেই খুব চা খেতে ইচ্ছে করলো। যদিও চা ভর্তি ফ্লাস্ক আমার ব্যাগেই আছে, কিন্তু চা একা একা খাওয়াটা ভীষণ বিরক্তিকর। মানুষ যখন আয়েশ করে চা খায় সেই দৃশ্য আমি বেশ মন দিয়ে দেখি। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে পর পর দুটো বগি পেরিয়ে সোজা ডাইনিং কম্পার্টমেন্টে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ফাঁকা দেখে টেবিলে বসলাম। কানে হেড ফোন গুজে দিয়ে উদাস হয়ে বাইরে তাকালাম।খুব প্রিয় ট্র্যাক "হয়তো তোমার-ই জন্য”। আয়েস করে চা ঢাললাম। চা অর্ধেকে নামতেই হঠাৎ টেবিলে ঠকঠক।
- আরে মিস রোদ্দুর! আপনি এখানে?
- হ্যাঁ আসলাম আর কী।
- বসতে পারি?
- বসুন
- আপনার বাবা কল করে আপনাকে চেয়েছিলেন। বাব্বাহ কি রাশ ভারী গলা। আপনি আশে পাশে নেই জেনে হতাশ হলেন। আমি বলেছি, আপনার সাথে দেখা হলে ফোন কলের কথা বলবো। আপনি কী আরেক টা কল করবেন। বোধহয় তিনি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছেন।
- ধন্যবাদ!
- ফ্লাস্কে চা!
- হ্যাঁ, আমি ট্রেনের চা খেতে পারিনা। তাছাড়া ওরা কাপ গুলা ঠিক মতো পরিষ্কার করেনা।
- আর?
- আমি নিজের হাতে বানানো চা খেতে ভালোবাসি।
- বাহ! যাক তাও ভালো। আমার অবশ্য টং এর চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই আশা করি এখানকার চা অনায়েসে খাওয়া যাবে।
- আপনি চাইলে আমার সাথে জয়েন করতে পারেন। আমার ভালো লাগবে।
-খেতে পারি তবে আমাকেও সুযোগ দিতে হবে আপনাকে একদিন এককাপ কফি খাওয়ানোর। অন্যের হাতে বানানো কফি নিশ্চয় খান! তাহলেই কেবল আপনার চা এক দাওয়াত নিতে পারি।
- বাব্বাহ! এ তো দেখি শর্ত প্রযোজ্য। আপনার দাওয়াত নিলাম। তবে রক্ষা করার কথা এখনই দিতে পারছি না। আমি অবশ্যই ভেবে দেখবো।

৩.
বাড়ি থেকে ঢাকা ফিরে পুরনো রুটিনে জীবন চলতে শুরু করলো। সামনে মাষ্টার্স পরীক্ষা তাই পড়াশুনোর চাপও বেশি। একদিন হ্যান্ড ব্যাগের ভেতরের পকেট থেকে শামস সাহেবের বিজনেস কার্ড বেরলো। এবং এতো মধ্যে আমি সেদিনের জন্য তাকে ধন্যবাদ বলার কথাও মনে করিনি। তাই আবার ভুলে যাওয়ার আগেই তাকে কলটা দিলামঃ
- হ্যালো
- মিস রোদ্দুর বলছিলাম। স্টেশনে পরিচয়।
- এতো দিন বাদে, কেমন আছেন?
- ভালো। আপনাকে পরে আর ধন্যবাদ বলার সুযোগ পাইনি। ইনফ্যাক্ট আপনি তো আমার আগেই নেমে গিয়েছিলেন।
- শুধু ধন্যবাদে তো হবে না মিস রোদ্দুর। আমার একটা দাওয়াত ছিলো এবং সেটা রক্ষা করারও প্রতিশ্রুতি ছিলো।
- ও হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত।
- দাওয়াত রক্ষা করবেন না সেটা মুখে বলুন, পরীক্ষার অজুহাত দেখানোর কোনো মানে নেই। তিরিশ মিনিটের জন্য আপনার পরীক্ষা আশা করি খারাপ হবেনা।
- আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় খাওয়াবেন বলুন।
- আপনি বলুন
- শর্মা হাউজ, রবিবার, বিকাল ৫.০০ টা।
- ঠিক আছে, দেখা হবে।

৪.

রবিবার ঠিকঠাক সময়ে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক উপস্থিত। আমাকে দেখে খুশি না হয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বেসলেন
- আরেহ আপনি একা কেন? আপনার বান্ধবীরা কোথায়?
- আপনি তো বান্ধবীদের আনতে বলেন নি।
- এটা আপনি কোনো কাজ করলেন?
- কেন?
- আমাকে আপনার মতো স্বল্প ভাষী ফর্মাল মানুষের সাথে পাক্কা তিরিশ মিনিট বসে থাকতে হবে। এম্পোসিবল! এই জন্য-ই কি অফিসে মিথ্যে বলে আধ ঘন্টা আগে এসে বসে আছি!!
- অপমান করছেন! কফির সাথে অপমান ফ্রি
- মাইন্ড করবেন না প্লিজ
- আমি সবাই কেই বন্ধু ভেবে ফেলি কিনা!

শামস সাহেব এতো কথা বলেন যে একবার বলতে শুরু করলে বলেই যান, বলেই যান, বলেই যান। প্রথম দিনেই ক্লাস ওয়ান থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত কোথায় কী পড়েছেন, পরিবারে কে কে আছেন, কে কি করেন সব প্রায় মুখস্ত করি ছাড়লেন। আমিও অসহায় মুখ করে শুনতে লাগলাম। আর ঘড়িতে বার বার চোখ রাখছিলাম। ঘন্টা খানিক পরে বললাম, আমাদের বোধহয় আজ ওঠা উচিৎ। এবার তিনি বেশ লজ্জা পেলেন, “এক ঘন্টা হয়ে গেছে! আগে বলবেন না? সব ষড়যন্ত্র!” সত্যি বলতে কী, লোক টাকে আমার ঠিক খারাপ লাগেনি কিংবা ভাল লেগেছে সেটা অস্বীকারও করা যাচ্ছে না।

৫.
মাঝে মাঝে আমাদের কথা হতে লাগলো। এমনকি দেখাও। আমার মাস্টার্স পরীক্ষার পরের সপ্তাহে আমাদের দেখা হলো। আবার সেই কথার মেইল ট্রেন। এবার আমাকে হতবাক করে দিয়ে সরাসরি বলে বসলেন,
- বৃষ্টি, আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই
- কী!!!
- প্লিজ অন্য ভাবে নিবেন না। আমি আপনার এবং আমার একটা বৈবাহিক সম্পর্কের কথা ভাবছি। যদি আপনার সম্মতি থাকে। আপনি রাজী থাকলে আপনার বাবা মা এর সাথে কথা বলতে পারেন। আর কোনো সমস্যা থাকলে এখনি আমাকে বলতে পারেন।
- আমি হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেলাম। হা ঈশ্বর কি হচ্ছে এই সব।
- আপনাকে এখনই হ্যাঁ বা না কিছু বলতে হবে না। আপনি সময় নিন। সময় নিয়ে ভাবুন।
- জ্বী আচ্ছা
- কিছু মনে করবেন না প্লিজ
- না না ঠিক আছে।
- আপনি তো বাসায় যাচ্ছেন, বেশ কিছু দিনের জন্য। আংকেল আন্টি নিশ্চয় আপনার বিয়ের কথা ভাবছেন। বলি বলি করে দেরি করে বলে সারা জীবন আফসোস করতে আমি রাজি নই।

আমি ঠিক কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। পরের সপ্তাহে বাসায় গিয়েও অস্বস্তিটা কাটাতে পারছিলাম না। বাবা কে কিভাবে বলি, ভেবে ভেবে দিন রাত এক করে ফেললাম। মা কিছু একটা আঁচ করে ফেললেন। একদিন রাতে এসে জিজ্ঞেস করলেন
- তুমি কি কিছু নিয়ে অস্বস্থিতে আছো?
- না আবার হ্যাঁ
- আমাকে বলা যাবে
- যাবে। মাকে শামস সাহেবের কথা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বললাম।
- আমি তোমার বাবা’র সাথে কথা বলে দেখি। তাছাড়া খোঁজ খবর নেবারও তো একটা বিষয় আছে।

সেদিন থেকে একটা রিলিফ ফিল করতে শুরু করলাম। কিন্তু এখন বাবা মা কে কেমন বিমর্ষ লাগতে শুরু করলো। আমি ভাবলাম, আমি-ই তাদের একমাত্র মেয়ে তাই হয়তো! দিন সাতেকের মধ্যে শামস সাহেবের ফোন এলো, “আপনি কি আপনার বাবা মা কে জানিয়েছেন?”। আমি বললাম, “আমার জানাতে হয়নি, তারাই জেনে নিয়েছেন”। তারা আপনার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে চান। তিনি বললেন, “কী জানতে চান, আমি চোর ডাকাত কিনা?”। আমি বললাম, “নাহ, তারা জানতে চান আপনি ফেরারি আসামী কি না!”

৬.
তিন মাসের মধ্যে বাবা তার “খোঁজ খবর” নেয়ার কর্মসুচীর ইতি টানলেন। সব কিছুই নাকি ঠিকঠাক। হ্যাঁ সবই ঠিকঠাক শুধু বাবার ঐচাপা অস্বস্তি টুকু বাদ দিয়ে। শামস সাহেবরা ১২ জন এসে এক শুক্রবার উপস্থিত হলো। উদ্দেশ্য কনে দেখা, পছন্দ হলে এনগেজমেন্ট। আমার হবু শ্বাশুড়ি বাসা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। অনেক গল্প করলেন। বিকেলে ফিরে গেলেন।

বাবা এবার আমাকে তার রুমে বেশ আয়োজন করে ডেকে পাঠালেন। তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। আমি অবাক হলেও বললাম, বলো বাবা কি বলবে?। কথাটা তোমাকে বলতেই হতো। তবে এমন খুশির দিনে বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমি এমন কথা বাবা, তুমি বলতে এতো ইতস্তত বোধ করছো!

বাবা বেশ গুছিয়ে শুরু করলেন, বৃষ্টি তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে। তোমার মা তোমাকে পেটে ধরেনি ঠিক-ই তবে তার আন্তরিকতার কোনো অভাব কোনো কালেই ছিলো না। আমাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে আমরা বাবা-মা হতে পারিনি। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে তুমি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে। তোমার জন্মগত বাবা বহু বছর ধরে নিখোঁজ। আর তোমার মা তোমার জন্মের সময় মারা জান। আমরা তোমাকে তোমার নানীর কাছ থেকে নিয়ে আসি যখন তোমার বয়স ৮দিন। তোমাকে হারানোর ভয়ে আমরা ঐ পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। তারা তোমার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিলেন। আর আমরা একটা সন্তান চেয়েছিলাম। এরপর বাবা শামস সাহেবের ফোন নম্বর নিলেন।বললেন তোমার জীবনের কথা তোমার যেমন জানা্র অধিকার আছে, আমি মনে করি তুমি যাদের সাথে জীবন কাটাবা তারও এইসব কথা জানা প্রয়োজন।

বাবা তিনদিন বাদে শামস এবং তার বাবা-মা এর সাথে কথা বলবেন বলে তারিখ নিলেন। নির্দিষ্ট দিনে বাবা-মা গেলেন সেই বাসায়। কি কথা হয়েছিল, জানি না। তবে তার পরের দিনই একজন লোক এসে একটা চিঠি আর এনগেজমেন্ট এর আংটি ফেরত দিয়ে যান। বাবা খুব মুষড়ে পরেন। আমিও আর শামস সাহেবের আত্মপক্ষ সমর্থনের ফোন কলটির অপেক্ষায় রইলাম। ফোন আসলো, শামস যা বললো তার সার কথা হলো “বৃষ্টি তুমি মন খারাপ করো না। বাবা-মা এই ধরনের সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। আমার অবস্থাটা তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি কি তোমার কাছে থেকে মাস খানিক সময় পেতে পারি”। জীবনটা রীতিমতো আমাকে নিয়ে খেলেই চলেছে

মাস খানিক বাদে শামস এলো আমার সাথে দেখা করতে। সেই কফি হাউজ। তবে আজকের শামস আর সেই প্রথমদিককার শামসের মধ্যে মিল নেই। শুরুতেই সামাজিক কুশলাদির পর বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা। শামস খুব সাবধানে আমার হাতের উপর হাত রাখলো।
- বৃষ্টি তুমি কি আমার উপর আস্থা রাখ?
- এই কথা কেন?
- চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি
- মানে?
- বাবা-মা এই বিয়েতে কোনো দিনই মত দিবেন না। তারা বলেছেন, আমি চাইলে তোমাকে বিয়ে করতে পারি। তাতে সব রেসপন্সিবিলিটি আমার। এবং হ্যাঁ আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। আমি তো আমার জীবন টা তোমাকে নিয়েই ভেবেছি। সেখানে তোমার পরিচয় আমার কাছে তুমি। আর কোনো কিছু জানার দরকার নাই আমার।
- আমি আমার দ্বিতীয় হাতটি শামস সাহেবের হাতের উপর রাখলাম।বললাম, তাতে আমাদের সংসার হবে কিন্তু আমি কোনো ভাবেই সম্মনিত বোধ করবো না। একটা অসম্মানের জীবন আমি চাই না। আমি অনেক ভেবেছি জানো, তুমি তাদের একমাত্র ছেলে। তুমি ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। কিন্তু দেখো আমার তো বাবা-মা আছেন। তারা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আমি এই সাময়িক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো। তাছাড়া আমি বেশ কিছু জায়গায় চাকরীর ভাইভা দিচ্ছি। একটা চাকরীর কথা বেশ কিছুদুর এগিছে। খুব শীঘ্রই জয়েন করে ফেলতে পারি। হাতের আংটি টা খুলে দিলাম। বললাম, এটা কেন আমার হাতে ছিলো জানো, আমি তোমার উপর আস্থা রাখি তাই। ভালো থেকো।

বাড়ীর পথটা সেদিন ভীষন দীর্ঘ মনে হয়েছিল.......

নতুন হোস্টেলে, নতুন পরিবেশে বেশ মানিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা-মা কে প্রায় বলি ঢাকা এসে আমার কাছে থাকো। তার কেবল-ই আশ্বাস দেন। কেন যেন তাদের আর আসা হয়না।

৭.

একটা আই এনজিও তে খুব ভালো পোষ্টে একটা চাকরী হয়ে যায় আমার। সময় বোধ হয় সব সময় খারাপ যায় না! এবার আমি আমার পরিবার কে আমার কাছে চাই। ছোট্ট সুন্দর একটা পাখির বাসা খুঁজে বের করি। বাবা-মা কে এক রকম টেনে ধরেই ঢাকাতে নিয়ে আসি।

গত ৮ বছরে দুইবার আমাকে চাকরী বদল করতে হয়েছে। এই সমাজ এখন পর্যন্ত একজন অবিবাহিত মেয়ের জন্য অনূকূল হয়ে উঠতে পারেনি। আমাকে অফিসের সহকর্মীদের নানা বিরুপ মন্তব্যের সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তাদের জন্য আমার করুনা হত, যারা অন্য কে অপদস্ত করতে ভালোবাসে।

বাবা-মা আর কখনোই আমাকে বিয়ের জন্য জোর করেন নি।তাদের মধ্যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির একটা সংকোচ ঢুকে গিয়েছিল। তবু, মা একটু আধটু বলতেন, তবে আমার যুক্তির কাছে তিনি হার মেনেছেন। আমি বলতাম, আমি না থাকলে তোমাদের কে দেখবে বলো। তোমরা আমাকে আদর দিয়ে বড় করেছো এবার আমি তোমাদের আদর দিয়ে বুড়ো করবো। মা’র যুক্তি, কিন্তু তোমারও একটা জীবন আছে। আমি বলতাম, আমার জীবন তো আমার বাবা আর মা। আমি তাদের রেখে কোথাও যাবো না। না যাই নি কখনো, কোথাও!

চাকরীর বয়েস বাড়ে আর আমারও। বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ চলে আর ব্যস্ততাতে দিন কাটে। বাবা-মা আর কখনো আমার পরিচয় নিয়ে কোনো কথা বলেন নি। আমিও আর কখনো জানতে চাইনি। যাদের কাছে আমি-ই জীবন, তাদের চেয়ে মূল্যবান আর কী আছে আমার জীবনে। তবে প্রতি রাতেই শুয়ে শুয়ে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া মায়ের একটা ছবি আঁকতাম। কেমন ছিলেন তিনি দেখতে।

বন্ধু-বান্ধব দের সাথে যোগাযোগ কমে যেতে যেতে প্রায় নেই বললেই চলে। আত্মীয়দের সাথে কোনো কালেই বাবা-মা সহজ ছিলেন না। হয়ত তাদের খারাপ সময়ের কোনো অভিমান থাকতে পারে। আমি জানতে চাইনা। বাবা-মা আর কখনো আমার বিয়ের কথা বলেন নি। বোধহয় অপেক্ষা করেছেন, আমি নিজেই নিজের কথা ভাববো।

চাকরী সুত্রে ফিল্ড ভিজিটে আমি একবার একটা গ্রামে যাই। মাতৃ স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে, সুন্দর ছিমছাম গ্রাম। মানুষ গুলোও বেশ আপন। একটা পরী পেলাম কুড়িয়ে। এক মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করে তার প্রেমিক কে। প্রেমিকের পরিবার গরীব এই মেয়েকে বৌ হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। ছেলেটা এক পর্যায়ে তালাক নামা পাঠায়। মেয়ে তখন অন্তঃস্বত্তা। তারা সদ্য ভুমিষ্ট এই শিশুটার জন্য একটা এতিমখানা খুঁজছিল। পরিবারটি মেয়েকে আবার বিয়ে দিবে। তারা কোনো পিছু টান রাখতে চায় না। আমি ঐ এলাকা তে মাস ছয়েক কাজ করার সূত্রে এই পরিবারের সাথে আমার পরিচয়। তাদের এই ইচ্ছের কথা জেনেই, এই বাচ্চাটাকে আমি নিতে চাই।

আমি বাবা-মা কে বুঝিয়ে রাজি করালাম। মা বললেন, লোকে ওর বাবার কথা জানতে চাইবে, কি বলবা তখন। তোমাকে আমরা যখন এনেছি তখন তোমার বাবা- এবং আমি দুজনেই তোমার পরিচয় ছিলাম। তুমি তো একা। বাকি জীবনটা তোমার জীবন সঙ্গী কি এই বাচ্চাটা মেনে নিবে? আমি আবার ভাবলাম। অনেক ভাবলাম। আমি আসলে কি চাই! একদিন গভীর রাতে মাকে বললাম, এই মুহূর্তে আমি একটা বাচ্চা-ই চাই।

সবকিছু লিখে পড়ে বাচ্চা টাকে আমি নিয়ে আসলাম। ওর মা ভীষণ কেঁদেছিল সেদিন। আমি নিজেকে প্রবোধ দিলাম, আমি তো জোর করে নিয়ে যাচ্ছি না। এটা তো আমাদের দুই জনের ইচ্ছার সম্মিলন! মেয়ে বেঁচে থাকলে আর বুঝতে শিখলে, আমি ওকে ঠিকানা দিয়ে দিবো।নিজের ইচ্ছের মূল্য দেবার পুরো অধিকার দিয়েই ওকে আমি বড় করবো। মেয়ে যদি কখনো ওর জন্মদাত্রী মা্যের কাছে যেতে চাই আমি নিজে তাকে পৌঁছে দিবো, নিজের কাছে এই বিষয়ে আমি অঙ্গিকারাবদ্ধ। সবথেকে বড় কথা আমি না নিলেও কেউ না কেউ তো ওকে নিতো-ই।

৮.
সামাজিক জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে আর কমেছে কাছের মানুষ। তাই একদমই কোথাও যাওয়া হয় না। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছি। তার নানা ভাই আর নানু মনি-ই তার দেখাশুনো করে। কেবল স্কুলে আনা-নেয়ার দায়িত্বটা আমার।

আমার বর্তমানে জীবনের একমাত্র বান্ধবী শায়লা’র বোনের বিয়ে। আন্টি খুব করে যেতে বলেছেন। এই ইনভাইটেশনটা রক্ষা না করলেই নয়। বাবা-মা’র বয়েস হয়েছে। তারা আর কোথাও যেতে চান না।বললেন একদিন শায়মা কে বাসায় ডেকো তখন না হয় জামাই দেখবো। শেষ পর্যন্ত আমি আর আমার মেয়েই গেলাম বিয়ে খেতে।

মেয়েটা শায়লার বাচ্চাদের সাথে ছুটোছুটি করছে আর তার পেছনে আমি। কেউ একজন ভীড়ের ভেতর থেকে ‘মিস বৃষ্টি’ বলে ডাকলেন। আমার নাম! কে হতে পারে? পেছনে তাকাতেই দেখি শামস সাহেব।

- হেসে বললেন, হওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
- আপনি!
- হ্যাঁ, কেমন আছো?
- ভালো
- আপনি?
- এই আছি আরকি। তোমার সাথে দেখা হবে কখনো ভাবিনি।
- আমি হাসলাম।
- ৭ বছর পর দেশে ফিরিলাম। ফিরলাম মানে বেড়াতে এলাম।
- কোথায় থাকো, কি করো?
- ঢাকাতেই থাকি, একটা চাকরী করি
- আংকেল আন্টি কেমন আছেন?
- ভালো আছেন
- তুমি একদম বদলাও নি, ঠিক আগের মতোই আছো
- আপনি বদলেছেন

ঠিক তখন-ই আমার মেয়ে মাম্মাম বলে ছুটে এসে আমার পেছনে লুকিয়ে পড়লো।

- তোমার মেয়ে?
- হ্যাঁ
- কী নাম মামনি তোমার?
- লোদ্দুল (রোদ্দুর)

শামস সাহেব খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। অভিমানি, মুগ্ধ, হতাশ আর বেদনাহত সেই চোখে লেখা ছিলো “বৃষ্টির মেয়ে তো ‘রোদ্দুর’-ই হবে!”

……………………………………………………………………………………………………………………………



সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:২৮
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এতো কাঁদাও কেনো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৬




আয়না হতে চেয়েছিলে আমার। মেনে নিয়ে কথা, তোমায় আয়না ভেবে বসি, দেখতে চাই তোমাতে আমি আর আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনা। রোদ্দুরের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে আলোয় আলোকিত মনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অচেনা মানুষ আপনাদের দীপাবলীর শুভেচ্ছা

লিখেছেন আজব লিংকন, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২১



আমারই বুকে না হয় শিবেরই বুকে
নাচো গো... ও নাচো গো...
পবন দা'র গলায় ভবা পাগলার গানটা কারা জানি ফুল ভলিউমে বাজিয়ে গেল। আহ.. সে সুরের টানে বুকের মাঝে সুখের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×