গত সাতদিন যাবৎ মনে হচ্ছে আমি আত্মহত্যা করি। এ জগতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। ঘুম আসে না ঠিকমতো। ব্যবসায় মন বসে না। কাউকে কষ্টগুলো বলতেও পারি না। পৃথিবীটাকে শুধু নিষ্ঠুর আর পাষাণ মনে হয়। দুচোখে শুধু অন্ধকার দেখি, আলোর ছিটেফোঁটাও দেখি না কোথাও।
আমাদের বিয়ে হয়েছে ৬ মাস হলো। বিয়ের পর থেকেই বউ আমার সাথে থাকতে চায় না। ২ মাস পর থেকে তার বাবার বাড়িতে। অনেকবার বলেছি আসতে, আসেনি। একবার আনতে গিয়েছিলাম, সে তার বাবা ও ভাইসহ অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন কল দিলেই বলে তালাক দিতে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছি। সম্পর্ক যে বেশীদিনের ছিলো তাও না। বিয়ের মাত্র ৪ মাস আগে পরিচিত হয়েছিলাম আমরা।
আমাদের গ্রামের বাজারে বড় একটি মুদি দোকান আছে আমার। ছোট থেকেই ব্যবসা করেছি। কোনো মেয়ের সাথে সময় দেয়ার সুযোগ হয়নি কখনো। বন্ধুরা মজা করে বলতো আমি নাকি দোকানের সাথে বিয়ে বসেছি। যাহোক এখন এলাকায় সবচে বড় ব্যবসায়ীর কথা বললে আমার নামটিই আসবে প্রথমে।
ওর নাম কণা, প্রথম যেদিন আমার দোকানে এক কেজি চিনি নিতে আসে, সেদিন তাকে দেখে এতটাই ক্রাশড হই যে আমি তার দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক্ষণ অবশ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছোট ভাইয়ের খোঁচা খেয়ে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম। পরে এক কেজি চিনি মেপে দিলাম ওকে। ওর থেকে চোখ না সরিয়েই চিনি মেপেছিলাম। ও বললো, চিনি তো বেশী দিয়েছেন। আমি বললাম সমস্যা নেই। এক কেজির দাম দিলেই হবে। ওর চলে যাওয়ার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আমার চোখের পলক পড়েনি একবারও।
সেদিনের পর থেকে আমি ওকে খুঁজতে থাকি। পরে জানতে পারি পাশের গ্রামেই ওর ফুফুর বাড়িতে এসেছে। ওর ফুফা আমার রেগুলার কাস্টমার। সহজে ওর সাথে যোগাযোগ করি ও সাক্ষাৎ করি।
প্রথম সাক্ষাতেই ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। ও রাজি হয়। আমি বাড়িতে বলে তাদের বাড়িতে প্রস্তাব দিয়ে আসার কথা বলি। তখন ও বলে এখন না, আরও পরে।
প্রস্তাব দিতে দেরি হলেও আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। দেখা সাক্ষাত করি। এমনকি শারিরিক সম্পর্কও করে ফেলি। আমি বিয়ের আগে এসব করতে চাইনি, ও একরকম জোর করেই আমাকে বিছানায় ডাকতো। এমনকি তাদের বাসায় পর্যন্ত এ কাজ করতাম আমরা।
ও প্রতিদিনই বিছানায় ডাকতো। আমার ইচ্ছে হতো না তবুও জোর করতো। আমি বারণ করলে সে মিষ্টি কথা বলে আমাকে মানিয়ে নিতো। খোদার কসম করে বলছি আমি বিয়ের আগে একটুও শারিরিক সম্পর্ক করতে চাইনি, ওর মন ভুলানো কথায় আমি রাজি হতাম। ওর কণ্ঠ এত মিষ্টি ও কথাগুলো এত মধুর হতো যে আমি কোনো বিষয়েই দ্বিমত করতে পারতাম না।
৪ মাস রিলেশনের পর জানতে পারি ওর এক প্রবাসী ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো। এছাড়া তার বাবা মাদকাসক্ত। এলাকায় নেশা, জুয়া, চাঁদাবাজি এমন কোনো কাজ নেই যা করে না। তবুও আমি সম্পর্ক রাখি। ভেবেছি আগের সম্পর্ক হয়তো ভুলে গেছে। আর তার বাবার কী দরকার, মেয়ে ঠিক থাকলেই হলো।
বাড়িতে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। আমার বাড়ি থেকে তাদের বাসায় কয়েকজন যায় এবং সেদিনই দেনমোহর, ডিমান্ডসহ বিয়ের কথা ফাইনাল হয়। পরবর্তী শুক্রবারে আমাদের বিয়ে।
বিয়ের দিন বরের স্টেজে বসে আছি। বন্ধুবান্ধব ফটো তুলছিলো। এমন সময় দেখলাম চাচা আমার দিকে হনহন করে হেঁটে আসছেন। রাগে তার ফর্সা চেহারা রক্তাভ হয়ে আছে। গুরুগম্ভীর না হলে হয়তো এতক্ষণে চিৎকার করে বিয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে তুলতেন।
আমার কাছে এসেই রাগ দমিয়ে সংযত কণ্ঠে বললেন, এসব কী? আমি বললাম কী হয়েছে কাকা?
এখানে বলে রাখি গত এক যুগ ধরে আমার কাকাই আমার বাবা। বাবা মারা যাওয়ার সময় উনার দুই ছেলের সাথে আমাকে বড় ছেলে হিসেবে লালনপালন করেছেন। আমি তার ভাতিজা এটা কখনো মনে হয়নি।
মেয়ের বাবা ও অন্যান্য মুরুব্বিদের সাথে আলোচনা করার জন্য একটি ঘরে বসে ছিলেন। সেখান থেকে ফিরেই তিনি এই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। উনি যা বললেন তা শুনে আমি অজ্ঞান হবার অবস্থা।
দেনমোহর ঠিক হয়েছিলো ৩ লাখ টাকা, ডিমান্ড ছিলো আমাদের নতুন ঘর সাজিয়ে দিবে। এখন মেয়ের বাবা বলছে ১৫ লাখের নীচে দেনমোহর হবে না এবং তারা কোনো ডিমান্ড-টিমান্ড পূরণ করবে না। জবাবে আমার চাচা বলেছেন এ বিয়ে হবে না। তখন মেয়ের বাবা নাকি শারিরিক সম্পর্কের কথা টেনে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসাবে বলে হুমকি দেয়। এসব শুনে চাচা আর বসে থাকতে পারেননি। রাগে অপমানে সোজা আমার কাছে চলে আসেন।
চাচা এখন রাগ শেষে কান্না মেশানো কণ্ঠে বলছেন তুই কেন এ কাজ করলি বাবা! এখন কী হবে?
আমি নিশ্চুপ। শারিরিক সম্পর্কের কথা আমি আর ও ছাড়া কেউ জানার কথা না। ও কীভাবে ওর বাবাকে জানালো সেটাই ভেবে কুল পাচ্ছি না।
ওরা বলেছিলো ৫০ জনের চলন আসতে। আমি ব্যবসায়ী তাই আমার পরিচিত অনেক মানুষ। অনেক বাছাই করলেও হয়তো ২০০ জন পর্যন্ত কমানো যাবে। অনুষ্ঠানের অর্ধেক খরচ আমি দিয়ে বলেছি আমার লোক ২০০ জন আসবে। পরে তারা রাজী হয়।
এখন বিয়ে বাড়িতে আমার পরিচিত শ' দুএক লোকে ভরা। বিয়ে ভাঙ্গার প্রশ্নই ওঠে না। এছাড়া এ কথা জানলে একটা মারামারি লেগে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার সম্মানের বিষয়টা তো আছেই।
সব ভেবে চাচাকে আমার পাশে বসিয়ে ভগ্নীপতিকে পাঠালাম তারা যেভাবে বলছে সেভাবেই বিয়ে ফাইনাল করতে। স্বাভাবিকভাবেই ধুমধাম বিয়ে হলো। বউ নিয়ে বাসায় আসলাম। সবাই যার যার বাসায় চলে গেলো।
সব ঝামেলা চুকে বাসর ঘরে যখন প্রবেশ করলাম তখন বাজে রাত ২টা। ওর ঘুম পাচ্ছে বলে ঘরে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। আমি বেচারা বাকীরাত Got married স্ট্যাটাসে কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে কাটালাম।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই ওর ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে ডেকে এনে তার সাথে চলে গেলো। আত্মীয়স্বজন কারও সাথে পরিচয় পর্যন্ত করে দিতে পারলাম না। ভাবলাম দুদিন পর তো আসবে, তখন পরিচয় করিয়ে দিবো।
দুদিন পর এসেছিলো কিন্তু বেড়াতে, থাকতে নয়। এভাবে দুইমাস অবধি অনেক ডাকাডাকি করলে মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে বেড়াতে আসতো আর থাকতো ওর বাবার বাড়িতেই।
দুই মাস পর আর বেড়াতেও আসে না। এক মাস পর যখন আনতে গিয়েছিলাম, তখন আমাকে যা তা বলে অপমানিত করে এবং একরকম তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এখন কল দিলেই বলে তালাক দিতে।
তালাক দেয়া তো কোনো ব্যাপার না, ১৫ লাখ টাকা দেনমোহর দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কোনো কষ্ট নেই।
কষ্ট হলো যাকে এত ভালোবাসলাম, যার রূপ-সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকতাম। যার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতাম না। যার গলায় গলা রেখে একে অপরের তরে কোরবান বলে শপথ রাখতাম। যার কথার মধুর সুর ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে যেতাম। যাকে কখনো পর মনে হয়নি। যাকে কখনো ছলনাময়ী তোর দূর কি বাত এতটুকুন ভালোবাসার ঘাটতি তার থেকে পাবো বলে কল্পনাও করিনি। তার এমন আচরণে কি করে সুখে থাকি!
আমি কী এমন পাপ করেছিলাম যার প্রায়শ্চিত্ত দিতে হচ্ছে! আমি নিজেকে নিয়ে হতাশ। বেঁচে থাকার কোনো আশাই নেই আর মনে। ভালো থাকবেন সবাই। কখন কোন সময় কোথায় পড়ে মরে থাকি আমি নিজেও জানি না। শুধু দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আমায় মাফ করেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ৮:১২