somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচেনা দিগন্ত (পর্ব-১)

১৮ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকালবেলার সূর্যের আলো জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে। মোবাইলের অ্যালার্ম বন্ধ করে নায়লা উঠে পড়লো। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালেন্ডারের চিহ্নিত তারিখটির দিকে একবার তাকিয়ে নীরবে নিজেকে মনে করিয়ে দিলো—এটাই সেই দিন।

সে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেলো। দাঁত ব্রাশ করতে করতে চিন্তা করছিলো এস ল্যাবের (সমন্তরাল ল্যাবরেটরি) গবেষণার ব্যাপারে। বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রমের পর তারা প্রথমবারের মতো একটি মানব মিশনের জন্য প্রস্তুত। আজ সে প্রথম ব্যক্তি, যে এই পরীক্ষার অংশ হতে যাচ্ছে।

নায়লার অ্যাপার্টমেন্টটি বেশ গোছানো। বুকশেলফে সারি সারি বই সাজানো, বেশিরভাগই পদার্থবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ও দর্শনের। দেয়ালে একপাশে স্টিফেন হকিং-এর একটি পোস্টার, অন্য পাশে ছোটখাটো আর্টপিস। অ্যাকুরিয়ামের পাশে রাখা ছোট্ট কাঠের টেবিলে তার ল্যাপটপ ও কিছু গবেষণার নোট। বিছানার পাশে একটি ল্যাম্প, যার নিচে পড়ে আছে কাল রাতের বই, 'The Elegant Universe'।

নায়লা নিজের নাস্তা নিজেই তৈরি করতে ভালোবাসে। ব্রাশ শেষে মুখ ধুয়ে সে রান্নাঘরে গেলো। চুলায় দুধ বসিয়ে দুইটা ডিম সিদ্ধ দিলো। টোস্টারে দুটি ব্রেড গরম হতে দিলো। চায়ের কাপে আদা-মধু মিশিয়ে নিজের পছন্দ মতো গাঢ় চা বানিয়ে নিলো। এই রুটিনটা তার প্রতিদিনের, এবং সে এতে অভ্যস্ত। নাস্তা শেষে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলো, হালকা লিপবাম দিলো, আর নিজের চোখের নিচের ক্লান্তির রেখাগুলো আঙুল দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করলো। তারপর দ্রুত তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো।

বিড়াল ‘কুইন’-এর জন্য খাবার দিলো। কুইন একটা মধ্যবয়সী ব্রিটিশ শর্টহেয়ার, যার ধূসর রঙের লোম আর উজ্জ্বল হলুদচোখ। সে বেশ চঞ্চল, বিশেষ করে যখন নায়লা ব্যস্ত থাকে তখন আরও বেশি বিরক্ত করে। নাস্তা করার সময় কুইন তার পায়ে গা ঘষছিলো, নায়লা হেসে বললো, “কি রে, একটু সময় দিলেই হলো না?” কুইন সাড়া দিয়ে মিউ মিউ করে তার দিকে তাকালো, যেন নায়লার ব্যস্ততা বুঝতে পারছে। নায়লা মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোর দিকেও নজর দিলো একবার। তার অ্যাকুরিয়ামে কয়েক ধরনের মাছ আছে—গাপ্পি, বেটা, আর কিছু নীল রঙের টেট্রা। পানির বুদবুদ উঠছে, ফিল্টার মৃদু গুঞ্জন করছে। মাছগুলো বেশ সুস্থই দেখাচ্ছে, খাবার ছড়িয়ে দিতেই দ্রুত ছুটে এলো।

রীনা, গৃহকর্মী, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। নায়লা বললো, “রীনা, আমি তিন দিনের মধ্যে না ফিরলে আপুকে জানাবে, আর অফিসেও যোগাযোগ করবে, ঠিক আছে?”

রীনা একটু চিন্তিত মুখে বললো, “আপা, সাবধানে যাবেন তো? এত বড় একটা কাজ... ভালো লাগছে না।”

নায়লা হালকা হাসলো, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক থাকবে।”

টয়োটা প্রিয়াসের চাবি হাতে নিলো, দরজা লক করে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। এটি তার বিশ্বস্ত গাড়ি, কালো রঙের, স্মার্ট হাইব্রিড সিস্টেম। সুশৃঙ্খল ইন্টেরিয়র, ডিজিটাল ডিসপ্লে, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম—এই গাড়ির সাথে তার এক ধরনের মানসিক সংযোগ তৈরি হয়ে গেছে।

সকাল আটটা, ঢাকার চিরচেনা যানজট শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে মিরপুর রোড পার হয়ে গাজীপুরের দিকে চললো। মাঝে মাঝে এস ল্যাবের সহকর্মী ড. অনীতা মেসেজ পাঠাচ্ছিলো।

“কোথায় তুমি?”

নায়লা উত্তর দিলো, “জ্যামে আটকে আছি।”

“উড়োজাহাজ থাকা উচিত ছিলো এই মিশনের জন্য!”

নায়লা মৃদু হাসলো। শহর পেরিয়ে রাস্তা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে এলো।

মধুপূর গড়ের পথে প্রবেশের পর থেকেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যেতে লাগলো। ঘন শালবন রাস্তার দুই পাশে গভীর ছায়া ফেলেছে। পথের ধারে মাঝে মাঝে শুকনো পাতার স্তর, বাতাসের ধাক্কায় সেগুলো উড়ে যাচ্ছে। সকালবেলা হলেও বনভূমির ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে ছায়ার ফাঁক দিয়ে। নির্জনতা গভীর, শুধু মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

প্রথম চেকপোস্টে গাড়ি থামলো। সামরিক পোশাক পরা একজন অফিসার কড়া গলায় পরিচয় জানতে চাইলো। চারপাশে সশস্ত্র পাহারা, লোহার শক্ত ফটক।

নায়লা আইডি কার্ড দেখালো। স্ক্যান করে অফিসার মাথা নাড়লো, “আপনি যেতে পারেন, ডক্টর নায়লা।”

দ্বিতীয় চেকপোস্টে আরও কড়া নিরাপত্তা। এখানে বায়োমেট্রিক স্ক্যান করা হলো, একটি ছোট ড্রোন এসে গাড়ির চারপাশ স্ক্যান করে নিলো। এরপর লোহার গেট খুলে দেওয়া হলো।

তৃতীয় চেকপোস্টে একজন প্রবীণ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসে বললেন, “আপনার আজকের মিশন নিয়ে সবাই কথা বলছে, ডক্টর নায়লা। সাবধানে থাকবেন।”

নায়লা মাথা নেড়ে বললো, “ধন্যবাদ। আশা করি সব ঠিকঠাক যাবে।”

অবশেষে এস ল্যাবের মূল ভবনের সামনে পৌঁছালো। গাড়ি পার্ক করে বেরিয়ে এলো।

এস ল্যাবের বহির্ভাগ দেখতে অনেকটা উচ্চ নিরাপত্তার সামরিক স্থাপনার মতো। চারপাশে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া, নির্দিষ্ট রুট ছাড়া চলাচল নিষিদ্ধ। প্রবেশদ্বারটি কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত, বড় ধাতব দরজা, যার একপাশে রেটিনা স্ক্যানার লাগানো। ভবনের বাইরের দেয়াল কালো ম্যাট পেইন্ট করা, যেনো এটি চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যায়। চারপাশের বনভূমির মধ্যে এ স্থাপনা যেন এক অদৃশ্য দুর্গ।

ড. অনীতা এগিয়ে এসে বললো, “অবশেষে এলে! এত দেরি করলে কেন?”

নায়লা মাথা নাড়লো, “জ্যাম। আর কী!”

অনীতা হাসলো, “শুনো, যাওয়ার আগে আমাদের প্রিয় রায় স্যার সম্পর্কে একটু বলো না! কাল তিনি আমাদের তিন ঘণ্টা ধরে বুঝিয়ে দিলেন যে আমরা কিছুই জানি না।”

নায়লা হাসলো, “উনি নিজেই টাইম ট্র্যাভেল করতে চান, কিন্তু সময়ের গতি তার জন্য খুব ধীর।”

অনীতা হেসে ফেললো, “সত্যিই! উনার রাগ দেখে মনে হয় কেউ চশমাটা লুকিয়ে রেখেছে!”

নায়লা যোগ করলো, “আর সব দোষ সবসময় আমাদেরই!”

তারা দু’জনই হেসে উঠলো। কিন্তু হাসির মাঝেও একটা চাপা উত্তেজনা লুকিয়ে ছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:১৭
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঈশ্বরের ভুল ছায়া – পর্ব ৩ | ভূমিকা-ব্রীজ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০৮



"তুমি যদি বাতাসকে ভালোবাসো, তাকে বশ করো না—তার সুর বোঝো। কারণ বাতাস একবার থেমে গেলে, তার কণ্ঠ আর কখনো শোনা যায় না।"

“ঈশ্বরের ভুল ছায়া” সিরিজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত ইসরায়েল ও ভারতের ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত

লিখেছেন ঊণকৌটী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:১৩


উভয় বাজারে নেতৃস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে। এটি ইসরায়েলকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করছে, যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধে সমস্যাযুক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবার কমন শত্রু আওয়ামী লীগ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:৫৮


শেখ হাসিনা সবসময় তেলবাজ সাংবাদিকদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতেন। তেলবাজ নেতাকর্মীরাও বোধহয় তার পছন্দ ছিল। দেশে কী হচ্ছে, না হচ্ছে, সে সম্পর্কে তার ধারণাই ছিল না। সামান্য কোটাবিরোধী আন্দোলন উনার পক্ষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কনফ্লিক্ট জোনে পরিণত করলো ড. ইউনুসের অবৈধ দখলদাররা ‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ২:২১



শেষ পর্যন্ত ড.ইউন তার আন্তর্জাতিক সক্ষমতা প্রদর্শন করে দেখালেন! উনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কখনোই কোন কাজ করেননি ।আমাদের কোনো দুর্যোগে কখনো পাশে দাঁড়িয়েছেন তার কোনো দৃষ্টান্ত নেই । যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত একটি মানবিক দেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৩৮



যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমরা ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
ভারতের মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা বাংলাদেশি তোমরা ভারতীয়। আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই। ভারতের বাংলাদেশের সাথে সাংস্কৃতিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×