১
চলে যেওনা লিনা । কথা দিচ্ছি আর কখনো এমনটি হবেনা, আমি জানি তুমি আমাকে অকোয়ার্ড ভাবছো, আমার কথাগুলি পাগলের প্রলাপ ঠেকছে তোমার কাছে । কিন্তু তুমি তো বলেছিলে যেকোনো পরিস্থিতিতে আঁকড়ে ধরবে আমার হতোদ্যম হৃদয়ের ঋজু ভালোবাসা। প্লীজ হানি, যেওনা আর একটিবার আমাকে সুযোগ দাও; শুধু একবার । তারপর দেখো আমি এই রাতের অন্ধকারের জোনাক দিয়ে কিভাবে নক্ষত্র বানাই । সেই নক্ষত্রের আলোকচক্রে দৃষ্টি হেনে নিশাচরেরা রাত্রি যাপনে আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলবে অন্ধকারের নকশা । লিনা তুমি এভাবে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে চলে যেতে পারনা ।
ধড়াম করে সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দে রণ বুঝে যায় লিনা ওকে অগ্রাহ্য করে চলে গেছে । ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরায় ছায়া পড়ে অন্ধকারের । অন্ধকার বড় ভালো লাগে । জৈবিক অনুভূতিগুলো জেগে ওঠে অন্ধকারেই; পাপসত্ত্বারা মুখ লুকায় সায়াহ্নের আঁচলে । রণ আধা অন্ধকার সঞ্চয় করে বেরিয়ে পড়ে ।
হেঁটে চলে সে কানাগলির সংকীর্ণ পথ ধরে । ইউরিনের ঝাঁঝালো গন্ধে ভারি হয়ে থাকে এখানকার বাতাস । ভাগাড়গুলো পরিণত হয়েছে কুকুরের আবাসস্থলে । রাজ্যের কাক এসে জুড়ে দেয় তাদের কর্কশ কলহপনা । আবর্জনা সরালে একটা ম্যানহোল দেখতে পায় সে । ম্যানহোলের ঢাকনা সরালে ভেতরে টানেল । সাবধানে নেমে যায় রণ ।
*
নিশ্ছিদ্র, নিঃস্পৃহ অন্ধকার না ফুরালে আমরা অপদার্থরা নির্নিমেষ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকি । অন্ধকারে একফালি তরল জ্যোৎস্নাকে জ্বালানি করে আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি তাড়না করি । দীর্ঘ রাত্রি অজগরের মত পেঁচিয়ে ধরে শহরটাকে, গিলতে থাকে আমাদের ছায়াসর্বস্য ।ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে আমাদের স্বপ্ন তৈরীর কারখানায় । স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা আর হাঁক দিয়ে বলেনা, স্বপ্ন কিনবেন স্বপ্ন? লাল নীল সবুজ স্বপ্ন, রঙ্গিন স্বপ্ন । আঁধারের রংধনু ক্রমশ শুষে নেয় আমাদের সোনালী দিন, দাম্পত্য জীবনের চিত্রকর্ম, প্রিয়তমার ঠোঁটের লিপিস্টিক, গ্লাসের তলানিতে জমে থাকা লাল তরল । এভাবেই তারা দূরীভূত করে তাদের রঙ সম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা, রঞ্জিত করে ফিকে হয়ে যাওয়া সাময়িক বাস্তুসমূহ ।
বিবর্ণ হয়ে যায় সব; বাক্যসীমার চারপাশে পরিভ্রমণ করে শুধু মিইয়ে যাওয়া শব্দসমূহ, প্রস্ফুটিত হয় সাদাকালো অন্য এক জগৎ, অন্য রূপে ।
তারপর আবার ঝলমলে রঙিন এক পৃথিবী । যেন সাইকো কোন আর্টিস্ট সবটুকু রঙ ঢেলে দিচ্ছে তার নিখুঁত শিল্পকর্মে । তারপর আমরা হারিয়ে যাই ওদের বিকৃত স্বর্গে; যেখানে যা ইচ্ছা তাই করা যায় । খুন-দর্শন-ধর্ষণ থেকে শুরু করে রাজনীতি-রাহাজানি, সাম্য-মৌলীবাদি সব । তবে ক্রিয়েটিভদের জন্য এটা ইলিজিয়াম; যেখানে নিজেই ক্রিয়েচার আবার নিজেই গড ! ভাঙ্গা গড়ার খেলা যে যত খুশি ইচ্ছেমত খেলতে পারে । এখানে এই অন্ধকূপে কোনদিন সূর্যোদয় হয়না, কিন্তু সূর্যমুখী ফুল ফুটে ।
২
লিনা তুমি আমাকে খারাপ ভাবতে পারো কারণ আমিই সবার চেয়ে ভালো । আজ আমি একটা খুন করেছি ! তীব্র অনুভূতির পুরো জগতটাকে ধ্বংস করার বদলে এর একটা সিস্টেমকে ধ্বংস করাটা অপেক্ষাকৃত ভালো নয় ? কম ভায়োলেন্সপূর্ণ । কিন্তু তুমি তো নিজেকে বেশ ইনোসেন্ট ভাবো
তাই না?
বেশ ।।
তবে প্রতি মুহূর্তে হাজারটা খুন করছ তুমিই । তোমার নিষ্পাপ চাহনি দ্বারা, তোমার সতীত্বের সূচালো শর দ্বারা; দুর্দমনীয় নিমজ্জিত স্বত্বাটাকে লাগাম পরানো ছাড়া আর কিই বা করতে পারো তুমি? তোমার অমানবিক হিংস্র জিঘাংসায় প্রতিদিন খুন হচ্ছে ভেতরকার অনুভূতিগুলো, অনুভূতির অণুজীবগুলো । তাদের জাগতিক পারিপার্শ্বিক ভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ছে । তোমার সৃষ্ট প্লাবনে প্রতিনিয়ত ভেসে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, বাঁচার আশা । প্রতিদিন জেগে ওঠা তীব্র ইচ্ছাটাকে অনিচ্ছার সাথে গলা টিপে ধরছ তুমি । কি দরকার বাপু? ওরাও তো সৃষ্টি । তোমার সৃষ্টি ……..
এই নাও একবার টেস্ট করে দেখো । সিরিঞ্জ রাখা আছে টেবিলেই ।
হে হে! আমি জানতাম তুমি কৌতূহলী হবেই । এটা N-60c, এখানে আছে ৮০ মিলি ।
হ্যাঁ, ড্রাগস বলা যেতে পারে তবে ক্ষেত্রবিশেষে । ক্ষেত্রবিশেষটা হচ্ছে রাত্রে । এখন নিলেও অসুবিধে নাই; এর প্রভাব শুরু হবে রাত্রে ।
ঠিক আছে অপেক্ষায় রইলাম । অন্যরকম এক অনুভূতি ।
৩
এই নিয়ে তুমি এটা তিন ডোজ নিয়ে ফেলেছ লিনা । তুমি জাননা কতটা হাই ইনফ্লুয়েন্সিভ এই ড্রাগস । তিন ডোজের বেশি নিলে তোমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করবে, সাবকনশাস মাইন্ডের ডিফেন্সগুলো ভেঙ্গে পড়বে ।
কি? তোমার আর স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা নেই? বলেছিলাম না তুমি সেটা কন্ট্রোল করতে পারবে না ।
আলফ্রেডটা কে আবার? আমি তো রণ ।
মাই গশ!! লিনা তুমি আমাকে চিনতে পারছনা ?
তুমিই তো লিনা । কি বলছ এসব তুমি ফারিয়া হতে যাবে কেন?
*
বাক্যালাপ চলতে থাকে । দূর থেকে আমরা দেখতে পাই সেখানে ফারিয়া ছাড়া আর কেউই নেই !! আমরা তাকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকি আর সন্তর্পণে তার অবসেশন কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করি ।
আমি তিন ডোজ নেওয়ার পরও আমার কিছুই হলো না । কেন?
কারণ আমার অবচেতন মনের কোণে কোন তীব্রতা নেই । পাপবিদ্ধ অনুভূতিগুলো তখনই মরে গেছে যখন থেকে নিজেকে আত্নবিসর্জন দিতে শিখেছি । আমার ধ্যান ধারণা তোমাদের আর দশজনের মত নয় ।
ধিক! তোমাদের এই সাইকো বিকৃত মানসিক স্বত্বাকে ।
আমিও বলতে পারি প্রতিনিয়ত তুমিই ধ্বংস করে চলেছ তোমার ভালো মানসিকতাকে । তোমাকে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে । নইলে তুমি পারবে না । পাপবিহব্বল কীটগুলো ঠিকই অন্ধকারের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে বের করে ফেলবে তোমাকে ।
#
তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে সৃজনশীলতা । তোমরা প্রত্যেকই একেকজন ঈশ্বর । কিন্তু তোমরা কেউই সেটা উপলব্দি করতে পারনা, বুঝতেও চাওনা । তোমাদের অবচেতন মন প্রতিনিয়ত ভেজে যায় অস্তিত্বের আবহসঙ্গীত । তোমাদের নিউরনে প্রতিনিয়ত নতুন ভাবনা অনুরণিত হয় । সৌন্দর্যের রঙিন কাঠামোগুলো তোমাদের নার্ভে টোকা মারে, সুর সৃষ্টি করে; তোমরা শুনতে চাওনা বলে পারনা ।
আমরা তোমাদের সাহায্য করবো । তোমরা নিজেরাও জাননা তোমাদের মনের অতল গহ্বরে মহাবিশ্ব লুকিয়ে আছে । সে মহাবিশ্বে তোমরা মহাশিল্পী । তোমাদের ক্যানভাস হবে মেঘমুক্ত সীমাহীন গগন কিংবা গগন ছোঁয়া দিগন্ত । তোমাদের ভেতর আমি জন্ম দেবো এক পরাক্রমশালী মহাসত্ত্বার । তারপর তোমরা জাগ্রত করো তোমাদের তীব্র এবং সুপ্ত আবেগগুলো, সেগুলো দিয়ে দ্রবীভূত কর নিজেদের দাম্ভিক আচার্যকে । দেখো স্বসৃষ্ট জগতকে এবং অনুভব কর নিজের অস্তিত্বকে, সে ই ঈশ্বর ।
৪
না ফারিয়া । আমাকে থেকে যেতে হবে । অন্ধকার না থাকলে আলো আসবে কোত্থেকে । সেই আলো যোগাতে হবে না ?
সবার ভেতরই অল্পবিস্তর ভালো খারাপ সবই থাকে । কেউই পুরোপুরি ইনোসেন্ট নয় আবার কেউই পুরোপুরি খারাপ নয় । শুধু মাত্রাগুলো একেকজনের একেকভাবে থাকে; কারও বেশি কারও কম । এই দুইয়ের মিশেলেই আমরা মানুষ । নইলে আমরা হতাম এঞ্জেল না হয় ডেমন । আলফ্রেড বলতে থাকে ।
তোমাকে আমার লিনা বলে ডাকতেই ইচ্ছা করছে ।
- কি আশ্চর্য ! আমারো তোমাকে রণ বলে ডাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য লাগছে । বেশ, আমরা পরস্পরকে তা’ই বলেই সম্বোধন করি কিছুক্ষণ ।
কিছুক্ষণ মানে তুমি কি চলে যাবে নাকি?
-হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে । ঐ দেখো অনুভূতিরা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে ।
রণ ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলে, তাইতো দেখছি । ঘৃণ্য কীটগুলো ক্রমেই কাছে আসছে ।
-কি বলো ? আমি তো দেখছি রঙিন প্রজাপতি । লিনা অবাক হয় ।
তা নাকি? প্লীজ আমাকে রেখে চলে যেওনা লিনা । প্লীজ ।
-কি যে বল । যেতে তো আমাকে হবেই । এবং এখনই । তোমার সাথে সব সম্পর্কের এখানেই ইতি ।
না । আমার কাছ থেকে তুমি কখনই পালাতে পারবে না লিনা । প্রতিটি পদে আমি তোমাকে অনুসরণ করবো, অনুপ্রেরণা যোগাবো । প্লীজ যেওনা এখনই ………….,
ধড়াম করে সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দে রণ বুঝে যায় লিনা ওকে অগ্রাহ্য করে চলে গেছে । ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরায় ছায়া পড়ে অন্ধকারের । অন্ধকার বড় ভালো লাগে । জৈবিক অনুভূতিগুলো জেগে ওঠে অন্ধকারেই; পাপসত্ত্বারা মুখ লুকায় সায়াহ্নের আঁচলে । রণ আধা অন্ধকারকে সঞ্চয় করে বেরিয়ে পড়ে । পেছনে অন্ধকার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা দাপিয়ে আসছে ।
রণ দৌড়ে গিয়ে ম্যানহোলে ঢুকে পড়ে । সেখানে N-60c এর অনেকগুলো প্রতিষেধক লুকায়িত আছে । একটি নিয়ে ইঞ্জেক্ট করতে গেলে তার আগেই অন্ধকার গ্রাস করে ফেলে তাকে ।
ধীরে ধীরে রণ দেখতে পায় সবকিছু ফিকে হয়ে আসছে । অবশেষে সবকিছু পুরোপুরি সাদাকালো হয়ে গেলে নিজের সৃষ্ট রং দ্বারা সব আবার রাঙাতে থাকে সে । নতুন করে ।
ঠিক এই মুহূর্তে দু জন হেঁটে বেড়াচ্ছে একই রাস্তা ধরে একই পদক্ষেপে । হতে পারে দু জন দু জগতের বাসিন্দা, একজনের আছে রাত আরেকজনের দিন । বহুদিন থেকে তারা এভাবে হেঁটে চলছে বহু পথ অতিক্রম করে । সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত ।
****************
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৩০