বহু..বহু...বছর পরের কোন এক দিন...(প্রথম খন্ড)
৩-১ এ এসে আমি হলে সিট পাই। তা বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে এজন্যে। সবার ক্ষেত্রে ঝামেলা না হলেও আমার ক্ষেত্রেই...! প্রভোস্ট স্যারের নানা প্রশ্ন। কোনভাবেই সিট দেবেন না। অগত্যা বলতে হল “আব্বা রিটায়ার করেছেন...চাচার বাসায় থাকতাম...চাচাও রিটায়ার করেছেন...দেশের বাড়ী চলে যাবেন...ঢাকায় থাকার জায়গা নেই... ” ইত্যাদি। যতটা সম্ভব করুণভাবে আমি আমার কল্পিত অবস্থা বর্ণনা করলাম। স্যারের মন গললো। কিন্তু ...“তুমি তোমার বাবার রিটায়ারমেন্টের একটা অফিসিয়াল পেপার অফিসে জমা দেবে...”!!! কয় কি ? আমার বাপের রিটায়ার করতে আরও ৩ বছর বাকী...কাগজ পামু কই ? বাপেরে গিয়া কি কমু ...? আমার তো মাথায় বাড়ি। যাই হোক, আব্বুর অফিসের একটা লোগো বানিয়ে, বুয়েটের নোটিস বোর্ডের অফিসিয়াল নোটিসের মতো করে সুন্দর একটা পেপার তৈরী করলাম...তো সিট পেলাম। বন্ধুরা (!) সবাই জেনে গেল। আমার নাম দিল “জালিয়াত নিরুপম”। সেই থেকে আমাকে দেখা মাত্রই “কি জলিয়াত...কয়জনরে (সেন্সরড) করলা ?” তো হলে যে খুব পড়াশোনা হতো তা কিন্তু নয়। নতুন নতুন সিনেমা দেখা, চোথা জোগাড়, ফিস্ট খাওয়া আর ল্যান কানেকশানের কল্যাণে নিজের “ব্যক্তিগত সংগ্রহ” সমৃদ্ধ করা - এই ছিল কাজ। এই টার্মে সেশনালে আমার একাকীত্ব বেশ খানিকটা কেটে যায়। আসে মনন। সেশনালে স্যারের লেকচারের সময় ওর কাজ হচ্ছে দাঁড়িয়ে ঘুমানো। “কি যে কয়...কিছুই তো বুঝিনা...আমরা পাশ কইরা যে কি করুম...ক্লাশ কইরা খালি খালি সময় নষ্ট”-এটা ছিল ওর কথা। সেশনালে ওর সাথে গল্প করে সময় ভালোই কেটে যাচ্ছিল। এই টার্মের শেষে ছিল আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ট্যুর। সে আসলেই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা ! দল বেঁধে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো আর খাওয়া। আর রাস্তার মাঝে স্পিড ব্রেকার দেখলেই সমস্বরে “উ...উ...উ...ই...ই..ই..ই..ই..”। বুয়েটের ছেলেদের যে কারণেই হোক খানাপিনার প্রতি একটা বিশেষ দূর্বলতা থাকে। ইন্ড্রাস্ট্রিতে মেশিনপাতি দেখার চাইতে কখন দুপুরের খাবারের সময় হবে, খাবার কি বুয়েট থেকে আসবে নাকি ওরাই দেবে, দিলে কেমন দেবে...এসব বিষয় নিয়েই আমাদের বেশী গবেষনা হত। তবে ঝাক্কাস খাওয়া হয়েছিল তালহা স্পিনিং মিল-এ। একেবারে জামাই আদর। আমাদের সবারই হয়তো তা মনে থাকবে।
৩-২ আর ৩-১ আমাদের কেটেছে সেশনালের মাঝে। বরাবরের মত এবারও আমি আর মনন দর্শক। মাঝে মাঝে গ্রাফ, ডাটা শিট ফটোকপি করার কাজ করতে দেয়া হত। আমরা মহানন্দে সেগুলো করতাম এবং আজও করি। আর একটা কাজ করতাম, সেটা হল রাব্বি বা জাকারিয়ার রিপোর্ট কপি করা। এই টার্মে আমাদের সাথে ছিল মেহেদী। ওর ফিগার, এ্যাটিচুড আর সিনেমেটিক লুক আজও আমাকে মুগ্ধ করে ! আমি কোন মেয়ে হলে অবশ্যই ওর সাথে লাইন মারার চেষ্টা করতাম (ওই...কেউ উল্টাপাল্টা কিছু ভাবিস না কইলাম)। এই টার্মে ও ৩-১ এর প্রায় সবগুলো সেশনালে ভাইভা ছিল। আর প্রতিবার আমার ভাইভা দিতে হত ডায়নার সাথে। বলতে দ্বিধা নেই, ওকে আমি বেশ ভয়-ই পাই। তা প্রতিবার ওর সাথে ভাইভা দেয়া ছিল আমার জন্য এক দুঃস্বপ্ন। আমাকে কোন প্রশ্ন করা হলে আমি খুব কনফেডিন্টলি একটা ভুল উত্তর দিতাম। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করা হতো “তুমি কি ওর সাথে একমত ?” ও যথারীতি “না” বলে তার ব্যাখ্যা শুরু করতো। উফ্ফ ! কি যে বিব্রতকর অবস্থা ! তবে এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করতেই হবে। এই টার্মে আমাদের মেশিন টুলস সেশনালের বোর্ড ভাইভার ঘটনা এটি। ধর স্যার আর কয়েকজন ছিলেন বোর্ডে। প্রথমেই আমাদের প্রতি তার প্রশ্ন “এস.এম.এস-এ তো সব কোশ্চেন পেয়ে গেছো”। আমাদের আগে যারা ভাইভা দিয়েছিল তারা বের হয়ে আমাদের কয়েকজনের কাছে এস.এম.এস. করে প্রশ্নগুলি পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্যার কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছেন। “কি কি কোশ্চেন পেয়েছো বল? আজ এটাই তোমাদের ভাইভা।” স্যার আমার দিকে তাকালেন। "কোশ্চেন ? এস.এম.এস. ?” আমি এমন একটা ভাব দেখালাম যেন এই শব্দ আমি জীবনে প্রথম শুনছি। “জ্বী না স্যার, আমরা কোন এস.এম.এস পাই নি”, রাব্বি স্বাভাবিকভাবে বলল। ডায়নার দিকে তাকিয়ে “কি তুমিও পাওনি ?” ডায়না একটু সেফ সাইডে থেকে বলল “অনেকেই পেয়েছে”। আর এটাই ওর কাল হল। "কে কে পেয়েছে বল ?” স্যার ব্যাঙ্গাতœকভাবে হুংকার দিলেন "কে এস.এম.এস. পাঠিয়েছে, সবাইকে আজ ফেল করাবো”। আমি আর রাব্বি নির্বিকারভাবে বসে আছি যেন কিছুই হয়নি। “না বললে তোমাকে ফেল কারাবো, কি বিশ্বাস হচ্ছে না ? এই দেখো তোমার নামের পাশে ক্রস দিলাম”, স্যার এটেনডেন্স খাতা দেখালেন। “স্যার, আপনি চাইলে আমাকে ফেল করাতে পারেন, কিন্তু আমার পক্ষে নাম বলা সম্ভব না, আমি নাম বলবো না” খুব দৃঢ়ভাবে বলল ডায়না- “স্যার আপনি সবার মোবাইল চেক করতে পারেন বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন”। স্যার বললেন "তোমার আর ভাইভা হবে না, তুমি ফেল, তুমি যাও।” ডায়নার উঠে যাবার উপক্রম। তখন স্যার নরম হলেন। ওকে বসালেন। আমাদের কিছু নীতিবাক্য শোনালেন। শুরু হলো ভাইভা। “সবগুলা এক্সপেরিমেন্টের নাম কও - আমি বলতে শুরু করলাম। “ওই মিয়া, কোন সিরিয়াল নাই...? ইচ্ছামত কইতাসো ?.....”- আমার গতানুগতিক ভাইভা আর স্যারের গতানুগতিক বিরক্তি। ডায়নার মাঝে সেদিন যে সততা ও দৃঢ়তা আমরা দেখেছিলাম সেটা আমার আজীবন মনে থাকবে। আমাদের সেশনাল ক্লাসের জটিল সব ক্যালকুলেশনের অধিকাংশই ডায়না করে। নিজ থেকেই করে। ওকে আমি ভয় পাই ঠিকই কিন্তু শ্রদ্ধাও করি। বুয়েটে হাঁটা চলার পথে বা ক্লাসরুমে আমি পারত পক্ষে ওর মুখোমুখি হই না। ওকে দেখলেই উল্টো দিকে হাঁটা দেই। এই ভয়ে, কখন কি প্রশ্ন করে বসে, আর যথারীতি আমিও তার ভুল উত্তর....। এই টার্মে আমাদের ফ্লুয়িড মেকানিক্স নিতেন ডি.কে.ডি. স্যার। তো, ক্লাসে একবার রাব্বিকে বোর্ডের দিকে দেখিয়ে একটি ইকোয়েশন বলতে বললেন। সেখানে রব্বি নিউ(ν) কে পড়লো ভি (V)। এই শুনে স্যার তো থ ! আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেন। সবারই প্রায় একই অবস্থা। স্যার তো রাগে কাঁপতে লাগলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পর স্যার জীবনে প্রথমবারের মত স্ট্রোক করলেন ! শুনে আমরা হাসবো না কাঁদবো তা বুঝতে পারলাম না । এই টার্মের শেষে ছিল আমাদের ইন্ডাস্ট্রিায়াল ট্রেনিং। আমাদের চারজনের গ্র“পে ছিল আনোয়ার, মনন আর আনিস। আমরা বেছে নিলাম হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড। সিমেন্ট প্রসেসিং প্লান্ট। উদ্দেশ্য একটাই - ঢাকায় থাকা...কারণ টিউশনি। প্লান্টে প্রবেেশর মুখেই বেশ বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “বাবা ! ভালোভাবে ফিরে এসো”...আমরা একটু থতমত খেয়ে গেলাম, জান নিয়া ফেরত যাইতে পারুম তো ? আমরা ছিলাম চরম ফাঁকিবাজ। যদি ওরা বলতো..."দেখো, আজ তো আমরা একটু ব্যস্ত, তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে একটু দেরী হবে...”- সংগে সংগে আমরা “না না ঠিক আছে... আপনাদের অসুবিধা থাকলে আজ বরং আমরা যাই...আপনাদের ব্যস্ততা কমলে তখন না হয়...”। মনন সেখানে গিয়ে “ডিসেপশান পয়েন্ট” বা “দ্য ভিঞ্চি কোড” পড়তো আর চলতো আড্ডা। এভাবে প্রতিদিনই (ছয় দিন নয়, সর্বোচ্চ ৩ দিন !) ৯ টায় গিয়ে “ট্রেনিং শেষ করে” ১২ টায় আমরা বাসায় ফেরত আসতাম। যদিও আনোয়ার আর ইন্টারনেটের কল্যাণে জটিল একটি রিপোর্ট আর প্রেজেন্টেশন দিয়ে আমরা চারজনই বেশ ভালোভাবে উৎরে গিয়েছিলাম। প্রতিদিনই সোনার গাঁ -এর পাশ দিয়ে প্লান্টে যেতে হতো। তাই ভাবলাম একদিন যাদুঘরে যাবো। গেলাম। সেদিন ছিল বুধবার। গিয়ে দেখি যাদুঘর তালাবদ্ধ। বুধবার নাকি সাপ্তাহিক ছুটি !
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:১২