[এই লেখাটি লেখা হয় ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারীতে। আমাদের শেষ বর্ষের শেষ টার্মে আমরা একটি ইয়ারবুক বের করার উদ্যোগ নেই এবং আমি তাতে এই লেখাটি জমা দেই। লেখাটি অনেক বড়, তাই অল্প অল্প করে দেব। তবে তা নির্ভর করে আপনাদের আগ্রহের উপর]
=============================================
এ লেখাটি আজ বা কাল পড়ার জন্য নয়। বহু...বহু...বছর পরের কোন এক দিন...যেদিন পুরানো আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ এই ম্যাগাজিনটি বের হয়ে আসবে তার জীর্ণ, মলিন হয়ে যাওয়া পাতায় কিছু তরুনের স্মৃতিমাখা দিন নিয়ে...পেয়ে বসবে এক নস্টালজিয়ায়...সেদিন...
সে অনেককাল আগের কথা...১৩ এপ্রিল ২০০২। নটরডেমিয়ান থেকে বুয়েটিয়ান। বুয়েট’র সীল পিঠে লাগিয়ে বেশ ভাবে আছি। জেনারেল মটরস, ফোর্ড, নাসা-তে নাকি আমাদের বুয়েটের মেকানিক্যালের অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছে (ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের এইসব ভুং ভাং নিশ্চই সবার মনে আছে)। আমিও নিজের অজান্তেই নিজেকে তাঁদের একজন ভাবতে শুরু করলাম ! অস্বীকার করবো না...সে সময় একজনের সাথে কিঞ্চিৎ ভাব জমাবার ইচ্ছা ছিল...। পরে ১-১ এর রেজাল্টের পর যখন দেখলাম আমি ৩.২ আর সে ৩.৯ এর ঘরে, তখন ...। যাই হোক। সে ইলেকট্রিক্যালের একজনকে নিয়ে ৩ বছর বেশ মুডেই ছিল। কিন্তু এখন দু’জনেই ...একা একা বিষন্ন ভঙ্গিতে এদিক সেদিক ঘুরে বেরায়। ১-১ এর সেশনালে পরিচয় হয় সবজান্তা রাব্বির সাথে। যে কিনা মেশিন দেখেই বলে দিতে পারে কোনটার কি কাজ। কোনটার কি সুবিধা-অসুবিধা। ওর বাসায় সম্ভবত বয়লার ছাড়া সবই আছে ! আর একজন যে তার লোমশ দেহ ঝঁকিয়ে সবাইকে যার যার নাম, কলেজ বলতে বলেছিল...সে ছিল জাকারিয়া(পশমী)। জাকারিয়া সবসময়ই একটু ফরমালিটিস মেইনটেইন করে চলার চেষ্টা করে আমাদের বিরক্তি আর হাসির খোরাক হয় (দোস্ত, মাইন্ড করিস না, তুই আসলে খুব ভালো বোকা ছেলে)। আর ছিল তাপস ও রোমান। রোমান লেভেল ২ তে আমেরিকায় চলে যায়, আর তাপস অসুস্থতার জন্যে টার্ম ড্রপ দিয়ে আমাদের এক ব্যাচ নিচে আছে। সেশনালের যাবতীয় ক্যালকুলেশান, ডাটা কালেকশান- সবই করতো রাব্বি, জাকারিয়া আর ডায়না (যার কথা আগেই বলা হয়েছে)। আমি তখন থেকে আজ অব্দি সেশনালের দর্শক ও ক্ষেত্র বিশেষে মালপত্র বহনকারী। যদিওবা ভুলক্রমে বা নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাকে কোন কাজ দেয়া হয়...ওদের থাকে তীক্ষ্ণ নজরদারী। ওদের শত ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে বেশ অপ্রয়োজনীয় মনে হয়।
১-২ ভালোই কাটলো। আমি টিউশনি শুরু করি বুয়েটে ক্লাস শুরুর একমাস আগে থেকে অর্থ্যাৎ মার্চ থেকে। আমার প্রথম ছাত্র ছিল ক্লাস ফাইভের। তার শীর্ণাকার দেহ আর আমার কোমর সমান উচ্চতা দেখে বেশ মায়াই হল। আহা বেচারা, এই বয়সেই কত চাপ ! প্রথম দিন আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম “পড়াশোনা আসলে খুব সহজ, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই”। উল্টো উত্তরে সে বলল “স্যার, বেসিক কনসেপ্ট ক্লিয়ার থাকলে আসলে কোন সমস্যাই নেই”- ক্লাস ফাইভের বাচ্চার মুখে এই কথা শুনে আমি তো থ ! ওর আব্বা ওকে বললেন “জানো, তোমার স্যার কোথায় পড়েন ? পারবে তাঁর মত হতে ?” আমি যারপরনাই মুগ্ধ ! আর কিছু না পাই, বুয়েটের সীল দিয়ে এই সম্মানটুকুতো পাওয়া গেল। এটাই বা কম কিসে ? যাই হোক, বেশ কতগুলো টিউশনী করিয়ে মাসে হাজার দশেক আসতো। টার্ম লোডও কম ছিল। আমিও টিউশনীতে আমার আন্তরিকতার চুড়ান্ত দেখালাম। ২-১ এ ওঠার পরও সে ধারা অব্যহত রইলো। কিন্তু এবার ছিল...৪ টা ৪ ক্রেডিট। ফলাফল যা হবার তাই। দুটো ৪ ক্রেডিটে ল্যাগ ! যা আজও আমার পিছু ছাড়েনি।
২-২ তে আমার বেশ ভালোভাবে পরিচয় হয় মাহবুবের সাথে। পুরো টার্ম ওর সাথে ফাইট দেই। ওকে একটু পাগলাটে স্বভাবের বলে মনে হতে পারে। পড়াশোনার ব্যপারে ওর বক্তব্য হচ্ছে “বই পড়ে কিছু শেখা যায় না, কি হবে এসব পড়ে ? ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের কাজটা আসলে কি ? আমরা আসলে কি করবো ? আমাদের এগুলো কেন শেখানো হচ্ছে ?”... ইত্যাদি। ওর একটি অসাধারণ গুণ হচ্ছে, ও প্রায় যেকোন সমস্যারই ম্যাথমেটিক্যাল মডেল তৈরী করতে পারে। হোক সেটা কোন দৈনন্দিন নাগরিক সমস্যা কিংবা উচ্চমার্গীয় ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা। একটা সাবজেক্ট ভালো লাগলে সেটা পড়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। যা ওর ভালো লাগে না তা সে কখনই পড়ে না। আর ফলাফল, এক টার্ম ড্রপ। তবে একথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করবো, আমার জীবনে দেখা সেরা মানুষ ও মেধাবীদের মাঝে সে একজন। এখনও সে ক্যাম্পাসে একা একা তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় ! কিছুদিন আগে ওর সাথে ক্যাম্পাসে দেখা। চিন্তিত মনে হল। “কি ব্যপার ?” জানতে চাইলে বলল “একটা সমস্যা হয়েছে...আমার মোবাইলটা টয়লেটে পড়ে গিয়েছে...কি করি ?” পরক্ষণেই “ভালোই হয়েছে...মোবাইল আসলে একটা পেইন !”
=======================================(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:২৯