somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাগরবক্ষে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়

২৩ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৪:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিদেশে কর্মী পাঠাতে হলে গমনেচ্ছুদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে; তারপরই কেবল তাদের বিদেশে পাঠাতে হবে। এ দায়িত্ব দেশের সরকারের। কেবল অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে যাকে-তাকে যেন-তেন প্রকারে বিমানে তুলে দিলেই সরকারের দায়িত্ব পালন হয় না। অর্থলিপ্সু কতিপয় দালাল যখন এমনতরো কাজ করে, তাদের দমন করা সরকারেরই দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে অভিবাসীদের অবদান সবচেয়ে বেশী এবং তাদের রেমিটেন্সের ওপর ভরসা করেই মধ্যআয়ের দেশ হবার স্বপ্ন দেখছে সরকার।
অথচ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে বাংলাদেশী দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বাজার বন্ধ রয়েছে। ফলে একটু ভাল থাকার আশায়, বেশী আয়ের লক্ষ্য দিয়ে দেশের নিরিহ মানুষগুলো আদম পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। কেউবা মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু বিক্রি করে অধিক আয়ের লক্ষ্যে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে- অজানা গন্তব্যে। এদের অনেকেই হয়তো আর ফিরে আসে না মাতৃভূমিতে। পথিমধ্যেই দালালদের চাপে অনেকেই সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসছে।
বিষয়টি নতুন নয়, বহুদিন ধরে চলে আসছে। তবে স¤প্রতি বিষয়টি এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, বিশ্ব বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। হাজার হাজার বাঙালী ও রোহিঙ্গা অভিবাসী মালাক্কা প্রণালী ও আন্দামান সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে দুই মাস ধরে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কোনো দেশই তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অনুরোধও তারা গ্রাহ্য করছে না; এমনকি জাতিসংঘের অনুরোধও তারা রাখছে না। এসব অসহায় মানুষদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মালয়েশিয়ার বিরোধী দলও সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে- কে শোনে কার কথা। ১৪ মে মালয়েশিয়া ৮ শতাধিক বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসী বোঝাই দুটি নৌকি ফিরিয়ে দিয়েছে। খাদ্যের অভাব, পানির অভাব সাগরে ভাসমান অনেকেই নিজের মূত্রপান করতে বাধ্য হচ্ছে। কোথায় মানবতা, কোথায় মানুষের অধিকার, কোথায় ধর্ম, কোথায় গণতন্ত্র আর কোথায় মানুষের জন্য রাজনীতি? যদিও মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে সামান্য খাবার ফেলছে সমুদ্রের পানিতে, তা একদিকে যেমন পর্যাপ্ত নয় অন্য দিকে সাগরে পরে যাওয়া খাবার সাঁতরে আনতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে অনেকে।
এসব অসহায় অভিবাসী বহনকারী নৌযানগুলো সাগরে ফিরিয়ে দেয়া বন্ধে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তিনটি দেশই লোক দেখানো খাবার সরবরাহ ও নৌকাগুলোর ইঞ্জিন মেরামত করে দিয়ে ফের সমুদ্রে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে বাধ্য।
মালয়েশিয়া বলছে, লংকাবি দ্বীপে প্রায় দেড় হাজার অবৈধ অভিবাসী উদ্ধারের পর পেনাংয়ের উত্তরাঞ্চলনীয় উপক‚লে পাঁচশত অভিবাসী বহনকারী একটি বোট পাওয়া যায়। আমরা কি করতে পারি? যাঁরা আমাদের সীমান্ত ভেঙে ঢুকতে চাইছে তাদের সঙ্গে আমরা এখনো ভালো আচরণ করছি, এখনো তাদের সঙ্গে মানবতাবোধ দেখিয়ে আসছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এভাবে অবৈধ অভিবাসীর ঢল সামলাতে হবে। কথাটা সত্য; তবে এখন প্রয়োজন এই অসহায় মানুষগুলোকে নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো- তাদের উদ্ধার করা। এখানে রাজনীতি করা উচিত নয়। আগামীতে এ ধরনের অবৈধ অভিবাসন যাতে না ঘটে সে চেষ্টা করা, আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা।
মানব পাচারকারীরা গ্রেপ্তার এড়াতে বহু আগেই নৌকা ছেড়ে চলে গেছে; ফলে নাবিকবিহীন অবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক নৌকা। কোনো কোন নৌকা দুই মাস বা তারওবেশী সময় ধরে ধরে সাগরে ভাসছে। রাজনীতিকরা, কোথায় বিশ্ব মানবতা? আমরা অস্ত্র কেনার জন্য, অস্ত্র উৎপাদন করার জন্য কত লাখ লাখ ডলার ব্যয় করি অথচ অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছুই কি করতে পারি না?
সাগরে ভাসমান এ অমানবিক ঘটনার গোড়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে, অধূনা মায়ানমার, যেটি আগে বার্মা বা বর্মা নামে পরিচিত ছিল, সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের, যারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত এবং ভেশীরভাগই সাবেক আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা। ধর্মে তার মুসলমান এবং তাদের ভাষার সাথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার কিছুটা মিল রয়েছে। মায়ানমার বরাবর বলে আসছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক, তাই রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিকত্ব নেই। বিগত শতকের আশির দশকেই তখনকার বার্মা থেকে রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়; সেই থেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা- আন্তর্জাতিক শরনার্থীর মর্যাদায়। হিসেবের বাইরে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে তা বলা মুষ্কিল। বৈধ বা অবৈধভাবে বসবাসরত এ সকল রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য এক বড় বোঝা এবং তাদের উপস্থিতি এদেশের সংষ্কৃতিতে বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মাদক পাচার থেকে শুরু করে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে আছে রোহিঙ্গারা, এমন অভিযোগ রয়েছে। শরনার্থ হিসেবে যে সব রোহিঙ্গা এদেশে রয়েছে, তাদের জন্মহার কম নয়- তাই রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত।
ধারণা করে যেতে পারে, এসব রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে দেশী ও বিদেশী অপরাধী চক্র কিছুটা উন্নত জীবনের আশা জাগিয়ে স্বল্প টাকায় নিরিহ মানুষদের বিদেশে যেতে উদ্বুদ্ধ করছে। নিঃসন্দেহে এমন কর্মে যারা যুক্ত তাদের রয়েছে শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোশক। সেই সাথে প্রশাসনের কিছু অসাধু লোকজন জড়িত না থাকলে ক্রমাগত মানব পাচার চলতে পারে না। কেননা, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে নদীপথে এসব পাচার হচ্ছে, যেখানে রয়েছে আধা-সামরিক বাহিনী বর্ডারগার্ড ও কোষ্টগার্ডের মত নিয়মিত বাহিনীর নিয়মিত টহল। রয়েছে পুলিশ প্রশাসন। যে কোন সাধারণ জ্ঞানের অধিকারীই বুঝতে পারবেন, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছাড়া এত বড়মাপের অপরাধ সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
সবশেষ খবরে প্রকাশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সাময়িকভাবে সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের আশ্রয় দেবে এটা অবশ্যই স্বস্তির সংবাদ। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয় হওয়ার ইঙ্গি দিয়েছে মায়ানমার, এমন সংবাদও শোন যাচ্ছে। রেহিঙ্গারা আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা, যুগ যুগ ধরে সেতায় তারা বসবাস করছে- প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে; তারা কি করে ভিনদেশী হয়? প্রশ্নটা আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আসতে হবে, মায়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য। অপ্রাসঙ্গি হলেও বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীদের বলা হয় রেড ইন্ডিয়ান; ওরা ছাড়া সকলেই তাহলে কি ভিনদেশী হবে, যারা বৃটেন বা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সেথায় বসবাস করছে? অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
বিশ্বজুড়ে চলা অভিবাসী সমস্যার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ইওরোপও এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত নয় যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা। তবে চলমান এশিয়ার এই অভিবাসী সমস্যার পেছনে মূলত মায়ানমারের একগুঁয়েমির কারণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যাই দায়ী তাতে কোন সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী বলে চালিয়ে দিতে যারা দায়ী তাদের সাথে মায়ানমারের সরকারেরও দায় রয়েছে বলে আমরা মনে করি। অপরাধী যে দেশেরই হোক না কেন, তার অপরাধীই। মায়ানমারের এই বিশাল ক্ষমতাশালী সরকারী অপরাধীদের সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের কিছু অপশক্তি- আমরা জানি না, তারা কারা। এদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের। আমরা আশা করবো, মানবসৃষ্ট ভয়াবহ এই মানবিক বিপর্যয়ের সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তাদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে। তবে শংকা থেকেই যায- অপরাধী সনাক্তের পরে রাজনৈতিক পরিচয় তাদের অব্যাহতির কারণ না হয়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগের সদস্যরা বেশ দক্ষ এবং অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তারা পার পাবে না।

সাগরবক্ষে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৪:২৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×