আমাদের মার্জনা করো, জিহাদ। আমরা তোমায় বাঁচাতে পারি নি। ডিজিটাল যুগে বসবাস করেও আমরা শেষ পর্যন্ত তোমায় উদ্ধার করলাম অ্যানালগ পদ্ধতিতে; ততক্ষণে তুমি নেই বাংলাদেশে বা বিশ্বের কোথাও- চলে গেছ না ফেরার দেশে। তোমার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে যে নাট্যাংশ অভিনীত হলো- তোমার বাবাকে, তোমার শেষ খেলার সাথীদের যেভাবে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, তাতে পুরো জাতি লজ্জিত, স্তম্ভিত এবং দুঃখিত। তোমার কাছে মার্জনা চাওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই- তবু বলবো, মিনতি করবো- জিহাদ, তুমি আমাদের মার্জনা করে দিও।
*** *** ***
ওয়াসার পরিত্যক্ত পাইপে পড়ে যাওয়া জিহাদ উদ্ধার অভিযান নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বিশেষত ফায়ার সার্ভিস যে নাটক করেছে তা দেশের সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। তাদের ২৩ ঘণ্টার নাটকীয় আচরণ নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। ‘পাইপে জিহাদ নেই’ কিংবা ‘পুরোটাই গুজব’ বলে শিশু জিহাদের বাবাকে ধরে নিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসা-বাদ, জিহাদে পাইপে পড়ে যাওয়ার সময়ে তার খেলার সাথী অবুঝ শিশুদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযানকালে একধিকবার কৌশল পরিবর্তন- একটি ‘অব্যবস্থাপনায় হত্যাকান্ড’ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
জিহাদের পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়ার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা পর্যন্ত নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। অথচ সরকারি ব্যর্থতার পর এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের চেষ্টায় উদ্ধায় হয় জিহাদ। এরাই শুক্রবার রাতে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল। তাদের বাধা দিয়েছে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
শুক্রবার সাড়ে তিনটায় ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের গর্তে পড়া যাওয়া শিশু জিহাদকে উদ্ধার অভিযানের শুর“তেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রথমে জানান, তারা শিশু জিহাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে তার জন্য পাঠানো হয় জুস। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন সে জুস পান করেছে। পরে চার দফায় দড়ি পাঠানো হয় জিহাদের জন্য। চার দফায়ই কিছুটা উঠে দড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথাও জানান। এরপর পাঠানো হয় চটের বস্তাা যাতে বস্তায় বেঁধে উঠে আসতে পারে জিহাদ। রাত দুইটায় ক্যামেরা পাঠিয়েই ফায়ার সার্ভিস নিশ্চিত করে পাইপের ভেতরে জিহাদ নেই। তাহলে ফায়ার সার্ভিসের পাঠানো জুস কে খেলো? ওই প্রচারণার স্বপক্ষে অবশ্য যুক্তি দেখিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান। তিনি বলেছেন, পাইপের ভেতরের ইকো সাউন্ডকে বাচ্চার কথা হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। পাইপের গভীরতা নিয়েও একেক সময় একেক কথা বলা হয়। প্রথমে ৩০০ ফুট বলা হলেও পরে বলা হয় ৬০০ ফুট। বোরহোল ক্যামেরাটি পাইপের ২৩৭ ফুট ভেতরে গিয়ে আর যেতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে ক্যামেরাটি আরও ভেতরে পাঠানো হলো না কেন? ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযানের পরিচালক মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেছেন, পরের লেয়ারে তারা যেতে পারেননি। ২৫ কেজি ওজনের ক্যামেরা দিয়ে লেয়ারটি ভাঙার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হন। অথচ চার বছরের শিশু জিহাদের শরীরের ওজন এর কম হওয়ার কথা। এই লেয়ারের নিচ থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে শিশু জিহাদকে। তাহলে সে কীভাবে ভেতরে চলে গেল? ক্যামেরায় পুরো পাইপের কোথাও জিহাদের পড়ার কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্যামেরার শেষ প্রারম্ভে টিকটিকি ব্যাঙ, কর্কশিট দেখা গেলেও জিহাদের পড়ার কোনো আলামত দেখেননি। ক্যামেরা শেষ প্রান্তে যাওয়ার মুহূর্তে রাত ২টার সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা চিৎকার করে উঠেছিলেন পুরোটাই ‘গুজব’ বলে। বলছিলেন, গুজবের ওপর ভিত্তি করেই অভিযান চালানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই রকম বক্তব্য রাখেন। অথচ উদ্ধার হওয়া শিশু জিহাদের শরীরে ছিলে যাওয়া দাগ পাওয়া গেছে।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবীদের নিজস্ব প্রযুক্তির ক্যাচার দিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া আবু বকর সিদ্দিকী বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলা হলেও পাইপটি মাত্র ২৪০ ফুট গভীর। তারা ২৩৬ ফুট গভীরতা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেছেন। এখানেও প্রশ্ন ওঠে তাহলে ক্যামেরাটি কতোটা ভেতরে প্রবেশ করেছিল। উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দফায় দফায় কৌশল পরিবর্তন করায় শিশুটির প্রাণ বিপন্ন হয়েছে বলে তাদের দাবি। তারা বলছেন, ক্রেন দিয়ে সাব মার্জিবল পাইপটি উঠিয়ে ফেলায় জিহাদের প্রাণ বিপন্ন হয়েছে। পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়ার পর পাইপটি ধরে রেখে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। রাতে বোরহোল ক্যামেরা পাঠানোর আগে তারা একটি সুযোগ চেয়েছিলেন কর্মকর্তাদের কাছে। ক্যামেরা ব্যবহার নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। রাত ১০টার দিকে ক্যামেরাটি ঘটনাস্থলে আনার দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পর এটি চালু করা সম্ভব হয়। ক্যামেরাটি দীর্ঘদিন আগে কেনা হলেও এটি আগে খোলাই হয়নি। শাহজাহানপুরে এনে প্রথমবারের মতো ক্যামেরাটির প্যাকেট খোলা হয়। পাইপের মুখে সেট-আপ করতে লাগে দীর্ঘ সময়। পাইপের ভেতরে প্রবেশ করার পরেও তিন চার বার কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো ছবি পাওয়া যায় নি।
এ ধরণের দুর্ঘটনা এ দেশে প্রথম। তাই বলে উদ্ধাকারী দলের কোন প্রশিক্ষণ থাকবে না, তা কি করে মেনে নেয়া যায়? ভাবতে অবাক লাগে, ফায়ার সার্ভিসের ডিজি পাইপের ভেতরে মানুষ নেই বলে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে জিহাদ উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত করেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় উদ্যোগে ওই পাইপের ভেতর থেকেই জিহাদকে উদ্ধার করা হয়। সরকারের বিশাল বাজেটে লালিত হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এমন কথা বলে কি করে? আরো অবাক করা বিষয়, জিহাদ উদ্ধার হওয়ার পরপরই ওই দায়িত্বপ্রাপ্তরাই দাবী করে বসেন, তাদের প্রচেষ্টায় জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে; কি লজ্জার কথা!! সরকারের লোকদের কি লজ্জা বা মানবিকতা বলে কিছু নেই? আগের রাতে বশির নামের এক স্বেচ্ছাসেবক যখন স্বউদ্যোগে পাইপের ভেতর নামতে চেয়েছিল কর্তাব্যক্তিরা তাকে নামার অনুমতি দেন নি। সাধারণ মানুষ মনে করছে, ফায়ার সার্ভিসের যদি এই অবস্থা তাহলে মোটা অংকে বাজেট দিয়ে তাদের লালন-পলনের দরকার কি? আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, যখনই কোন বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে, ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়- প্রয়োজনী আধুনিক যন্ত্রপাতি তাদের হাতে নেই; স্মরণ করা যেতে পারে বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকান্ড, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা। কোন ধরণের দুর্ঘটনায় কোন ধরণের যন্ত্রপাতি দরকার, তা বোছার ক্ষমতা কি কর্তাব্যক্তিদের নেই!
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো রাতভর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার কাজ সরাসরি স¤প্রচার করেছে। গভীর রাতে দেখা গেল একজন কর্তব্যক্তি বলছেন, পুরো বিষয়টাই গুজব। জানা গেল তিনি এনএসআই’র কর্তাব্যক্তি। তারমত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন কথা প্রকাশ্যে বলেন কি করে? এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না কে জানে! মনে রাখতে হবে এনএসই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত একটি গোয়েন্দা সংস্থা। একটি শিশুর গর্তে পড়ে যাওয়া নিয়ে তিনি এমন উদ্ভট কথা বলতে পারলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় তার মত মানুষরা কতখানি দায়িত্ববান হতে পারবেন, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথা আর নাই বা বললাম। দুর্ভাগ্য আমাদের- বাংলাদেশের। কোন কালেই আমরা দায়িত্ববান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পেলাম না। আমাদের ভাগ্যে জুটেছে- ‘আল্লাহর মাল আল্লাহয় নিছে’, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’, ‘বাড়িতে তালা লাগিয়ে যাবেন’ তত্ত্বের এবং ‘পিলার ঝাঁকানো তত্ত্বের’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই দায়িত্ব নিয়োজিত মন্ত্রী যদি বলেন, ‘পাইপের ভেতরে শিশু নেই, এটি বলা হয়নি। আপনারা ভুল শুনেছেন।’- তাহলে সাংবাদিক বা জনসাধারণের অবাক হওয়ার মত কিছু থাকে না! স্মরণ করা যেতে পারে শুক্রবার দিনগত রাত তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিষয়টিকে গুজব বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ওই সময় তিনি বলেন, “প্রায় ১১ ঘণ্টার চেষ্টায় ৩০০ ফুট নিচেও শিশুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা নিশ্চিত পাইপটির ভেতরে শিশুটি নেই। তবে গর্তে টিকটিকিসহ কিট পতঙ্গ আছে। এতে বোঝা যায় সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে।” ফায়ার সার্ভিসের ডিজির দুই সময়ে দু’কথা বলা বা অন্যের কৃতিত্ত ছিনতাই করায় মন খারাপ করা মত কি কিছু থাকে?
এরপরও ফায়ার সার্ভিস বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবীদের সংবর্ধনার নামে নিজেদের কৃতিত্বই প্রচার করালো, তাদের মুখ দিয়ে। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের মতো করে বিষ্ময়ের সাথে বলতে হয়, “সত্যিই বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস!”
লিংক: জিহাদ, জাতিকে মার্জনা করে দিও