একজন স্কাউট বলতেই পারে, জন্মের পর থেকে জেনে এসেছি দেশের রাষ্ট্রপতি চিফ স্কাউট; এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট কেন? প্রশ্নটা যুক্তিসঙ্গ এবং সত্যও বটে। প্রশ্নটা হলো- কোন আইনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের চিফ স্কাউট হলেন এবং এ দায়িত্ব প্রদান/গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতি সম্মানিত হলেন না কি তাঁর দফতরকে অসম্মানিত করা হলো? বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে দেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
৪৮। (১) বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।
(২) রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।
(৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যিনি দেশের “রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন” তাঁকে কোন আইন বলে বাংলাদেশ স্কাউটস এর মত একটি বেসরকারী সংগঠনের প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয়? সংবিধান বলছে “এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।” অথচ বাংলাদেশ স্কাউটস এর মত একটি বেসরকারী সংগঠন নিজস্ব ‘গঠন ও নিয়ম’ দ্বারা কি ভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বন্টন করে? বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’ দেশের কোন আইন নয়, বরং নিজস্বগঠনতন্ত্র মাত্র।
যদিও দীর্ঘ দিন ধরে এই ধারা চলে আসছে এবং সকলে প্রায় আত্মস্থ করে ফেলেছেন যে,রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে দেশের ‘চিফ স্কাউট’ হয়ে থাকেন; তবু এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে সংবিধান অনুসারে একটি বেসরকারী সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাল করাটা রাষ্ট্রপতির জন্য সম্মানজনক কি না? তাছাড়া বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’ দিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বন্টন করা যায় কি না? বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’ এর ২৬ ধারা দিকে একটু নজর দেয়া যাক:
২৬। চীফ স্কাউট
(ক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদাধিকারবলে বাংলাদেশের চীফ স্কাউট। তিনি বাংলাদেশের স্কাউট আন্দোলনের প্রেরণা ও উদ্দীপনার মূল উৎস। চীফ স্কাউট ইচ্ছা করলে এর যে কোন সভা এবং অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারবেন।
(খ) যে কোন স্থানে ও সময়ে তিনি জাতীয় কাউন্সিলের সভা ডাকতে এবং সেই সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবেন।
(গ) জাতীয় কাউন্সিলের সাধারণ সভা তিনি মূলতবী অথবা স্থগিত ঘোষনা করেত পারবেন।
(ঘ) ‘গঠন ও নিয়ম’ এর বিধি মোতাবেক স্কাউট সংগঠন সম্পর্কে তাঁর সিদ্দান্তই চূড়ান্ত বিবেচিত হবে।
(ঙ) জাতীয় কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে তিনি তাঁর স্বাক্ষরিত সনদপত্র দ্বারা প্রধান জাতীয় কমিশনার নিয়োগ করবেন।
(চ) প্রধান জাতীয় কমিশনারের সুপারিশক্রমে তিনি নিজ স্বাক্ষরে জাতীয় কমিশনার এবং আঞ্চলিক কমিশনারদের সনদ দেবেন।
(ছ) প্রধান জাতীয় কমিশনারের সুপারিশক্রমে তিনি প্রেসিডেন্ট’স স্কাউট ও প্রেসিডেন্ট’স রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড অনুমোদন করবেন এবং তাতে স্বাক্ষর করবেন।
একই সাথে বর্ণিত ‘গঠন ও নিয়ম’ এর ৩ ধারার দিকে নজর বুলিয়ে নেয়া যাক।
৩। আদর্শ
(ক) বাংলাদেশ স্কাউটস সরকার বা কোন সংস্তা, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ-নিরপেক্ষ স্বেচ্ছাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান।
(খ) স্কাউট আন্দোলনের বিশ্ব সংস্থা (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব দি স্কাউট মুভমেন্ট)-র সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের স্কাউটিং বিশ্ব স্কাউটিংয়ের আদর্শ ও স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে।
(গ) এ প্রতিষ্টানের নীতি, ট্রেনিং ও প্রোগ্রাম অসাম্প্রদায়িক, শ্রেণী বৈষম্যহীন ও উদার ধর্মীয় চেতনার উপর গুরুত্ব দেবে।
(ঘ) এর সদস্যগণ স্কাউট পোশাক পরে কোন রাজনৈতিক সভা-সমিতি অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত কোন কাজে অংশগ্রঞণ করতে পারবে না।
(ঙ) এর সদস্যগণ কোন রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, সরকারী, বেসরকারী মতবিরোধে কোন পক্ষ সমর্থন করবে না।
এবার ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, স্কাউট সংগঠন নিজেই বলছে সংগঠনটি সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়, অতএব এটি একটি বেসরকারী সংগঠন অর্থাৎ এনজিও। একটি এনজিও যদি নিজ গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিকে তাদের প্রধান মনোনীত করে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা হানি হয় না বৃদ্ধি পায়? পক্ষান্তরে, যেভাবেই হোক পূর্বেকার সকল রাষ্ট্রপতি ‘চীফ স্কাউট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ মতে তাঁর পক্ষে ‘চিফ স্কাউট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কি সম্ভব? বোধগম্য নয়, কোন কালে কোন কর্তাব্যক্তি বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতির গোচরে এনেছিলেন কি না।
বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’ এর ২৬ ধারার (ঙ), (চ) ও (ছ) উপধারা মতে ‘চিফ স্কাউট’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি যখন দায়িত্ব পালন করেন তখন কি সেই দায়িত্ব পালন বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি হয়ে ওঠে না? বিষয়টি আর বিস্তারিত আলোচনা না করলেও এটা আশাকরি সকলের কাছে পরিস্কার যে, বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনার যে কাজগুলো ‘চিফ স্কাউট’কে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন, তা দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
একবার ভাবুন, রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুসারে স্পিকারের কাছে (আগে প্রধান বিচারপতি শপথ পাঠ করাতেন) শপথ বাক্য পাঠ করেন। শপথ গ্রহণপূর্বক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে আবারো শপথ নিতে হয় স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের কাছে- যিনি একজন সরকারী কর্মকর্তা (শুরু থেকেই একজন সচিব এ দায়িত্ব পেয়ে আসছেন)। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিতে তারই অধীনস্থ এক সরকারী কর্মকর্তা তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করানোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা হানি হয় না কি? লক্ষ্যনীয়, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি দুটো পদই সাংবিদানিক পদ; পক্ষান্তেরে স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের পদে যিনি আছেন বা ছিলেন, তিনি সরকারী কর্মকর্তা।বিষয়টি নিয়ে ভাবনা হয় বৈকি।
সঙ্গত কারণেই রিট পিটিশন দাখিল করলে মহামান্য হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুল জারি করেন।
দ্বিতীয় পর্ব
হাইকোর্টে বাংলাদেশের প্রধান স্কাউট হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন নিয়ে রিট পিটিশন হবার পরে এবং এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রুল জারির পরে কারো কারে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে এবং নানান মন্তব্য শুনতে হয়েছে। এতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। খোদ বাংলাদেশ স্কাউটস এর বড় বড় কর্তাব্যক্তিগণও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন বলে জানতে পেরেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য সভাকক্ষেই নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের আগে ভাবনা উচিত ছিল; এখন ভুল সংশোধন করার সময় এসেছে। তবে বিপক্ষেও ছিলেন অনেকে- তারা এ বিষয়ে আইনী লড়াই চালাবেন বলেছেন বলে জানতে পেরেছি। বিষয়টি আইনী লড়াইয়ের নয়, ভুল সংশোধন করার। কেননা, মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশের প্রধান স্কাউট মনোনয়ন করাটা দোষের নয়, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে; তবে আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে, সেটি ভুল এবং পরিষ্কারভাবে দেশের সংবিধানের লংঘন। বাংলাদেশ স্কাউটস এর মতো একটি বেসরকারী সংগঠন রাষ্ট্রপতি কোন পদ-পদবী প্রদান করতে পারে না। এক্ষেত্রে দেশের সংবিধানের মাধ্যমে তাঁকে এ দায়িত্ব প্রদান করলে তা হত যথাযথ। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারো পরামর্শে কাজ করতে পারেন না; এখানে বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি যে সকল কাজ করছেন, সেগুলোই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন প্রধান নির্বাহী; অথচ স্কাউট সংগঠনে প্রধানমন্ত্রীর কোন অফিসিয়াল অবস্থান নেই।
এবার আসি বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশগুলোয় চিফ স্কাউট প্রসঙ্গে। এ কথা সকলেই জানেন, বিশ্বের চিফ স্কাউট হচ্ছেন স্কাউটিং এর প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টিফেনশন স্মিথ ব্যাডেন পাওয়েল (লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল বা বিপি নামে সমধিক পরিচিত)। আজো পর্যন্ত এ মর্যাদা অন্য কাউকে দেয়া হয়নি। যেখানে বিশ্বের প্রধান স্কাউট একজন আর্মি অফিসার (লেফটেনেন্ট জেনারেল পদ মর্যাদার) সেখানে স্কউটিং এর জন্মভূমি ইংল্যান্ডে (যুক্তরাজ্য) সংগত কারণে মহামান্য রানী চিফ স্কাউট হননি। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ইংল্যান্ডের চিফ স্কাউট পদটি নির্বাচিত পদ। বর্তমানে ইংল্যান্ডের নির্বাচিত চিফ স্কাউট হচ্ছেন বিয়ার গ্রিলস (Bear Grylls ) যিনি পেশায় একজন টেলিভিশন সাংবাদিক। তিনি বিশ্বখ্যাত ডিসকভারী চ্যানেল এ কাজ করেন। তাঁর “ম্যান অ্যান্ড ওয়াইল্ড” সিরিজটি বিশ্বখ্যাত এবং খুবই জনপ্রিয় সিরিজ।। ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করা বিয়ার গ্রিলস হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ চিফ স্কাউট। তিনি ২০০৯ সালে চিফ স্কাউট হিসেবে নির্বাচিত হন।
অস্ট্রেলিয়া স্কাউটস এর চিফ স্কাউট পদেও পদাধিকারবলে কেউ অধিষ্ঠিত নন। সেখানে ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘স্কাউট অস্ট্রেলিয়া’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট দেশের গভর্নর জেনারেলকে দেশের চিফ স্কাউট পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপধান বৃটেনের রানী এবং রানীর পক্ষে সেখানে গভর্নর জেনালের রাস্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন, অস্ট্রেলিয়া স্কাউটস-এ ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট এবং ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান দুটো আলাদা পদ এবং দু’জন ব্যক্তি এ দু’টি পদে অধিষ্ঠিত হন।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতে চিফ স্কাউট নামে কোন পদ নেই, বরং ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইড এর ‘চিফ প্যাট্রন’ হিসেবে অধিষ্ঠিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনিই, যিনি ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার অধ্যক্ষ; তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সেদেশে রাষ্ট্রপতিকে কোন পদে আসীন করা হয়নি। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ আমেরিকায় চিফ স্কাউট নামে কোন পদ নেই। ভুটানেও চিফ স্কাউট নামে কোন পদ নেই রয়েছে ‘প্যাট্রন’- দেশের যুবরাজ এ পদে অধিষ্ঠিত; রাজাকে এ পদে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। নেপালের শিক্ষা ও ক্রীড়া মন্ত্রী হচ্ছেন সে দেশের ‘চিফ স্কাউট’। শ্রীলঙ্কায় ১৯৫৭ সালের ১৩ নং আইনে বলা হয়েছে দেশের প্রেসিডেন্ট স্কাউটস এর ‘প্যাট্রন’ হবেন, তিনি রাজী না হলে যিনি রাজী হবেন তেমন কাউকে এ পদে মনোনয়ন দিতে পাবে স্কাউট কাউন্সিল।
প্রসঙ্গত একটি বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিফ স্কাউট কমিশনারগণ (যে পদবীধারীই হোক না কেন- চিফ ন্যাশনাল কমিশনার, ন্যাশনাল কমিশনার, চিফ স্কাউট কমিশনার ইত্যদি) শীর্ষ বৈঠকে মিলিতি হন। যদি কোন এক শুভ লগ্নে বিভিন্ন দেশের চিফ স্কাউটগণ এমনি এক শীর্ষ বৈঠকে বিশ্বের কোন এক স্থানে মিলিত হন, তখন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতিকে বসতে যুক্তরাজ্যের চিফ স্কাউট বিয়ার গ্রিলস এর সাথে- বিষয়টি রাষ্ট্রপতির জন্য কতটা সম্মানজনক হবে!
মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ (২) মোতাবেক “রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং ……”; তাঁকে দেশের অসংখ্য বেসরকারী সংগঠনের মধ্যে একটি (যদিও সর্ববৃহৎ নিঃসন্দেহে) বাংলাদেশ স্কাউটস এর “চিফ স্কাউট” পদে বসিয়ে“জাতীয় স্কাউট কাউন্সিল” এর সদস্য বানিয়ে “রাষ্ট্রপতি’র পদমর্যাদার যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি।
পাশাপাশি একথা স্বীকার করতেই হয়, বহু দেশেই রাষ্ট্রপ্রধান (যে নামেই হোক না কেন- প্রেসিডেন্ট, রাজা, রানী, গভর্নর জেনারেল) চিফ স্কাউট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের দেশেও করছেন; তবে আমাদের দেশের সংবিধান এ পদে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন প্রক্রিয়া যথাযথ নয়; যদিবা বিষয়টি নিয়ে আগে কখনোই ভাবা হয়নি। তাই, এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রুল জারির পরে যদি সরকার ইচ্ছে করেন, তবে মহান জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে রাষ্ট্রপতিকে দেশের চিফ স্কাউট হিসেবে মনোনীত করে দায়িত্ব প্রদান করতে পারে এবং সেটাই হবে সংবিধান সম্মত।
তৃতীয় পর্ব
এবারে আসা যাক বাংলাদেশে স্কাউটিং আন্দোলনের গোড়ার কথায়। এ কথা সকলের জানা আছে, স্কাউটিং শুরু হয়েছিল ১৯০৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ইংল্যান্ডের পুল হারবারে অবিস্থত ব্রাউনসী দ্বীপে মাত্র ২০ জন বালককে নিয়ে। একজন বৃটিশ সেনাধ্যক্ষ লেফটেনেন্ট জেনারেল রবার্ট স্টিফেনশন স্মিথ ব্যাডেন পাওয়েল (বিপি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত) স্কাউটিং কার্যক্রম শুরু করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে। স্কাউট কার্যক্রমের ব্যতিক্রমতার কারণে সে সময়ে ইংল্যান্ড ছাড়াও পুরো বৃটিশ কলোনীতে এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ফলে ১৯২২ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে বিশ্বময় স্কাউট আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক কাঠামো দেয়া ও তদারকি করার লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক স্কাউট কনফারেন্স’ গঠিত হয়ে এর একটি নির্বাহী কমিটি ও সচিবালয় স্থাপন করা হয়। সেই শুরু- বর্তমানে এটির নাম “ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব দি স্কাউট মুভমেন্ট”। এর সদর দফতর জেনেভায় এবং সচিবালয়টি “বিশ্ব স্কাউট সংস্থা” নামে পরিচিত।
বৃটিশ আমলেই বর্তমান বাংলাদেশ ভ‚খন্ডে স্কাউটিং শুরু হলেও প্রথম দিকে তা কেবল এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের প্রদশে হিসেবে পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) স্কাউটিং কার্যক্রম চলে। ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মত পাকিস্তানে স্কাউট কার্যক্রমের আইনী বৈধতা আসে একটি অর্ডিন্যান্স বলে যেটি “পাকিস্তান বয় স্কাউটস অ্যাসোসিয়েশন অর্ডিন্যান্স-১৯৫৯” শীরোনামে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারী করা হয় ২৯ জুলাই ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে (Ordinance No. XLIII of 1959)।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ১১১ নম্বর আদেশ বলে পাকিস্তান বয় স্কাউট সমিতিকে “বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতি” হিসেব নামকরণ করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় এবং পূর্বোক্ত “পাকিস্তান বয় স্কাউটস অ্যাসোসিয়েশন অর্ডিন্যান্স-১৯৫৯” অধাদেশটি রহিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে Bangladesh Boy Scouts Samity (Amendment) Ordinance, 1978 (Ordinance No. LIV of 1978) বলে “বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতি”-র নাম পরিবর্তন করে করা হয় “বাংলাদেশ স্কাউট”। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সর্বশেষ সংশোধনীতেও রয়েছে এই কথাগুলো:
4. The constitution, powers and functions of the Bangladesh Scouts be such as may be prescribed by rules to be made by the Bangladesh Scouts with the previous approval of the Government, and until such rules are made, the rules of the Pakistan Boy Scouts Association and in force immediately before the commencement of this Order shall continue to be in force and be deemed to have been made under this Order.
বাংলাদেশ স্কাউটস এখনও তেমন কোন আইন তৈরী করেনি যা মহান জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে বা অনুমোদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তান বয় স্কাউটস অ্যাসোসিয়েশন অর্ডিন্যান্স মতে চলতে হলে সংগঠনটিকে চলতে হবে THE SOCIETIES REGISTRATION ACT, 1860অনুসারে। আর যদি কোন আইন বা নীতিমালা করতে হয়, তবে তা হতে হবে জাতীয় সংসদ কর্র্র্তৃক পাশকৃত। সে মতে চলতে হলে সংগঠনটির প্রতিটি স্তরে থাকতে হবে নির্বাচিত কমিটি। এবার দেকা যাক বাংলাদেশ স্কাউটস এর সাংগঠনিক কাঠামো কেমন। প্রথমেই বলতে হয় জাতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কাঠামো প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশ স্কাউটস এর “গঠন ও নিয়ম” মোতাবেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন “চিফ স্কাউট”। চিফ স্কাউটসহ বিশাল সংখ্যক মানুষ নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ স্কাউটস এর “জাতীয় কাউন্সিল” যা কি না সংগঠনটির সর্বোচ্চ নতিনির্ধারণী সংস্থা। “গঠন ও নিয়ম” এর ১৫ ধারা অনুসারে এই কাইন্সিলের সদস্য হিসেবে রয়েছে “জাতীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য” এবং
১৫ (ছ). বাংলাদেশের সকল স্বায়ত্বশাষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে চলমান বছরে দেশের প্রশাসনিক বিভাগসমুহ থেকে পর্যায়ক্রমে একজন করে উপাচার্য জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হবেন। বাংলাদেশ স্কাউটস এর সভাপতি ও প্রধান জাতীয় কমিশনার কর্তৃক যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এ উপাচার্যগণ জাতীয় কাউন্সিলের সাধারণ সভায় অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হবেন।
মন্তব্য: বাংলাদেশ স্কাউটস একটি এনজিও হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিজ সংগঠনে একজন কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন দেবার অধিকার কি ভাবে লাভ করলো এবং মাননীয় উপাচার্যগণ কি করে এতে অংশগ্রহণ করেন? একজন উপচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন মহামান্য রাষ্ট্রপতি (বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য) কর্তৃক; তাঁকে একটি এনজিওতে সদস্য হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব বা মনোনয়ন দেবার অধিকার কি ঐ এনজিও’র আছে?
“গঠন ও নিয়ম” এর একই ধারা মতে জাতীয় কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন:
জ. মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর
ঝ. মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর
ঞ. মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর
ট. সকল আঞ্চলিক স্কাউটস এর সভাপতি
ঠ. চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ড
ড. চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড
ঢ. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (উপ সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়)
ণ. যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (উপ সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়)
ত. জাতীয় উপ কমিশনারগণ
থ. আঞ্চলিক কমিশনার, বাংলাদেশ স্কাউটস, সকল অঞ্চল
দ. জাতীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য
ধ. জাতীয় কমিশনার, বাংলাদেশ গার্ল গাইডস এসোসিয়েশন
ন. মহাসচিব, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
প. আজীবন পৃষ্ঠপোষকদের মধ্য থেকে সভাপতি ও প্রধান জথিীয় কমিশনার কর্তৃক যৌথভাবে মনোনীত একজন আজীবন পৃষ্ঠপোষক সদস্য
ফ. আজীবন সদস্যদের মধ্য থেকে সভাপতি কর্তৃক যৌথভাবে মনোনীত পর্যায়ক্রমে একজন সদস্য
ব. সাধারণ সদস্যদের মধ্য থেকে সভাপতি কর্তৃক মনোনীত পর্যায়ক্রমে একজন সদস্য
ভ. প্রধান জাতীয় কমিশনার কর্তৃক মনোনীত প্রত্যেক অঞ্চল থেকে একজন লিডার ট্রেনার
ম. আঞ্চলিক কমিটি কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধিগণ………
য. নির্বাহী পরিচালক।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, উপধারা ‘জ’ থেকে ‘ণ’ পযর্ংন্ত সকলেই সরকারী কর্মকর্তা। একজন সরকারী কর্মকর্তা স্বীয় দায়িত্বের বাইরে অন্য কোন সংস্থায় কর্মর্তা হিসেবে কাজ করতে পারেন কি না সে বিষয়ে আমাদের চেয়ে তারাই ভাল বলতে পারবেন। উপধারা ‘ত’- তে বর্ণিত জাতীয় কমিশনারগণ মনোনীত হন প্রধান জাতীয় কমিশনার কর্তৃক এককভাবে স্বীয় পছন্দে, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই হচ্ছেন সরকারী কর্মকর্তা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে “থ”-তে বর্ণিত আঞ্চলিক কমিশনারগণ সরকারী কর্মকর্তা। বিষয়টি বিতর্কিত। তবে আলোচ্য অংশে আমার বক্তব্য অন্যত্র। বাংলাদেশ স্কাউটস এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা “জাতীয় কাউন্সিল” এ নির্বাচিত সদস্যের চেয়ে মনোনীতদের সংখ্যা এতটাই বেশী যে, নির্বাচিত সদসগণ সেখানে “আদীবাসী বা উপজাতি বা সংখ্যালঘু” হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন।
এবারে আসা যাক উপধারা ‘দ’ মোতাবেক ‘জাতীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য’ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ স্কাউটস এর নির্বাহী সংস্থা হিসেবে ‘জাতীয় নির্বাহী কমিটি’ কি ভাবে গঠিত হয় দেখুন:
ধারা ২৩: বাংলাদেশ স্কাউটসেন একটি জাতীয় নির্বাহী কমিটি থাকবে। এ কমিটি জাতীয় কাউন্সিলের পক্ষে প্রশাসনিক ব্যাপারে সর্বোচ্চ নির্বাহী পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। নিম্নলিখিত সদস্যদের নিয়ে জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে-
ক. সভাপতি {নির্বাচিত}
খ. সহ-সভাপতিগণ {দুই শিক্ষা সচিব পদাধিকারবলে এবং একজন নির্বাচিত}
গ. প্রধান জাতীয় কমিশনার {জাতীয় কাউন্সিলে সুপারিশকৃত এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত}
ঘ. কোষাধ্যক্ষ {নির্বাচিত}
ঙ. জাতীয় কমিশনারগণ {এদরে সংখ্যা ১৫, সকলেই প্রধান জাতীয় কমিশনার এর পছন্দের ব্যক্তি এবং তার সুপারিশে রাষ্ট্রপতি কর্তক নিয়োগকৃত}
চ. উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় {পদাধিকারবলে}
ছ. মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর {পদাধিকারবলে}
জ. মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর {পদাধিকারবলে}
ঝ. চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা অধিদফতর {পদাধিকারবলে}
ঞ. সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান {পদাধিকারবলে}
ট. চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড {পদাধিকারবলে}
ঠ. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি (উপ সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়)-{পদাধিকারবলে}
ড. জাতীয় নির্বাহী কমিটি কর্তৃক সহজোযাজিত তিন জন সদস্য।
ঢ. জাতীয় নির্বাহী কমিটির জন্য ৬ অঞ্চলের ৬ জন কাউন্সিল প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। পরবর্তী মেয়াদে বাকী ৬ অঞ্চলের ৬ জন কাউন্সিলর প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। ফলে পূর্ববর্তী মেয়াদে নির্বাচিত ৬ জন কাউন্সিলরের পদ শুন্য হবে।
ণ. সকল আঞ্চলিক স্কাউটস থেকে দু’জন করে সদস্য (আঞ্চলিক কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত একজন এবং আঞ্চলিক কমিশনার)
ত. নির্বাহী পরিচালক।
{….} এর মধ্যের কথাগুলো বক্ষমান নিবন্ধকারের মন্তব্য।
এবারে দেখুন, কতজন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত? দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কেবিনেটে ১০ শতাশেংর বেশী অনির্বাচিত মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন না; এখানে প্রধান জাতীয় কমিশনার নিয়োগকৃত ১৫ জন জাতীয় কমিশনারের সকলেই মনোনীত, কেউই নির্বাচিত নয়।
প্রসঙ্গক্রমে বলে নেয়া ভাল, যারা নিয়মিত স্কাউটিং করেন, তারা দীর্ঘ দিন স্কাউটিং করে (কখনো কখনো ১৫ থেকে ২৫ বছর অতিক্রম করে) লিডার ট্রেনার হয়ে থাকেন। তাদের সংখ্যা দেশে খুব বেশী নয়। সর্বশেষ তথ্য না থাকায় লিডার ট্রেনারদের সংখ্যা উল্লেখ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো লিডার ট্রেনার হিসেবে জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে স্থান করে নিতে পারেন না; এমনকি জাতীয় কাউন্সিলে যে কয়জন লিডার ট্রেনার থাকেন তারাও প্রধান জাতীয় কমিশনার এর পছন্দের ব্যক্থি। তাদের প্রয়োজন কেবল “ট্রেনিং” এর সময়ে। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে থাকেন ‘লিডার ট্রেনারগণ হচ্ছেন ‘মৌলবী’-দের মতন, কেবল জানাজা পড়তে তাদের ডাক পড়ে।
এনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে পাঠক বিরক্ত হতে পারেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি “প্রধান জাতীয় কমিশনার” হিসেবে কোন গণতান্ত্রিক নিয়মে এতগুলো পদে মনোনয়ন দেবার অধিকার লাভ করেন? আর এই যখন অবস্থা, তখন সেই সংস্থার সেই কমিটি বা কাউন্সিল কতটা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
১৫ জন জাতীয় কমিশনার ছাড়াও ৩০ জন জাতীয় উপ কমিশনার নিয়োগ দিয়ে থাকেন প্রধান জাতীয় কমিশনার। এই ১৫ জন জাতীয় কমিশনার এবং ৩০ জন জাতীয় উপ কমিশনার জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য এবং তাদের ভোটাধিকার রয়েছে। বলা যায় কাউন্সিল বা কমিটিতে প্রধান জাতীয় কমিশনার এর একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা বা স্বৈরশাসন বজায় রাখার জন্যই “গঠন ও নিয়ম” টা এমনি করে তৈরী করা হয়েছে।
এবার দেখা যাক অঞ্চলগুলো কেমনে চলছে। নৌ অঞ্চল ও বিমান অঞ্চল যথাক্রমে নিয়ন্ত্রণ করে নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনী। রেলওয়ে অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে রেলওয়ে বিভাগ। রোভার অঞ্চল দেশব্যাপী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভারিং নিয়ন্ত্রণ করে। এই অঞ্চলের সভাপতি হচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এর আগে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রোভার অঞ্চলের সভাপতি ছিলেন। অন্য সকল অঞ্চলের মতই রোভার অঞ্চলের প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন আঞ্চলিক কমিশনার। রোভার অঞ্চলের আঞ্চলিক কাউন্সিলে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত বা সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত কোন ব্যাক্তিকে প্রধান জাতীয় কমিশনারের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। বাস্তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এক প্রকার দখল করে রেখেছেন রোভার অঞ্চলের আঞ্চলিক কমিশনারের পদটি দীর্ঘদিন ধরে। মজার বিষয় হচ্ছে রোভার অঞ্চলের আঞ্চলিক কমিশনার (মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর) জাতীয় কাউন্সিল ও জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে দু’টি পদ একআি দখল করে রেখেছেন। দেখুন জাতীয় কাউন্সিল সম্পর্কিত ধারা ১৫ (জ) ও ১৫ (থ)এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটি সংক্রান্ত ধারা ২৩ (ছ) ও ২৩ (ণ)।
আঞ্চলিক স্কাউট কাউন্সিল ও আঞ্চলিক নির্বাহী কমিটির অবস্থায় একই। ব্যতিক্রম নয় জেলা ও উপজেরা পর্যায়ের কাউন্সিল ও নির্বাহী কমিটির গঠন প্রক্রিয়াও। সকল স্তরে কাউন্সিল ও নির্বাহী কমিটির গঠন প্রক্রিয়া এমনভাবে করা হয়েছে যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে সবকিছুই “প্রধান জাতীয় কমিশনার” এর নিয়ন্ত্রনে থাকে। ফলত “বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব” নিয়ে যে সংগঠনটির গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করার কথা, সেটি হয়ে উঠেছে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে একটি স্বৈরাচারী সংগঠন। এখানে কেউ যদি“প্রধান জাতীয় কমিশনার” সুনজরে থাকেন তিনি হবেন “রাজ বংশের মানুষ”। “বিদ্রোহী”।কে; যদিও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত“স্কাউটিং হচ্ছে সকলের জন্য উন্মুক্ত”।
মূলত “গঠন ও নিয়ম” এর মধ্য দিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের “পদাধিকারবলে” স্কাউটিং এর সর্বস্তরের কমিটিতে দখলদারিত্ব কায়েম করার মধ্য দিয়ে স্কাউটং এর মূলনীতি থেকে বহুদূরে চলে গেছে বাংলাদেশ স্কাউটস। অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সংগঠন নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনার সুযোগ এলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে।
একটি এনজিও হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রতিটি সাংগঠনিক স্তরে নির্বাচিত কমিটি থাকা দরকার এবং অবশ্যই যারা স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত তাদের নিয়ে। বিশেষত যারা দীর্ঘ দিন ধরে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত, তাদের প্রতিটি স্তরের কমিটিতে থাকার নিয়ম করলে স্কাউটিং হবে সত্যিকারের স্কাউটিং- যা এখন পরিণত হয়েছে সরকারী কর্মকর্তাদের বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে। সরকারী কর্মকর্তাগণ স্কাউটিং করবেন না, তা বলছি না; অনেক সরকারী কর্মকর্তা আছেন যারা ছাত্র জীবন থেকে স্কাউটিং করে আসছেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে সরকারী কর্মকর্তাদের “পদাধিকারবলে” স্কউটিং এর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় বসিয়ে স্কাউটিং এর মূলধারা থেকে সড়ে যাওয়ার বিষয়ে। যেমন একজন জেলা প্রশাসক চান বা না চান, তাকে জেলা স্কাউটস এর সভাপতি হতেই হবে। কোন কোন জেলায় জেলা প্রশাসককে একাধিক জেলা স্কাউটস এর সভাপতি হতে হয়; কেউ কেউ এতে বিরক্তও হন। যেমন, ঢাকার জেলা প্রশাসক তিনটি জেলা স্কাউটস এর সভাপতি- “ঢাকা মেট্রোপলিটন স্কাউটস”, “ঢাকা জেলা স্কাউটস” এবং “ঢাকা জেলা রোভার”।
এছাড়া গঠন ও নিয়মে ২৪৩(খ) ধারায় বর্ণিত “অস্কাউটসুলভ আচরণ” ব্যবহার করে অপছন্দের মানুষদের স্কাউটিং থেকে দূরে রাখার প্রবণতা এবং ২৪৯ ধারয় বর্ণিত “বাংলাদেশ স্কাউট ফাউন্ডেশন” নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনার ইচ্ছে রইল। এখানে মজার বিষয় হলো বর্ণিত “গঠন ও নিয়ম”-এ “অস্কাউটসুলভ আচরণ” এর সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা না থাকায় এটির ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে; বলা যায় এটি হচ্ছে একটি “নিপীড়নমূলক স্কাউট আইন”।
(চলবে)