যুদ্ধশিশু '৭১ এবং আমার অভিজ্ঞতা...
প্রিয় এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশ্। এদেশের হাজার বছরের লাখো লাখো শহীদের রক্তস্রোত প্রবহমান তেরোশ' নদীর জলে। হাজার হাজার লাঞ্ছিত-ধর্ষিত মা-বোনের কাপড় যেন এদেশের মৃত্তিকা আর প্রতিদিন বঙ্গভবন, প্রধান উপদেষ্টার ভবন থেকে শুরু করে একজন রহম আলীর রিকসার সামনের চাকার উপরে ওড়ে যে প্রিয়তম লাল- সবুজ পতাকা;তা হলো একাত্তরের 'যুদ্ধশিশু'দের অস্তিত্বের আব্রু।
বাংলাদেশ এখন ৩৭ বছরের তরতাজা তরুন। অথচ ইতিহাসের নির্মমতা এতই প্রবল- এখনো পর্যন্ত আমরা যুবক ' বাংলাদেশের' সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরতে পারিনি। খোঁজ রাখিনি বাংলাদেশের সহোদর 'যুদ্ধশিশু'দের। বাংলাদেশের জন্মযন্ত্রনা আর যুদ্ধশিশুদের জন্মযন্ত্রনা সমার্থক। আর কবছর পর স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তি পালিত হবে। এরকম বাস্তবতায় আমাদের সামনে বাংলাদেশের পরিচয়ের নতুন সমুপস্থিত। আমরা কী পারবো সেই পাঠের প্রতিটি পৃষ্ঠায় নিজেদের বোধ,বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত চেতনার পরিচয় তুলে ধরতে?
এই প্রশ্নের জবাবের প্রত্যাশায় ইতিহাসের এক বিস্মুত প্রায় অধ্যায় ''যুদ্ধশিশূ'৭১''
নিয়ে ১৯৯৮ সালে ব্রতী হয়েছিলাম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রচনায় । সে সময় বেরিয়ে আসে রোমহর্ষক এবং বিস্ময়কর সব তথ্য । যা প্রথমে সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র এবং পরবর্তীতে দৈনিক আজকের কাগজে ছাপা হয়। বোধগম্য কারণেই তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরী হয় পাঠক মহলে। যদিও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দলটি সেময় বাংলাদেশের
রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও,যুদ্ধশিশুদের প্রশ্নে কোনো রকম উদ্যোগ গ্রহন করেনি।
তারপর শীতলক্ষায় আরো অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর অংশিদারিত্ব এসেছে। এমন কী এই সামহোয়ার ইন ব্লগে যুদ্ধাপরাধী- রাজাকারদের ভাবশিষ্যদের (মাঝে মাঝে) আস্ফালন দেখে মনে হয়েছে, সেই বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়ের উন্মোচন কাহিনীটি আবারো তুলে ধরি।
'আল্লার ঘর '-এ পাশবিকতার রক্তছাপ কিংবা বর্বরদের স্বরূপ অন্বেষায়....
টুপটাপ ঝরে নৈঃশব্দের শিশির
ঝরে বেনারসি বকুল,
জরায়ুর প্রতি ফোটা রক্তজলে
জ্বলে আমার জন্মের এলান-
করবে কি তুমি,'কবুল কবুল'!?
দৃশ্যপট- এক.
১৯৭১। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হতে আর মাত্র ৬ দিন বাকী। যশোরের মাহমুদপুর-ঘোনা- আলীপুর- অঞ্চল মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগুচ্ছেন। দলনেতা বিশ্রাম সিং নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন।হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন , দূরে সড়কে দশ-পনেরজন পৌড়ের জটলা।হাত উঁচিয়ে থামতে বলছেন। কিছু শংকা, কিছু কৌতুহল।
কোনো ফাঁদ নয়তো। প্রাষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে একটৃ দুরুত্বেই ব্রেক কষলেন তিনি। দৌড়ে এলেন সে-ই দশ-বারো জন।
হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার গমকে থমকে থমকে যা জানা গেলো, তা হলো- গ্রামের একমাত্র মসজিদ তথা ' আল্লার ঘর '-এ আটক রয়েছে এ গাঁয়ের অধিকাংশ মেয়ে গত ৭ মাস ধরে। ঐ মসজিদই হচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্য দের ক্যাম্প। গ্রামের মানুষ তখনো জানে না, কেমন আছে তাদের সন্তানেরা।
এ সংবাদ শোনা মাত্রই জ্বলে উঠলেন জীপে বসা বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অস্ত্র তাক করেতাঁরা ছুটলেন সেই মসজিদের দিকে।
পেছনে পেছনে গ্রামবাসি।
সুড়কি উঠা এবড়ো থেবড়োগ্রামের সেই 'বনেদী মসজিদ'টির কাছাকাছি অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা যে যার মতো পজিশন নিলেন। ফায়ার চললো প্রায় আধঘন্টা টানা। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে কোনো জবাব পাওয় গেলো না। বরং যেন খুউব ক্ষীণ সুরে কান্নার মতো শব্দ ভেসে আসতে লাগলো ।
সবার আগে ছুটে গেলেন সেই বৃদ্ধ, যে হাত উচিয়ে থামিয়ে ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের।
বিস্ময়ে বিমূড় হয়ে গ্রামবাসী শুনলেন, বৃদ্ধের আর্তচিৎকার।
'হায়!হায়!ইয়া আল্লা,ইয়া মাবুদ.. হার্মাদরা কী করছে আমার মায়েরে'
মসজিদের ভেতর পাওয় গেল সেই গ্রামের ১১জন কন্যা।
যাঁরা প্রত্যেকই ছিলেন বিবস্ত্র।
মসজিদের মেঝেতে লেগে থাকা শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্ত সাক্ষ্য বহন করছিলো পাশবিক নির্যাতনের। দাঁড়াবার মতো শক্তি ছিলোনা সেই সব বোনদের।যুদ্ধেরে সাত মাস ধরে মসজিদ তথা 'আল্লার ঘর' এর পবিত্র আঙিনায় পাকিস্তানি নরপশুরা পালাক্রমে ধর্ষন করেছে ওঁদের।