তিতুমীর যার আসল নাম ছিল সৈয়দ মীর নিসার আলী ।তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী। তিতুমীরের জন্ম হয় চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের চাঁদপুর গ্রামে এটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হিসেবে খ্যাত। তার পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তার গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতেও লেখাপড়া করেছেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। একই সাথে তিনি বাংলা, আরবি এবং ফার্সি ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
তিতুমীর ওয়াহাবী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি জমিদার এবং ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম এবং তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে যান,আর তিনি মক্কায় স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে তাহ্বান্দ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত দাঁড়ির খাজনা এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার এবং নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।
তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তারা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন।যা বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বিস্তর বিশিষ্ট সেই কেল্লাটি নির্মাণ করেন।
তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয়ও বরন করেন। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন সেই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন।
শেষে ১৮৩১ সালের ১৩ই নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দেন তিনি তখন বলেন একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এই দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে। ১৪ই নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর এবং তার অনুসারীদের আক্রমণ করেন।[তাদের সাধারন তলোয়ার এবং হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ১৪ই নভেম্বর তিতুমীর এবং তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় আখ্যা দিয়ে থাকেন কারন মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীর যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন। একথা সত্য তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জেহাদের ডাক দিয়ে। ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, নদীয়া কাহিনীর রচয়িতা কুমুদ নাথ মল্লিক তিতুমীরকে ধর্মোন্মাদ এবং হিন্দু বিদ্বেষী বলেছেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে আক্রমন ও দেবনাথ রায় হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। অপরপক্ষে অমলেন্দু দের ভাষায় তিতুমীরের লক্ষ্য এবং পথ ছিল ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার আর নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায় তিতুমীরের সেই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ যার অভিমুখ ছিল অত্যাচারী জমিদার আর নীলকর সাহেবরা।
সূত্রঃ
ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে সংগ্রহ
ছবিঃ গুগল সংগ্রহ
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৭ রাত ১২:৩৭