জাকিয়া সবে চুলে তেল দিয়েছে। চিরুনিটা হাতে নিতে নিতেই শোবার ঘর থেকে শুনতে পেলো কলিং বেলের শব্দ। এই রাত দশটার সময় কে এল? মা রাহেলা খাতুনের দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকাল, “এত রাতে আবার কে কলিং বেল টাপে?” চিরুনিটা চুলে লাগিয়ে বিছানা থেকে নামতে গেল। রাহেলা খাতুন বললেন, “থাক। তোর যাওয়ার দরকার নেই। আমি দেখছি।” শাড়ির আচঁল মাথায় দিতে দিতে বিছানা থেকে নেমে গেলেন, “জয়গুনটা যে কেন এত সকাল সকাল ঘুমিয়ে যায় বুঝি না!” সামান্য বিরক্ত কন্ঠে বললেন তিনি।
জাকিয়া কিছু বলল না। জয়গুন এবাড়ির কাজের মেয়ে। সারাদিন নানান রকম কাজ কর্ম করে সন্ধ্যার পর ঘুমানো শুরু করে মরার মত। গত পরশু ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিং এর সব ফ্ল্যাটের লোকজন হুড়োহুড়ি করে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল সন্ধ্যার সময়- জয়গুন সে সময় ঘুমাচ্ছিল। তাকে ঠেলে, ধাক্কিয়েও তোলা সম্ভব হয়নি। সে ভূমিকম্পের আগেই মারা গেছে এরকম একটা ধারণা নিয়ে রাহেলা খাতুন নিচে রাস্তায় নেমে গিয়েছিলেন। ভয়ে আর বাসায় যাননি, পাশের ফ্ল্যাটে বোনের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন। পরদিন বাসায় ঢুকে আবিষ্কার করা হয় জয়গুন বেঁচে আছে, মগে চা বানিয়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে!
জাকিয়া চুল আচঁড়াতে আচঁড়াতে শুনতে পেল বসার ঘরের দরজা খুলে মা কারো সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কথা। আরো কারো গলা শোনা যাচ্ছে আবছা ভাবে। ফ্যানের শব্দের চোটে বোঝা যায় না কে কথা বলছে। তবে পরিচিত লাগল গলাটা। কার মনে পড়ল না।
ক্ষাণিক বাদে শোবার ঘরে এসে ঢুকলেন রাহেলা খাতুন। মুখ গম্ভীর।
“এতক্ষণ লাগল যে? কে এসেছে?”
“জামাই।” একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন তিনি। চুলে চিরুনি চালানো হাতটা মাঝ পথেই থেমে গেল জাকিয়ার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবতা। জাকিয়া বলল, “কেন এসেছে?”
“তোর শ্বাশুড়ির অবস্থা নাকি খুব খারাপ। বারবার তোকে দেখতে চাচ্ছেন।”
“আমাকে দেখতে চাচ্ছে কেন? ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম যখন – তখন কোথায় ছিল এত দরদ?” চাপা গলায় ঝাঁঝ প্রকাশ পেল জাকিয়ার।
“দ্যাখ, সংসার করতে গেলে টানা ছেচঁড়া থাকবেই। গোঁ ধরে বসে থাকতে পারবি না তুই। অল্প কিছুর জন্য জেদ ধরতে গেলে শেষে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।” রাহেলা খাতুন শান্ত মুখে বললেন।
জাকিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মার দিকে তাকাল, “ফিজিক্যাল টর্চারকেও পাত্তা না দিতে বলছো?”
“জামাই তোকে এমন কিছু করেনি যে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে আসতে হবে।” কঠিন গলায় বললেন রাহেলা খাতুন।
“মা! সে আমার ভার্সিটি লাইফের বন্ধু ছিল, ক্লাস মেট। বিয়ের পর সে তার মায়ের কারণে আমাকে চড় মারবে আর আমি মেনে নেবো? কি পেয়েছে সে? ওর ঘর, ওর সব কিছু, জবও করে সে-ই, আমি পড়ে থাকি বাসায়, সব কাজ আমার- ঠিক আছে মানলাম - তাই বলে টর্চার সহ্য করব?” রাগ চাপতে কষ্ট হচ্ছে জাকিয়ার, “চড়টা তোমার সামনে আমাকে মারলে এসব বলার ইচ্ছে হত না তোমার।”
“কি হয়েছে সেটা নিয়ে পড়ে থেকে লাভ নেই। ঘর সংসার এমন-ই। রাগারাগি থাকবে, মিলমিশও হয়ে যাবে। সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে জামাই উল্টা পাল্টা কিছু করে বসতে পারে।”
“কি করবে? আরেকটা বিয়ে করবে এই তো? যাক না, করুগ্যে আরেকটা বিয়ে, হাত পা বেধে রেখেছি নাকি আমি? পুরুষ জাতটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে আমার এই এক বছরে! তোমার স্বামী যখন করতে পেরেছে- তোমার জামাই করলে আর কি এমন দোষ হবে? করুগ্যে আরেকটা বিয়ে।” চিরুনিটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। রাগে ফুসছে ও।
রাহেলা খাতুন মেয়ের পাশে বসলেন। একটা সূক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস অতি সাবধানে গোপন করলেন, “তোর বাবা যখন আমার সাথে রাগারাগি করত- আমিও তোর মত প্রয়োজনের থেকে বেশি জেদ ধরে থাকতে গিয়ে নিজের সংসারটা হারিয়েছি। ছেলেগুলো হুট করে রাগতে পারে, আবার ঠান্ডাও হয়ে যায়- ব্যপারটা তখন বুঝতাম না। এখন বুঝি, নইলে সামলে রাখতে পারতাম নিজের ঘরটা। দিনের পর দিন বাপের বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকতাম। স্বামীর বাড়ি যেতাম না। কত বার যে তোর বাবা আমাকে নিতে এসেছিল- যাইনি। গোঁ ধরে পড়েছিলাম বাপের বাড়িতে। বলতে পারিস নিজের দোষেই সংসারটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তোর বাবকে একা দোষ দিয়ে লাভ কি?”
জাকিয়া কোনো কথা বলল না। রাহেলা খাতুন আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমার এক জীবনে আমি জেদের জন্য অনেক কিছু খুইয়েছি। তুই আমার জেদটাই পেয়েছিস- কিন্তু কপালটাও আমার পাস- এটা চাই না। প্রথম সংসারটাকে যতটা পারিস আকঁড়ে বাঁচার চেষ্টা কর- ওটাই মেয়েদের আসল ঠিকানা।”
কবিরের সঙ্গে জাকিয়া যখন রাস্তায় বেরিয়ে এল- রাত তখন এগারোটার মত। রাহেলা খাতুন চাচ্ছিলেন কবির খেয়ে যাক এখান থেকে- কিন্তু কবির শুকনো মুখে কেবল বলল, “মায়ের অবস্থা খুব খারাপ আম্মা। এখন খাওয়া দাওয়া গলা দিয়ে নামবে না আমার।” তাই রাহেলা খাতুনও জোড়াজুরি করননি। ওদের সাথেই আসতে চেয়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু বাসা খালি রেখে যাওয়া ঠিক হবে না দেখে এলেন না, পাশের বাসার লোকজনও নেই, দেশের বাড়িতে গেছে। তাই রাতের বেলা খালি বাসা রেখে যেতে স্বস্তি পাচ্ছেন না। বললেন সকালেই যাবেন।
রিক্সা ডাকতে যাচ্ছিল কবির। জাকিয়া নিচু স্বরে বলল। “সি.এন.জি ডাকো। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।
কবির একটু অবাক হলেও কিছু বলল না। কবিরদের বাসা খুব একটা দূরে না, রিক্সায় গেলে পচিঁশ ত্রিশ মিনিটের পথ। তাছাড়া জাকিয়া সি.এন.জি.তে উঠতে চায় না মাথায় তেল দিলে। বাতাসে চুলে আরো ময়লা লেগে যাবে। তাই রিক্সায় চড়ে বেশির ভাগ সময়। কবিরের সেটা জানা আছে। কিন্তু আজকে যখন নিজে থেকেই সি.এন.জি ডাকতে বলল, কবির কিছু না বলে চুপচাপ একটা সি.এন.জি নিয়ে এল।
সি.এন.জি টা বেশ জোরে যাচ্ছে। রাস্তায় জ্যাম নেই। ঠান্ডা বাতাস হু হু করে এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জাকিয়া শক্ত হয়ে বসে রয়েছে কবিরের পাশে। কবির থম থমে মুখে বসে আছে। শূণ্য দৃষ্টি চোখে।
জাকিয়া খেয়াল করল কবিরের ডান হাতটা আপনা আপনি কাঁপছে। ভার্সিটি থেকেই হাত কাঁপা রোগ আছে ওর, টানশনে থাকলেই হাত কাঁপা শুরু হয়। সিগারেট না খেলে সেটা কমে না। কিন্তু জাকিয়া ওকে সিগারেট খেতে দিত না বিয়ের পর থেকে।
“তোমার হাত কাঁপা এখনো ঠিক হয়নি?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করল জাকিয়া।
কবির ভাবলেশহীন মুখে জাকিয়ার দিকে তাকাল একবার। তারপর ডান হাতের দিকে এক নজর তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। চোখে শূণ্য দৃষ্টি ওর। এক ভাবে বাহিরে তাকিয়ে আছে।
জাকিয়ার মনে হল যেন কবিরের দু চখের কোণে পানি জমে উঠেছে। রাস্তার লাইট পোষ্টের ক্ষণিক আলোয় দেখতে পেল কবিরের চোখ দুটো চিকচিক করছে।
শাহেদা বেগমের লাশটা একটা চেকের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে জাকিয়া যখন ঘরে ঢুকল। ঘর ভর্তি লোক জন। বেশির ভাগই মহিলা। মাথার ওপর ঘটর ঘটর করে ফ্যান ঘুরছে।
কবির ঘরে ঢুকে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়ল। যেন কিছুই হয়নি। জাকিয়া মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মাঝ খানে।
মেরুদন্ডে ভার না রাখতে পারায় শাহেদা বেগম গত ষোল বছর ধরে বিছানায় পড়েছিল জড় পদার্থের মত। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই বিছানায় শুয়ে দিন পার করতেন। ঘরের আর দশটা আসবাব পত্রের মত তিনিও মিশে গিয়েছিলেন যেন সবের সাথে। হঠাৎ করে জানালার খুলে ফেলা পর্দার মত শূণ্য দেখাচ্ছে তাই ঘরটাকে। এতদিন বেঁচে থেকেও নিজের অস্তিত্ব জানান না দিতে পারলেও আজ না থেকেই তার অস্তিত্বের অনুপস্থিতিটা প্রকট করে দিয়েছেন সবার সামনে, খুব অদ্ভূত দেখাচ্ছে তাই ব্যপারটা। সবার মাঝে শুয়ে থেকেও ঘরটায় যেন তিনি নেই। অথচ এখানে সেখানে তার তাজা ছাপ লেগে রয়েছে এখনো। তার জায়নামাজ, তসবী, কোরআন শরীফ, ওষুধ পত্র, পিঠে দেয়া পাউডার- সব কিছুতেই কেমন যেন জীবন্ত একটা ভাব।
জাকিয়া ঘরের এক কোনায় বসে রয়েছে একটা চিঠি হাতে নিয়ে। ভাঙ্গা চোরা ভাষায় লেখা শাহেদা বেগমের একটা চিঠি। স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে কাগজটার দিকে, কিন্তু তার দৃষ্টি কাগজটায় যেন আটকে নেই। চিঠিটা পেরিয়েও বহু দূরে চলে গেছে........
“বৌ মা,
ঘরের ফার্নিচার হয়ে থাকাটা অনেক কষ্টের বুঝলা? শুয়ে থাকতে থাকতে মেজাজ কেমন যেন খিট খিটা স্বভাবের হয়ে গেছিল। তাই এত বছর ধরে কবির নামের ছাগলটারে ইচ্ছা মত গালি গালাজ করে আসছিলাম। কিন্তু সে হয়েছে তার আব্বার মত। কথা বললে মনে হয় যেন চেয়ার টেবিলের সঙ্গে কথা বলতেছি। বাপ-ছেলেয় এত মিল যে কেমনে হইল আমি বুঝে পাই নাই। এত কিছু বললেও ছেলে একটুও রাগ করত না। শেষে তোমারে বিয়ে করে ঘরে আনার পর মনে হইল যাক অবশেষে একটা মানুষ পাওয়া গেল চিল্লা ফাল্লা করার জন্য। আমি ছোট বেলা থেকেই খুব বাচাল আর চঞ্চল স্বভাবের আছিলাম। বিছানায় পড়ে থাকনের মত ব্যারাম না হইলে তোমার সঙ্গে বহুত ঘুরাঘুরি করতে পারতাম। তাই উপায় না দেখে খালি ঝগড়া করতাম। এর বেশি আর কি করবো? চোখের সামনে তুমি এত সুন্দর হাটে চলে বেড়াও- সহ্য হইত না। তাই খালি ক্যাট ক্যাট করতাম।
গত কয়দিন ধইরা বাড়ির চারপাশে কুকুর কান্দে। কুকুর কান্দা ভাল লক্ষণ না বুঝলা? ভাবলাম যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তাই তোমারে আবার ঘরে নিয়াসি। ঘর তো তোমার। ফালায় কোথায় যাবা? আমার ঘর তো ষোল বছর আগে কবরে চলে গেছে!
বৌ মা, একটা কথা বলি। মন দিয়া শুনিও। আমি তোমার শ্বাশুড়ি মানুষটা কিন্তু খারাপ আছিলাম না। বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে একটু মাথায় দোষ ধরছিল। তাও বলি, তোমারে বড় ভাল লাগত আমার। নতুন বৌ হইয়া আসার পর যখন এই ঘরে ঐ ঘরে ঘুরে বেড়াইতা, কোমরে আচঁল বাইধা কাজ কারবার করতা- তখন আমার আগের দিন গুলার কথা মনে পরত। ঠিক তোমার মতই আছিলাম আমিও। সারাদিন এইটা সেইটা খুটুর খাটুর করেই যাইতাম। তোমারে দেখে খুব শান্তি লাগত আমার তখন। আর তুমি সন্ধ্যার পর থেকে মাথায় এত তেল দেও কেন? মাথায় এত তেল দিবানা। চুলের গোড়া নরম হইয়া যায়।
বড় স্নেহ করি তোমারে। আমার ছেলেটারে দেখে রাইখো। ও হইল ফার্নিচার ধরণের ছেলে। যত্ন না নিলে মরিচা ধরে যায়, কিন্তু মুখ খুলে তোমারে বলবে না কিছু। ভাল থাকিও তোমরা। আমার অনেক গুলান নাতি পুতি হইবো ইনশাল্লাহ। আর আমার মরার পর আমার কবর যিয়ারতে কিন্তু আমার নাতি নাতনিদের ঠিকই নিয়া যাবা। ছোট মানুষের দুয়া আল্লাহ পাক বেশি কবুল করে।
এই সংসারটারে ধইরা রাইখো বৌ মা। সংসার বড় মায়ার জায়গা। না ধরতে পারবা, না ছাড়তে। কেবল দেখে যাবা দুই চোখ ভইরা। আহারে! সংসার বড় মায়ায় বাধছে আল্লায়!
- তোমার আম্মা, শাহেদা বেগম”
জাকিয়া এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কাগজটার দিকে। কিন্তু লেখা গুলো পড়তে পারছে না। ঝাপসা হয়ে এসেছে দুই চোখ। বিছানার ওপর শুয়ে থাকা শাহেদা বেগম কি দেখতে পাচ্ছেন তাকে? যদি পেতেন, তাহলে দেখতেন- তার ঝগড়া করার মেয়েটি আজ কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছে, কাঁদছে না। কেবল দু চোখে চিকচিক করছে দু ফোঁটা জল, ঝরছে না........ স্থির হয়ে জমে গেছে যেন অনন্তকালের জন্য...........