somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চতুরঙ্গ – প্রথম পর্ব

১৮ ই আগস্ট, ২০১১ ভোর ৬:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডাঃ এমরান তাঁর ইলেক্ট্রিক হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার দিকে চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন। ভ্রুঁ জোড়া কাছাকাছি হল তাঁর। হাল্কা নীলচে চোখ। সচরাচর বাঙ্গালীদের মাঝে এমন চোখ দেখা যায় না। হঠাৎ করে এভাবে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমি নড়ে চড়ে বসলাম চেয়ারটায়। সামনা সামনি বসেছি দুজন। মাঝখানে টি টেবিল। টি টেবিলের ওপর একটা ফ্লাওয়ার ভাস, একটা ডায়েরী আর আমার ফাইল। ফ্লাওয়ার ভাসটা এক নজর দেখেই বলে দেয়া যায় অ্যানটিক মূল্য অনেক হবে। নঁকশা কাটা কাঁসার ফ্লাওয়ার ভাস। কবেকার আর কোথাকার বুঝতে পারলাম না। তবে খুব দামী জিনিস সেটা বোঝা গেল।
যে ঘরটায় বসে আছি, সেটা প্রায় একটা হল রুমের মত বিশাল ঘর। অনেকটা চার্চের বিশাল প্রার্থনা ঘরের সমান। মাথার ওপরের ছাদটা প্রায় চার তলা উঁচুতে। ছাদ কিম্বা সিলিং যাই বলি না কেন – বেশ অদ্ভূত। যেন বিশাল কোনো দাবার বোর্ড ছাদটা। সাদা কালো ঘর কাটা। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান ঘরে উলটো ভাবে বিশাল বিশাল একেকটা ঘুটি ঝুলছে! প্রত্যেক ঘুটিই মানুষের সমান কিন্তু বর্ম পরা, অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত। হঠাৎ করে ছাদময় বিশাল দাবার বোর্ড আর উলটো ভাবে ঝুলে থাকা মূর্তি গুলোকে দেখলে ভয় লাগে। আধো অন্ধকারে কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছে অত উঁচু ছাদময় দাবার বোর্ডটাকে। ছাদটা হল রুম পেরিয়ে অন্যদিকে বাঁক নিয়েছে। হল রুমটা বেশ বড় বোঝাই যাচ্ছে, কয়েকটা মোড় ঘুরে চলে গেছে আরেকদিকে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না ওদিকটা। ছাদটাও সেভাবেই চলে গেছে। দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে অন্য দিকেও ছড়ানো এরকম হল রুম, জিনিস পত্রে ঠাসা, এবং দাবার বোর্ডে ঝুলন্ত মূর্তিতে ভরা সেদিকের ছাদটাও।
নিচ তলা থেকে শুরু করে একেবারে চার তলা পর্যন্ত কুন্ডলী পাঁকিয়ে উঠে গেছে একটা ধাতব সিঁড়ি। সেটা হল রুমের এক পাশে। ওপরে বোধ হয় থাকার ঘর। কারণ দেখলাম একপাশে ছোট একটা লিফটও রয়েছে। ডাঃ এমরানের জন্য নিশ্চই। হুইল চেয়ার নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা পর্যন্ত পুরো হল রুমের মত ঘরটার চার দেয়াল জুড়ে শুধু বই আর বই। বুক শেলফ উঠে গেছে চার তলা উঁচু ছাদ পর্যন্ত! আমি আমার জীবনে এত উঁচু বুক শেলফ দেখিনি, শেলফ গুলোর পাশে অনেক বড় মুভিং লেডার। মইটা একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। কিন্তু ডাঃ এমরান কিভাবে বই নামান? কেউ নামিয়ে দেয় হয়ত। সারা ঘর জুড়ে ঠাসা সব অ্যানটিক্সের জিনিস পত্র। পেইন্টিং , মূর্তি, কাস্কেট, স্টাফ করা জন্তু জানোয়ার, শো পিস- কি নেই। হাটা যায় না ঠিক মত। হল রুম বোঝাই করে ফেলেছেন এসব দিয়ে। গলা খাকারি দিলেন ডাঃ এমরান। আমি আবার তাঁর দিকে তাকালাম।
“তো মিস নোভেরা – হঠাৎ কেন আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার ‘কিউরেটর’ হতে আগ্রহী হলেন?” অদ্ভূত কন্ঠস্বর ডাঃ এমরানের। কেমন যেন কম্পনহীন শব্দ। ভারী আর ভরাট একটা গলা।
অস্বস্তিটা দূর করতে হাসার চেষ্টা করলাম, “ স্যার ছোট থেকে আপনাকে ঘিরে আমার বিরাট একটা আগ্রহ। আপনার লেখা বই যেখানে যখন পেয়েছি তখনি পড়েছি। এক রকম পাগল ছিলাম আপনার বইয়ের জন্য। আপনাকে দেখার জন্য বহুবার আপনার গেটের সামনে এসেছিলাম। ছোট বলে ঢুকতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি লেখা লেখি ছেড়ে দেয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তার ওপর যখন আপনার দূর্ঘটনা ঘটল – আমি মেনে নিতে পারিনি।”
“আবেগ...... আবেগ......” হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালেন, “ আবেগের চোখে দুনিয়া দেখার বয়স আপনার এখন। তাই খুব স্বাভাবিক জিনিস গুলোকে অনেক বড় করে দেখছেন।”
“ স্যার, প্লিজ আমাকে ‘আপনি’ করে বলবেন না। আমি আপনার অনেক ছোট।” ক্রমশ অস্বস্তিটা বাড়ছে। যার লেখার জন্য এত পাগল ছিলাম – সে মানুষটাকে সামনে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।
“ হুম......” চশমাটা চোখ থেকে খুলে আমার ফাইলটা ইঙ্গিত করলেন, “ তোমার ফাইলে দেখলাম তুমি ডাক্তারি পাস করেছো। ডাক্তারি বাদ দিয়ে হঠাৎ আমার এখানে আসাটা – ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।”
“ পত্রিকায় দেখলাম কিউরেটর চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। আর স্যার আমি শুনেছি আপনার ২৪ ঘন্টা একজন ডাক্তার দরকার পরে। তাই ভাবলাম আমিই যাই। আপনার কিউরেটর কাজের পাশাপাশি ডাক্তারিটাও চলল।”
“ কিঊরেটর হতে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার, হুট করে চাইলেই সেটা সম্ভব না।”
“ আমি জানি স্যার, আমার বাবা ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিলেন। ছোট থেকেই তাই এসব জিনিসের প্রতি একটা আগ্রহ ছিল।”
উনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন, “ বাবা-মা কি বলে তোমার?”
এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম, “ নেই। দু বছর আগে কার একসিডেন্টে মারা গেছেন।”
“ স্যাড...... আর কে কে আছে তোমার?”
“ আমার খালা আর আমার ছোট বোন।”
“ বোন কতটুকু? মানে বেশি ছোট? নাকি পড়াশোনা করে?”
“ দু বছরের ছোট আমার থেকে। পড়াশোনা করছে এখনো।”
“ আর খালা?”
“ ওনার আর কেউ নেই। বিয়ের পরেই স্বামী মারা যান লিভার সিরোসিস হয়ে। তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে আছেন।”
“ খুব একটা ভাল হল না তাহলে। তোমার কোনো হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করা উচিত। পঙ্গু বুড়ো মানুষের পেছনে ডাক্তারি বিদ্যা খরচ করে লাভ নেই।” হুইল চেয়ারটা আপনা আপনি নড়া শুরু করল। অন্য দিকে চলে যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে কথা বলা শেষ – আমি যেতে পারি এখন এ রকম ইঙ্গিত করলেন যেন।
আমি ভাবতেই পারিনি এভাবে হুট করে ‘না’ করে বসবেন। ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে মড়িয়া হয়ে বললাম, “প্লিজ স্যার, এটা আমার স্বপ্ন আমি আপনার সাথে কাজ করবো, আপনার দেখাশোনা করবো।”
একটা বুক শেলফ থেকে বসে বসে বই নামাতে নামাতে আমার দিকে পেছন ফিরে বললেন, “ তোমার ফাইলটা হাতে নাও, এন্ড জাষ্ট গেট আউট। উনিশ বছরের পড়াশোনা পানিতে ফেলার কোনো অর্থ হয় না।”
“ স্যার প্লিজ......” চোখে পানি এসে গেল, ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না ঠেকালাম।
“ অযথা কান্না কাটি করে লাভ নেই।” আমার দিকে না তাকিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলেন, “ আমার বয়েস হয়েছে। যখন তখন মরে যেতে পারি। ঝামেলা সামলাতে কোনো শক্ত সামর্থ ছেলের দরকার। তুমি পারবে না।”
আমি চোখের পানি মুছে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা হলুদাভ কাগজ বের করে বাড়িয়ে ধরলাম, “ আমি যখন ছোট ছিলাম আপনাকে প্রায়ই চিঠিতে লিখতাম – আমি বড় হয়ে আপনার মত ডাক্তার হবো, বই লিখতে না পারি – আপনার সাথে সাথে থাকবো। আপনার লেখা পান্ডুলিপি সবার আগে পড়বো। আর হাসপাতালে আপনার সাথেই প্র্যাক্টিস করবো। আপনি বহুদিন পর একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কি লিখেছিলেন জানেন?”
বেশ অবাক হয়ে ঘুরে তাকালেন ডাঃ এমরান আমার দিকে। আমার হাতে ধরা কাগজটার দিকে কৌতুহলি চোখে তাকালেন।
“ আপনি লিখেছিলেন – মা, দোয়া করি তুমি বড় হয়ে অনেক বড় ডাক্তার হও। কথা দিলাম তোমার সাথে কাজ না করতে পারি – তোমার রুগী অবশ্যই হব!” পড়ে শোনালাম চোখের পানি মুছতে মুছতে। এভাবে যে চোখে পানি চলে আসবে ভাবিনি। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ওনার সামনে।
ডাঃ এমরান তাঁর জট পাঁকা দাড়িতে আঙ্গুল বুলালেন বিভ্রান্ত মুখে, বিড়বিড় করলেন, “ আমি লিখেছিলাম? কবে?......... মনে পড়ছে না তো......”
চোখের পানি মুছে জেদ চেপে ফাইলটা তুলে নিলাম, “ মনে থাকবে কিভাবে? বয়স তো আর কম হয়নি আপনার। তার ওপর লাখ লাখ পাঠক পাঠিকা। আমার কথা আর মনে থাকে?” আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে বের হয়ে এলাম ডাঃ এমরানের বিশাল দূর্গ রুপি মিউজিয়াম থেকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরলাম। সারা পথ একটু পর পর আপনা আপনি দু চোখ ভরে যেতে থাকল পানিতে। বোধ হয় খুব বেশি আশা করেছিলাম। সেটা ভেঙ্গে যাওয়ায় নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
ট্যাক্সি থেকে নেমে যখন ভাড়া দিচ্ছিলাম, হাত থেকে ফাইলটা পড়ে গেল বেখেয়ালে। লাইট পোষ্টের আলোয় তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়া কাগজ গুলো তুলতে লাগলাম। কাগজ তুলতে গিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম সেখানে হলুদ একটা খাম; ভেতরে চিঠি! আমার না এটা, আমি রাখিনি। ল্যাম্প পোষ্টের পোঁকা ওড়া আলোতে চিঠিটা খাম থেকে বের করতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। গুটিগুটি হাতের লেখা –

“ নোভেরা,
আশা করছি সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ চাকরিটা করতে গিয়ে হাফিয়ে উঠবে না। আমি সময়ানুবর্তিতা পছন্দ করি।
ডাঃ এমরান চৌধুরী ”

কখন দিলেন এটা? সারাক্ষণ তো হুইল চেয়ারেই ছিলেন আমার সামনে! বিমূঢ়ের মত লাইট পোষ্টের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাতের বেলা খবরটা জাহিদকে ফোন করে জানালাম। বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারছিলাম না চাকরি পাওয়ার কথাটা। রীতিমত হড়বড়িয়ে সব বলে ফেললাম, “ জাহিদ তুমি বিলিভ করতে পারবে না! ডাঃ এমরানের চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি! কাল থেকে যাবো!”
জাহিদ ঘুমের ঘোরে হাই তুলতে তুলতে কেবল বলল, “ বুড়োকে বেশি ভাও দিও না। লেখক মানুষ, তাদের আদি অন্ত - অনন্ত যৌবন। শেষ মেষ আমার কপাল ফাটিয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছে শুনবো!”
আমি হাসতে লাগলাম।
“ ওই আমি রাখি। ঘুমের জন্য দুই চোখের পাতায় দশ কুইন্টল পাত্থর চেপে আছে।” জাহিদ ফোন রেখে দিল।
আমি ঘুমাতে পারলাম না। সারা রাত এপাশ ওপাশ করলাম কেবল। তখনো জানতাম না যেচে পড়ে গিয়ে চাকরিটা নিয়ে কত বড় ভূল করে ফেলেছি.........
শেষ রাতের দিকে ঘুমের মধ্যে দেখলাম আমি সেই বিশাল হল রুমটায়। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বাহিরে। কাঁচের জানালা দিয়ে লম্বা আলো-ছায়া সৃষ্টি হয়েছে হল রুমের দেয়ালে। আমি ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছি সেই বিশাল দাবা বোর্ডের দিকে। অন্ধকারের মধ্যেও মনে হচ্ছে মূর্তি গুলো নড়ছে...... জীবন্ত মানুষের মত হাটাহাটি করছে......

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ডাঃ এমরানের দূর্গ রুপি ব্যক্তিগত মিউজিয়ামের দায়িত্য বুঝে নিতে চার দিন লেগে গেল আমার। একজন মানুষ এক জীবনে এত বিশাল সংগ্রহ শালা কি করে তৈরি করেন আমাকে বারবার বিষ্মিত করল। পৈতৃক সূত্রেই ডাঃ এমরানের পরিবারটা দেশের সবচেয়ে ধনী পরিবার গুলোর মধ্যে একটা ছিল। আর কর্ম জীবনেও ডাঃ এমরান তাঁর পূর্ব পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন। তাই এরকম মিউজিয়াম তৈরি করা খুব একটা অসম্ভব না তাঁর জন্য।
ডাঃ এমরানের বিশাল মিউজিয়াম তুল্য বাড়িতে মানুষ বলতে ছিলাম কেবল আমি, ডাঃ এমরান আর তিন জন কর্মচারী। তাদের একজন হলেন রাধুনী কাম হাউস মেড। নার্গিস নাম। মধ্যবয়সী, শান্ত স্বভাবের এক মহিলা। আরেক জন হলেন ড্রাইভার আবু নাসের। তার বয়স প্রায় ষাটের ঘরে। অন্য জন ওয়াচ ম্যান, সোলেমান আলী। চল্লিশের মত বয়স। পাহাড়-পর্বতের কথা মনে আসে তাকে দেখলেই। মোটামুটি এ কয়েকজন মানুষ ডাঃ এমরানের দূর্গের বাসিন্দা।
আমি চাকর্রিটা শুরু করার পর থেকেই দেখতাম ডাঃ এমরান দিন রাত তাঁর দো’তলার ঘরে শুয়ে বই পড়েন আর একা একা দাবা খেলেন বিছানায় বোর্ড রেখে। আর নামাযের সময় হলে হুইল চেয়ার ছেড়ে অন্য একটা কাঠের চেয়ারে বসে নামায পড়েন নিজের ঘরের ভেতর। কথা বার্তা একেবারে দরকার না পরলে বলেন না। আমি তাঁর বি.পি. একদিন চেক করার সময় কেবল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন নিজে থেকে, “ দাবা খেলতে পারো?”
“ খুব একটা না। নিয়ম মনে থাকে না কোন ঘুটি কত ঘর চলে।” স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে হাতের পালস ধরার চেষ্টা করলাম, শুকিয়ে গেছেন খুব, যদিও হাত গুলো জোয়ান মানুষের মত মোটা এখনো। পালস পাওয়া যায় না। সেটা খোঁজার চেষ্টা করছি টিপেটিপে।
“ দাবা ইংরেজী জানো?”
“ হুম। CHESS?”
“ সমার্থক শব্দ?”
“ দাবার আবার সমার্থক শব্দ আছে নাকি?” পালসটা পেতেই স্বস্তি পেলাম।
“ আছে। চতুরঙ্গ।” বিড়বিড় করলেন তিনি।
আমি ঠিক মত খেয়াল করলাম না তাঁর কথাটা।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

আমি এখানে আসার পর প্রথম যেদিন এই দূর্গের রহস্যের সাথে জড়ানো শুরু করি সেটা প্রায় এক মাস পরের কথা।
সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থেকে থেকে কান ফাটানো বজ্রপাতের শব্দ। তার ওপর দূর্গের দেয়াল গুলো মিলে সেই শব্দকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণ। ডাঃ এমরানের জ্বর গত রাত থেকে। তাই বাসায় যাইনি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন। আমি তাঁকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার দিকে যখন তাঁকে দেখতে গেলাম তখন জ্বর আরো বেড়েছে। নিজের দেয়া হাসপাতাল আছে তাঁর, অথচ হাসপাতালে বিচিত্র কোনো কারণে যেতেই চান না তিনি। কিন্তু এ অবস্থা চলতে থাকলে হস্পিটালাইজড করা ছাড়া উপায় থাকবে না। নার্গিসকে নিয়ে ওনার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করলাম। ভেজা কাপড় দিয়ে সারা শরীর মুছে দিলাম। তাতে অবস্থার একটু উন্নতি হল। নার্গিসকে পানি আনতে যখন পাঠিয়েছি তখন হঠাৎ ডাঃ এমরান কথা বলা শুরু করলেন, “ নামায পড়ো?” বেশ পরিষ্কার কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন। হাতের ইসারায় তাঁর পাশে বসতে বললেন।
আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম, “ মিস্ যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায বোধ হয় রোজা ছাড়া আর কখনো পড়া হয়নি।”
“ তোমার বয়সে আমিও নামায খুব একটা পড়তাম না। তবে বিয়ের পরে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে হতো। আমার স্ত্রী জয়নাব খুব ধার্মীক স্বভাবের মেয়ে ছিল। জোর করেই ঠেলে, ধমকে নামায পড়তে পাঠাতো মসজিদে। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে নামাযের অভ্যাসটা পেয়ে গেল। বলতে পারো নেশার মত। নেশা খারাপ অর্থে বোঝাচ্ছি না – জাস্ট অবস্থাটা বোঝাচ্ছি।” দম নিলেন।
আমি চুপ করে বসে আছি। একবার ভাবলাম বলি এ অবস্থায় কথা না বলার জন্য। কিন্তু বললাম না। তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ খুব কম মেলে।
আবার বলা শুরু করলেন, “ এক ওয়াক্ত নামায না পড়লে সারা দিন অশান্তিতে কাটত। যে কোনো অপারেশন করতে O.T. তে ঢোকবার আগে সব সময় নফল নামায পড়ে নিতাম। একবার সে রকমই একটা মেজর অপারেশনের আগে নামায পড়ছিলাম নিজের চেম্বারে। খুব আশ্চর্যের বিষয় আমি প্রথমবার যখন রুকু করার জন্য হাটুতে দু’হাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকেছি – কেন যেন হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমার চেম্বারে কেউ না জিজ্ঞেস করে ঢুকবে না। আপনা আপনি সেজদার দিক থেকে চোখ চলে গেল দু পায়ের মাঝ দিয়ে পেছনের দিকে। মধ্য বয়সী কোনো পুরুষ লোকের পা, আর সাদা পাজামার অংশ বিশেষ দেখা যাচ্ছে। অনেকটা জামাতে নামাযে দাঁড়ালে ইমামের পেছনের জন যেভাবে থাকে – ঠিক সেভাবে। এবং মনে হল একজন নয়, আরো কয়েকজন।
নামাযের এ অবস্থায় নামায ভাঙ্গার প্রশ্নই আসে না। তাই নামাযটা শেষ করে যখন সালাম ফেরালাম, অবাক হয়ে দেখলাম আমার পেছনে কেউ নেই। তার থেকেও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার – আমার পেছনে যদি কেঊ নামায পড়ে – তার সেজদা যেখানে হবে- সেই জায়গা গুলোতে নির্দিষ্ট দুরুত্ব পরপর পাশাপাশি কয়েক ফোঁটা করে পানি। ঠিক যেন তিন জন লোক সেজদায় গিয়ে চোখের পানি ফেলেছে! আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।
সেদিনের অপারেশনে রোগীটাকে বাঁচাতে পারিনি আমি। ” থামলেন। হাঁফাচ্ছেন কথা বলতে গিয়ে।
আমি তাঁর কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলাম একবার। বাহিরে বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছেই। আজকে বাড়ি যাওয়া কপালে আছে কিনা কে জানে। ফোন করে দিতে হবে নয়তো।
“ সেদিনের যে রোগীটাকে আমি বাঁচাতে পারিনি, সে ছিল খুব বৃদ্ধ লোক। তোরাব আলী নাম। অপারেশনের আগের দিন গুলোতে একা একা দাবা খেলতেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে। দাবা খেলাটা আমার নেশা ছিল ছোট থেকেই। আমার নেশা দেখে আব্বা এই বাড়ির পুরো ভেতরের ছাদ জুড়ে উলটো ভাবে বিচিত্র দাবার বোর্ডের ডিজাইন করিয়েছিলেন। হাসপাতালের কাজের ফাঁকে দু’এক দান খেলে ফেলতাম তোরাব চাচার সঙ্গে। কোনো দিনই হারাতে পারিনি। জেতার পর উনি হাসতে হাসতে বলতেন, “ বাজান, আমার দেখা সব চাইতে ভালা ছেলেটা হইলা তুমি। রুগির সাথে ডাক্তারেরা যে কত খারাপ ব্যবহার করে – এই জীবনে কম দেখি নাই। কিন্তু তুমি পুরা অন্যরকম। আমি খাস দিলে দোয়া করি আল্লাহ্ পাক তোমারে দেইখা রাখবো। আর যদি আমি মইরা যাই কখনো- সেই দিন থেকে তোমারে আর কেউ হারাইতে পারবো না।”
কথাটা কতটুকু ফলেছে জানি না। তবে সত্যি সত্যি তার মৃত্যুর পর আমি দাবা খেলায় কারো কাছে হারিনি আজ পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশের গ্রান্ড মাষ্টারদের সঙ্গে খেলেছি, দাওয়াত দিয়েও এনেছিলাম এখানে। অদ্ভূত কোনো কারণে কেউ’ই আমাকে হারাতে পারেনি।” আবার থামলেন।
আমি লাইটের দিকে তাকালাম। যেভাবে মিটমিটিয়ে আসছে- তাতে কারেন্ট চলে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। চার্জার দরকার নেই। জেনারেটর আছে। কারেন্ট গেলেই সোলেমান আলী সেটা চালু করে দেবে। আমি মোম বাতি আর ম্যাচ বের করে রাখলাম তাও। যেন আমার মোম বাতি বের করার অপেক্ষাতেই ছিল, বের করার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল। আমি অন্ধকার খুব ভয় পাই। তাড়াতাড়ি মোম জ্বালিয়ে ফেললাম। বাহিরে ব্জ্রপাত আর ঝড় যেন মহা প্রলয় লাগিয়ে দিয়েছে।
“ তোরাব চাচা মারা যায় যে বিকালে, সে রাতটা এ রকমই ঝড় বৃষ্টির ছিল। জয়নাবকে নিয়ে ঘুমিয়েছি। তাহাজ্জুদের নামায পড়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সে রাতে খুব ক্লান্ত থাকায় তাহাজ্জুদের নামায পড়বো না ভেবেছিলাম। খুব বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল সেই রাতে। আমি মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভূত জিনিষটা দেখলাম। প্রথমে মনে হল বিশাল কোনো দাবার বোর্ডে শুয়ে আছি! তারপরেই উঠে বসার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম হল রুমের ছাদের সেই বিশাল দাবার বোর্ডে! বাদুরের মত উলটো হয়ে ঝুলে আছি! এবং আশ্চর্যের বিষয় হল আমার গ্রাভিটেশন ঠিক বোর্ডের দিকে! আমি অবলীলায় সেখানে উলটো ভাবে দাঁড়িয়ে আছি! আমার মাথার দিকে পুরো হল রুমের বিছিয়া থাকা অসংখ্য জিনিস পত্র, লাইব্রেরী! আমার আশে পাশে সেই বিশাল মানব আকৃতির দাবার মূর্তি গুলো। এবং বজ্রপাতের ক্ষণিক আলোয় দেখতে পেলাম আমার ঠিক সামনের দিকে বড় বড় দাবার চারটা ঘরে চারজন সাদা কাপড় পরা মানুষ নামায পড়ছেন আমার মত উলটো ভাবে! একজন ইমাম এবং বাকি তিন জনের জামাত!
আমি প্রচন্ড ভয় পেলেও ধীরে ধীরে হাটতে লাগলাম তাদের দিকে। আমি পড়ে যাচ্ছি না! অনায়াসে হেটে যাচ্ছি উলটো ভাবে ছাদে পা রেখে! মুর্তি গুলোর আড়াল থেকে ব্জ্রপাতের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম জামাতের ইমাম হলেন তোরাব চাচা! যিনি আজ বিকেলে অপারেশন থিয়েটারে আমার সামনে মারা গেছেন!
আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হল রুমের একটা সোফার ওপর আবিষ্কার করি। বলার অপেক্ষা রাখেনা আমার কোমরে তখন মারাত্মক ব্যথা। যেন আমি খুব ওপর থেকে পড়ে গেছি।” আবার থামলেন ডাঃ এমরান। হাঁফাচ্ছেন খুব।
আমি তাঁর কথা গুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জ্বরের ঘোরে মানুষ কত কথাই বলে। তার ওপর সে যদি হয় লেখক মানুষ তাহলে তো কথাই নেই। আমি তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কথা বলে অবস্থা খারাপ করে ফেলছেন তাই।
সে রাতে চলে আসার সময় ঘটল ঘটনাটা। রাত দশটা বাজে। বৃষ্টি থেমেছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ট্যাক্সি পাবো না বলে ড্রাইভার আবু নাসের গাড়ি বের করলেন আমাকে পৌছে দেয়ার জন্য। আমি হল রুমের তালা লাগিয়ে দেবো- শেষ বারের মত সব কিছু দেখে নিচ্ছি। এমন সময় আরবী সুরা পড়ার শব্দ পেলাম হল রুমে। লাইট প্রায় সব নিভিয়ে দিয়েছি। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকালাম, সুরা কে পড়ছে? ক্রমশ সুরটা চড়ছে। কেন যেন মনে হল শব্দটা ওপর দিক থেকে হচ্ছে। ওপরে অন্ধকার ছাদের দিকে তাকিয়েছি সবে – জমে গেলাম বরফের মত। হাত থেকে তালা চাবির থোকাটা খসে পড়ল শব্দ করে। তীব্র একটা ভয় আমার মাথা থেকে দৌড়ে যেন পায়ের দিকে চলে গেল!
বজ্রপাতের সাদাটে আলোতে ছাদের বিশাল দাবা বোর্ডের মূর্তি গুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে বোর্ডের ঘর গুলোতে। তার মাঝেই একটা ফাঁকা জায়গায় জায়নামায বিছিয়ে উল্টো ভাবে কেউ নামায পড়ছে! এবং এত নিচ থেকেও তাঁকে স্পষ্ট চেনা গেল – ডাঃ এমরান!

ডাঃ এমরানের চতুরঙ্গ রহস্যের সঙ্গে সে রাতেই আমার প্রথম পরিচয়।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ৮:০২
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×