আপনি প্রায়ই রাত জাগেন অথচ খুব সকালেই আপনাকে হয়তো অফিসে বসের মুখোমুখি হতে হয়। রাত জাগার এ ক্লান্তি দূর করতে আপনাকে হয়তো প্রায় সময়ই অতিরিক্ত কফি পান করতে হয় এবং যত চেষ্টাই করুন না কেন আপনার হয়তো কোনো রাতেই পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে না।
এমন কিছু অপ্রকাশ্য শারীরিক অসঙ্গতি আপনার এই ক্লান্তির জন্য দায়ী যা আপনি হয়তো অনুমানও করতে পারেন না । এমনকি খাদ্যাভ্যাস কিংবা ব্যায়ামের অভ্যাসও হতে পারে ক্লান্তির মূল কারণ।
এই ক্লান্তির রহস্য খুঁজে বের করা ও তার সমাধানের বিষয়ে এখানে রয়েছে কার্যকরী ৭টি উপায়, যা আপনাকে কর্মোদ্যম ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর করে তুলবে, ঠিক যেমনটি আপনি চান।
আপনি কি পানিশূন্যতায় ভুগছেন?
দ্যা জার্নাল অব নিউট্রিশন পত্রিকার একটি গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবতী নারীই তাদের শরীরের চাহিদার মোট ১.৫ ভাগ পানিও পান করেন না। গবেষকরা লক্ষ্য করেন, নিওরনের হাইপোথ্যালামাস, অর্থাৎ মস্তিষ্কের যে অংশ আপনার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে- সেটি পানীয় জলের চাহিদা না মেটানো পর্যন্ত অবিরত বার্তা পাঠাতে থাকে যা কিনা আপনার ক্লান্ত অনুভূতি তৈরি করার জন্য যথেষ্ট।
সমাধান:
দৈনিক কমপক্ষে আট গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করুন। যদিও, আপনি কি পরিমাণ পানি পান করবেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাপ নেই কেন না আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে আপনার শরীরে পানির চাহিদা পরিবর্তিত হয়। ফলে, যখনই তৃষ্ণা অনুভব করবেন তখনই পান করুন। শিকাগো স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পুষ্টি বিজ্ঞানি ড. জিনা সারশিও বলেন, প্রতি তিন ঘণ্টায় যদি একবার অন্তত মলত্যাগের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং তার রঙ যদি প্রায় স্বচ্ছ দেখা যায় তবেই আপনি কেবল ধরে নিতে পারেন শরীরে পানির চাহিদা যথেষ্ট পূরণ হয়েছে।
অপর্যাপ্ত ভিটামিন বি ১২
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সচল রাখতে এবং রক্তের লোহিত কণা তৈরি করতে ভিটামিন বি ১২ ভূমিকা রাখে। সেই সাথে, রক্তের মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সরবরাহ করে এই ভিটামিন। এটি মূলত প্রাণীজ আমিষের ভেতরে বেশি পাওয়া যায়। ফলে, নিরামিষাসীরা ভিটামিন বি ১২ এর অভাবে ভুগতে পারেন। এই ভিটামিনের অভাবে ক্লান্তিজনিত কারণে আপনি মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারেন বলে জানান ড. সারশিও।
সমাধান:
যদি একই সাথে ক্লান্তি, বিস্মৃতি, অস্থিরতা এবং শরীরের কিছু স্থানে অসারতা অনুভব করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে এর কারণ হিসেবে ভিটামিন বি ১২-এর অভাবকে দায়ী করতে পারেন। ফলে, আপনি দ্রুত একজন ডাক্তার কিংবা পুষ্টিবিদের সঙ্গে আলাপ করুন। আপনার হয়তো ১০০ থেকে ৫০০ মি. গ্রা. পর্যন্ত ভিটামিন সেবন করতে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ড. সারশিও বলেন, এই ভিটামিন বড়িগুলো প্রয়োজনমতো দ্রুতই আপনার ক্লান্তিকে দূর করবে, যদি আপনার শরীরে তার ঘাটতি থেকে থাকে। তবে, বি ১২ ভিটামিনের ঘাটতি না থাকলে এটা কোনো কাজই দেবে না। অর্থাৎ, ক্যাফেইনের মতো যেকোনো অবস্থাতেই আপনার ক্লান্তি দূর করার ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়।
কাজের চাপে যখন বিপর্যস্ত
সাধারণত, দৈনন্দিন কাজের সাথে তাল মিলিয়ে স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা সকালে সর্বোচ্চ কর্মক্ষম থাকে এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পরে। কিন্তু টরেন্টোর ন্যাচারোপ্যাথিক স্ট্রেস মেডিসিনের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মার্ক বাবস বলেন, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ আপনার শরীরের স্ট্রেস হরমোনকে নাজেহাল কিংবা অকর্মন্য করে ফেলতে পারে। যার কারণে রাত বাড়তে থাকলেও আপনার ঘুম না আসা কিংবা ঘুমের মধ্যে হাঁটার মতো অসুস্থতা আপনাকে পেয়ে বসতে পারে।
সমাধানঃ
আপনি চাপের কারণ মোকাবিলা করতে না পারলেও আপনার প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মেডিটেশন একটি অত্যন্ত কার্যকর উপায়। দিনে মাত্র ১৫ মিনিটের একটি মেডিটেশনের অভ্যাস আপনার দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ থেকে অনেকটাই হালকা করে দিতে পারে।
অজানা হৃদরোগে আক্রান্ত?
ফুসফুস এবং হার্ট-সংক্রান্ত গবেষণাবিষয়ক একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়, হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি নারীরাই রাতে ঘুমানোর আগে অস্বাভাবিক রকম ক্লান্তিতে ভোগেন।
গবেষক ডা. হুসেইন বলেন, সিড়ি দিয়ে ওঠানামা কিংবা ব্যায়ামের পর যদি আপনার ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিতেও ক্লান্তি হয়, তাহলে নিশ্চিত থাকুন আপনার ধমনি হৃদযন্ত্রে যথাযথভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে পারছে না।
সমাধানঃ
এ বিষয়ে ডা. হুসেইনের পরামর্শ আপনার এই ক্লান্ত দশা এবং সেই সাথে অন্যান্য কোনো উপসর্গ যদি থাকে, যেমন বুকে ব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি একজন ডাক্তারের কাছে খুলে বলুন। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো আপনাকে একটি স্ট্রেস টেস্ট বা ইকোকার্ডিওগ্রাম করার পরামর্শ দিয়ে থাকবেন।
অপর্যাপ্ত কিংবা মাত্রাতিরিক্ত লোহিতকণার উপস্থিতি
রক্তস্বল্পতা ক্লান্তির অন্যতম কারণ, বেশিরভাগ নারীই এ রোগে ভুগে থাকেন। সেইসাথে, রক্তে অতিরিক্ত লোহিতকণার উপস্থিতিও পর্যাপ্ত অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দেয়। ফলে, আপনার শরীরে লোহিতকণার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত না থাকলে অক্সিজেন প্রবাহের অপর্যাপ্ততার ফলে আপনি সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।
সমাধানঃ
নিরামিষাশীদের রক্তস্বল্পতায় ভোগার সম্ভবনা থাকে। সেই সাথে, থাইরয়েডজনিত অসুখ, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং অতিরিক্ত রক্তস্রাব রক্তস্বল্পতার জন্য দায়ী। অন্যদিকে, অত্যাধিক আয়রন বড়ি সেবন আপনার রক্তে লোহিতকণা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিতে পারে। মাথার চুল ও নখ পাতলা হয়ে যাওয়া কিংবা দাঁড়ানো অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখা আপনার রক্তে লোহিতকণার মাত্রাধিক্যতা নির্দেশ করে। সে ক্ষেত্রে ডা. সারশিওর পরামর্শ, বছরে অন্তত একবার রক্তে লোহিতকণার মাত্রা পরীক্ষা করে নিন এবং অস্বাভাবিক কিছু পেলেই সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করুন।
অকর্মন্যতা
অলসতা কিংবা অকর্মন্যতাও হতে পারে আপনার দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির জন্য দায়ী- বলে জানান ডা. বাবস। একটি কর্মব্যস্ত দিন কিংবা একটু হাত-পা ছুড়ে নেওয়া আপনার রক্তে গ্লুকোজের সরবরাহ তৈরি করে, যা আপনাকে ক্লান্ত হতে দেয় না। এর বিপরীতে, দিনভর কম্পিউটারের পর্দায় কিংবা বিছানায় অলস সময় যাপন আপনার শরীরের ক্যালরি পুড়তে দেয় না- যার ফলে আপনি অলসতাজনিত ক্লান্তিতে ভুগতে থাকেন।
সমাধানঃ
আপনার চটপটে চলাফেরা এরা কর্মোদ্দীপ্ত জীবনযাপন এর একটি সমাধান হতে পারে। সম্প্রতি আমেরিকার শরীরচর্চা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা প্রকাশের পর নারীদের সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট পরিমিত শরীরচর্চা করার নির্দেশনা দিয়েছে সে দেশের সরকার। নিয়মিত শরীরচর্চার ফলে আপনি আরো ভালোভাবে ঘুমুতে পারবেন যার ফলে এক সপ্তাহের মধ্যেই আপনি দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেন।
মূত্রনালীর সংক্রমণ
যদি মূত্রনালীতে সংক্রমণের ফলে আপনি মূত্রত্যাগের সময়ে জ্বালাপোড়া অনুভব করবেন। অর্ধেকের বেশি নারীরাই এ সংক্রমণের শিকার এবং এ অসুস্থতা তাদেরকে ক্লান্ত করে তোলে। ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইওরোগাইনিকোলোজির সহযোগী অধ্যাপক ডা. অ্যাশলে ক্যারোল জানান, এ সংক্রমণের অত্যাচারের আপনার শরীরের বেশ কিছু শক্তিক্ষয় ঘটে এবং আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন বাড়িয়ে তোলে।
সমাধানঃ
ডাক্তার যদি আপনার মূত্রথলিতে সংক্রমণের আশঙ্কা করেন তবে এই ব্যাকটেরিয়া নির্মূলের জন্য তিনি সাত থেকে দশ দিন মেয়াদি যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। পরবর্তীতে, পুনরায় এ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
এ বিষয়গুলোতে সচেতন থাকলে আপনি সহজেই একটি কর্মে উদ্যম, উৎফুল্ল এবং ক্লান্তিহীন জীবন যাপন করতে পারবেন।
এইটা সূত্র