কয়েকদিন ধরে দেশকে তোলপাড় করে দেয়া খবর, শিক্ষকের মুখোশধারী নরখাদক পরিমল জয়ধরের ভিকারুননিসার দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ।...এর প্রতিবাদে ধর্ষণকারীর বিচার এবং ভিকটিম মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়াতে ফেসবুকে অনেক পেজ, গ্রুপ, ইভেন্ট দেখলাম। অভিভাবক সহ হাজার হাজার বর্তমান ও পুরোনো ভিক্কি এবং সাধারণ মেয়েরাও শনিবারের রোড মার্চ অংশ নিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো পরিমল এর বিচার ও হবে আশা করছি। কিন্তু তবুও ভয় হয়, মনিপুর স্কুলের ইসলাম ধর্ম শিক্ষক আমিন আলি মোল্লা বা
বিসিআইসি কলেজ এর বাংলা শিক্ষক সেলিম এর মত পরিমলও কয়েকদিন পর ছাড়া পেয়ে যাবে নাতো??? আর ছাড়া পেয়ে
পূবপুরুষদের মত প্রতিশোধের হিংসায় সেসব মেয়েদের কোন ক্ষতি করে বসবে নাতো, যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়ত কিন্তু তার দুঃসময়ে সহযোগিতা করেনি???
২০০৮-এ বিসিআইসি কলেজ এর ঘটনার কথা কি মনে আছে? না থাকলে একটু মনে করিয়ে দেই। আর যদি মনে থেকেই থাকে, তবে এখন বিসিআইসি কলেজ এর একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একটু ঝালাই করিয়ে নিন।...আমি হয়তো এই লেখাটা লিখতাম না, যদি না কয়েকদিন আগে আমার এক কলেজ সহপাঠীর সাথে দেখা হত। হ্যাঁ, আমার সহপাঠীটি সেই মেয়ে
(সঙ্গত কারণেই তার নামটা প্রকাশ করলাম না) যাকে ২০০৮ সালে সেলিম নামক শিক্ষক মুখোশধারী পিশাচের হাতে ধর্ষিত হতে হয়েছিল। (ভাবছেন, পুরোনো কাসুন্দির বোতলটা কেন নূতন করে খোলার দরকার ছিল? ছিল না, যদি জানতেন কাসুন্দির বোতলের গায়ে আর আসল কাসুন্দিতে আসলে কি কি উপকরণ রয়েছে।) যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষ আসলে তত্কালীন প্রিণ্সিপাল মিডিয়াকে বলেছেন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল তবে তাতে উনি (সেলিম) সফল হননি। তবে আসল সত্যটা হয়তো মিডিয়া জানতে পারত যদি না কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার অনুমতি দিত। ২০০৮ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সেলিম স্যারের কাছ থেকে অফার আসে তার কাছে পড়ার এবং এতে করে HSC তে কি কি ADVANTAGE রয়েছে তা সহ। বলাবাহুল্য এসব শিক্ষকের কিছু কিছু চামচা থাকে শিক্ষার্থীর মধ্যে তারও ছিল, তানজিয়া রহমান তুলি ও নাহিদ ফেরদৌস রাফি (বর্তমানে রেডিও দূরবীনে RJ হিসেবে কর্মরত)। তুলি আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, তাই ওর কথা আমি ফেলতে পারিনি, এবং উনি যখন শিক্ষক হিসেবে এতো ভালো তাই আমি সহ আরও অনেকেই ভর্তি হয়েছিলাম উনার কোচিং এ। যদিও এটাকে ক্লাসের অনেকই ভালো চোখে দেখেনি, যেহেতু সবাই জানতো স্যারের উপর তুলির দূর্বলতা আছে। কিন্তু আমি ক্লাস করতে পেরেছিলাম দেড় মাসের মত। দেড় মাস পরের থেকে হঠাত্ করেই স্যার কলেজে আসা বন্ধ করে দেন। আসল কারণটা কেউই জানত না, শুধু কলেজ প্রিণ্সিপাল, ওই ভিকটিম মেয়ে ও তার অভিভাবক এবং সেলিম স্যার ও তার চামচারা ছাড়া। তবে কলেজে সবাই এটা জানত যে উনাকে বের করে দেয়া হয়েছে।...............
যেহেতু উনি অনেক জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন, তাই তার চামচাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি এই বলে যে তিনি কিছু শিক্ষকের চক্ষুশূল, তাই তার এই অবস্থা। এজন্যে তাকে কলেজে ফিরিয়ে আনার জন্যে কিছু শিক্ষার্থী তুলি, রাফির প্ররোচনায় পরে সেলিম স্যারের ছত্রছায়ায় প্রেসক্লাবে মানব বন্ধন করে এবং প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করে। প্রেস কনফারেন্সে তারা বলে, কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক পড়ার আড়ালে তাদের যৌন নির্যাতন করেন এবং সেলিম স্যার এর প্রতিবাদ করায় তাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটা পুরোপুরি সাজানো ছিল। তবে মুখে কালো কাপড় বেঁধে যারা গিয়েছিল মানব বন্ধনে, তারা প্রায় সবাই উনার কাছে প্রাইভেট পড়ত। এবং এই খবর প্রখম এসেছিল দৈনিক যুগান্তরে। এখানে বলে রাখি তখন যুগান্তরের সম্পাদক যিনি ছিলেন, তিনি সেলিমের স্রী। এই ঘটনা যখনকার আমি তখন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ১৫ দিনের শয্যায়। তবে যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়েও মানব বন্ধনে যায়নি তাদেরও অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে, কি মূল্য সেটা পরে বলছি।
যেই অসহায় মেয়েটিকে কলেজের পরের Extra Class এ ধর্ষিত হতে হয়েছিল, তার ঘটনা এবং মানব বন্ধনের ঘটনা জানাজানি হয় অক্টোবর মাসে। এবং এটাও জানা যায় আমাদের আগের ব্যাচের মেয়েদের সাথেও তিনি এমন ঘৃণিত কায়জ করার চেষ্টা করেছেন। এসব জানার পর প্রভাতি শাখার মেয়েরা ও দিবা শাখার ছেলেরা এক হয়ে ঐ শিক্ষকের বিচার এবং তার চামচা তুলি রাফি সহ মোট ৭জনকে T.C দেওয়ার দাবিতে পরীক্ষা, ক্লাস বয়কট করে রাস্তায় নামে। মানব বন্ধন, মিছিল করা সহ কয়েকটা বাসও ভাঙচুর করে ছেলেরা। শিক্ষার্থীদের চাপে প্রিণ্সিপাল মিরপুর থানায় কেস করে সেলিম ও তার চামচাদের নামে। সেলিমকে না পেলেও তার চামচাদের মধ্যে তুলি ও রাফিকে পুলিশ ২৪ ঘন্টা আটক করে রাখে। আর বাকিরা শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ায় তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। তুলির এই ঘটনা জানার পর ওর সাথে আমার ৮বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়।……………..
সেলিমের কোন বিচার হয়নি, এমনকি তাকে গ্রেপ্তার করাও সম্ভব হয়নি। যুগান্তরসহ কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এর সহয়তায় এই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। হওয়ার মধ্যে যা হয়েছে, প্রিণ্সিপালকে ঘোড়াশাল শাখায় বদলি করা হয় এবং কলেজকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে টেস্ট পরীক্ষাও পিছিয়ে দেওয়া হয়। তবে তুলি রাফিদের যে T.C দেওয়া হয়েছিল পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। এখনকার মত তখন ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল এত বেশি ছিল না, ব্লগের কথাতো বাদই দিলাম। তাই হয়তো সেই মেয়েটির উপর হওয়া অন্যায়ের বিচারের দাবিতে সবাই এক হতে তখন হয়তো আমরা আজ ভিকারুননিসার মেয়েদের মত ফেসবুক বা ব্লগে আহবান জানাতে পারিনি। পারলে হয়তো সেলিমের মত পিশাচেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারতো না।
এখন সেই কথাটাতে আসি যেটা পরে বলব বলেছিলাম। ২০০৯ এ HSC পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিসিআইসি কলেজের একজন HSC পরীক্ষার্থীর মোবাইলে একটা SMS আসে। যাতে অকথ্য ভাষায় কিছু বাক্যসহ RAPE এর হুমকি ছিল। আরেকজনের TNT ফোনে ফোন করে আজে বাজে অফারের পরে RAPE এর হুমকি। এইরকম আরেকজনকে HSC পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে অভিভাবকের সামনে প্রকাশ্যে RAPE এর হুমকি দেয়া হয়। আর এছাড়াও মোবাইল নম্বর ছড়ানোতো আছেই। যাদেরকে এসব হুমকি দেয়া হয়েছিল তারা সবাই সেলিমের কাছে প্রাইভেট পড়ত এবং তার কথামত প্রেসক্লাবে যেতে রাজি না হওয়ায়, সেলিম এবং তার চামচাদের প্রতিশোধের রেষানলের এই রূপ ধারণ। একবার চিন্তা করে দেখুন, একজন HSC পরীক্ষার্থী পরীক্ষা চলাকালীন যখন এতবাজে হুমকি পায় তখন তার মনের অবস্থা কি দাঁড়াতে পারে!!!............
এতকিছু বলার একটাই কারণ, আজ ভিকারুননিসার মেয়েরা যে আন্দোলনে নেমেছে তার ফলস্বরূপ তাদের যেনো, আমাদের যে অবস্থা হয়েছিল সে অবস্থা না হয়। সেলিমদের মত পিশাচদের প্রতিশোধের অনলে তাদের যেন পুড়তে না হয়। একটা কথা জেনে রেখ, তুমি যতই এই সমাজে মাথা উঁচু করে, সম্মানের সাথে বাঁচতে চাও না কেন, এই সমাজ তোমাকে ততটাই পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে চাইবে। যুদ্ধে জয়ী হও মেয়েরা, শুভকামনা রইল।